নিরব রদনে পব-১২

0
1002

#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:১২
.
.
.
আজ সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙেছে নীলয়ের। সে বসার ঘরে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিল। পত্রিকা পড়া তার উদ্দেশ্য নয়। আজকের পত্রিকায় তার লেখা একটা কবিতা ছাপানোর কথা আছে। ছাপানো হয়েছে কিনা সেটাই সে দেখছে। প্রায় আধ ঘন্টা আগে ফতির কাছে চা চেয়েছে সে। এখনো সেটা পাওয়া যায় নি। ফতি এই বাসায় কাজ করে। মেয়েটা চূড়ান্ত রকমের ফাঁকিবাজ। আজ সে কাজে এসেছে প্রায় পনেরো দিন পরে। প্রত্যেকবার বিশাল একটা ফাঁকিবাজির পর সে এমন সব যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলে যেন কাজে না এসে সে উচিত কর্মটিই করেছে।
পত্রিকার সাহিত্য পাতায় নীলয় নিজের কবিতাটা খুঁজে পেয়েছে। এখন শুধু এক কাপ চা দরকার। সে উঁচু গলায় ফতিকে ডাকলো,
–ফতি, তোর চা হলো? কখন দিবি?
ফতি সাড়া দিলো না। দু’মিনিট পরে চা নিয়ে এলো। কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
–ভাইজান, চা লন।
নীলয় চা নিলো। বিরস মুখে বলল,
–এতক্ষণ লাগে চা আনতে?
ফতি ব্যস্ত গলায় বলল,
–আমার কি একটা কাম, ভাইজান? কত কাম! তার উপরে আম্মার মন মেজাজ ভালো না।খালি কঙ্কা আপার জন্যে কান্দে।
নীলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–আচ্ছা, যা। চাচা চাচী খেয়েছেন?
–জ্বি না। এখনো খায় নাই। আমি খাওয়ামু নে। চিন্তা কইরেন না। সুরমা আপা কি আর আসবো না?
–কালই তো গেছে। এক্ষুনি কি আবার আসতে পারবে? আপারও তো সংসার আছে।
–হ, তা ঠিক কইছেন।
–তুই এতদিন কেন আসিস নি? সবসময় শুধু ফাঁকি দেওয়ার তালে থাকিস তুই, ফতি। এই স্বভাব বদলা।
ফতি কপাল চাপড়ে বলল,
–ও আল্লাহ! আমি ফাঁকির তালে থাকি? আমার আব্বা অসুস্থ ছিল বইলা এই কয়েকদিন আসি নাই। ইচ্ছা কইরা করি নাকি? এইডা ঠিক কইলেন না, ভাইজান। মনে কষ্ট পাইলাম।
নীলয় হতাশ গলায় বলল,
–আচ্ছা, আমার ভুল হয়েছে। এবার তুই যা।
ফতি চলে যাচ্ছিলো। তখনই কলিং বেল বাজলো। ফতি দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
–এই সময় আবার কে আসে? ফতির দেখতাছি মরার সময় নাই।
ফতি দরজা খুললো। দরজা খুলে কিছুক্ষণের জন্য তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। দরজার সামনে অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পরনে কালো রঙের শাড়ি, কালো শাড়িতে নীল রঙের চিকন পাড় আছে, সেখানে ছোট ছোট সাদা পাথর বসানো। মেয়েটির চুলে খোঁপা বাঁধা, ডান হাতে সোনালী চেইনের ঘড়ি, কাঁধে ঝোলানো লম্বা ব্যাগ। ফতি জিজ্ঞেস করলো,
–আপনে কে, আপা? কারে চান?
মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বলল,
–সকাল সকাল এসে বিরক্ত করেছি হয়তো। প্রথমেই সেজন্য দুঃখিত। এখানে কি কবি নীলয় আহসান থাকেন? আমি আসলে উনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
ফতি অহেতুক তাড়াহুড়ো করে বলল,
–হ, থাকে তো। উনি বহুত বড় কবি। লম্বা লম্বা কবিতা লেখতে পারেন।
মেয়েটি হেসে ফেললো। বলল,
–আমি উনার কবিতা পড়েছি। একবার উনার সাথে দেখা করতে চাই। সেজন্যই এসেছি। দেখা করা যাবে কি?
ফতি অতি উৎসাহী হয়ে বলল,
–যাইবো না মানে? অবশ্যই যাইবো। আসেন আসেন, ভেতরে আসেন। আপা, আপনের নাম কি?
মেয়েটি অসম্ভব সুন্দর করে হেসে বলল,
–পুতুল। আমার নাম পুতুল।

ফতি পুতুলকে নিয়ে বসার ঘরে এসেছে। নীলয় অতীব বিস্ময় নিয়ে পুতুলের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের পলক পরছে না। সাতাশ বছরের জীবনে এমন রূপবতী নারী সে আর দেখে নি। কঙ্কাও রূপবতী বটে। কিন্তু এ মেয়েটা কেমন অন্যরকম। পুরোটা চোখমুখ জুড়েই ভীষণ কোমলতার ভাব। কঙ্কার চোখেমুখে সবসময় একটা বুদ্ধিদীপ্ত ভাব দৃশ্যমান থাকতো। এতে তার সৌন্দর্যের উপরে একটা ঝাঁঝালো পর্দা পরে যেতো।নীলয়ের ধারণা সেই ভাব শুধু সেই দেখতে পেতো, অন্যকেউ নয়। নীলয়ের বিস্ময় কাটছে না। সে তাকিয়েই আছে পুতুলের দিকে। ফতি হঠাৎ উল্লসিত গলায় বলে উঠলো,
–ভাইজান, এই আপা আপনের কবিতা পইড়া আসছে।
ফতির কথা কানে আসতেই নীলয়ের ধ্যান ভঙ্গ হলো। এতে সে কিছুটা বিরক্ত হলো। ফতির উল্লসিত কন্ঠস্বরকে তার বিতিকিচ্ছিরি শব্দের মতো লাগলো। এত তাড়াতাড়ি ঘোর কাটার প্রয়োজন ছিল না। আর কিছুক্ষণ মেয়েটাকে দেখলে ক্ষতি কি হতো? ভাবনার এ জায়গাতে নীলয় থমকে গেল। নিজের চিন্তায় নিজেই লজ্জিত হলো। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলল, ছিঃ ছিঃ! এসব কি ধরণের ভাবনা? সে নিজেকে সামলে নিলো। গম্ভীর গলায় ফতিকে বলল,
–ফতি, আরেক কাপ চা নিয়ে আয়।
ফতি চলে গেল। নীলয় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
–আপনি বসুন।
মেয়েটি বসলো। নীলয়ও সামনাসামনি বসলো। পুতুল বলল,
–ভালো আছেন, নীলয় সাহেব?
–জ্বি, ভালো। আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।
মেয়েটি হেসে বলল,
–চেনার কথাও নয়। আমি পুতুল।
নীলয়ের মন খারাপ হয়ে গেল। এত সুন্দর একটা মেয়ের নাম পুতুল কেন হবে? পুতুল কি এত সুন্দর হয়? মেয়েটার মা বাবা নিশ্চয়ই পুতুলের মতো সুন্দর ভেবে মেয়ের নাম পুতুল রেখেছেন। কিন্তু এ মেয়ে তো পুতুলের চেয়েও সুন্দর। তার নাম তো হওয়া উচিত ক্লিওপেট্রা অথবা কুইন অব সেবা; কিংবা হেলেন অব ট্রয়, যার রূপের ছটায় অবলীলায় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে সবকিছু। নীলয় পুতুলের দিকে তাকালো। পুতুলের মুখে স্নিগ্ধ একটা হাসি লেগে আছে। মেয়েটির হাসি দেখে নীলয় মুগ্ধ হয়েছে। মেয়েটি শব্দ করে হাসলে না জানি কত সুন্দর লাগে তাকে! আচ্ছা? পুতুলের হাসির শব্দ কেমন? সে কি খিলখিল করে হাসে? নাকি বাঁশির মতো রিনরিনে তার হাসির শব্দ? নীলয় পুতুলের হাসির শব্দ শোনার উদ্দেশ্যে রসিকতা করে বলল,
–ও আচ্ছা। আপনি পুতুল? আমি ভেবেছিলাম আপনি মানুষ।
পুতুল হেসে ফেললো। শব্দ করে নয়, সে হাসলো নিঃশব্দে। নীলয়ের উদ্দেশ্য পূর্ণ হলো না। পুতুল এবার সামনের টেবিলে রাখা পত্রিকা হাতে নিলো। নীলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
–কবি সাহেব, আমি আপনার একজন ভক্ত।
নীলয় অতিমাত্রায় বিস্মিত হলো। চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে সে তাকিয়ে রইলো পুতুলের দিকে। পতুলের কবি সাহেব ডাকটা ভয়ংকর রকমের ভালো লাগছে তার। পুতুল বলল,
–গত একমাসে এই পত্রিকায় আপনার যতগুলো কবিতা ছাপা হয়েছে, আমি তার সবগুলোই পড়েছি। যত পড়েছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি। এত বেশি মুগ্ধ হয়েছি যে একবার আপনাকে নিজের চোখে না দেখে শান্তি পাচ্ছিলাম না। আপনি ভীষণ সুন্দর কবিতা লিখতে পারেন। আপনি কি তা জানেন?
নীলয় বিমুগ্ধ হয়ে গেল। কোনো কথা বলতে পারলো না। সে যে খারাপ লিখে না এটা সে জানতো। কিন্তু এত বেশি ভালো লিখে সেটা জানতো না। কঙ্কা আজীবন তার কবিতাকে ছাঁইপাশ বলে এসেছে। এই প্রথম কোনো মেয়ে তার কবিতার প্রশংসা করলো। নীলয় তাকিয়েই রইলো। পুতুল আবার বলল,
–আপনি প্রিয়ংবদা নামের যে কবিতাটা লিখেছেন, সেটা পড়ে আমার মনে হয়েছে যেন আমাকে নিয়েই সে কবিতা লেখা হয়েছে।
কথাটা বলেই পুতুল হাসলো, অপ্রতিভ হাসি। নীলয়ের মনে হলো সত্যিই বোধহয় ওই কবিতাটা পুতুলকে নিয়েই লেখা। অথচ কবিতাটা সে লিখেছিল কঙ্কাকে ভেবে। এখন মনে হচ্ছে বিরাট ভুল হয়েছে। পুতুল আবার বলল,
–আপনি মাঝেমধ্যে দুঃখের কবিতাও লেখেন। কেন বলুন তো?
নীলয় এবার মুখ খুললো। মৃদু হেসে বলল,
–আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর কারোর জীবনেই অবারিত সুখ নেই। দুঃখের জীবনও আছে। সে জীবনগুলো নিয়েও লেখার প্রয়োজন আছে।
–অন্ন কবিতায় বাচ্চা মেয়েটা সারাদিন এক মুঠো খাবারের জন্য এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালো। অথচ কবিতার শেষে গিয়েও মেয়েটা একটু খাবার পেলো না। উল্টো সে একদল দুষ্কৃতকারীর হাতে পরলো। এমন একটা দুঃখের কবিতা না লিখলেও পারতেন। কবিতাটা পড়ে আমি সারাদিন কেঁদেছিলাম।
নীলয় হাসলো। এই অপূর্ব চোখ জোড়ায় জল এলে পুতুলকে দেখতে কেমন লাগে সেটা দেখার একটা অন্যায় ইচ্ছা তার হতে লাগলো। তার বলতে ইচ্ছা করলো, আমার সামনে একবার কাঁদবেন, পুতুল? কাঁদলে আপনাকে কেমন দেখায় সেটা দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু একথা কখনো বলা যায় না। নীলয় সে কথা বললও না। সে অন্যকথা বলল। জিজ্ঞেস করলো,
–আমার ঠিকানাটা কি করে পেলেন?
–পত্রিকার অফিসে যোগাযোগ করে পেয়েছি।
–ও।
পুতুল তার ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি আর কলম বের করলো। নীলয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–আমাকে একটা অটোগ্রাফ দেবেন, কবি সাহেব?
নীলয় অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো পুতুলের হাত কাঁপছে। পুতুল বলল,
–পছন্দের কবির থেকে অটোগ্রাফ চাইছি তো, সেজন্য কেমন একটা নার্ভাস লাগছে। তাই হাত কাঁপছে। অটোগ্রাফ দেবেন না?
নীলয় ইতস্তত করে বলল,
–ইয়ে…আমি অটোগ্রাফ দেবো? আপনি সত্যিই আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষের অটোগ্রাফ চান?
–জ্বি, চাই। আপনি সম্মত না হলে ভীষণ কষ্ট পাবো। আপনার একজন ভক্ত এত কাঠখড় পুড়িয়ে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। আর আপনি তার মনে কষ্ট দেবেন?
নীলয় হাসলো। পুতুলের হাত থেকে ডায়েরি আর কলম নিলো। কাঁপা হাতে লিখলো একটা লাইন, “পুতুল, আপনি ভীষণ ভালো।” নিচে নিজের নাম লিখলো এবং তারিখ লিখলো। তারপর ডায়েরিটা এগিয়ে দিলো পুতুলের দিকে। পুতুল ডায়েরি ব্যাগে রাখলো। কলমটা নীলয়কে দিয়ে বলল,
–কলমটা আপনার জন্য উপহার হিসেবে এনেছি। নিলে খুশি হবো।
নীলয় কলমটা নিলো। তার এখন যুবক বয়স। সুন্দরী তরুণীকে না বলার সক্ষমতা তার নেই। পুতুল উঠে দাঁড়ালো। হাসিমুখে বলল,
–আসি, নীলয় সাহেব। ভালো থাকবেন। আপনার পরবর্তী কবিতা পড়ার অপেক্ষায় থাকবো।
নীলয় তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো,
–সেকি? কিছু না খেয়েই চলে যাবেন? এক কাপ চা অন্তত।
–না, আজ নয়। অন্য কোনো দিন।
কথা শেষ করে পুতুল বেরিয়ে গেল। নীলয়কে অভাবনীয় এক মুগ্ধতায় ডুবিয়ে দিয়ে মেয়েটা চলে গেল। নীলয়ের কানে বাজছে পুতুলের সেই কথাটা, “কবি সাহেব, আমি আপনার একজন ভক্ত।” সে কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে বসলো। ফতির দিয়ে যাওয়া চা হাতে নিয়ে চুমুক দিলো। খেতে বিশ্রী লাগছে। একে চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, তার উপর চায়ে লিকার বলতে কিছু নেই। শুধু একগাদা চিনি। ফতি চা খুব খারাপ বানায়। নীলয় চা রেখে দিলো। আচ্ছা? পুতুল কি চা বানাতে পারে? তার হাতে একদিন চা খেতে চাইলে কি সে খুব রাগ করবে? কিন্তু চাইবে কি করে? তার ঠিকানা, ফোন নাম্বার, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, কোনো কিছুই যে জিজ্ঞেস করা হলো না! আফসোসে নীলয়ের মরে যেতে ইচ্ছা করছে।
আয়েশা বেগম নাস্তার ট্রে হাতে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন। নীলয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
–কিরে, নীলয়? ফতির কাছে শুনলাম একটা মেয়ে নাকি এসেছে তোর কবিতা পড়ে। কোথায় সে?
নীলয় মাথা তুলে তাকিয়ে বলল,
–চলে গেছে, চাচী।
–চলে গেল? আমি তো মেয়েটার জন্য খাবার নিয়ে এলাম।
নীলয় কিছু বলল না। আয়েশা বেগম নাস্তার ট্রে টেবিলে রাখলেন। নীলয়ের পাশে বসে বললেন,
–মেয়েটাকে দেখতে কেমন রে?
–সুন্দর।
–মেয়েটা কি তোকে পছন্দ করে?
–আমার কবিতা পছন্দ করে।
–তোদের কি আগে থেকেই পরিচয় ছিল?
–না, চাচী। মেয়েটা আমার কবিতা পড়েছে। কবিতা ভালো লেগেছে বলে পত্রিকা অফিস থেকে ঠিকানা জোগাড় করে দেখা করতে এসেছে।
–ও আচ্ছা। ঠিক আছে। খাবারগুলো তাহলে তুই খেয়ে নিস।
–তুমি খাবে না, চাচী?
–খাবো। তুই খেয়ে নে।
–চাচা কোথায়?
–একটু বেরিয়েছে। ফিরতে দেরি হবে বলেছে। যে মেয়েটা এসেছিল তার নাম কি রে?
–পুতুল। মেয়েটার নাম পুতুল।
নীলয় খাবার মুখে দিলো। আয়েশা আচমকা বলে বসলেন,
–মেয়েটাকে কি তুই বিয়ে করবি, নীলয়?
নীলয় খাবার মুখে নিয়েই হেসে ফেললো। ফলস্বরূপ সে বিষম খেলো। আয়েশা পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন,
–নে, পানি খা। অযথা হাসছিস কেন?
নীলয় পানি খেয়ে বলল,
–তোমার কথা শুনে হাসছি, চাচী। একটা মেয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে শুনেই তুমি বিয়ে পর্যন্ত ভেবে ফেললে? তুমি পারোও বটে!
আয়েশা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
–আসলে নিজের ভাবনাগুলোকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি। ব্যস্ত না রাখলে সারাক্ষণ শুধু কঙ্কার কথা মনে পড়ে। মেয়েটা এমন একটা কাজ করবে আমি ভাবতে পারি নি। ওর বাবা রোজ রাতে কাঁদে। এত আদর করে ওকে বড় করেছি। অথচ ও কিনা..!
নীলয়ের খাওয়া থেমে গেল। সে কিছু বলতে পারলো না। একবার মনে হলো, কঙ্কার চিঠিটা চাচীকে পড়তে দেবে। পরক্ষণেই মনে হলো, না থাক। অযথা মানুষটার দুঃখ বাড়িয়ে লাভ নেই। সে কথা ঘুরিয়ে বলল,
–চাচী, নাও তো। আমি আজ তোমাকে খাইয়ে দেই।
নীলয় খাইয়ে দিতে শুরু করলো। আয়েশা বেগম আপত্তি করলেন না। নীলয় একটা বিষয় নিয়ে চিন্তায় পরলো। কঙ্কার চিঠিটা চাচীকে পড়তে দেওয়া উচিত কিনা সে বুঝতে পারছে না। আপা থাকলে ভালো হতো। জিজ্ঞেস করে নেওয়া যেতো। অবশ্য এই চিন্তা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ঘুরেফিরে নীলয়ের মস্তিষ্ক দখল করে নিলো পুতুল নামক মেয়েটি। আচ্ছা? মেয়েটা কি আর কখনো আসবে না?
________________________
শাদাব অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। আজকের সকালটা অদ্ভুত সুন্দরভাবে শুরু হয়েছে। চোখ খুলেই নিজের বুকে ভালোবাসার মানুষটাকে দেখতে পাওয়া, তাকে দেখতে পাওয়া যে মানুষটা তাকে ভালোবাসে, এর মতো সুন্দর অনুভূতি আর হয় না। শাদাবের মনে হচ্ছে সত্যিই একটা নতুন শুরু এসেছে তার জীবনে।
সুরমা ঘরে ঢুকলো। শাদাবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মানিব্যাগ এগিয়ে দিলো তার দিকে। শাদাব হাসিমুখে সেটা নিলো। জানতে চাইলো,
–খেয়েছ, সুর?
–না, তোমার সাথে খাব।
–মা খেয়েছে?
–না। আজ আমরা সবাই একসাথে খাব।
শাদাব হাসলো। হাতে ঘড়ি পরতে পরতে বলল,
–তোমার কিছু লাগবে? অফিস থেকে আসার সময় নিয়ে আসবো?
সুরমা হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
–হ্যাঁ, মায়ের ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। নিয়ে আসবে মনে করে।
–আচ্ছা, আনবো। তোমার জন্য কিছু আনবো না?
সুরমা ইতস্তত করে বলল,
–আমার একটা জিনিস লাগবে।
শাদাব সুরমার দিকে ঘুরলো। সুরমার হাত ধরে বলল,
–কি লাগবে? বলো।
সুরমা মৃদু গলায় বলল,
–একটা নতুন সিম কার্ড।
শাদাব ভ্রু কুঁচকে ফেললো। প্রশ্ন করলো,
–সিম কার্ড দিয়ে কি হবে?
–আগেরটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি ওটা ফেলে দিয়েছি। তাই নতুন একটা লাগবে।
শাদাব হালকা হেসে সুরমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। সে কারণটা বুঝতে পেরেছে। সুরমা চায় না কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ফোন কল কখনো তার কাছে আসুক। সে কারণেই আগের সিম কার্ডটা সে ফেলে দিয়েছে। শাদাব জড়িয়ে ধরায় সুরমার মন ভালো লাগায় ভরে গেল। আগের শাদাবকে সে ফিরে পেয়েছে। আর তার কিছুই চাওয়ার নেই।
ঘরের দরজায় টোকা পরলো। সুরমা শাদাবের কাছ থেকে দূরে সরলো। বাইরে থেকে সাবিনা বানুর গলা পাওয়া গেল,
–শাদাব, বৌমা।
সুরমা তাড়াতাড়ি বলল,
–মা, ভেতরে আসুন।
সাবিনা বানু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। সুরমা কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,
–কিছু দরকার, মা? আমাকে ডাকলেই তো পারতেন।
–কেন? আমার কি ছেলের ঘরে আসতে মানা?
সুরমা থতমত খেয়ে গেল। দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,
–না না, মা। ছিঃ ছিঃ! মানা হবে কেন?
সাবিনা বানু হেসে ফেললেন। বিছানায় বসে বললেন,
–তোরা দুজন আমার সামনে বোস তো। কয়েকটা কথা বলি।
শাদাব আর সুরমা একে অপরের দিকে একবার তাকালো। তারপর সামনের সোফায় দুজন পাশাপাশি বসলো। সাবিনা বানু সরাসরি প্রশ্ন করলেন,
–তোদের দুজনের ভেতর সব ঝামেলা মিটেছে?
সুরমা উত্তর দিলো না। তার খুব লজ্জা লাগছে। শাদাব বলল,
–হ্যাঁ, মা। মিটেছে।
সাবিনা বানু কড়া গলায় বললেন,
–আলহামদুলিল্লাহ। শুনে খুশি হলাম। আমি যেন আর কখনো না শুনি তোরা আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিস। বুঝতে পেরেছিস?
সুরমা চট করে বলে উঠলো,
–আমি ভাবি নি, মা। আপনার ছেলে ভেবেছিল। আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
শাদাব সঙ্গে সঙ্গে বলল,
–এখন আমার দোষ হয়ে গেল? কেন ভেবেছিলাম সেটা বলো। আমি যেন কষ্ট পাই নি!
সুরমা নতমুখে বলল,
–দোষটা আমারই ছিল। আমি তো স্বীকার করেছি সেটা। ক্ষমাও তো চেয়েছি।
সাবিনা বানু আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাসলেন। তারপর কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে বললেন,
–হয়েছে। থাম তোরা। শোন, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হবে, মান অভিমান হবে, আবার সেসব মিটেও যাবে। একজন আরেকজনকে বুঝতে হবে, একে অপরের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তোরা আমার সামনে প্রতিজ্ঞা কর, সারাজীবনে কখনো একে অপরের হাত ছাড়বি না। পরিস্থিতি যাই হোক, একসাথে থেকেই সেটা সামলাবি।
সুরমা মাথা নিচু করে বলল,
–প্রতিজ্ঞা করছি, মা। আপনার ছেলের গলায় একবার যখন ঝুলে পরেছি, তখন এ জীবনে আর ছাড়বো না।
শাদাব মৃদু হেসে বলল,
–আমিও ছাড়ছি না।
সাবিনা বানু প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
–আলহামদুলিল্লাহ! এতদিনে আমার বাসায় আবার শান্তি ফিরে এসেছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। এখন শুধু আমার একটা নাতি নাতনি চাই।
আচমকা এই কথায় সুরমার মুখ লজ্জায় আরক্ত হয়ে গেল। শাদাব তার দিকে তাকাতেই সেই লজ্জা বেড়ে দশগুণ হলো। সুরমা হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালো। কোনোরকমে বলল,
–আমি নাস্তা রেডি করছি। আপনারা খেতে আসুন, মা।
বলেই প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। শাদাব উঠে দাঁড়ালো। ইতস্তত করে বলল,
–ইয়ে মা, তোমার নাকি ওষুধ শেষ হয়ে গেছে? সুরমা বলছিল।
সাবিনা বানু হেসে উঠে দাঁড়ালেন। শাদাবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–আয়, নাস্তা খেতে আয়। লজ্জায় মারা যাচ্ছে দুজন।
কথাটা বলেই তিনি বাইরের দিকে যেতে লাগলেন। শাদাব মাথা নিচু করে হাসলো। তারপর সেও মায়ের পিছু পিছু খাওয়ার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
____________________
দুপুর গড়িয়ে বিকাল প্রায়। কঙ্কা আর আবির প্রায় দু’ঘন্টা আগে আবিরদের বাড়ি এসে পৌঁছেছে। আর এই দু’ঘন্টা ধরেই তারা বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কয়েকদিনের সংসারে যেকটা জিনিস কেনা হয়েছিল সেগুলো খুব অযত্নে দরজার পাশে পরে আছে। রংপুর থেকে তারা রওনা হয়েছিল সকালের দিকে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই সমস্ত কিছু গোছগাছ করে তৈরি হয়ে গিয়েছিল কঙ্কা। আবিরের ধারণা ছিল চলে আসার সময় বাড়িওয়ালা হয়তো কিছুটা ঝামেলা করবেন। কিন্তু কোনো ঝামেলা তারা করেন নি। আসার সময় বাড়িওয়ালাকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
কঙ্কা আবিরদের বাড়ি দেখছে। বাড়িটা দোতলা, বাইরের দেয়ালে সাদা রঙ করা। বাড়িটা বেশ বড়। আবিরের বাবা ধনী মানুষ, বেশ ধনী। কঙ্কা তা আগে থেকেই জানতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধনীর আদরের দুলালরাই এমন নষ্ট চরিত্রের হয়ে থাকে। এদের বাড়ি যে বড় হবে তা কঙ্কা ধারণা করেছিল। কিন্তু এত বড় হবে সেটা কঙ্কা ভাবে নি। বাড়ির সামনে একটা ফুলের বাগানও আছে। আবিরের বাবা আসলে করেন কি? উনার কি অবৈধ কোনো ব্যবসা আছে? বাড়ির মূল দরজায় একজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। সে মাঝে মাঝেই কঙ্কার দিকে তাকাচ্ছে। আর একবার তাকাতেই কঙ্কা লোকটাকে ভেঙচি কাটলো। লোকটা থতমত খেয়ে গেছে। এখন আর সে তাকাচ্ছে না। আবির কঙ্কার পাশে বসে উশখুশ করছে। তার প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। এভাবে বসে থাকার কোনো মানে হয় না।
কঙ্কা গায়ের চাদর ভালো করে টেনে নিলো। আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
– আবির, তোমার বাবার কি কোনো অবৈধ ব্যবসা আছে?
আচমকা এমন প্রশ্নে আবির হতভম্ব হয়ে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাঠকাঠ গলায় বলল,
–কঙ্কা, আমার বাবা খুব ভালো মানুষ।
–ও আচ্ছা।
–আর কখনো এরকম কথা বলবে না।
–আচ্ছা।
কঙ্কা চুপ করে গেল। আবির বলল,
–তুমি বলেছিলে আমার মাকে তুমি সামলাবে। কিন্তু সামলাতে তো পারলে না। মা তো আমাদের বাসায় ঢুকতেই দিলো না। চলো আমার ফ্ল্যাটে যাই।
কঙ্কা শক্ত গলায় বলল,
–না। তোমার ওই নোংরা ফ্ল্যাটে আমি যাবো না।
–তাহলে কি এখানেই বসে থাকবে? দু’ঘন্টা ধরে বসে আছি। একটু পরে সন্ধ্যা নামবে।
কঙ্কা নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলো,
–আর দুয়েক ঘন্টা বসে থাকতে হবে। তারপর মা নিজেই আমাদের ভেতরে নিয়ে যাবেন। এখন একটা কাজ করো। আশেপাশে কোনো চায়ের দোকান আছে? থাকলে কাউকে দিয়ে চা আনাও। চা খেতে খেতে তোমার সাথে গল্প করবো।
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার বউটা এত অদ্ভুত কেন?
.
#চলবে……
(খুবই দুঃখিত আমি। মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না বলে লিখে উঠতে পারছিলাম না। আমি প্রতিদিন লিখবো বলে ঠিক করেছি। পারবো বলে আশাও করছি। আল্লাহ ভরসা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here