জীবনের নানা রং পর্ব-১৪

0
624

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব–১৪
মাহাবুবা বিথী

জাবেদ রুমে এসে শিউলিকে বললো,
—-আমি জানি,শিউলি তোমার মনটা ভালো নেই।আর এটাও জানি মা তোমার সাথে সবসময় খিটমিট করে।তবে মাতো আমাদের ভালবাসে।এ বিষয়টা তোমার আমার মাথায় আসেনি।কিন্তু মা তো মুরুব্বি মানুষ।তার অভিজ্ঞতার ঝুলিটাও অনেক পূর্ণ।আমি হয়তো তোমাকে জোর করে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারতাম।কিন্তু তোমার মঙ্গলের কথা চিন্তা করে আগালাম না।আমারও মনটা ভালো না।অনেক আশা করে টিকিট কেটে ছিলাম।তবে এটাও বিশ্বাস করি এরপরে আল্লাহপাক আমাদের যে সুযোগ দিবেন এর থেকে অনেক বেটার কিছু দিবেন।
শিউলি বললো,
—-ইনশাআল্লাহ।হয়তো এটাই আমাদের ভবিতব্য।প্রতিক্ষণে সংসারের জটিলতায় শিউলি হাপিয়ে উঠে।
জাবেদ পরদিন অফিসে গিয়ে জয়েন করলো। ছেলে বৌয়ের বেড়ানোর ঝামেলাটা সামলে নিতে পেরে মরিয়ম বিবিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।অস্টেলিয়া থেকে মেয়ে জুলি ফোন দিয়েছে
—- হ্যালো মা কেমন আছো?ভালো আছো।
মরিয়ম বললো,
—–আমার আবার ভালো থাকা।সংসারের যাঁতাকলে আমার জীবন ওষ্টাগত।কতদিকে মাথা ঘামাতে হয়।ওদের তো কারও বুদ্ধি নেই।(একটু জোরে শিউলিকে শুনিয়ে)জাবেদের কোনো কান্ড জ্ঞান আছে পোয়াতি বউটারে নিয়ে উনি এখন সাগর ভ্রমনে যাবেন।যাক ওর সুৃমতি হয়েছে।আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপর শিউলির ঘরে গিয়ে ওর হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিলেন।
—হ্যালো ভাবি কেমন আছো?তোমাদের বিয়েতে আসতে পারলাম না।তোমার বিয়ের পর এই প্রথম তোমার সাথে কথা হচ্ছে।আমি যখন ফোন দেই তুমি তখন কাজে ব্যস্ত থাকো তাই কথা হয় না।
শিউলি বললো,
—-আপু তুমি কেমন আছো? দুলাভাই বাচ্চারা ভাল আছে।
জুলি বললো,
—-সবাই ভালো আছে।তোমার জন্য একটা সুন্দর একটা কাঞ্জিভরন শাড়ি কিনেছি।এই ডিসেম্বরের ছুটিতে দেশে আসবো।ইনশাআল্লাহ আর ছ,মাস পরে দেশে আসবো।দুদিন পর রোজা শুরু হবে। এই শরীরে রোজা রাখতে পারবে?ঈদ উপলক্ষ্যে তোমার জন্য শাড়িটা কিনেছি।
শিউলি বললো,
—-আমাদের রোজা রাখার অভ্যেস আছে।অনেক ছোটো বেলা থেকে ভাইবোনরা রোজা রাখি। শিউলি আর বেশী কথা বাড়ালো না।জুতো মেরে গরু দান শিউলির ও ভালো লাগে না। ওর ও শাশুড়ীর আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বলে।আপু এখন ফোনটা রাখি।
শিউলি শাশুড়ীর হাতে ফোনটা দিয়ে ভাবে,
এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ রাজনীতি করে বেড়ায়।এতোদিন আপু কথা বলতে চাইলেও শাশুড়ী কথা বলতে দেননি।আর আজকে নিজ ইচ্ছাতেই দিয়ে গেলেন।উনি শিউলির বেড়াতে যেতে না পারার কষ্টের ক্ষতটায় মলমের প্রলেপ দিচ্ছেন এটা শেফালী ঠিক বুঝতে পেরেছে।

প্রেগন্যান্সি অবস্থায় শিউলি রোজা রাখছে।যদিও জাবেদ একটু টেনশনে ছিলো।শেষ পর্যন্ত রোজাটা শেষ করতে পারবে কিনা।আল্লাহর রহমতে রমজান মাসের দিনগুলি শিউলির ভালোই কাটলো।

বিয়ের পর শিউলিদের প্রথম ঈদ।ঈদের আর এক সপ্তাহ বাকি।শেফালী রাশেদকে নিয়ে শিউলি জাবেদ ওর শ্বশুর শাশুড়ী আর ননদ তুলির জন্য ঈদের পোশাক নিয়ে কুমিল্লায় শিউলির শ্বশুড় বাড়ি রওয়ানা হলো।সাথে ইফতার ও বানিয়ে নিলো। অনেক ফলমূল কিনে আনলো।জাবেদও ওইদিন বাসায় ছিলো।সবাই মিলে একসাথে ইফতার করলো।ওদেরকে দেখে শিউলির শাশুড়ী মুখটা কালো করে রাখলো।শেফালী এই পরিবেশ ইগনোর করে শিউলির রুমে গিয়ে বসলো।শিউলি আর জাবেদ শেফালীকে বললো,
—–আজকে থেকে গেলে হয় না
শেফালী বললো,
—-না থাকা হবে না।বড় আপার বেবী হবে।ওর টিউমারের অপারেশন হবে।ওকে ঈদের পর হাসপাতালে ভর্তি করবে।আমাকে ঢাকায় গিয়ে আপার কাছে থাকতে হবে।
জাবেদ শিউলিকে চা বানাতে বললো।দু,বোনকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে ও রুম থেকে বের হয়ে গেলো।শিউলি ওর বোনের সাথে গল্প করতে লাগলো।এমন সময় শেফালী আর শিউলি শুনতে পেলো,জাবেদের মা তুলিকে বলছে,
—-তুলি আমার মনে হয় জাবেদ এগুলো কিনে ওর শ্বশুর বাড়ি রেখে এসেছে।আর শেফালী ওর মায়ের নাম করে এগুলো নিয়ে এসেছে।নিজেদের খাওয়া পড়ার ব্যবস্থা নাই।আবার গিফট কেনার এতো টাকা কোথায় পাবে।এগুলো সব শিউলির বুদ্ধি।ফকিরের ভিক্ষে দেওয়ার শখ হয়েছে। আমি যাতে ওরে কথা শুনাতে না পারি কাহিনীটা এইজন্য করেছে।

শেফালীর সামনে শিউলির মুখটা অপমানের কালিতে ঢেকে গেলো।শেফালী শিউলিকে বললো,
—-চা আর খাবো না।রাত হয়ে যাচ্ছে।আমি বাসায় চলে যাই।
শেফালী শিউলির রুম থেকে বের হয়ে ওর শাশুড়ীর সাথে দেখা করতে গেলো।ওর শাশুড়ীকে বললো,
—-রাত হয়ে যাচ্ছে।এখন রওয়ানা দিবো।আন্টি আল্লাহর রহমতে আমরা কোনদিন ফকির ছিলাম না।তাই ভিক্ষে নেওয়ার অভ্যাস আমাদের নেই। এক সময় আমাদের কাপড় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলে যেতো।এখন অবস্থা একটু পরতির দিকে।মানুষের জীবনে উত্থান পতন থাকে। এটাই জীবনের রীতি।কিছু মানুষ থাকে যারা অন্যকে অপমান করে আনন্দ পায়।কিন্তু সে বুঝতে পারে না নিজের অজান্তেই সে তার অপমানের রাস্তাটা খুলে দেয়।শেফালীকে
শিউলির শাশুড়ী বললো,
—-এতো কথা শুনাচ্ছো কেন।বোনের বাড়ি এসছো।
ভালো মতো বেড়াও।পারলে নিজে সংসারী হওয়ার চেষ্টা করো।তবে এটা ঠিক চোপার জোর থাকলে এদের সংসার জীবন সুখী হয় না।সংসারে সুখী হতে সংসার জীবনের কূট কৌশল মানিয়ে নিয়ে তবে সুখী হতে হয়।
শেফালী বলে
—তাতো বটেই মানিয়ে নিতে নিতে একসময় কবরটাকেই মানিয়ে নিতে হয়।এটাই তো আপনাদের মতে সংসার জীবনের সার্থকতা।তবে আমি এই জীবনের সাথে একমত না।আর কথা না বলি।কথায় কথা বাড়ে আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।
জাবেদ আর ওর বাবার কাছে বিদায় নিয়ে শেফালী আর রাশেদ রওয়ানা হলো।
শেফালী নিজের মনে ভাবে,মেয়ে মানুষের জীবন বড়ই অদ্ভূত।বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলো ভূলে যায় তাদের বউমা একজন রক্ত মাংসের মানুষ।সেও কথার আঘাতে রক্তাক্ত হয়।যে মানুষটার উপরে ওরা সংসারের দায় পুরো চাপিয়ে দেয় সেই মানুষটা যদি নিজে ভালো না থাকতে পারে তাহলে ওদেরকে ভালো রাখবে কিভাবে।

শেফালী চলে যাবার পর জাবেদ ওর মাকে বললো,
—–মা নিজের সম্মান নিজেকে রক্ষা করতে হয়।তুমি ঐ কথাগুলো বলে নিজে ছোটো হলে আর আমাকেও ছোটো করলে।তোমার ছেলের উপর তোমার কোনো বিশ্বাস নেই।তোমার কারনে শিউলির কাছে আমাকে ছোটো হতে হয়।
ওর মা বললো,
—কোনো রাজ পরিবার থেকে মেয়ে আনিস নি।যে মান্য করে খেতে হবে।হাড় হাভাতে ঘরের মেয়ে তার আবার সম্মান কিসের।আমার বাড়িতে বউ করে এনেছি এটাই ওর সাতপুরুষের ভাগ্যে।
জাবেদ বললো,
—তোমার এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছো।দুদিন পর তুলির বিয়ে হবে।দিনশেষে এই হাড়হাভাতে মেয়েটার কাছে তোমাকে থাকতে হবে।
ওর মা বললো,
—বউয়ের হয়ে খুব কথা বলতে শিখেছিস। তোর সামনে এমনভাবে থাকে যেন ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানে না।তুই বাড়ি না থাকলে ও আমাকে ভালোই কথা শুনায়।
জাবেদ বললো
—-মা,আঘাত পেতে পেতে কাঠের পুতুলও এক সময় কথা বলা শিখে যায়।

জাবেদ প্রতিবাদ করাতে শিউলি কিছুটা স্বস্তি পায়।তবে অবাক হয়ে ভাবে,নারীর জীবনের অশান্তির কারণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নারীরাই হয়ে থাকে।প্রতিবাদ করলে মুখরা কিংবা নষ্টা মেয়ে বলে।যাতে মেয়েরা সবকিছু নিরবে সয়ে যেতে পারে এই “আদর্শ নারী “নামক তকমা নারীদের গায়ে নারীরাই লাগিয়ে দেয়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here