সুরমা খপ করে শাদাবকে জড়িয়ে ধরলো। বজ্রপাতে সে মোটেও ভয় পায় না। কিন্তু কেন যেন এই অজুহাতে শাদাবকে একবার জড়িয়ে ধরার লোভ সে সামলাতে পারলো না। বৃষ্টির ছাঁটে সে পুরোপুরি ভিজে গেছে। ঠান্ডায় রীতিমতো সে কাঁপছে।
শাদাব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বজ্রপাতের ধ্বনি কমে আসতেই শাদাব কঠিন গলায় বলল,
–এবার ছাড়ো। বজ্রপাত থেমে গেছে।
সুরমার হঠাৎ ভীষণ কান্না পেলো। শাদাবের “এবার ছাড়ো” শব্দ দুটো বিষম আঘাত করলো তার বুকে। শাদাব তার সাথে এমন করছে কেন? শাদাব কি এভাবেই তাকে শাস্তি দেবে?
সুরমার কোনো হেলদোল না দেখে শাদাব আবার বলে উঠলো,
–কি হলো? ছাড়ো। এতক্ষণ আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলে তোমার প্রেমিক রাগ করবে না?
সুরমা এবার তাকে ছেড়ে দিলো। বেছে বেছে সবচেয়ে দূর্বল জায়গাতেই শাদাব তাকে খোঁচা মেরেছে। সুরমা খানিক দূরে সরে গিয়ে বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়ালো। শাদাব কি তাকে ক্ষমা করবে না কখনো? সে তো নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে। কেউ যদি অনুতপ্ত হয়, তবে কি তাকে ক্ষমা করে দিয়ে কাছে টেনে নেওয়া যায় না?
শাদাব বারান্দা থেকে ঘরে চলে গেল। ভিজে যাওয়া পাঞ্জাবি বদলে একটা টি শার্ট গায়ে দিলো। তারপর কাঁথা গায়ে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। সুরমা মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠলো। শাদাব একটা বারও তাকে ঘরে আসতে বলল না! সে যে বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে গিয়েছে, তাও তো শাদাব দেখলো। তবুও তো ভেজা কাপড়টা বদলে নিতে বলল না একবারও। কই? আগের মতো করে মাথা মুছে দিলো না তো! শাদাবের এই উদাসীনতা সুরমাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে। নিদারুণ অভিমানে চোখ ফেটে জল পরছে। আচ্ছা? সেও কি এতটা যন্ত্রণাই শাদাবকে দিয়েছিল?
সুরমা চোখ মুছলো। ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে বারান্দার দরজা আটকে দিলো। শাদাবের পাশে শুয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার মুখের দিকে। শাদাব চোখ বন্ধ করে ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলছে। কয়েকদিন পরে তার আর শাদাবের ডিভোর্স হয়ে যাবে। তবুও কি একটুও কষ্ট শাদাবের হচ্ছে না? অবশ্য হবেই বা কেন? সে তো শাদাবকে শুধু অবহেলাই করেছে এতদিন। তার ধারণা ছিল শাদাবকে সে কখনো ভালোবাসে নি। তবুও ডিভোর্সের কথা শোনার পর থেকেই তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে নিজেকে সামলাতে পারছে না কিছুতেই। অথচ শাদাব নির্লিপ্ত। আর এই নির্লিপ্ততাই পুড়িয়ে ছাই করে ফেলছে সুরমাকে। হঠাৎ সুরমার মাথায় যেন ভূত চাপলো। সে শাদাবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। শাদাবের চোখেমুখে অজস্র চুমু খেয়ে তার বুকে আদুরে বিড়ালের মতো লুকিয়ে পরলো সুরমা। ঘটনার আকস্মিকতায় শাদাব হতভম্ব হয়ে গেল। হকচকিয়ে চোখ মেলে তাকালো। ততক্ষণে সুরমা তার বুকে নিঃশ্বাস ফেলছে। শাদাব চাপা গলায় বলল,
–সুরমা, সরে যাও।
সুরমা ফিসফিস করে বলল,
–বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে বলে আমার ভীষণ ঠান্ডা লাগছে।
–কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে পরো। আমি তোমাকে আরেকটা কাঁথা দিচ্ছি।
সুরমা এক বিন্দু নড়লো না। আরও বেশি করে কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,
–আমার কাঁথার দরকার নেই। আপনি কাছে থাকলেই হবে।
বলেই শাদাবের বুকে চুমু বসিয়ে দিলো সুরমা। শাদাব নিজের অজান্তেই আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। সুরমার তপ্ত নিঃশ্বাস পরছে তার বুকে। তার ভেতরটা উথালপাতাল করছে। স্ত্রীর আকণ্ঠ আদরে ডুবে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা তাকে গ্রাস করে ফেলছে। মেয়েটা যদি তাকে না ছাড়ে তাহলে হয়তো সত্যিই সে আর নিজেকে সামলাতে পারবে না। শাদাবের শরীরে কাঁপন ধরেছে। সে কাঁপা গলায় প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল,
–সুরমা, আমার থেকে দূরে যাও।
সুরমা ফিসফিস করে বলল,
–না, যাব না। প্লিজ আমাকে দূরে সরিয়ে দেবেন না। আমাকে আরও কাছে টেনে নিন।
শাদাব শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। তার অন্তরের বাঁধ ভেঙে গেল। সুরমাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো সে। দুজনের কারোরই আর জগৎ সংসারের হুঁশ রইলো না। বাইরে বৃষ্টি বাড়ছে। আর ভেতরে দুজন মানব মানবী তীব্র প্রণয়ের আহ্বানে পরস্পরের মাঝে ডুবে যাচ্ছে। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারলো না। হঠাৎ তীব্র বজ্রপাতের শব্দে শাদাবের হুঁশ ফিরলো। এক ঝটকায় সুরমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সে উঠে বসলো। সুরমা তার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–কাছে আসুন।
এই আকুল আহ্বানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো শাদাব। সে সুরমার কাছে আর গেল না। সুরমা ব্যথিত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলো। শাদাব জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে সে খুলে ফেলা টি শার্ট আবার গায়ে চড়িয়ে নিলো। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে টেবিলে বসলো। বড় করে শ্বাস নিয়ে পরিষ্কার গলায় বলল,
–ডিভোর্স লেটার দু একদিনের মধ্যেই চলে আসবে। আজ সন্ধ্যায়ই উকিলের সাথে কথা বলেছি আমি। তুমি চাইলে কালই চলে যেতে পারো। আমি ডিভোর্স লেটার নিজ দায়িত্বে পাঠিয়ে দেবো।
সুরমার বুকে কথাগুলো বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধলো। সে শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে উঠে বসলো। শাদাবের দিকে দৃষ্টি রেখেই ব্যথিত গলায় প্রশ্ন করলো,
–আপনি তার মানে সত্যিই আমাকে ডিভোর্স দেবেন?
শাদাব স্বাভাবিক গলায় বলল,
–কেন? তুমিই তো চেয়েছিলে। এতে তোমারই লাভ। যাকে ভালোবাসো না, তার সাথে আজীবন সংসার করবে কি করে? তুমিও পারবে না, আর আমিও না। আজীবন শুধু দায়িত্ব আর শরীরের সংসার আমি চাই না।
সুরমা এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। শাদাবকে সে কিছুতেই বুঝাতে পারছে না। শাদাব বিরক্ত গলায় বলল,
–অযথা কাঁদবে না। যাকে ভালোবাসো তার কাছে ফিরে যেয়ো। কাউকে বন্দি করে রাখায় আমি বিশ্বাস করি না।
কথা শেষ করে শাদাব উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার খিলে হাত দেওয়ার আগেই সুরমা ছুটে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো। আতঙ্কিত মুখে প্রশ্ন করলো,
–আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
–আমি যেখানেই যাই না কেন, তোমার জানার কোনো প্রয়োজন নেই। সরে দাঁড়াও।
সুরমা জোরের সঙ্গে বলল,
–আমার প্রয়োজন আছে। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে এত রাতে আপনি কোথায় যাবেন তা জানার প্রয়োজন আমার আছে।
শাদাব অত্যন্ত কর্কশভাবে বলল,
–তোমাকে বলতে কি আমি বাধ্য, সুরমা? কে তুমি? হু আর ইউ?
সুরমা এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো। তার চোখ ছলছল করছে। সে কাতর গলায় বলল,
–শাদাব! আমি আপনার স্ত্রী।
শাদাব মলিন হাসলো। বিদ্রূপ করে বলল,
–স্ত্রী শব্দটা তোমার কাছে খুব খেলো, খুব সস্তা। তাই না, সুরমা?
প্রশ্নটা করেই শাদাব হালকা ধাক্কা দিয়ে সুরমাকে সরিয়ে দিলো। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সুরমা থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর মেঝেতে আছড়ে পরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কি করবে সে এখন? কি করে নিজের সংসারটাকে বাঁচাবে?
_____________________
ঝমঝম বর্ষণের মধ্যেই মধ্যরাতে বাড়ির চিলেকোঠার ঘরটায় উপস্থিত হলো কঙ্কা। ছাদের দরজা থেকে চিলেকোঠা পর্যন্ত আসতেই সে পুরোপুরি ভিজে গেছে। হেমন্তের ঠান্ডা বৃষ্টিতে সে মৃদু কাঁপছে। ঘরে আলো জ্বলছে। নীলয় নিশ্চয়ই কোনো নতুন কবিতা লিখতে বসেছে আজ। কঙ্কা বিরক্ত হলো। একটা মানুষ কি করে দিনরাত কবিতা লেখে কে জানে! কঙ্কা দরজায় টোকা দিলো। মৃদু গলায় বলল,
–নীলয় ভাই, দরজা খুলুন।
নীলয় একটা নতুন কবিতা লিখতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই মনমতো সাজিয়ে উঠতে পারছিল না। কঙ্কার গলা শুনে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এই চিলেকোঠার ঘরটায় নীলয় বহুদিন ধরে বাস করছে। কঙ্কার বাবা, কলিমউদ্দিন সাহেব, দশ বছর বয়সের নীলয়কে আশ্রয় দিয়েছিলেন এই বাড়িতে। সেই থেকেই নিশ্চিন্তে এখানে আছে নীলয়। আশ্রিত বলে সবসময়ই নিজেকে কিছুটা সংকুচিত করে রাখে নীলয়। যদিও এ বাড়ির লোকজন তাকে কখনো আশ্রিত বলে খোঁটা দেয় নি। তবে কঙ্কা মেয়েটা বড় বাঁধভাঙা।
নীলয় চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজা খুললো। জিজ্ঞেস করলো,
–কিরে? এত রাতে তুই এখানে?
কঙ্কা নীলয়কে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলো। নীলয়ের বিছানায় পা তুলে বসে বলল,
–এত রাতে জেগে আছেন কেন? নতুন কবিতা লিখছেন নাকি?
নীলয় আলনা থেকে তোয়ালে নিয়ে কঙ্কার দিকে এগিয়ে দিলো। তারপর চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
–হ্যাঁ, লিখছি। শুনবি নাকি?
কঙ্কা হাত নাড়িয়ে বলল,
–মাফ করুন, নীলয় ভাই। ওসব ছাঁইপাশ আমি শুনতে চাই না। আমার অনেক বেশি জরুরি কথা আছে।
নীলয় কঙ্কার দিকে তাকালো। ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
–জরুরি কথা? আমার সাথে?
–জ্বি, আপনার সাথে। কথাটা হলো, আমি আগামীকাল পালিয়ে যাব।
অতি সহজে বলে ফেলা এই কথাটা নীলয় বুঝতে পারলো না। প্রশ্ন করলো,
–পালিয়ে যাবি মানে?
কঙ্কা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বলল,
–পালিয়ে যাব মানে পালিয়ে যাব। বাবা আমার বিয়ে ঠিক করছে। কিন্তু আমি বিয়ে করবো আমার প্রেমিককে। সেজন্যই পালাবো।
নীলয় আঁতকে উঠে বলল,
–তুই ওই লম্পটটার সাথে পালাবি? ওকে বিয়ে করবি?
কঙ্কা হেসে ফেলে বলল,
–হ্যাঁ, ওই লম্পটটাকেই বিয়ে করবো।
নীলয় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কঙ্কার মুখোমুখি বসে বলল,
–কঙ্কা, এত বড় ভুলটা তুই করিস না। চাচা খুবই কষ্ট পাবেন। আর আবির ছেলেটাও তো ভালো নয়। ওকে বিয়ে করলে তোর জীবনটা নষ্ট হবে। চাচা তোকে খুব ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন, কঙ্কা।
কঙ্কা হেসে উঠলো। নীলয় ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কঙ্কাকে সে বুঝে উঠতে পারে না। আবির যে একটা চরিত্রহীন ছেলে সেটা কঙ্কার অজানা নয়। অগণিত মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক। কত মেয়েকে নিয়ে হোটেলের রুমে গেছে তারও কোনো ইয়ত্তা নেই। সবকিছু জেনেও কঙ্কা এই ছেলেটার সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে গেছে। আবার এখন বিয়েও করতে চাইছে। কেন নিজের সর্বনাশ নিজে করছে মেয়েটা? মাঝে মাঝে নীলয়ের মনে হয়, সে কঙ্কাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল বলেই হয়তো কঙ্কা অভিমানে নিজের জীবন নষ্ট করছে। পরক্ষণেই আবার মনে হয়, আরেহ না!
কঙ্কা হাসি থামিয়ে বলল,
–নীলয় ভাই, আবির আগে চরিত্রহীন ছিল। এখন ও শুধরে গেছে। ও আমাকে সত্যিই ভালোবাসে। এমন ভালোবাসা আর যত্ন খুব কম মেয়েই পায়।
নীলয় মাথা নাড়িয়ে বলল,
–তুই ভুল করছিস, কঙ্কা। আবির তোকে ভালোবাসে না। ও তোকে অন্য মেয়েদের মতো আজ অব্দি বিছানায় নিয়ে যেতে পারে নি। তাই তোর সাথে বিয়ে বিয়ে খেলা খেলতে চাইছে। দেখবি কিছুদিন পরেই ওর সব ভালোবাসা উবে গেছে। তোকে আর তখন ভালো লাগবে না ওর। আর তাছাড়া তোর বাবার অনেক টাকা। ও জানে যে পালিয়ে যাওয়ার সময় তুই অনেক টাকাপয়সা সাথে নিয়ে যাবি।
কঙ্কা হাসতে হাসতে বলল,
– আমার আর আবিরের সম্পর্কটা একেবারে পার্ফেক্ট, নীলয় ভাই।
নীলয় মৃদু হেসে বলল,
–পৃথিবীতে কোনো কিছুই পারফেক্ট হয় না,কঙ্কা।সবকিছুর ভেতরেই কিছু না কিছু খুঁত থাকাটাই নিয়ম।প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্কও এ নিয়মের বাইরে নয়।যদি কোনো প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ককে একেবারে পারফেক্ট বলে মনে হয়,তাহলে বুঝতে হবে দুজনের যেকোনো একজনের ভেতরে সমস্যা আছে।
কঙ্কা অত্যন্ত বিরক্ত হলো।ভুরু কুঁচকে বলল,
–আপনার এসব ফিলোসফি ধরণের কথাবার্তা আমার পছন্দ নয়,নীলয় ভাই।
নীলয় হেসে উঠলো।কঙ্কা এবার বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলল,
–হাসি বন্ধ করুন।আপনার হাসিও আমার পছন্দ নয়।
নীলয় হাসি বন্ধ করলো না।সে হাসতেই হাসতেই বলল,
–আমার কোনো কিছুই তোর পছন্দ নয়।ঠিক না?
কঙ্কা কঠিন গলায় বলল,
–হ্যাঁ,ঠিক।আপনাকে আমি একদম পছন্দ করি না।কবি ধরণের মানুষ আমার অসহ্য লাগে।
নীলয় আরও একদফা হেসে নিয়ে বলল,
–সম্পর্ক যখন এতই পার্ফেক্ট, তাহলে পালাচ্ছিস কেন? চাচাকে আবিরের কথা জানিয়ে দে। তারপর পারিবারিকভাবে বিয়েটা কর।
–পাগল? আবিরকে বাবা মেনে নেবেন? কখনো না।
–কেন নেবেন না? তুই চাচাকে বুঝিয়ে বলবি যে আবির তোকে ভীষণ ভালোবাসে।
–ভালোবাসাটা তো বাবা দেখবেন না। বাবা যখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারবেন যে ওর আরও অনেক সম্পর্ক ছিল, তখনই তো রাজি হবেন না।
–তুই কেন রাজি হচ্ছিস?
–কারণ আমি জানি যে আবির বদলে গেছে।
–মানুষের চরিত্র এত সহজে বদলায় না, কঙ্কা। আর আমি খুব ভালো করেই জানি যে তুই আবিরকে ভালোবাসিস না। তুই জেনেশুনে এরকম একটা ছেলেকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়েছিস। আর সবটাই তুই করেছিস আমার উপরে অভিমান করে। তাই না?
কঙ্কা প্রথমে চমকে উঠলো। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলল,
–হ্যাঁ, তাই। এখন আপনি কি করবেন? আবিরের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমাকে বিয়ে করবেন?
নীলয় থতমত খেয়ে গেল। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কঙ্কার দিকে। তারপর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–কঙ্কা, তুই কেন বুঝতে চাস না? তোকে অধিকার করার যোগ্যতা আমার নেই। আমি এক ছন্নছাড়া কবি। আমার বই পর্যন্ত কেউ ছাপতে চায় না। বড়লোকের রাজকন্যাকে আমি রাখবো কোথায়? চাচা তোর জন্য অনেক ভালো ছেলে খুঁজে আনবেন।
কঙ্কা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল,
–আপনার সত্যিই মনে হয় যে আপনার প্রতি এখনো আমার অনুভূতি আছে?
কঙ্কার বিদ্রুপে নীলয়ের মুখ কালিবর্ণ হয়ে গেল। তার মনে হতে লাগলো বিষম অপমানে যেন তার মাথাটা কাটা পরেছে। কঙ্কা এখনো মৃদু মৃদু হাসছে, বিদ্রুপের হাসি। মুখে হাসি রেখেই সে বলল,
–আপনার প্রতি আমার যে অনুভূতি ছিল সেসবই কিশোরী বয়সের আবেগ। এখন আর সেসব নেই। আমি আবিরকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি। ও আমাকে কখনো আপনার মতো অবহেলা করে নি। ও আমার প্রতি খেয়াল রাখে, আমার সব ছোট ছোট বিষয়ে কেয়ার করে।
নীলয় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
–সবটাই লোক দেখানো, কঙ্কা। মন থেকে নয়।
–উফ, নীলয় ভাই! আপনি থামুন তো। আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না আপনাকে। আমি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আর আবির যেই লাল নীল সংসার পাতার পরিকল্পনা করেছি তা আমি সফল করবোই।
নীলয়ের বলতে ইচ্ছে করলো, লাল নীল সংসার হাতের মোয়া নয়। প্রেমিককে বিয়ে করলেই যে তা পাওয়া যাবে, এমনটাও নয়। কিন্তু নীলয় এসব বলল না। স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো,
–তোর পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তবে ফাইনাল?
–হ্যাঁ, ফাইনাল।
নীলয় এবার কিঞ্চিৎ রাগী গলায় বলল,
–যা খুশি কর। আমাকে কেন বলতে এসেছিস? তোর কি ধারণা আমি তোকে সাহায্য করবো? শোন, কঙ্কা। আমাকে চাচা ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছেন। ওই মানুষটা আমার কাছে ফেরেশতা। আমি বেইমানি করতে পারবো না।
কঙ্কা হেসে বলল,
–আপনার সাহায্য আমার লাগবে না। আমি শুধু আপনাকে একটা দায়িত্ব দিতে এসেছি।
নীলয় ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ঠান্ডা গলায় বলল,
–কিসের দায়িত্ব?
–বাবার হাই ব্লাড প্রেশার। আবার শুগারও আছে। উনার একমাত্র কন্যা যখন টাকাপয়সা আর গয়নাগাটি নিয়ে পালাবে, তখন উনি নির্ঘাত স্ট্রোক করবেন। আপনার দায়িত্ব হলো আগে থেকেই একটা অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে রাখা এবং বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। আর হ্যাঁ, মাকেও সামলে রাখবেন।
নীলয় হতভম্ব হয়ে কঙ্কার দিকে তাকিয়ে রইলো। এসব কি বলছে মেয়েটা? নিজের বাবার অসুস্থতার আশঙ্কার কথা এত সহজ গলায় বলছে কি করে? কঙ্কা উঠে দাঁড়ালো। হাই তুলে বলল,
–আমি এখন আসি, নীলয় ভাই। কাল অনেক কাজ। আজ ভালো করে ঘুম দরকার।
কঙ্কা চলে গেল। নীলয় কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলো। কঙ্কা জাহান্নামে যাক। সে আর এই বেপরোয়া মেয়েটার কথা ভাববে না। কিন্তু দুঃখের কথা হলো, তার নতুন কবিতাটা আজ আর লেখা হলো না।
.
#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#সূচনা_পর্ব