#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
শেষ পর্ব
মাহাবুবা বিথী
শেফালী রাশেদকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করে।প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাশেদও শেফালীর খুব বাধ্য ছিলো।চাকরি পাওয়ার পর রাশেদ একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে।বিয়ের পর রাশেদ পুরোটাই বদলে যায়।শাহেদও প্রচন্ড স্বার্থপর। শাহেদকে দেখে রাশেদেরও স্বার্থপরতা বেড়ে যায়।তারপরও স্নেহে অন্ধ শেফালী রাশেদকে সন্তানের মতো ভালবাসে।কিন্তু রাশেদের স্বার্থপরের মুখোশটা শেফালীর সামনে উম্মোচন হয়।রাশেদ অনার্সে প্লেস করে।তখন শেফালী ওকে বাহিরে পিএইচ ডি করতে যেতে বলে।রাশেদ বলে,
—-শাহেদ ভাই তো মাকে দেখে না।আমি ও যদি চলে যাই মাকে কে দেখবে।
শেফালী তখন খুব খুশী হয়।শাহেদ তো মার খেয়াল রাখে না কিন্তু রাশেদ মা অন্ত প্রাণ ছেলে।আসলে রাশেদের ওটা মুখোশ ছিলো।বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে রাশেদ দেশের বাহিরে যাওয়ার জন্য সুর তোলে।আসলে ও মার দায়িত্ব শেফালীর দায়িত্ব সব পাশ কাঠিয়ে চলে যেতে চায়।
তখন শেফালী রাশেদকে বলে,
—–তোমাকে বিয়ের আগে বিদেশে যাওয়ার কথা বললাম। তুমি যেতে চাইলে না।এখন তোমার বিয়ে হয়েছে। বাচ্চা হয়েছে।এখন বউ বাচ্চা কার কাছে রেখে যাবে।আর মাকেই বা কে সামলে রাখবে।
রাশেদ শেফালীকে বলে,
—যতদিন বউ বাচ্চা নিতে পারবো না আপনি একটু খেয়াল রাখবেন।আর মা আপনার কাছেই থাকুক।
শেফালী রাশেদকে বলে,
—–আমার বয়স বাড়ছে।এতকাল দায়িত্ব করে আমি এখন খুব ক্লান্ত।আর তুমি ভালো করে শুনে রাখো,তোমার বউ বাচ্চা তো তোমাকেই দেখতে হবে আর আম্মার দায়িত্ব তুমি পালন করবে।
রাশেদ রেগে গিয়ে শেফালীকে বলে,
—-কি দায়িত্ব পালন করেছেন?
শেফালী রাশেদ কে বলে,
—-আমার দায়িত্ববোধ নিয়ে আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত দিতে রাজি নই।তুমি নিজে আগে দায়িত্বশীল হও।আর তোমার বউকে দায়িত্ব শেখাও।
শেফালী বুঝতে পারে এ সংসারে ঘুণপোকা লেগেছে।মিরা সুযোগ পেলেই শেফালীর বিরুদ্ধে রাশেদকে উস্কে দেয়।তাই মিরাকে কিছু কথা শুনিয়ে দেয়।শেফালী মিরাকে ডেকে বলে,
—শোন মিরা বিয়ে করলে শুধু হয় না।সেই সাথে সংসারের দায়িত্ববোধ শিখতে হয়।
মিরা বলে,
—-আপনি এ কথা আমাকে শুনান কেন?
শেফালী বলে,
—কারণ বিয়ের পর সংসারের কোন দায়িত্বটা পালন করেছো।আজ অবধি সকালের নাস্তাটা বানাওনি।শ্বাশুড়ীর কোনো দায়িত্ব পালন করনি।এমনকি তোমার বাচ্চটাও আমার হাতের উপর দিয়ে বড় হচ্ছে।
রাশেদ শেফালীর উপর ক্ষেপে গিয়ে বলে,
—-আপনি কোন সাহসে আমার বউয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন।আমি আপনার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হবো।আমি আপনার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করবো।
শেফালী এতটাই আঘাত পেলো।মাকে বললো,
—–মা আপনি শুনছেন রাশেদ আমাকে কি বললো?
রাহেলা বেগম শেফালীকে বললো,
—–তুই বা এতো চিৎকার চেঁচামেচি কেন করিস।ওর কতদিকে খেয়াল রাখতে হয়।আমার দেখাশোনা করে ওর নিজের সংসারের দেখভাল করতে হয়।তোরও তো বয়স বাড়ছে।হয়তো একসময় তোর দায়িত্ব রাশেদকে পালন করতে হবে।তুই একটু মানিয়ে চল।
রাশেদও মায়ের সাথে সুর মিলিয়ে বলে,
—-এ সংসারে থাকতে গেলে আমার কথা মেনে থাকতে হবে।অসভ্যর মতো ব্যবহার এখানে চলবে না।
শেফালী এই অপমানের পর মাকে বলে,
—-থাকবো না আমি তোমার সংসারে।আমার দায়িত্ব কাউকে পালন করতে হবে না, আমার দায়িত্ব আল্লাহর রহমতে আমি নিজে পালন করতে পারবো।
শেফালী খুব কষ্ট পায়।কিন্তু ওর এই অপমানের জবাব ও মুখে দেয় না।সময়ের উপর ছেড়ে দেয়।সময় একদিন ওর অপমানের জবাব দিয়ে দিবে।কবির ভাষায় বলতে হয়,
“কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছেপায়,
তাই বলে মানুষের কুকুরকে কামড়ান শোভা পায়।
শেফালী ঐ সংসার থেকে বের হয়ে বড় বোন সরুপার কাছে চলে যায়।
সরুপার কাছে কয়েকটা দিন সময় চেয়ে নেয়।একটু গুছিয়ে নিয়ে ও বাড়ি ভাড়া করে চলে যাবে।
সংসারের যাঁতাকলে শেফালীর দীর্ঘ লড়াইয়ের গল্পশুনে কখন যে আমার চোখের কোন নোনা জলে ভরে গেলো টের পেলাম না।
জাবিনের কথায় আমি সম্বিত ফিরে পেলাম।
—আম্মু স্কুল তো ছুটি হয়ে গেছে।তুমি বাড়ি যাবে না।আম্মু তুমি আর শেফালী আন্টি কাঁদছে কেন?
আমি জাবিন কে বললাম,
—-তুমি মাঠে আর একটু খেলো।আন্টির সাথে কথাটা শেষ করে আসছি।
শেফালী আমাকে বললো,
—-রাশেদ আমার সাথে তো খারাপ ব্যবহার করলো আবার শাহেদ আমাকে বলে,
—যত নষ্টের গোড়া তুমি।তোমার কারণে আমি ঐ সংসার থেকে বের হয়েছি।
তাই আমিও ঐ সংসার থেকে বের হয়ে আসলাম।এতে যদি ওরা সুখে থাকে থাক।আমার জীবনও থেমে থাকবে না।আপন নিয়মে জীবন তার গতি ফিরে পায়।
আমি শেফালীর কাছে বিদায় নিয়ে বাসার পথে জাবিনকে নিয়ে রওয়ানা হলাম আর ভাবলাম,
মানুষের জীবন বড় বিচিত্রময়।
আমার ও বাবা নেই, বড় ভাই নেই।আমারও ছোটো দুবোন আছে।বোনেরা বিয়ে করতে চাইতো না।আমাদের ও মধ্যবিত্ত সংসার।তারপরও বোনদের বুঝিয়ে বিয়ে দিয়েছি।কারন এইটুকু বুঝেছি সারাজীবন ভাইরা দেখবে না।ভাইদের সংসারে অনাহুতের মতো থাকার চেয়ে নিজের সংসারে মানিয়ে নিয়ে খাওয়াই ভালো।রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো যখন স্বার্থপরতা করে সেটা সহ্য করা অনেক কঠিন।
শেফালীও আমার বোনদের চিনতো।তাই আমাকে বললো,
—আপনি অন্তত আপনার বোনদের বুঝিয়েছেন।আমার কপাল টা দেখেন,
—-আমাকে বুঝানো তো দুরের কথা।ওরা ধরেই নিয়েছে, আমি হচ্ছি ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলা।অনেকে আমাকে বলে,
—-আমি তো স্বেচ্ছায় এই জীবনটা বেছে নিয়েছি।আপু আমার মা অসুস্থ। তার যত্ন নেওয়া,রাশেদ তো তখন ছোটো ছিলো ওকে গড়ে তোলা, আমার বাবারও অনেক কাহিনী ছিলো সেগুলি শেষ করা,সব তো আমাকেই সামাল দিতে হয়েছে।আমার দুর্ভাগ্য আমি এই সংসারের প্রয়োজনের প্রিয়জন হয়েছি কারও আপনজন হয়ে উঠতে পারেনি।
শেফালীর সাথে মাঝে মাঝে আমার ফোনে কথা হয়।মাসদুয়েক পর ও আমাকে ফোন দিয়ে ওর বিয়ের দাওয়াত দেয়।আর আমার সাথে দেখা করতে চায়।কারণ বিয়ের পর বরের সাথে আমেরিকায় চলে যাবে।আমার খু-উব আনন্দ হয়ে ছিলো।সংসারের ব্যস্ততার কারনে ওর বিয়েতে যেতে পারিনি।তবে একদিন সময় বার করে শেফালীর সাথে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে যাই।আসলে আমার ও খুব কৌতূহল ছিলো। তবে জীবনে এটুকু আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহপাক মানুষকে পরীক্ষা করেন।তারপর যতটুকু পরীক্ষা উনি নেন তারথেকে বহুগুন তার জীবনটা ভরিয়ে দেন।
নিদিষ্টদিনে আমি আর শেফালী একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করি।শেফালীকে দেখে আমি সত্যি অবাক হয়ে যাই।ওর সারাশরীরে সুখ আর সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ছে।আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
— কেমন আছেন?
শেফালী আমাকে বললো,
—অনেক ভালো আছি আপু।
আমি ওর বর বিয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলাম।
শেফালী আমাকে বলে,
—আপনি তো জানেন আপু আমি বুটিকসের কাজ করি।অনলাইনে আমার একটা পেইজ আছে।সেখানে এক ভদ্রলোক আমাকে ওনার মায়ের জন্য দুটো শাড়ি অর্ডার করে।আমি শাড়ি দুটো নিজেই ওনার মায়ের বাসায় পৌছে দেই।ওনার মা আমার ডিজাইন করা শাড়ি খুব পছন্দ করে।এবং আমাকেও ওনার খুব পছন্দ হয়।ভদ্রমহিলা আমার বিয়ের ব্যপারে জানতে চান।আমি ওনাকে মজা করে বলি,
—-আমাকে বোঝার মতো পুরুষের জন্মই হয়তো এই
পৃথিবীতে হয়নি তাই হয়তো আমার বিয়ে হয়নি।
উনি ওনার ছেলেকে আমার কথা বলে।
ভদ্রলোকের নাম জামান।ওনারও জীবনটা সুখের ছিলো না।ভালবেসে বিয়ে করে বউ নিয়ে আমেরিকায় চলে যান।বউ ওখানে গিয়ে অন্য মানুষের হাত ধরে চলে যায়।তারপর থেকে কােনো নারীকে উনি ওনার জীবনসঙ্গী হিসাবে বিশ্বাস করতে পারেন না।আমার সাথে পরিচয়ের পর মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো।ওনার সাথে আমার একটা জায়গায় খুব মিল ছিলো।উনি যেমন কোনো নারীকে বিশ্বাস করতে পারেন না তেমনি আমিও কোনো পুরুষকে জীবনসঙ্গী হিসাবে বিশ্বাস করতে পারতাম না।কিন্তু ইদানিং নির্ভর করার মতো সঙ্গীর অভাব অনুভব করতাম।
ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের মতো হবে।ওনার মায়ের পছন্দের কারনে উনি আমাকে প্রথম প্রোপজ করে।উনি আমাকে বলে নিজের পছন্দে বিয়ে করে সুখ পেলাম না। আমি ওনাকে বলি,
—-হয়তো সঠিক মানুষটা আপনার জীবনে আসেনি।
উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করে,
—-আমি কেন বিয়ে করিনি?
আমিও তাকে বলি,
—আমার ভালবাসার মানুষটা হয়তো এখনও আমার খোঁজ পায়নি।
তারপর স্বর্গীয় সুখের সন্ধানে
পোড় খাওয়া দুটো মানুষ বিশ্বাসের বিঁনিসুতায় ভালবাসার মালা গেঁথে একে অপরের সাথে হৃদয়ের বন্ধনে নিজেদের বেঁধে রাখলো।
বিঃদঃ-যারা কষ্ট করে আমার লেখা প্রথম উপন্যাসটার সাথে থেকে আমাকে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করেছেন তাদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন।জানি অনেক ভূল ত্রুটি হয়েছে।সামনে আরও ভালো লেখার চেষ্টা করবো।