জীবনের নানা রং পর্ব-১৯

0
1224

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব–১৯
মাহাবুবা বিথী

পরদিন খুব ভোরে শেফালী ঘুম থেকে উঠে পড়ে।মা রাহেলা বেগমের সাথে সকালের চা নাস্তার আয়োজনে সাহায্য করে।ঘরে নতুন বউ আছে।সাদা মাটা নাস্তা বানালে তো হবে না।শেফালী পরোটা, কলিজা ভূনা, বিবিখানা পিঠা, পায়েস, ফলের জুস,মিষ্টি দিয়ে নাস্তার টেবিল সাজিয়ে রাখলো।
তারপর শেফালী শাহেদের রুমে দরজায় নক করে বললো,
—–নাস্তা রেডী,তোমরা খেতে আসো
শাহেদ নীলা ফ্রেস হয়ে চলে আসলো।সবাই একসাথে নাস্তা করে নিলো।
রাহেলা বেগমের শরীরটা মাঝে মাঝে খুব ঘেমে উঠে।তখন দুর্বল হয়ে যায়।এইজন্য শেফালী বাসায় থাকলে রান্নাটা ও করে দেয়।
শাহেদ এখনও ছাত্র।যদিও দোকানের আয় আছে তারপর ও সংসার চালাতে শেফালীর অনেক কষ্ট হয়।রাশেদের লেখাপড়ার খরচ শেফালীর মার চিকিৎসা খরচ আবার শাহেদের পড়াশোনা সব মিলিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

শেফালী বুটিকসের কাজ শুরু করেছে।শাহেদের বিয়ের বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেলো।শেফালীকে মাঝে মাঝে খুব সকালে বের হতে হয়।সেদিন সকালে বের হওয়ার সময় নীলাকে ডেকে শেফালী বললো,
—–মাকে একটু চা করে দিও।রুটি আর ভাজি তৈরী করা আছে তুমি আর মা আর শাহেদ খেয়ে নিও।শাহেদ সেদিন বাসায় ছিলো।দুপুরের জন্য সবজি কুটে রেখো আমি এসে রান্না বসাবো।
নীলা বললো,
—-আপু আমাকে সকালে ঘুম থেকে ডাকবেন না।আমার মাথা ব্যথা করে।বেলা দশটার আগে আমি ঘুম থেকে উঠতে পারবো না।আর সবজিও কুটতে পারবো না।আমার নখ কালো হয়ে যাবে।
শেফালী বললো,
—-সারাজীবন সকালেই স্কুল কলেজ ভার্সিটিতে যেতে হয়।মাথা ব্যথা করলে তুমি পড়াশোনা করলে কিভাবে?আর নখ কালো হলে লেবু দিয়ে ঘসলে দাগ উঠে যায়।
শাহেদ বাসায় থেকেও নীলাকে কিছু বললো না।শেফালীও আর কথা না বাড়িয়ে ওর কাজে চলে গেলো।ওকে যে বুটিকসের কাজগুলো করতেই হবে।সামনে রাশেদের পড়াশোনার খরচ আরও বেড়ে যাবে।সংসারের আয় বাড়াতে হবে।

পাঁচ বছর পর—-
এর মাঝে শেফালীর দাদা ও মারা গেলো।শেফালী আরও অভিভাবকহীন হয়ে পড়লো।মাঝে মাঝে সংসারের কোনো জটিল সমস্যা হলে দাদার কাছে বুদ্ধি পরামর্শ নিতো।
শাহেদ পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি যোগাড় করে।এর মাঝে নীলার বাবা ওদের বিয়েটা মেনে নেয়।নীলা ওর বাবা মার একমাত্র সন্তান।এখন বাবার বাড়ির সাথে নীলা আর শাহেদের অনেক সুন্দর সম্পর্ক তৈরী হয়েছে।নীলা মা হতে চলেছে।সারাদিন শুয়ে থাকে।সংসারের সব কাজ শেফালী এক হাতে সামলায়।রাহেলা বেগমেরও বয়স বেড়েছে।মারও সেবা যত্ন শেফালীকেই করতে হয়।
রাহেলা বেগম নীলাকে বললো,
—-তোমার বাচ্চা হওয়ার সময় মাকে নিয়ে এসো।আমি তো এখন কিছু করতে পারি না।
নীলা তেতে উঠে বললো,
—-বাচ্চা তো এই বংশের। আমার মা কেন আমার আর বাচ্চার সেবা করবে।তারপরও যদি মাকে নিয়েও আসি মা শুধু আমার দিকেই খেয়াল রাখবে।আপনার কিংবা আপনার সংসারের খেয়াল রাখার দায় আমার মার নয়।
শেফালী এই কথা শুনে বললো,
—তুমিই যেখানে তোমার শাশুড়ীর খেয়াল রাখো না।তোমার স্বামীকে সকালে আজ অবধি নাস্তা বানিয়ে দাওনি সেখানে তোমার কাছে আমি বা আমার মা কোনো আশাই করি না।তোমার খেয়াল রাখলেই হলো।
তারপর ডেলিভারীর সময় ও ঘনিয়ে আসলো।নীলার মাতো আসলই না।শাহেদের ছেলে হয়েছে।নীলার মা হাসপাতালে বাচ্চা দেখতে এসে বলে,
—-তোমগো বংশের বাতি আইছে।তােমরাই সামাল দাও।আমার শরীরের অবস্থা ভালো না।
শেফালীও কিছু না বলে ওর দায়িত্ব আপন মনে পালন করে গেলো।আর এটাও বুঝে নিলো নীলা ওকে দিয়েই ওর কাজ উদ্ধার করে নিলো।ওর গর্দভ ভাইটা টেরও পেলো না।না কি বুঝেও না বুঝার ভাণ করলো।

নীলা এবং ওর সন্তানের পুরো দেখভাল শেফালীকেই করতে হলো।বাচ্চাটা যখন একবছর শাহেদ আর নীলা আলাদা বাসায় উঠে গেলো।যদিও শেফালী আর ওর মার মনটা খারাপ হলো তবুও সম্পর্ক ভালো রাখার স্বার্থে মুখে কিছু বললো না।রাহেলা বেগম এই ছেলেকে চোখে হারাতো সেই ছেলেও মার দায়িত্ব শেফালীর উপর চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়লো।শাহেদের পড়াশোনা, বিয়ে হওয়া বাচ্চার দায়িত্ব সব শেফালীর কাঁধের উপর দিয়ে শাহেদ আর নীলা আদায় করে নিলো।

রাশেদের ও পড়াশোনা শেষ হলো।ও সোসিওলজিতে অনার্স শেষ করে একটা এনজিও তে গবেষক হিসাবে চাকরি নিলো।রাহেলা বেগম ছেলেকে বিয়ে দিতে চাইলেন। ওনার বয়স হয়েছে।শেফালীর ও কাজে সাহায্য হবে।শেফালী রাশেদকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-মা তোর বিয়ে দিতে চাইছে।তোর কোন পছন্দ আছে।
রাশেদ বললো,
—-ওর নিজের পছন্দ আছে।তবে ও অনেক ঘটা করে বিয়ে করবে।ওর বউকে সাত ভরি গয়না দিতে হবে।নামকরা কনভেনশন হলে ওর বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হবে।আপু তুমি গয়নাটা ম্যানেজ করো।আর কনভেনশনহলের কিছুটা খরচ বহন করো।আর বিয়ের ডালার শাড়িগুলো কিনে ফেলো।
শেফালী অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকিয়ে থাকলো।ওর ভাইগুলি কি ধাতু দিয়ে গড়া।সাতভরি গয়নার টাকা কোত্থেকে আসবে সে হিসাবটাও রাশেদ করলো না।কনভেনশন হলের খরচও যোগাড় করতে হবে।
রাহেলা বেগমও চাইছেন তার ছোটো ছেলের বিয়ে অনেক জাঁকজমক করে দিবেন।নিরুপায় শেফালী বোনদের শরনাপন্ন হলো।

শিউলি এখন ঢাকাতেই শ্বশুর শাশুড়ী সহ থাকে।দুটো মেয়ে হয়েছে।আবেদ মারা যাওয়াতে ওরা সবাই একসাথে ঢাকাতে থাকে।জাবেদও অফিস করে এসে আর রান্না করতে পারে না। খাওয়ার কষ্ট হয়।মেয়েরাও বড় হচ্ছে।ওদের পড়াশোনার জন্য ভালো স্কুলের দরকার।শিউলি আর সরুপার এখন সুখের সংসার।শেফালীদের দোকানটা বিক্রি করে টাকা সব ভাইবোন ভাগ করে নেয়।শেফালী নিজের কিছু টাকা আর বোনদের কাছে টাকা নিয়ে রাশেদের বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বউ ঘরে তুলে নেয়।

বিয়ের কিছুদিন পর শেফালীর মা অসুস্থ হয়ে হাডপাতালে ভর্তি হয়।শেফালী দিনরাত মায়ের কাছে থাকে।শেফালী বাড়িতে গেলে রাশেদও হাসপাতালে থাকে।বাড়ি গিয়ে রান্না করে শেফালী মায়ের জন্য খাবার নিয়ে আসে।

রাশেদের বউয়ের নাম মিরা।মিরার মা ফোন করে শেফালীকে বলে,
—-শোন শেফালী অসুস্থ রোগীর সেবা আমার মেয়ে করতে পারবে না।তোমাদের মার সেবা তোমরাই করো।
শেফালী বললো,
—-আমার মায়ের সেবা আন্টি আমরাই করতে পারি।আপনার মেয়ের সেবা করার দরকার নেই।সরুপা আর শিউলিও এসে মায়ের সেবা করে।

অবশেষে রাহেলা বেগম সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে। বছর তিনেক পর রাশেদ আর মিরার একটা ছেলে হয়।সেই দায়িত্ব ও শেফালীকে সামলাতে হয়।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শেফালী এই সংসারের পিছনে শ্রম দিয়ে যায়।মিরা সুযোগ পেলে শেফালীর স্নেহের সুবিধা নিয়ে বাচ্চার দায়ও শেফালীর উপর চাপিয়ে দেয়।

শেফালীর নিজের কাছে নিজেকে অনেক বোকা মনে হয়।আষ্টে পিষ্টে বাঁধা কলুর বলদের মতো খেটে যাওয়া সংসার থেকে শেফালী মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করে।আগের থেকে বয়সও অনেকটা বেড়ে গেছে।শরীরের যতনা বয়স হয়েছে মনের বয়স বহুগুন বেড়ে গেছে।এখন শেফালী নিজের একজন
মনের মানুষ চায়।যার সাথে জীবনের সব দুঃখ কষ্টগুলি ভাগ করে নিতে মন চায়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here