#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:৩
.
.
.
শাদাবকে খাবার বেড়ে দিয়ে সামনের চেয়ারে বসলেন সাবিনা বানু। শাদাব ডাল দিয়ে মেখে অল্প অল্প করে ভাত মুখে দিচ্ছে। সাবিনা তৃপ্তি নিয়ে ছেলেকে দেখছেন। শাদাবের বাবাও এভাবে অল্প অল্প করে ভাত মুখে দিতেন। ছেলের স্বভাবে তার বাবার স্পষ্ট ছাপ খুঁজে পান সাবিনা। খেতে খেতে শাদাব প্রশ্ন করলো,
–তোমার খাওয়া হয়েছে, মা?
সাবিনা গ্লাসে পানি ঢেলে দিতে দিতে বললেন,
–অনেকক্ষণ আগেই হয়ে গেছে। বৌমা আমাকে এতক্ষণ না খেয়ে থাকতে দেবে নাকি?
শাদাব হেসে বলল,
–তা তো দেবেই না। ও ভীষণ দায়িত্ববান মেয়ে কিনা! ওর মতো দায়িত্বশীল আর একজনকে তুমি পাবে না, মা। দায়িত্বের বাইরে ও আর কিছুই করে না।
কথাটা শেষ করতেই শাদাবের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সাবিনা ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ছেলের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলেন,
–শাদাব, তোদের মধ্যে কি হয়েছে বল তো? তোর আচরণ কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।
শাদাব খেতে খেতেই জবাব দিলো,
–কিছুই তো হয় নি, মা।
–তাহলে তুই আজ একাই খেতে বসে গেলি কেন? বৌমাকে সাথে নিয়ে বসলি না যে?
–সবসময় একই কাজ করতে তো মানুষের ভালো লাগে না, মা।
সাবিনা কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে বললেন,
–শাদাব, বৌমা তোকে ডাকতে গেল একসাথে খাবে বলে। অথচ তুই ঘর থেকে একাই বেরিয়ে এলি খেতে। সুরমা এখনো খেতে এলো না। কেন বল তো? আর কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে মেয়েটা?
শাদাবের খাওয়া বন্ধ হলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে সে জানতে চাইলো,
–সুরমা এখনো খায় নি?
–না, খায় নি। সকাল থেকেই ও না খেয়ে আছে।
শাদাব আহত হলো। ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–আচ্ছা, দাঁড়াও। আমি ওকে ডেকে আনছি।
সাবিনা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
–থাক। তোকে আর যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি।
কথা শেষ করে উনি ছেলের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। শাদাব চিন্তিত মুখে বসে রইলো। সুরমা আসলে চায়টা কি? ওর খুশির জন্যই তো শাদাব এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে এখন এরকম আচরণের মানে কি?
সাবিনা ঘরে ঢুকে দেখলেন সুরমা বিছানায় বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। সুরমার কান্না দেখে উনার মাতৃহৃদয়ে চিন্তার মেঘ ঘনীভূত হলো। মনে মনে পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করলেন, “হে আল্লাহ! সব যেন ঠিকঠাক থাকে।” উনি পুত্রবধূর কাছে এগিয়ে গেলেন। সুরমার মাথায় হাত রেখে মৃদু গলায় ডাকলেন,
–বৌমা!
সুরমা তাড়াহুড়ো করে চোখমুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। হাসার চেষ্টা করে বলল,
–হ্যাঁ, মা। বলুন।
সাবিনা একপলক তাকিয়ে থাকলেন সুরমার মুখের দিকে। তারপর ইশারা করে বললেন,
–বসো।
সুরমা বসলো। সাবিনা পাশে বসলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন,
–একটু পরে তো তোমার খালার বাড়িতে যেতে হবে। ব্যাগ গোছানো হয়েছে?
–হ্যাঁ, মা।
–শাদাবের ব্যাগ গুছিয়েছ?
সুরমা মলিন মুখে বলল,
–গুছিয়েছি। কিন্তু ও বলেছে ও ওখানে থাকবে না। আমাকে পৌঁছে দিয়েই চলে আসবে।
–আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি ওকে বলবো যেন ও তোমার সাথে দুটো দিন ওখানে থেকে তবেই ফিরে আসে।
সুরমা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,
–না, মা। ওকে জোর করবেন না। আপনি এ বিষয়ে ওকে কিছু বললে ও আমার উপরে রাগ করতে পারে।
–আচ্ছা, বেশ। আমি কিছু বলবো না। তুমি খেতে চলো এখন।
–ক্ষিদে লাগে নি, মা।
সাবিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শীতল গলায় বললেন,
–বৌমা, তোমাদের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে?
সুরমা মাথা নিচু করে বলল,
–না তো, মা।
সাবিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর স্নেহার্দ্র স্বরে বললেন,
–শোনো মা, তোমাকে কয়েকটা কথা বলি। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক একেবারে অন্যরকম। অন্যসব সম্পর্কের মতো এইটা না। ঝগড়া হবে, মান অভিমান হবে, কিন্তু সবকিছুই কাটিয়ে উঠতে হবে। আর সেজন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজেদের মধ্যেকার বোঝাপড়া। একজন আরেকজনের অনুভূতি বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। একে অপরের অনুভূতিকে সম্মান করতে হবে। হ্যাঁ, সেটা খুব একটা সহজ না। কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টা করলে সেটা অসম্ভবও না। সারাজীবন সুখেদুঃখে একসাথে চলার প্রতিজ্ঞা দিয়ে যে সম্পর্ক শুরু হয়, সে সম্পর্ক এত ঠুনকো না। এই সম্পর্কের দায়ও অনেকটা ভারী বটে। কিন্তু সেই ভারটা কখন সহজ হবে জানো? যখন ভালোবাসা থাকবে। শুধু দায়িত্ব আর সম্মান দিয়ে যেমন সারাজীবন থাকা যায় না, তেমনি শুধু ভালোবাসা দিয়েও সারাজীবন কাটানো যায় না। সবকিছুর সমন্বয় লাগে। এই সম্পর্কের গভীরতা অনেক, মা। সবার আগে সেটা বুঝতে হবে। যখন তোমরা একজন আরেকজনকে বুঝতে চেষ্টা করবে, মানুষটার ভেতরটা জানার চেষ্টা করবে, তখন দেখবে ভালোবাসা, বিশ্বাস, সব আপনা থেকেই চলে আসবে। মাঝেমধ্যে এটাও মনে হবে যে এই মানুষটার সাথে একসাথে থাকা যায় না। কিন্তু দেখবে, দূরে গেলেই এই সাময়িক রাগের অর্থহীনতা বোঝা যায়। তখন আরও বেশি করে কাছে থাকতে ইচ্ছা করে। রাগ, অভিমান, যাই হোক না কেন, সবই সাময়িক। হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে চলে না। প্রচেষ্টা করে যেতে হয়। বুঝলা, মা?
সুরমা মুগ্ধ হয়ে তার শাশুড়ি মায়ের কথা শুনছিল এতক্ষণ। এবার মাথা নিচু করে বলল,
–আমার বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেল, মা। অনেক দেরি। এখন এর কি যে প্রতিকার হবে, কিছুই যে বুঝতে পারছি না!
সাবিনা মৃদু হেসে বললেন,
–দেখো মা, আমি তোমাদের ব্যাপারে ঢুকবো না। নিজেদের সমস্যা তোমাদের নিজেদেরই সমাধান করতে হবে।
সুরমা এবার কেঁদে উঠে বলল,
–মা, আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। শুধু ভুল নয়, আপনার ছেলের সাথে অন্যায় করেছি আমি। ও আর আমাকে এখন বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি ওকে বোঝাতেও পারছি না। কি করলে সমাধান হবে আমি বুঝে উঠতে পারছি না।
–সমাধান হবে। ভুল সংশোধন করো। ওরে বুঝাও যে তুমি মন থেকে তোমার ভুল শুধরে নিতে চাও। নিজের মনের কথাগুলো ওকে বোঝানোর চেষ্টা করো। ভুল যখন করেই ফেলেছ, তখন সেটা শুধরে নেওয়ার চেষ্টাও তোমাকে করতে হবে।
–আমি আপনার কথা বুঝতে পেরেছি, মা।
সাবিনা হেসে বললেন,
–এখন চোখ মুছে ফেলো। আর খেতে চলো।
সুরমা চোখমুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। তারপর মায়ের সাথে খাওয়ার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
___________________
নীলয়ের উপরে বাজার করার দায়িত্ব পরেছিল আজ। বাড়িতে মেয়ে জামাই আসবে, আবার কাল আরেক মেয়েকে দেখতে পাত্রপক্ষও আসবে। সব মিলিয়ে অনেক বাজার-সদাই করতে হয়েছে আজকে। বিকালবেলা বাজারে ভালো জিনিস পাওয়া যায় না। ভালো মাছ আর সবজি পেতে চাইলে সকাল সকাল বাজারে যেতে হয়। কিন্তু আজ সকালে নীলয় একজন প্রকাশকের অফিসে গিয়েছিল বলে বাজারে যেতে পারে নি। যদিও সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রকাশকের অফিসে বসে থাকার ফলাফল শূন্য।
বাজারের ব্যাগগুলো নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই শাদাব আর সুরমাকে বসে থাকতে দেখলো সে। কঙ্কা তাদেরকে চা নাস্তা এগিয়ে দিচ্ছিলো। নীলয় এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে বলল,
–আসসালামু আলাইকুম, দুলাভাই।
শাদাব মুখ তুলে তাকালো। হেসে বলল,
–ওয়া আলাইকুম সালাম। শালাবাবুর খবর কি? আছ কেমন?
–ভালো আছি, দুলাভাই। খবর ভালো।
কঙ্কা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–নীলয় ভাই, ব্যাগগুলো আমাকে দিন। আমি রান্নাঘরে রেখে আসছি।
নীলয় ব্যাগগুলো এগিয়ে দিলো। কঙ্কা সেগুলো নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। নীলয় সোফায় বসতে বসতে সুরমার উদ্দেশ্যে বলল,
–আপা, তুমি ভালো আছ?
–আছি, ভাই। ভালো আছি। তোর কবিতার খবর কি?
নীলয় হেসে বলল,
–কোনো খবর এখনো নেই। হবে ইনশাআল্লাহ।
সুরমা হাসলো। বলল,
–সত্যি, নীলয়! সেই স্কুলজীবন থেকে কবিতার পিছনে ছুটছিস। এখনো কবি হওয়ার ভূত মাথা থেকে নামলো না তোর।
নীলয় অপ্রতিভ হেসে উঠে দাঁড়ালো। বলল,
–আমি যাই, আপা। বাজার থেকে এসেছি তো। জামাকাপড় বদলে নিই। দুলাভাই, আপনি আজ থাকছেন তো? রাতে আড্ডা হবে।
শাদাব ইতস্তত করে বলল,
–আর বলো না, শালাবাবু। অফিসে ভীষণ কাজের চাপ। আজ থাকতে পারছি না।
–সে কি? কাল কঙ্কাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আর বাড়ির একমাত্র জামাই সেখানে থাকবে না? এ কেমন কথা? এখান থেকে অফিসে যাওয়া যায় না, দুলাভাই?
সুরমা তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো,
–আমিও তো তাই বলছিলাম।
নীলয় বলল,
–হ্যাঁ, দুলাভাই। আপনি থাকুন।
শাদাব হেসে বলল,
–আসলে অনেক কাজ আমার। এত কাজের চাপ যে মাঝেমধ্যে চাকরি ছেড়ে কবিতা লিখতে ইচ্ছা করে।
নীলয় হেসে ফেললো। তারপর নিজের চিলেকোঠার ঘরে যাওয়ার জন্য সিড়ির দিকে পা বাড়ালো। কঙ্কা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নীলয়ের পিছু পিছু ছুটলো। সবাই চলে যাওয়ার পর শাদাব আর সুরমার মধ্যে আর কোনো কথাই হলো না। কারণ শাদাব একেবারেই আগ্রহ দেখালো না। তাই শত চেষ্টা করেও সুরমা কথা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে নি। কারণ কথপোকথন কখনো একপক্ষ থেকে হতে পারে না।
নীলয় সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল। কঙ্কা তাকে ডাকলো,
–নীলয় ভাই, শুনেন।
নীলয় থামলো। পিছনে ঘুরে বলল,
–কি চাস?
–আপনি কি এম্বুলেন্স ঠিক করে রেখেছেন?
নীলয় বিরক্তি নিয়ে বলল,
–কঙ্কা, তুই পাগল হতে পারিস। কিন্তু আমি পাগল নই।
কঙ্কা হেসে ফেলে বলল,
–আপনি মনে হয় রেগে আছেন আমার উপরে।
–তোর উপরে আমি রাগ করতে যাব কেন? তুই কে?
কঙ্কা হঠাৎ কোমল গলায় বলল,
–আমি সত্যিই চলে যাচ্ছি, নীলয় ভাই। আর কখনো হয়তো এ বাড়ির কারোর সাথে আমার দেখা হবে না। আমার খুব খারাপ লাগছে, নীলয় ভাই। খুব কষ্ট হচ্ছে।
নীলয় দুই পা এগিয়ে গিয়ে বলল,
–তাহলে কেন যাচ্ছিস? যাস না, কঙ্কা। এত বড় ভুলটা তুই করিস না। আরেকবার ভেবে দেখ।
–আর পিছিয়ে আসার উপায় আমার নেই। আবির আমাকে জালে জড়িয়ে ফেলেছে। চিরকাল নিজেকে বুদ্ধিমতী ভেবে এসেছি। কিন্তু আমি বিশাল বোকামি করেছি। আর কিচ্ছু করার নেই। এই জালে আমাকে ঢুকতেই হবে।
কথা শেষ করে কঙ্কা বাড়ির ভেতরে চলে গেল। নীলয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কঙ্কা এসব কি বলে গেল? কিসের জালে জড়িয়েছে ও?
রাত প্রায় আটটা। শাদাবকে কিছুতেই আটকে রাখা যায় নি। সবাই এত করে বলার পরেও শাদাব শুনলো না। শেষ পর্যন্ত সে চলেই গেল। সুরমা মনমরা হয়ে ঘরে বসে আছে। আয়েশা বেগম ঘরে ঢুকলেন। সুরমার পাশে বসে বললেন,
–এসে থেকেই দেখছি মন খারাপ করে আছিস। কি হয়েছে রে, মা?
সুরমা হাসার চেষ্টা করে বলল,
–কিছু হয় নি, খালা। খালুজান কোথায়?
আয়েশা বেগম সুরমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
–তোর প্রিয় তিলের খাজা আনতে গেছে। এক্ষুনি চলে আসবে।
সুরমা হেসে বলল,
–সত্যিই খালুজান পাগল। এখন যাওয়ার দরকার ছিল? পরেও যাওয়া যেতো।
আয়েশা বেগম আর কিছু বলতে পারার আগেই কঙ্কা সেই ঘরে ঢুকলো। ঘরে উপস্থিত দুজন মানুষই বিস্ফারিত নয়নে কঙ্কার দিকে তাকিয়ে রইলো। কারণ কঙ্কা বউ সেজেছে। মায়ের বিয়ের লাল বেনারসি পরেছে, মায়ের গয়নাগাটিও পরেছে। সে হাসি হাসি মুখ করে বলল,
–দেখো তো, আমাকে কেমন লাগছে?
.
#চলবে…….