#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ৫৫ (উষ্ণতা)
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নাজিম শিকদারের অনুভূতিহীন চোখে চোখ রেখে গাড়ির ডিকি থেকে বেরিয়ে এলো আইজা। রি*ভলবারটা এই মুহুর্তে নিচের দিকে তাক করা থাকলেও আইজার দিকে তাক করতেই বা কতক্ষণ! রিস্ক নিতে চায় না ও! তাই নাজিম শিকদার কিছু করার আগেই আইজা নিজের সাথে নিয়ে আসা স্প্রে বোতল দ্বারা নাজিমের চোখ বরাবর হামলা করে বসলো!
বিশ্রি কতগুলো গা*লি বেড়িয়ে এলো লোকটার মুখ থেকে। কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
-“এই গোডাউন থেকে বেরোনোর সব পথ বন্ধ। কতক্ষণ পালাবি তুই!!”
ক্রমশ জ্বলতে থাকা আঁখি জোড়া ধরে রেখে কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছে সে! বাইরে যাওয়ার দরজাটা আসলেই লক। শেষপর্যন্ত কিছুদূরের ছোট্ট সিঁড়িটা চোখে পড়তেই সেটায় চড়ে উঠলো আইজা। সীমান্তর সাথে সাথে জামিলকেও টেক্সট করে এসেছিলো। ও জানে জামিল মাহমুদও এই শিকদার বাড়ির ভাইদের বিরুদ্ধে প্রমান যোগাড় করতে কতটা উতলা হয়ে আছে! এই চক্করেই তার ছয় মাসের সাস*পেন্সন হয়েছিলো!
সীমান্তকে যেহেতু ফোনে পাচ্ছে না; জামিলকেই কল করবে ও! এই মুহুর্তে কিছুটা বিস্মিতও হচ্ছে আইজা। নাজিম নিজের ভাড়া করা গু*ন্ডাদের এখনো আইজার পেছনে পাঠায়নি! স্ট্রেন্জ!! ওপরের সরু পথের শেষ প্রান্তে একটা জঙধরা অথচ মজবুত দরজা দেখা যাচ্ছে। সেটাও লক! নিচ থেকে ক্ষুব্ধ পদচালনা শুনতে পারছে ও!
তাড়াহুড়োর মধ্যে মাথাটাও তেমন একটা কাজ করছে না! অতঃপর একপাশে থাকা কিঞ্চিত জঙধরা জানালাটা খুলে ফেললো আইজা। যদিও জানালাটা নিয়ে তেমন আশা ছিলো না ওর। তবে দেখে যা মনে হচ্ছে এই শরীর নিয়ে একটু চেষ্টা করলেই সহজে ওপাশে যাওয়া যাবে!
সময় নষ্ট করলো না আইজা। কোনমতে জানালার ওপাড়ে টপকালো! কাঁধে যে ব্যাগ ঝুলিয়ে এসেছে তা থেকে আবারও বের করলো নিজের ফোন। রুমটা বেশ শুনশান। যেন এর আশেপাশে অন্তত মানুষের কোন অস্তিত্ব নেই! যদিও কয়েক কদম এগোতেই ভুল প্রমানিত হলো আইজার ধারণা।
বেশ পরিচিত একজন পুরুষকে নিজের দিকে পি*স্তল তাক করতে দেখে সহসা আঁতকে উঠলো ও! ফ্লোরে দুইজন জ্ঞানহীন ব্যক্তি পড়ে আছে! আর এই বিশাল বড় রুমটার কর্ণারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা হয়তো ল্যাপটপে কিছু করছিলো। আইজা সামনে পড়তে না পড়তেই সাথে সাথে নিজের হাতে থাকা অ*স্ত্রটা তুলে ধরলো সে ওর দিকে!
-“সীমান্ত!”
ক্রোধ আর বিস্ময়ের সংমিশ্রণ তার চাহনিতে। যেন এই মুহুর্তে আইজাকে এখানে একদমই আশা করেনি সে! তৎক্ষনাৎ পিস্ত*ল নামিয়ে নিলো সীমান্ত!
-“আপনি কী করছেন এখানে?”
-“আমারো একই প্রশ্ন! আপনি এখানে কী করছেন আইজা?”
দাতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলো সীমান্ত! আইজার থেকে চোখ সরিয়ে নিলো সে। ল্যাপটপে লাগানো পেনড্রাইভটা খুলে তীক্ষ্ণ কন্ঠে আরো বলে উঠলো,
-“থাক্! যা বলার বাইরে বলবেন! এখন চলুন!”
সীমান্তর চাহনি জুড়ে অধৈর্য্যের রেশ। মনে হচ্ছে আইজাকে এখানে দেখে বিস্মিত হতে গিয়েও হয়নি সে!
-“এটা কী?”
সীমান্তর হাতে থাকা পেনড্রাইভকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে বসলো আইজা। যদিও ইতোমধ্যে কিছু একটা ধারণা করে নিয়েছে ও!”
আইজার প্রশ্নে ক্ষুব্ধ নিশ্বাস ছাড়লো সে!
-“আপনি যা চেয়েছিলেন তাই আছে এতে! খুশি!!” পেনড্রাইভটা নিজ হাতে আইজার ব্যাগে রেখে দিলো সে!
সীমান্ত এখানে জাফর শিকদারের বিরুদ্ধে প্রমান যোগার করতে এসেছিলো! আইজার গতরাতেই মনে হয়েছিলো তার মাথায় কিছু একটা চলছে! সকালে পুরো বাড়ি ছান মেরেও পাওয়া যায়নি তাকে! আর নাজিম শিকদারের ড্রাইভারও হঠাৎ করেই কোথায় যেন চলে গেলো! বরাবরের মতো এবারও সীমান্ত সবটা লুকিয়ে গেছে আইজার কাছ থেকে!
-“আসলে…আপনি সব জানেন?”
মৃদু সংকোচের রেশ লেগে আছে আইজার কন্ঠে!
-“হ্যাঁ! বাবা নিজের ভাইকে সেফ রাখতে এখানে ফুটেজটা রেখেছিলো!”
নিষ্প্রভ ভঙ্গিতে বললো সে!
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আইজা। সীমান্ত হয়তো নিজের মায়ের ব্যপারে জানে না! হঠাৎ ফ্লোরে পড়ে থাকা দু’জন ব্যাক্তির মাঝে একজন জেগে উঠলো। সীমান্ত হুট করেই এগিয়ে গেলো তার দিকে! তখনই আইজার মনে হলো ওর হাতের আংটিটা জায়গামতো নেই! হয়তো জানালা টপকানোর সময় নিচে পড়েছিলো! আইজা দ্রুত সেই জানালার কাছে গিয়ে দেখলো আসলেই নিচে একপাশে পড়ে আছে আংটিটা! চশমাটা তো আবার গাড়ির ডিকিতেই ফেলে এসেছে ও!
আংটিটা হাতের আঙ্গুলে বসাতে না বসাতেই খট করে খুলে গেলো সেই বিশাল রুমের দরজা। নাজিম শিকদার ক্ষোভ ভঙ্গিতে একহাতে রিভল*বার আর অন্য হাতে পানির বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! চোখ গুলো খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার! তবুও রিভল*বারের নিশানা একদম আইজার কপাল বরাবর!
-“বাবা কী করছেন! আমি আপনার ছেলের বৌ! আমাকে মে*রে ফেললে তো আপনার ছেলেরই কষ্ট হবে!”
এক পা দুই পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে আইজা।
-“তো! তোকে তো আজ ছাড়বো না! নইলে তুই সীমান্তকে সব বলে দিবি!”
-“কী বলবো তাকে! যে বাবাকে সে এতো সম্মান করে সে-ই তার মায়ের খু*নি!”
আইজার কন্ঠস্বরে কঠোরতার রেশ!
-“বেচে ফিরলে তো বলবি!”
বাঁকা হেঁসে বলে উঠলো নাজিম। পানির বোতলে থাকা পানিগুলো চোখে ছিটকে সেই খালি বোতলটা ছুড়ে ফেললো সে! যদিও তার মুখে লেপ্টে থাকা বাঁকা হাসি বেশিক্ষণ টিকলো না। আইজার পাশ ঘেঁষে সামনে আসা ব্যক্তিকে দেখতেই মিলিয়ে গেলো সে হাসি!
নাজিমের দিকে নড়বড়ে হাতে পি*স্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে সীমান্ত। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দুগুলো চক্ষুগোচর হয়নি কারো। ঠান্ডা শীতল ঘরটা মুহূর্তেই গুমোট মনে হচ্ছে!
সাথে সাথেই নিজের হাত নামিয়ে ফেললো নাজিম।
-“সীমান্ত দেখ্! আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি এসব! তুই তো জানিস, আমি তোর মাকে কতটা ভালোবাসতাম!”
ধীরে ধীরে সীমান্তর দিকে পা বাড়াচ্ছিলো সে। ছোট বাচ্চাদের যেভাবে ফুঁসলে নিজের আয়ত্তে আনা হয় নাজিম সেভাবেই সীমান্তকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে!
-“আর এক পা-ও যাতে আগে না বাড়ে তোর! মা’কে নিয়ে তোর মুখ থেকে একটা কথা-ও শুনতে চাই না আমি!”
সবসময় নিজেকে সামলে ঠান্ডা রাখা সীমান্ত আজ সে কার্যে ব্যর্থ!
সহজে কাউকে আপনি ছাড়া সম্বোধন না করা লোকটাও আজ তুইতোকারি করছে! তাও আবার নিজের জন্মদাতাকে!
-“সীমান্ত!!”
-“তুই একটা খু’নি! আমি সারাজীবন একটা খু*নিকে….!”
গলা থেকে আর আওয়াজ যেন বেরুতে চাইছে না সীমান্তর। বুকটা ঝলসে যাচ্ছে ওর!
সীমান্তর চোখে নাজিমের জন্য আজ ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারছে না নাজিম! নিজের ছেলের কাছ থেকে এই চাহনি সহ্য করতে পারছে না ও!
-“হ্যাঁ! আমি মে*রেছি তোর মাকে! আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছিলো সে! একটা সামান্য মালিকে খু*ন করেছি বলে আমাকে ছাড়তে চাইছিলো! আমি কী করে সহ্য করতাম সেটা! তার না-কি আমাকে দেখলে গা ঘিনঘিন করতো! যাকে এতো আগলে রাখলাম সে-ই আমাকে জে*লে পাঠাতে চেয়েছিলো!!!”
পাগলের মতো প্রলাপ করে যাচ্ছে নাজিম! তার বদ্ধ উন্মাদনায় মেতে থাকা আঁখি জোড়া ক্রমশ ফুঁসে উঠছে। লোকটাকে এই মুহুর্তে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ মনে হচ্ছে না!
তবে সীমান্তর দিকে চোখ যেতেই আইজার ভয়ের মাত্রাটা পূর্বের তুলনায় একটু বেশি বেড়ে গেলো যেন! তার হাতটা ট্রি*গারে মজবুত হয়ে আসছে। চোখগুলো আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় উত্তপ্ত! ব্যান্ডেজ ভেদ করে রক্তের ছাপ আরো গাড়ো হয়ে এলেও তাতে কোন হেলদোল নেই সীমান্তর!
-“সীমান্ত আপনি….!!”
গু*লি বর্ষনের আওয়াজে সাথে সাথে কানে হাত দিয়ে চুপ হয়ে গেলো আইজা! সীমান্তর হাতে থাকা পি*স্তল থেকেই নিক্ষেপ হয়েছে সেই গু*লি! মুহুর্তেই ঐ অ*স্ত্র নিচে নামিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো সে! যেন এভাবেই তার মধ্যে চলতে থাকা তুফান শান্ত হবে! কারো প্রতি ভরসা যতটা গভীর হয় ; সেই ভরসা ভেঙে যাওয়ার পর অন্তরে চলা আত্ম চিৎকার হয়তো ততটাই ভয়ানক হয়!
নাজিম শিকদার স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে নিজের ছেলের দিকে! গু*লিটা একদম তার পাশ ঘেঁষে গেছে। থরথর কাঁপছে সে। ক্রোধে না-কি অন্য কোন অনুভূতিতে তা তেমন একটা বুঝা যাচ্ছে না। তবে আইজার এই বিভ্রান্তির পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে হাতে থাকা রিভল*বারটা আবারও উপরে তুলে নিলো লোকটা। কিন্তু এবার রিভল*বারের মুখটা আইজার দিকে না বরং সীমান্তর দিকে! সীমান্তর তো কোনদিকে খেয়াল নেই। যতক্ষণে আইজা কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তার আগেই দ্বিতীয়বারের মতো গু*লি ছোড়ার আওয়াজ গুঞ্জে উঠলো চারিদিক!
নাজিম শিকদারের হাতে থাকা রিভল*বার মুহূর্তেই ফ্লোরে আছড়ে পড়লো! লোকটার হাতের উল্টোপিঠ রক্তাক্ত হয়ে আছে। আর তার কিছুদূরে জামিল মাহমুদ নাজিমের দিকে বন্দু*ক তাক করে আছে! রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করলো সে আইজার দিকে!
-“তোদের চেয়ে বোকা আমি দু’টো দেখিনি! সীমান্তকে নিয়ে বাইরে যা! তোদের জন্য আজ আমাদের সব পরিকল্পনা অকেজো হয়ে যেতো!”
জামিল মাহমুদের পেছনে আসা কয়েকজন পুরো জায়গাটা ঘিরে রেখেছে! আইজা একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে সীমান্তকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। পুরো জায়গাটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে। প্রায় পাঁচ মিনিট হেঁটে চলার পর বাইরের ঠান্ডা হাওয়ার অস্তিত্ব টের পেলো ও!
সীমান্ত আগের তুলনায় শান্ত হয়ে হেঁটে চলছে। এখন আর তাকে টেনে নেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। হাতের আংটিটা জ্বলজ্বল করছে আইজার চোখের সামনে। সেটা খুলে নিলো ও। হয়তো আর এই আংটি রূপী মিনি ক্যামেরার দরকার হবে না! গতকালই তো রিয়াদকে দিয়ে আনিয়েছিলো বস্তটা। তখন ভেবেছিলো সীমান্তর চশমার পেছনে থাকা রহস্য নিশ্চয়ই নাজিম জানে! হঠাৎ শরীরে দমকা হাওয়া বাড়ি খেয়ে যাওয়ায় টনক নড়লো আইজার। পাশে সীমান্তকে না দেখতে পেয়ে চারিদিকে চোখ বুলাতে শুরু করলো ও!
স্থান অথবা সময় কোনকিছুরই যেন খেয়াল নেই সীমান্তর। ধীর গতিতে পা ফেলে যাচ্ছে ও! এই হাড় কাঁপানো শীতে থাকা ফোবিয়াটাও যেন আর গায়ে লাগছে না! কতটা বছর প্র’তিশো’ধের স্পৃহায় জ্বলে গেছে সে! নিজের মায়ের খু*নিকে শা*স্তি পেতে দেখার আকাঙ্খায় প্রতিনিয়ত ছারখার হয়েছে! কত কিছু করেছে সীমান্ত এর জন্য! কিন্তু আজ সে কাঙ্খিত দিন ওর চোখের সামনে থাকা স্বত্বেও নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে এই প্র’তিশো’ধের নে*শায় মেতে থাকা খেলায় জিত তো কখনো সীমান্তর ভাগ্যে ছিলোই না!
নিজের বুকে কারো হাতের স্পর্শ টের পেলো সীমান্ত। আইজা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে ওকে। তার ঠান্ডা হাত জোড়া শক্ত করে চেপে ধরলো সীমান্ত। মুহূর্তেই উষ্ণতায় ছেয়ে গেলো হৃদয়! এই উষ্ণতা যে সীমান্তর কতোটা প্রয়োজন সেটা আগে কখনো বুঝতে পারেনি ও!
চলবে…
(শেষ পর্ব হয়তো আজ রাতে অথবা কাল সকালে আসবে। সবাইকে ইদ মোবারক।)