জীবনের নানা রং পর্ব-১৬

0
640

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব–১৬
মাহাবুবা বিথী

দুদিন পর সরুপাকে কেবিনে দিয়ে সিস্টার বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়াতে ওর পাশে শুইয়ে দিলো।শেফালীকে ওষুধপত্র বুঝিয়ে দিয়ে সিস্টার চলে গেলো।শেফালী সরুপার দিকে তাকিয়ে দেখলো। ওকে খুব বিমর্ষ লাগছে।শেফালী সরুপাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—আপু তোর কি কোন কারণে মন খারাপ?
সরুপা বললো,
—-ডাক্তার আমার ইউটেরাস ফেলে দিয়েেছে।আমি তো আর মা হতে পারবো না।
শেফালী বললো,
—ডাক্তার তোর ভালোর জন্যই হয়তো ইউটেরাস ফেলে দিয়েছে।শোন আপু এই পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক পুরুষ মানুষ আছে যারা স্ত্রীর অসুস্থ হওয়াকে স্বাভাবিক ভাবে নেয়।সুস্থ সবল কর্মক্ষম বউ পুরুষ মানুষের পছন্দ।আমি তো ছোটো বেলায় দেখেছি,মা অসুস্থ হলে বাবার মেজাজ সপ্তমে উঠে থাকতো। সংসার আর তিনটে সন্তানকে ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে তোর সুস্থতার কোনো বিকল্প নাই।
মন খারাপ করিস না।
পাঁচদিন পর সরুপা হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলো।শাশুড়ী নাতির গলায় সোনার চেইন পড়িয়ে দিলেন।শেফালী তখন সরুপার শাশুড়ীকে বললো,
—-আপনার নাতির গলায় না দিয়ে আমার বোনের গলায় পড়িয়ে দেন।
সরুপার শাশুড়ী বললো,
—-ওই একই হলো।আমার নাতি কি আর পড়বে।তোমার বোনই পড়ে বেড়াবে।
শেফালীর খুব ভালো লাগছে। আন্টি ওর বোনের যত্ন নিচ্ছে।দুপুরে সরুপার জন্য কালিজিরার ভর্তা পাবদা মাছের ঝোল আর পাঁচ মিশালী সবজি দিয়ে ভাত দিয়েছে। মুরগীর সুপ বানিয়ে দিয়েছে। বাপের বাড়ির মানুষগুলোর খুব বেশী চাওয়া থাকে না। একটু আদর ভালবাসা আর সম্মান পেলেই অনেক পাওয়া হয়ে যায়।ভাল ব্যবহারের জন্য শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলোকে টাকা খরচ করতে হয় না।শুধু মনটা একটু উদার হলেই হয়ে যায় । আল্লাহ যেন আন্টিকে হেদায়াত দান করে।যদিও কয়লার ময়লা ধুইলো যায় না তবুও শেফালী আল্লাহপাকের কাছে এই দোয়া করে সরুপার সংসারে সুখ যেন উপচে পড়ে।

শেফালী লালবাগে ফিরে আসলো।রাহেলা বেগম শেফালীকে বললো,
—-আমার শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে।ডাক্তার দেখানো দরকার।
শেফালী মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো, আসলেই মাকে অনেক কাহিল দেখাচ্ছে।মনে হয় মার শরীরের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে।
রাহেলা বেগম শেফালীকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-সরুপা কেমন আছে?ছেলেটা দেখতে কার মতো হয়েছে?
শেফালী বললো
—-আপু ভালো আছে।আম্মা তোমাকে তো সোনার চেইন নিয়ে নাতিকে দেখতে যেতে হবে।তখন দেখে এসো তোমার নাতি দেখতে কার মতো হয়েছে।আম্মা রাশেদ আর শাহেদেতো বাসায় ছিলো।ওদেরকে বলতে তোমাকে ডাক্তার দেখাতে।তুমি এই শরীরে আবার ওদের জন্য রান্না করেছো।তোমাকে তো ভীষণ অসুস্থ দেখাচ্ছে।
রাহেলা বেগম বললেন
—রাশেদের সামনে টেস্ট পরীক্ষা।ওর তো হাতে একদম সময় নেই।
শেফালী রাহেলা বেগমকে বললো,
—-আম্মা শাহেদ কে বলতে তোমাকে নিয়ে যেতে
রাহেলা বেগম বললেন
—-ও তো সময় পায় না।কোচিং পড়াশোনা সব কিছুর চাপ সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে।
শেফালী বলে,
—-ওরা তোমাকে ডাক্তার দেখাতেও সময় পায় না।দোকানে বসতেও সময় পায় না।সব কিছুতেই অলসতা।আর আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া।
তাহলে তো দোকান এবার লাটে উঠবে।মাঝে মাঝে দোকানে গেলে কি এমন পড়াশোনার ক্ষতি হতো।রমিজ তো দোকান চালাচ্ছে। শুধু ওর দিকে একটু নজর রাখা।কাল তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
যাক আমার কিছু বলার নাই।শেফালী রাগ করে রুমে চলে গেলো।শেফালীর রুমের পাশেই শাহেদের রুম।শেফালী শুনতে পায় শাহেদ অনেক রাত অবধি কার সাথে ফোনে কথা বলে।এতে সময় নষ্ট হয় না।দোকানে বসলে সময় নষ্ট হয়।শেফালী মনে মনে শাহেদের উপর খুব বিরক্ত হয়।
মাকে নিয়ে পরদিন শেফালী ডাক্তারের কাছে যায়।ডাক্তার টেস্ট করে বলে একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়ে গেছে।ডাক্তার ওষুধপত্র দিয়ে শেফালীকে মায়ের দিকে খেয়াল রাখতে বলে।
শেফালী মায়ের খুব যত্ন নেয়।দুভাইয়ের দিকেও নজর রাখে।শাহেদের চলাফেরা ওর খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না।রাশেদ তো এখনও ছোট।শেফালীকে তাই ভয় পায়।কিন্তু শাহেদের যতই বয়স বাড়ছে বেয়ারাপনা ততই বেড়ে চলেছে।

দুদিনপর কোরবানীর ঈদ।জাবেদ গরু কিনতে হাটে গিয়েছে।শিউলি ধীরে ধীরে সংসারের কাজ গুছাতে লাগলো।বমিটা এখনও বন্ধ হয়নি।এইজন্য শরীর খুব দুর্বল।
শাশুড়ীর কথা হচ্ছে পোয়াতি মেয়েদের বেশী খাওয়া ঠিক না।বেশী খেলে বাচ্চা বড় হয়ে যাবে।বাচ্চা বড় হলে নরমাল ডেলিভারী হবে না।আর নরমাল ডেলিভারী না হলে মায়ের সাথে বাচ্চার বন্ডিং হবে না।শাশুড়ী সারাদিন কাজ করতে বলেন।পোয়াতি মেয়েদের শুয়েবসে থাকা ঠিক না।জাবেদ ওর মাকে ভালভাবেই চিনে।তাই এখন সপ্তাহান্তে দুবার বাসায় আসে।অনেক ফলমূল নিয়ে আসে।শিউলির দিকে খেয়াল রাখে।ঈদের ছুটিতে সাতদিন অফিস বন্ধ আছে।জাবেদ বাসায় থাকাতে শিউলি কিছুটা শারীরিক আরাম পাবে।

জাবেদ হাট থেকে এসে বাথরুমে গোসল করতে ঢুকেছে।শিউলির কিছু কাপড়, বিছানার চাদর জাবেদের নিজের পোশাক সব ধুয়ে গোসলটাও সেরে নিলো।এরমাঝে শাশুড়ী বালতির কাপড় উল্টে পাল্টে দেখেন।শিউলির পরনের কাপড় দেখতে পেয়ে জাবেদকে বললে,
—-যত দিন যাচ্ছে তুই স্ত্রৈন হয়ে যাচ্ছিস।কি দিয়ে যে তোকে ও বশ করলো? যা বলে তাই শুনিস।কোনদিন আমার পরনের কাপড় তো ধুয়ে দেখিসনি।বিয়ের পর তোর দিন এতই খারাপ হলো যে,বউয়ের কাপড় ধুয়ে ভাত খেতে হয়।
জাবেদ বললো,
—-মানুষকে যদি বশ করা যেতো শিউলি সবার আগে তোমাকে বশ করতো মা।ও আমাকে কোনদিন কোনো কাজ করে দিতে বলেনি।আমি নিজ দায়িত্ববোধ থেকে করি। একটা অসুস্থ মানুষকে সাহায্য করা এটাতো দোষের কিছু না।তুমি ভূলে গেছ মা তুমি অসুস্থ হলে আমি তোমারও কাপড় ধুয়ে দিতাম।

জাবেদের মা জাবেদকে বললো,
—তুই কি আমাকে খোঁটা দিচ্ছিস? জন্মের পর থেকে হাগা মোতা সাফ করে আমি তোদের বড় করলাম। আমার মুখ দিয়ে তো কোনদিন বের হলো না।কালে ভদ্রে করেছিস সেটা আবার আজ মুখ তুলে বলে দিলি।
জাবেদ ওর মাকে বললো,
—-তুমি কষ্ট পেওনা মা,আমি তোমার অসুখ হলেই সাহায্য করেছি।সেটা হয়তো কালে ভদ্রে করেছি।শিউলিরও যে সবসময় করি তা,না।ও এখন অসুস্থ বলেই সাহায্য করি।
জাবেদের মা বললো,
—-এখন তোদের কাছে আমার নিয়ম কানুন শিখতে হবে। জাহিদ ও তোর চাচাতো ভাই।শায়লারে কেমন টাইটের উপর রাখছে।শায়লার বাপের বাড়ি থেকে আস্ত খাসি পাঠাইয়া দিছে।যে পোলা বউরে টাইট দিয়া রাখে সেই পোলা শ্বশুর বাড়িতে অনেক খাতির পায়।জাহিদরে দেইখা তোর শেখা উচিত।তুই তো তোর বউরে মাথায় উঠাইয়া রাখছোস।
জাবেদ বললো,
—-আমার শেখার দরকার নাই।আমি কাউরে মাথায় উঠাই নাই। জাহিদ শায়লাভাবির নামে কোনো কুরবানি দেয় না তাই শায়লাভাবির বাপের বাড়ি থেকে কুরবানি দেওয়ার জন্য খাসি পাঠাইয়া দেয়।আল্লাহ আমারে একটা গরু কুরবানী দেওয়ার সামর্থ্য দিয়েছে।সবার নামেই কুরবানী দেওয়া হয়।তাহলে শিউলির বাপের বাড়ি থেকে খাসি আনার দরকার কি? আর আমার আত্মসম্মানে বাঁধে।

মানুষের জীবন সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার কাব্য।রাত পোহালে যেমন ভোর হয়,তেমনি দুঃখের রজনীর পর সুখের ভোর আসে।আর সময়ই পারে দুঃখ ঢেকে দিয়ে জীবনকে আনন্দে ভাসিয়ে দিতে।জীবনের ময়দান যেন ক্রিকেটের মাঠ।কখনও ছক্কা পেটাতে হয় কখনও বা এক এক রান করে এগিয়ে যেতে হয়।কখনও বা রান না করে উইকেটে টিকে থাকতে হয়।

দিনভর পরিশ্রমের পর রাতের সময়টুকু শিউলি আর জাবেদ নিজেদের মতো করে কাটায়।সংসারে কূটকৌশলে সারাদিনের উপার্জিত শিউলির বেদনাগুলো জাবেদের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে ধুয়ে মুছে চলে যায়।তাই অযুত লক্ষ অপমান আর অবহেলার পরেও শিউলির মতো নারীদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সাধ রয়ে যায়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here