গল্পের নাম: কালো মেঘে রোদ্দুর (পর্ব-3)
লেখিকা: আরশিয়া জান্নাত
ভালোবাসা একটা মিষ্টি সুভাষের মতো। যখন এটা জীবনে আসে চারদিকটাই কেমন সুভাষিত হয়ে যায়। তখন দীর্ঘশ্বাস আর ভেতরের জমানো কষ্ট অনুভব করার ফুরসত মেলে না যেন। সেই মানুষটার কথা ভাবতেই মন ফুরফুরে হয়ে যায়।
মোহনার এখন রোজকার ব্যস্ত রুটিনে নতুন করে যোগ হয়েছে সেই মিষ্টি অনুভূতির গল্প। বসের বকা শোনা,কিংবা রাস্তায় ইভটিজিং এর স্বীকার, টাকার সমস্যাসহ হাজারটা টেনশনের মাঝেও স্বস্তির জায়গা সেই অচেনা অজানা মানুষটা। তার কথা মনে হলেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। সে জানেনা এই অনুভূতির আদৌতে কোনো ভ্যালু আছে কি না। চাঁদের দূরত্ব আকাশছোঁয়া হলেও তার আলো মাখার লোভ তো বেঁধে রাখা যায় না। পূর্ণিমার অপার সৌন্দর্য অবলোকন করার সুযোগই বা কে হাতছাড়া করবে? সেই মানুষটাও তার জন্য দূর আকাশের চাঁদের মতো। যাকে দেখে ভালো অনুভব করাটা জ্যোৎস্নাবিলাসের মতোই।
বাস্তবতা সেও জানে,তার চেয়ে বেশি কে জানবে কত কঠিন এর রূপ? বাইশ বছরের মেয়েটা তো আর ছোট্ট খুকি নয়। সে ঠিকই জানে ভাগ্য বরাবরই তার বিপক্ষে।
এখন তার জীবনের একটাই লক্ষ্য কিভাবে এই ফাটা ভাগ্যের সাথে লড়াই করে ছোটবোনটাকে জিইয়ে রাখা যায়। ওর ভালো ট্রিটমেন্ট করিয়ে সুস্থ করার জন্যই তো দিনরাত এক করে খাটছে। ছোটবোনটা যে তার প্রাণভোমরা। তাকে ছাড়া এক মূহূর্তও কল্পনা করার সাধ্যি নেই।
ফুড পান্ডায় একটা মাটন বিরিয়ানি অর্ডার করে টিউশন থেকে বের হলো মোহনা। বাসায় ফেরার পথে পিকাপ পয়েন্ট থেকে নিয়ে যাবে এমনটাই প্ল্যান তার। বাসা মোড় থেকে অনেক দূর বলে ডেলিভারি চার্জ অনেক বেশি আসে। সেই খরচা বাঁচাতেই মূলত এই প্ল্যান। কিন্তু ওর কপালে মানুষের কটু কথা শোনার দারুণ এক এপ আছে। তাই আজ ডেলিভারিম্যান ও কথা শুনিয়ে গেল, যেখানে কাস্টমাররা কথা শোনায়!
সঠিক জিপিএস শো না করার দরুণ পিকাপ পয়েন্ট থেকেও অনেকটা দূর তাকে হেঁটে যেতে হলো। সাথে একগাদা কথাও শুনতে হলো। মোহনার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে হেডঅফিসে কমপ্লেইন দিয়ে দিতো। কিন্তু ছেলেটার চাকরি অযথাই চলে যাবে ভেবে আর কিছু বললো না।
বরং এক্সট্রা বিশ টাকা টিপস দিয়ে বাড়ির দিকে চলে এলো। সুখে তো আর কেউ রাইডার হয় না। মধ্যবিত্তের চাকরি করার ভোগান্তি ও বুঝবে না?
কিন্তু ঘটনাটার ইতি এখানে ঘটেনি,,,,
“আপু তুই মাটন বিরিয়ানি এনেছিস। ওয়েএএএ কত্ত ভালো তুই।”
“খাওয়াইতে পারলে উত্তর বাড়ির জ্যাঠাও ভালা। হুহ মা ধরো তোমার জন্য পুরা বাজার ঘুরে এই সজনে পাতা বের করেছি। এসব সচরাচর পাওয়া যায় নাকি!”
“কত নিছে মুঠ? শহরে এইডাও কিইন্না খাইতে হয়। আর তোর দাদাবাড়িতে এইসব পইড়া থাকে খাওয়াইন্না লোক নাই।”
“দাদাবাড়ির কোনোকিছুই এখন আর আমাগো নাই। সেই গল্প বাদ দাও।”
মোহনার মা হেসে বললেন, আমার মেয়েরা এই দুনিয়ায় কষ্ট করতাছে তো আখিরাতে ঠিকই সুখ পাইবো। এইডাতো ক্ষণিকের জীবন এই জীবনে সুখ পাইলেও লাভ নাই। আসল তো হইছে ঐডা। আমি দোআ করি আল্লাহর কাছে তোরা যেন ঐ দুনিয়ায় রাণী হইয়া থাকোস।
“মা সব দোআ মরার পরের জন্য না রাইখা এই দুনিয়াতেও কিছু রাখো। জীবন ছোডো হইলেও এতো ছোডো না যে এখনই শেষ হইয়া যাইতাছে। বহুত প্যারা খাইতাছি আর ভাল্লাগেনা।”
“উফফ তোমাদের দুঃখের কথা ছাড়বা বিরিয়ানি ঠান্ডা হয়ে যাইতেছে দেখি হা করো।”
পিহু সবাইকে মুখে তুলে খাইয়ে দিলো সাথে নিজেও খেলো। এক প্যাকেট বিরিয়ানিতে তিনজন মানুষের মন পরম তৃপ্তিতে ভরে উঠলো।
।
।
।
মিসেস রেহানা ফোনের স্ক্রিনে একটার পর একটা ছবি দেখেই যাচ্ছেন কিন্তু কাউকেই তার মনে ধরছে না। বড় মেয়ে আইরিনের জন্য পাত্র খুঁজতে খুঁজতে সে মরিয়া। আইরিন বরাবরই বেশ খুঁতখুঁতে এমনিতেই বিয়েশাদীতে একটুও আগ্রহ নেই। তার উপর যদি একটা দোষ বের করতে পারে বৈরাগী হবার সুযোগ লুফে নিতে দু মিনিট সময় নিবেনা। তাই খুব সতর্কতার সাথে তিনি চুজ করার চেষ্টা করছেন।
ইলহাম মায়ের এমন সিরিয়াস মুখ দেখে হাসি আটকে রাখতে পারলো না। সে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে হাসতে বললো, মা তোমায় সিরিয়াস লুকে কোকিলা আন্টির মতো লাগছে।হাহাহাহা
“তোর তো হাসি আসবেই। আমার যত জ্বালা। তোর বোনকে এই পর্যন্ত কয়টা ছেলে দেখিয়েছি কাউকেই তার মনে ধরে না। এর এই দোষ তো ওর ঐ দোষ। কোনো মানুষ কি 100% পারফেক্ট হয়? কিন্তু না নবাবজাদী নাক তুলবেই!”
“শোনো মা তোমাদের একটা মিস্টেক আছে এখানে। তুমি নিজের মতো করে এতোদিন ছেলে না দেখে আপুকে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল ওর পছন্দের কেউ আছে কি না। কেউ যদি থেকে থাকে ছেলে যদি ভালো হয় আমাদের তো আপত্তি থাকার কথা না।”
“তুই বলতে চাইছিস আইরিন প্রেম করে?”
“এখন এটা অস্বাভাবিক না মা। তুমি জিজ্ঞাসা করে দেখো। তবে নেগেটিভলি নিও না।বিষয়টা পজিটিভলি নাও।”
“আমার মেয়ে প্রেম করছে জেনেও আমি পজিটিভলি নিবো? আবার তুই বলছিস ওকে আমি জিজ্ঞাসা করবো! এই দূর্দিন এলো আমার? গর্ভধারিণী মা হিসেবে ছেলেমেয়ের জন্য জীবনসঙ্গী চুজ করার একটুও অধিকার আমার নেই?”
“আহা মা এভাবে ভাবছো কেন?”
“তোহ কিভাবে ভাববো?”
“দেখো তুমি যদি এমন ভাবনাতেই থাকো তবে আমি লিখে দিচ্ছি আপু আজীবন সন্ন্যাসী থাকবে। আর তোমার জন্য আমাদেরো বিয়ে হবেনা।”
রেহানা মুখ ভার করে চিন্তায় পড়ে গেলেন।
রাইয়্যান বাসায় ফিরতেই তার ছোট বোন ইসরাত এসে বললো, ভাইয়া বাসায় তো কোল্ড ওয়্যার শুরু হয়ে গেছে। জলদি ফ্রেশ হয়ে এসো মা সবাইকে স্টাডিতে ডেকেছেন।
“কেন কি হয়েছে?”
“ছোট ভাইয়া নাকি ইঙ্গিত দিয়েছে বড় আপুর রিলেশন আছে। সেজন্য মা ক্ষেপেছেন।”
“ইলহাম পারেও বটে। আমার জন্য এক গ্লাস পানি দিয়ে যা।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
আজাদ সাহেব তার স্ত্রীর ন্যাকা কান্না দেখে দেখে অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। তাকে কোনভাবেই বোঝানো গেল না সংসারটা যারা করবে তারাই মুখ্য, এখানে অন্য কারোর পছন্দ অপছন্দের ভূমিকা তেমন নেই।
রেহানার ঘুরেই এক কথা তবে আমরা আছি কিজন্য? আমাদের কোনো অধিকার নেই?
সবমিলিয়ে শীতলকুঠিতে আজ অশীতল তান্ডব।
।
।
।
“আস্সালামু আলাইকুম। আপনি কি আমায় চিনতে পেরেছেন?”
হোয়াটসএপে আনসেইভ নাম্বারের দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো মোহনা। কললিস্ট চেক করে সিওর হলো এটা গতকালকের ডেলিভারিম্যানের নাম্বার। হঠাৎ নক করলো কিজন্য?
“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। জ্বি চিনতে না পারার কি আছে গতকালই তো পার্সেল দিয়ে গেলেন”
“আসলে আমি একটা কথা বলতে আপনাকে নক করেছি। যদিও কোনো কাস্টমারের কনট্যাক্ট রাখা রুলসের এগেইনস্ট। কিন্তু আপনাকে বিষয়টি না বলে শান্তি পাচ্ছিলাম না। প্লিজ আপনি আবার কমপ্লেইন করে বসবেন না। আমি কথাটা বলেই নাম্বার ডিলেট করে দিবো।”
“কি কথা বলেন?”
“আপনি কি আমার বিহেভিয়ারে মনে কষ্ট পেয়েছিলেন? আসলে গতকাল আপনার পার্সেলটা দিতে গিয়ে আমি খুব বিড়ম্বনায় পড়ে গিয়েছিলাম। আপনার জিপিএস শো করছিল এক জায়গায় আর আপনার লোকেশন ছিল আরেক জায়গায়। কোম্পানি জিপিএস অনুযায়ী চার্জ ধরে তাই আর কি,,,,”
“না সমস্যা নেই ইটস ওকে।”
“না সমস্যা তো আছেই। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে খুব রুড বিহেভ করতো কিংবা কমপ্লেইন করতো। কিন্তু আপনি তার কোনোটাই করেননি বরং এক্সট্রা টিপস দিয়েছেন আর খুব সফটলি কথা বলেছেন। এটা আসলে আমার জন্য খুবই আনএক্সপেক্টেড ঘটনা। আর মেইন কথা হলো আপনার ডেলিভারি দিয়ে আসার পথে আমার ছোটখাটো এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমার কেন জানি মনে হলো এটা আপনার সাথে রুড বিহেভিয়ারের ফলে হয়েছে। সেজন্যই আসলে আপনাকে নক করা। আমি খুব দুঃখিত আমার আরো বেশি ধৈর্যশীল হবার দরকার ছিল।”
মোহনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার আসলেই তখন অনেক মনে কষ্ট লেগেছিল। অতখানি পথ হেটে যাওয়া প্লাস ফোনে লোকটার মেজাজ দেখিয়ে কথা বলাটা আসলেই তখন গায়ে লেগেছিল। তবে কি সত্যিই অপ্রত্যাশিতভাবে অভিশাপ লেগে গেছে! কিন্তু সে তো অভিশাপ দেয় নি।
“আপনার বেশি ক্ষতি হয়েছে? দেখুন সত্যি বলতে তখন রাগ হয়েছিল কিন্তু অভিশাপ দেইনি। আর কমপ্লেইন করিনি কারণ আমি জানি শখের বশে কেউ রাইড করেনা।”
“না বিশেষ ক্ষতি হয়নি শুধু আমার বাইকটা ইনজুরড হয়েছে। যাই হোক অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আর কখনো যদি আপনার পার্সেল ডেলিভারির সুযোগ হয় দেখা হবে,,,,”
“হুম”
“আচ্ছা আমি কি আপনার কনট্যাক্ট টা রাখতে পারি?”
মোহনা আর রিপ্লাই করলো না। ততক্ষণে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল অনাকাঙিক্ষতভাবে। ওদিকে ছেলেটা রিপ্লাইয়ের আশায় তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনে,,,,,,
চলবে,,,,