অপ্রিয় প্রেয়সী পর্ব-৫০

0
2362

#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ৫০ (ভরসা)

ভ্রু কুঁচকে আইজাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে সীমান্ত। আইজার দৃষ্টিতে ওর চশমাটা যেন কোন দূর্লভ বস্তু! তবে তার কথার মূল অর্থ বুঝতে দেরি হয়নি সীমান্তর।
-“আপনার উদ্দেশ্য যদি চোখ বিষয়ক হয় তাহলে বলবো এই চশমা কার্যকরী! কিন্তু আপনি যা চাচ্ছেন সেটা এই চশমায় পাবেন না!” আইজার হাত থেকে চশমাটা নিয়ে নিলো ও! শক্ত গলায় আরো বলে উঠলো,
-“আমি কিন্তু আপনাকে খুব ভালো করেই চিনি আইজা! প্লিজ কোন উল্টোপাল্টা কাজ করবেন না!”

মুহুর্তেই ক্রোধরেখার দেখা মিললো তার আঁখি জোড়ায়।

-“আপনি নিশ্চিত তো আপনার বাবার তার ভাইয়ের করা কাজ সম্পর্কে কোন আইডিয়া নেই! এমনও হতে পারে সে জাফরকে সাহায্য করছে!”
হুট করে বলে উঠলো আইজা। ভণিতা করার সময় এই মুহুর্তে ওর আর নেই!

সীমান্তর বর্তমান চাহনি আজকের আবহাওয়াকেও হার মানাবে। আইজার মনে হচ্ছে তার নেত্রগোলক যেন কোন বরফের খন্ডে রূপান্তরিত হয়েছে! মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না আইজা, এতো চতুর একজন ব্যাক্তি নিজের বাবার সামনে পৃথিবীর সবচাইতে বোকা প্রাণি কী করে হয়ে যায়! না-কি সীমান্ত আইজাকে বোকা বানাচ্ছে! হয়তো সে সবটা জানে! আইজার এ ভয়টা দ্বিগুন বাড়িয়ে নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সীমান্ত।

আইজা আবারও একই সাহস কী করে দেখাচ্ছে! সীমান্তর প্রতি ওর মনে একবিন্দু হলেও ভরসা নামক অনুভূতির অস্তিত্ব টের পাচ্ছে ও! কেন! সীমান্ত প্রথম থেকেই আইজার কাছ থেকে অনেক কিছু লুকিয়েছে! এর কী গ্যারন্টি যে সে আজও কিছু লুকোচ্ছে না! এই বাড়ির কাউকে ভরসা করবে না ও! কাউকে ভরসা করে ঠকার যন্ত্রণা ভিষণ নিষ্ঠুর!

ক্লান্ত নিশ্বাস ফেললো আইজা। সীমান্তর পিছু পিছু ছুটলো ও! সে যখন ইচ্ছে আসবে; যা ইচ্ছে করবে; আর আইজা চুপচাপ সেটা নিয়েই নাচবে! এটা কী করে ভাবলো সে!

-“দাঁড়ান! আমার কথা শেষ হয়নি!”

আইজার উচ্চস্বরে বলা কথায় সীমান্ত নিজের পদচালনা থামিয়ে দিলো। দেখে মনে হচ্ছে বরাবরের মতো সেই স্টাডিরুমের দিকেই যাচ্ছিলো সে! আইজার মুখে ফুটে উঠলো তাচ্ছিল্যের হাসি! স্টাডিরুম তার জন্য একটা লুকোনোর জায়গা মাত্র!

-“আর কতো পালাবেন আপনি! পারিবারিক মায়ায় তো আপনিও আটকে আছেন! জাফরের ব্যপারে হয়তো সব জানা আছে আপনার! তবুও চুপ থেকে আমাকে দমাচ্ছেন! আমার মনে হয়েছিলো অন্তত আপনি আমাকে বুঝবেন! আপনি নিজেও তো.….!”

আর বলতে পারলো না আইজা। সীমান্তর নির্লিপ্ত চাহনির তাড়নায় চুপ হয়ে গেলো। আইজার মনে হচ্ছে ও এতোক্ষণ কোন মজবুত দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো! অযথা সময় নষ্ট!

হঠাৎ আইজার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো সীমান্ত। টেনে নিয়ে গেলো স্টাডিরুমের দিকে। যেখানে সে নিজেই এক সময় আইজাকে যেতে বারণ করেছিলো! রুমের এক কর্ণারে রাখা ছোট কেবিনেট থেকে একটা চশমার বাক্স বের করে আইজার হাতে রাখলো সীমান্ত। নিষ্প্রভ গলায় বলে উঠলো,
-“এর ট্র্যাকার কখনো অফ করবেন না! বাকি আপনি যা চান তা এই চশমার মধ্যে পেয়ে যাবেন!”

আইজা ভ্রু কুঁচকে সেই চশমার বাক্স খুলে তার মধ্যে থাকা চশমাটা বের করে নিলো। সীমান্তর বাকি সব চশমা থেকে এটা বেশ আলাদা। বস্তুটা সুক্ষ্ম ভঙ্গিতে নিজ আঁখি জোড়ায় সেট করলো ও! স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে চশমাটা সীমান্ত স্পেশালি আইজার জন্যই বানিয়ে এনেছে!

-“প্লিজ আজ আর আমাকে বিরক্ত করবেন না। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে!”

আইজা কিছু বলার আগেই সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন কন্ঠে বলে উঠলো সীমান্ত। কপাল কুঁচকে এলো আইজার। কিন্তু কিছু বললো না। লোকটা শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মনের মধ্যে থাকা প্রশ্ন গুলো নিয়েই স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে এলো ও। আইজা জানে সীমান্ত এই মুহুর্তে ওর কোন প্রশ্নের জবাবই দেবে না! উল্টো কথা ঘুরাবে! এই চশমাটা যে আইজার ওপর নজর রাখার জন্য সেটাও বুঝতে পারছে ও!

***

মৃদু আলোয় ঘেরা ছোট্ট একটা ঘরে বসে আছে আইজা। ওর সামনে একটা ছোট বাচ্চা অনবরত চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। আইজা বাচ্চাটার দিকে যত আগাচ্ছে ততটাই পিছিয়ে যাচ্ছে সে। হাজার চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে একটা আওয়াজও বের করতে পারছে না ও।

হঠাৎ একটা লোক দ্রুত পায়ে সেই বাচ্চাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।লোকটার মুখে ক্রুর হাসি। বাচ্চাটা আইজার চোখে চোখ রেখে চিৎকার করে যাচ্ছে। তার প্রতিটা চিৎকারে যেন ওর হৃদয় ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও সেদিকে পৌঁছানোর ক্ষমতা নেই আইজার।

লোকটা শেষবার আইজার দিকে হিং*স্র চাহনিতে তাকিয়ে সেই বাচ্চাটাকে লা*থি মারতেই হুরমুরিয়ে চোখ খুলে যায় ওর! এই শীতেও ঘেমে একাকার হয়ে গেছে আইজা। পাশ ফিরে দেখে সীমান্ত নেই। নিজের চোখে হাত রাখতেই বিন্দু বিন্দু অশ্রু কণার অস্তিত্ব টের পেলো ও।

ঘন ঘন নিশ্বাস ছেড়ে শান্ত হয়ে বসলো আইজা। এ পর্যন্ত এই বিভৎস স্বপ্নটা যে কতবার দেখেছে হিসাব নেই। বলতে গেলে এখন যেন অভ্যেস হয়ে গেছে! ভয়ানক ভাবে ধরফর করতে থাকা হৃদপিণ্ডের গতিকে একপ্রকার উপেক্ষা করেই উঠে দাঁড়ালো আইজা। ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে।

চোখ জোড়া জ্বলে উঠছে একটু পর পর। গলাও শুকিয়ে এসেছে। রুমে পানি না থাকায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘর থেকে বের হলো ও। কিচেনের লাইট অন দেখে মাঝ পথেই থামলো আইজা। এতো রাতে রান্নাঘরে কে থাকতে পারে!

রাত তিনটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। এ সময় সীমান্তকে রান্নাঘরে পেঁয়াজ কাটতে দেখে কিছুটা বিস্মিতই হলো আইজা। নিঃশব্দে সীমান্তর পাশে দাঁড়ালো ও। বেশ মনোযোগ সহকারে কাজ করছে সে। আইজাকে নিজের পাশে টের পেয়েও নিশ্চুপ হয়ে আছে।

-“অভ্যেসটা নতুন না-কি পুরোনো?”

শুনশান নিস্তব্ধতার দুই মিনিটের মাথায় প্রশ্ন করে বসলো আইজা। মাথাটা ভনভন করছে। এই মুহুর্তে চুপচাপ থাকতে একদম ইচ্ছে করছে না ওর। আইজার করা প্রশ্নের সাথে সাথেই কোন জবাব দিলো না সে। ওর তো মনে হচ্ছিলো সীমান্ত বোধহয় কিছু বলবেই না। তখনই আইজার ধারণাকে ভুল প্রমান করলো সে! মৃদু হাসির ঝলক ফুটে উঠলো তার মুখে।

-“ছোটবেলায় রায়হান কারো রান্না খেতে চাইতো না। বাইরের খাবার নিয়েই পড়ে থাকতো। তাই ওর জন্য রান্নাটা শেখা। মজার ব্যপার হলো আমার রান্না প্রথম প্রথম যতই বাজে হতো না কেন, রায়হান কোন অভিযোগ করতো না। চুপচাপ খেয়ে নিতো! যদিও এখন আর আগের মতো বায়না করে না ও!”

শেষের কথাটা বলতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো সীমান্তর মুখ থেকে। সীমান্তকে রায়হানের সাথে কথা বলতে তেমন একটা দেখেনি আইজা। দু’জনের মধ্যে সবসময়ই যেন এক অদৃশ্য জড়তা কাজ করতো! তবে আইজা কখনো এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি।

-“আমি জানি, আপনি রায়হানের সাথে কী করেছেন!” কথাটা বলেই আইজার চোখে চোখ রাখলো সে। আইজা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সীমান্তর দিকে।

-“আশা করি, পরবর্তীতে এসব করবেন না!”

-“রায়হানের সাথে আমার কোন শ*ত্রুতা নেই! আপনার কী মনে হয়, মানুষকে ব্ল্যাক*মেইল করতে ভালো লাগে আমার! না! কিন্তু শুরুটা আপনি করেছিলেন। আপনি যদি আরফান আর সিমিকে নিয়ে আমাকে ভয় না দেখাতেন তাহলে আমিও রায়হানকে ব্ল্যাক*মেইল করতাম না!”

মুহুর্তেই সবজি থেকে ছু*রিটা উঠিয়ে নিলো সীমান্ত। আইজার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে বলে উঠলো,
-“আপনার সত্যি মনে হয়েছিলো আমি আপনাদের কোন ক্ষ*তি করবো!”

-“আমি কী মনে করেছিলাম তাতে কিছু যায় আসে না। হুম*কি দেয়া আপনি শুরু করেছিলেন, আমি তার জবাব দিয়েছি। আর সত্যি বলতে আপনার ভাইও কিন্তু ইনোসেন্ট ছিলো না সীমান্ত!”

-“সেটা আমি বুঝবো! আমার ভাইকে আমি শাসন করবো! আপনি আর এর মাঝে আসবেন না!”

-“আমার কোন শখ নেই আপনার ভাইকে নিয়ে সময় নষ্ট করার!”

সীমান্তর শক্ত চাহনির বিপরীতে রুক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আইজা। হনহন করে চলে এলো ও। ইতোমধ্যে ভেবে নিয়েছে জাফর শিকদারকে কী করে সামলাবে! এখন তো শুধু সময়ের অপেক্ষা। অনেক ভেবে চিন্তে প্ল্যান করেছে আইজা। যে পরিকল্পনার মাধ্যমে এটাও বুঝা যাবে যে সীমান্ত আসলেই জাফরের ব্যপারে কিছু জানে কী না!

***

কাল ছুটি। ছুটির আগের দিন অফিসে দ্বিগুণ খাটানো হয় এমপ্লয়িদের! ভিষণ বিরক্ত মুখে অফিসে বসে আছে আইজা। ঘড়িতে বেলা এগারোটা বেজে দশ মিনিট। কিন্তু আইজার মনে হচ্ছে শত বছর পাড় হয়ে গেছে! একটু পর পর বেজে উঠছে ফোন। হাতে নিয়ে দেখলো সীমান্ত কল করেছে। মেজাজটাই বিগড়ে গেলো আইজার। লোকটার সাথে কথা বলতে একদম ইচ্ছে করছে না ওর! অতঃপর ফোন সাইলেন্ট করে ব্যাগে রেখে দিলো আইজা।

তবে অফিসের পরিস্থিতি বেশ অদ্ভুত লাগছে ওর। এতোক্ষণ পাত্তা না দিলেও এখন গা গুলিয়ে আসছে। সবার নজর আইজার ওপর। নিজের পাশের টেবিলে বসে থাকা কলিগের দিকে তাকালো ও। মেয়েটার নাম জাকিয়া। আইজার নজর টের পেতেই নিজের চেয়ার সহ ওর দিকে এগিয়ে এলো মেয়েটা। ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করে বসলো,
-“রায়হান শিকদার আপনার দেবর না?”

আইজা জাকিয়ার প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না। তার প্রশ্নের ভঙ্গি ভালো লাগেনি ওর। জাকিয়া কোন উত্তর না পেয়ে মুখ বাঁকিয়ে নিজের টেবিলে ফিরে গেলো। আইজা সেসবে মাথা না ঘামিয়ে দ্রুত ফোন অন করলো। এবার শুধু কল না বরং বেশ কিছু টেক্সট মেসেজও জমে আছে।

আরফানের পাঠানো মেসেজে ক্লিক করলো ও! কোন নিউজের লিংক পাঠিয়েছে সে!

-“মা*দক মাম*লায় দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নাজিম শিকদারের পুত্র রায়হান শিকদার গ্রে*প্তার!”

স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আইজা। সীমান্তর নাম্বার থেকে ৫০+ মিসডকল! উঠে দাঁড়ালো ও। দ্রুত হাতে সীমান্তর পাঠানো মেসেজগুলো চেক করতে করতে করিডরে চলে এলো!

-“আমি আপনাকে ভরসা করেছিলাম আইজা!!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here