নিরব রদনে পব-১৪

0
914

#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:১৪
.
.
.
আশরাফউদ্দিন সাহেব বাগানে হাঁটাহাঁটি করছেন। বাগানে নতুন ফুলগাছ লাগানো হয়েছে; শীতকালীন ফুলগাছ। গাছগুলোতে নতুন কলি এসেছে। এবার যাকে মালি হিসাবে রাখা হয়েছে সে বেশ ভালোই কাজ করছে। বাগানের একধারে একটা বকুল গাছ আছে। অযাচিনী বকুল ফুল খুব পছন্দ করে বলে আশরাফউদ্দিন সাহেব গাছটা লাগিয়েছিলেন। গাছ লাগানোর পর তিনি অযাচিনীকে ডেকে বলেছিলেন,
–অযাচিনী, তোমার পছন্দের বকুল ফুলের গাছ লাগিয়েছি।
আশরাফউদ্দিন ভেবেছিলেন অযাচিনী খুশি হবে। কিন্তু গাছটা লাগানো হয়েছে শোনার পরেই অযাচিনী কঠিন গলায় বলেছিল,
–বকুল ফুল আমার ভালো লাগে না। এই ফুল অতি বিশ্রী।
আশরাফউদ্দিন সাহেব হতভম্ব হয়ে বলেছিলেন,
–কিন্তু বকুল ফুল তো তুমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করো।
–আগে করতাম। এখন আর করি না।
কথাগুলো বলেই অযাচিনী চলে গিয়েছিল। আজ পর্যন্ত এই গাছের একটা ফুলও অযাচিনী স্পর্শ করে নি। আশরাফউদ্দিন সাহেব বকুল গাছটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। বকুল গাছের পাশেই একটা কাঠের চেয়ার, তার সামনেই ছোট একটা টেবিল। বকুল গাছের পাশেই চেয়ার রাখার পিছনে আশরাফউদ্দিন সাহেবের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। অযাচিনী প্রতিদিন সকালে যখন উনাকে চা দিতে আসবে তখন যেন গাছটা তার চোখে পরে। আশরাফউদ্দিনের ধারণা এতে করে গাছটার প্রতি অযাচিনীর দমিয়ে রাখা আকর্ষণ প্রকাশিত হবে। কিন্তু এত বছরেও তা হয় নি। আশরাফউদ্দিন সাহেব চেয়ারে বসলেন। বেশ শীত লাগছে। গায়ের চাদর ভালো করে জড়িয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বাসার দরজার দিকে তাকালেন। আজ অযাচিনী আসছে না। উনি ট্রে হাতে নিয়ে কঙ্কাকে হেঁটে আসতে দেখতে পাচ্ছেন।
কঙ্কা উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদুস্বরে বলল,
–বাবা, আপনার চা।
আশরাফউদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন,
–এখানে রাখো, মা।
কঙ্কা হাতের ট্রে টেবিলে রাখলো। হেসে বলল,
–বাবা, আপনি নাকি প্রতিদিন সকালে মেহগনি বীজ ভেজানো পানি খান?
–হ্যাঁ, বৌমা। মেহগনি বীজ ভেজানো পানি খেলে ডায়াবেটিস আর ব্লাড প্রেশারটা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
–সত্যি?
–হ্যাঁ, সত্যি।
আশরাফউদ্দিন সাহেব গ্লাসটা হাতে নিলেন। উপর থেকে বীজগুলো ফেলে দিয়ে এক চুমুকেই সবটুকু পানি শেষ করে ফেললেন। উনার মুখ সামান্যতম বিকৃতও হলো না। কঙ্কা জিজ্ঞেস করলো,
–বাবা, এটা খেতে কেমন?
আশরাফউদ্দিন সাহেব চা নিতে নিতে বললেন,
–ভয়ংকর তেতো। খাবে নাকি?
কঙ্কা মুখে হাসি টেনে বলল,
–না না, বাবা। আমার দরকার নেই।
আশরাফউদ্দিন সাহেব হেসে ফেললেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
–বৌমা, তোমাকে একটা কথা বলা দরকার।
–জ্বি, বলুন।
–আসলে তোমাদের এভাবে চলে আসাটা তোমার শাশুড়ি মা ঠিক মেনে নিতে পারছে না। ও চায় তুমি তোমার মা বাবার বাসায় যাও। তারপর মোটামুটি ধরণের একটা আয়োজন করে তোমাকে নিয়ে আসা হবে। এবার তুমি বলো। তোমার মা বাবার সাথে কি কথা বলবো?
কঙ্কা দৃষ্টি নত করে বলল,
–না, বাবা। আমি আর আমার মা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবো না।
–ঠিক আছে। তবে দরকার নেই। আমি তোমার শাশুড়ি মাকে বুঝিয়ে বলবো।
কঙ্কা কিঞ্চিৎ অবাক হলো। এত সহজে মেনে নেওয়ার কারণটা সে বুঝতে পারলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আশরাফউদ্দিন সাহেব বললেন,
–তুমি এখন ভেতরে যাও, মা।
কঙ্কা গেল না। কারণ উনাকে দেখে কঙ্কার মনে হচ্ছে উনি আরও কিছু বলতে চান। আশরাফউদ্দিন চা খেতে খেতেই বললেন,
–বৌমা, তুমি কখনো তুরস্কের চা খেয়েছ?
–জ্বি না, বাবা।
–ও আচ্ছা। আবির ঘুম থেকে উঠেছে?
–না, বাবা। ডেকে দেবো?
আশরাফউদ্দিন সাহেব আনমনা হয়ে উত্তর দিলেন,
–হু? না, থাক। ডাকতে হবে না।
কঙ্কা কিছুটা ইতস্তত করে বলল,
–বাবা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
আশরাফউদ্দিন চায়ের কাপ হাত থেকে রাখলেন। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললেন,
–করো।
–আমার মা বাবা হয়তো আবিরের সাথে আমার বিয়েটা মেনে নেবেন না। সেকারণেই আমি আর উনাদের সামনে যেতে চাই না। মা কি এই ব্যাপারটা মানতে পারবেন?
–তোমার শাশুড়ি মায়ের কথা বলছো? ওকে আমি বুঝিয়ে বলবো।
কঙ্কা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
–আপনি মেনে নিয়েছেন, বাবা?
আশরাফউদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন,
–নিয়েছি, মা। শুধু যে মেনে নিয়েছি তাই নয়, তুমি যে আবিরকে বিয়ে করেছ তাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। আর আমার ধারণা তুমি আবির সম্পর্কে সবকিছু জেনেই ওকে বিয়ে করেছ।
কঙ্কা হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
–স…সবকিছু জেনে মানে?
আশরাফউদ্দিন সাহেব স্বাভাবিক গলায় বললেন,
–অনেক মেয়ের সাথে আবিরের সম্পর্কের কথা জেনে।
কঙ্কা অবাক হয়ে গেল। উনি কি তবে ব্যাপারটা জানেন? কিছুটা অস্বস্তিও লাগছে তার। স্বামীর চরিত্রহীনতার কথা যখন অন্য কেউ বলে তখন স্ত্রীর জন্য তা অবশ্যই লজ্জাজনক। কঙ্কা কথা বলতে পারলো না। আশরাফউদ্দিন সাহেব বললেন,
–আবিরকে কার সাথে বিয়ে দেবো, সেটা নিয়ে আমি খুব চিন্তায় ছিলাম। জেনেশুনে কোনো মেয়েকে ওর সাথে বিয়ে দেওয়া যায় না।
কঙ্কা প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল,
–আ..আপনি সব জানেন?
আশরাফউদ্দিন সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
–হ্যাঁ, সবটাই জানি। নিজের ছেলে সম্পর্কে তো জানতেই হতো।
–তাহলে….তাহলে কেন আবিরকে শোধরাবার চেষ্টা করেন নি, বাবা? সবটা জেনেও আপনি কিচ্ছু করলেন না!
–কিচ্ছু করি নি, কথাটা ঠিক নয়। আমি চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সফল হতে পারি নি।
কঙ্কা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বলল,
–এর মানে কি, বাবা? আপনি তো আবিরের বাবা। আপনার তো উচিত ছিল আবিরকে শাসন করা।
–আসলে আমি নিজে তো শতভাগ শুদ্ধ মানুষ নই। তাই আমার শাসনে অত জোড় ছিল না।
কঙ্কার চোখে হঠাৎ জল এসে গেল। সে মাথা নিচু করে নিলো। আশরাফউদ্দিন সাহেব কোমল গলায় বললেন,
–কেঁদো না, মা। এখন তুমিই পারবে আবিরকে সঠিক পথে আনতে।
কঙ্কা চোখে জল নিয়েই হেসে ফেললো, তাচ্ছিল্যের হাসি। চোখ মুছতে মুছতে বলল,
–যাকে নিজের বাবা শোধরাতে পারে নি, তাকে স্ত্রী কি করে শোধরাবে? আপনার ছেলে কখনো বদলাবে না।
–বদলাবে, মা। তোমাকে ভালোবেসেই ও বদলাবে।
কঙ্কা কঠিন গলায় বলল,
–যে নিজের বাবা মাকে ভালোবেসে বদলাতে পারে নি, সে আর কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারে না।
আশরাফউদ্দিন সাহেব হেসে বললেন,
–বৌমা, বাবা মায়ের ভালোবাসা পেতে গেলে তো নিজেকে বদলানোর প্রয়োজন হয় না। এমনিতেই তা পাওয়া যায়। কিন্তু স্ত্রীর ভালোবাসা পাওয়া সাধনার ব্যাপার। আমিও তোমার শাশুড়ি মায়ের জন্যই নিজেকে বদলে ফেলেছিলাম।
কঙ্কা হকচকিয়ে বলল,
–মানে?
আশরাফউদ্দিন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন,
–আমার একটা অবৈধ ব্যবসা ছিল। চোরাচালানের ব্যবসা। তোমার শাশুড়ি মায়ের জন্যই এই কাজ আমি ছেড়েছি।
কঙ্কা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। চোরাচালানের ব্যবসার কথা শুনে কঙ্কা অবাক হয় নি। এমন কিছু সে আগেই ধারণা করেছিল। সে অবাক হয়েছে কথাটা এত অনায়াসে তাকে বলে ফেলায়। সে মৃদু গলায় বলল,
–এখন আর একাজ করেন না?
–না, মা। বহুবছর আগেই ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহর কাছে মাফ চেয়েছি। এখন শুধু নিজের ছেলের একটা সুন্দর সংসার দেখে যেতে পারলেই আমার শান্তি। তুমি এসেছ, এখন আমি নিশ্চিন্ত।
কঙ্কা মুখে কিছুই বলল না। শুধু মনে মনে দুঃখ প্রকাশ করলো। নিজের মনেই বলল, ‘আপনার স্বপ্ন পূর্ণ হবে না বলে দু:খিত, বাবা। আমি আপনার ছেলের সাথে সুন্দর সংসার সাজাতে আসি নি।’
আশরাফউদ্দিন সাহেব চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন,
–ভেতরে যাও, মা। এই ঠান্ডায় বাগানে থাকার দরকার নেই।
কঙ্কা ট্রে হাতে তুলে নিতে নিতে বলল,
–বাবা, একটা বিষয়ে আপনার অনুমতি লাগবে?
–কি বিষয়, বৌমা?
–আমার একটা কাজ আছে। খুব জরুরি। আমি কি একটু বাইরে যেতে পারি?
–কি কাজ? চাইলে আমাকে বলে যেতে পারো।
কঙ্কা খুবই স্বাভাবিকভাবে বলে ফেললো,
–আমি আপনার ছেলের সাথে পালানোর সময় আমার মায়ের গয়নাগুলো নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো ফেরত পাঠাতে চাই।
আশরাফউদ্দিন সাহেবও সহজ গলায় বললেন,
–আচ্ছা, যেও।
কঙ্কা মৃদু হেসে বলল,
–ধন্যবাদ, বাবা।
তারপর ভেতরে চলে গেল। অযাচিনী টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছিল। কঙ্কা অভিভূত হলো। এর মধ্যে মেয়েটা নাস্তাও বানিয়ে ফেলেছে! মেয়েটা ভীষণ চটপটে তো। কঙ্কা রান্নাঘরে ট্রে রেখে অযাচিনীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হাসিমুখে বলল,
–অযাচিনী, আমি কি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?
অযাচিনী হেসে উত্তর দিলো,
–না, পারেন না। আপনি রান্নাবান্নায় যোগ দিলে ম্যাডাম আর কিছুই খাবেন না।
–ম্যাডাম মানে আমার শাশুড়ি মা?
–হ্যাঁ।
–কিন্তু আমি তো রান্না করছি না। শুধু পরিবেশন করবো।
–সেটাও করা যাবে না। আপনি বরং ঘরে যান। আপনার আর ছোট বাবুর খাবার ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ম্যাডাম সেরকমটাই বলে দিয়েছেন।

কঙ্কা আর কথা বাড়ালো না। সে দ্রুত পায়ে দোতলায় উঠে নিজের ঘরে ঢুকলো। আবির তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছিল। কঙ্কা ভেতরে যেতে যেতে বলল,
–আজ ডাকার আগেই উঠে পরেছ?
আবির মৃদু হেসে ছোট্ট করে জবাব দিলো,
–হু।
কঙ্কা আলমারির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। আবির হাত ধরে তাকে কাছে টেনে নিলো। কোমড় জড়িয়ে ধরে গাঢ় গলায় বলল,
–কঙ্কা, কি করলে তোমায় পাবো বলো তো?
হঠাৎ এমন কথায় কঙ্কা ভ্রু কুঁচকে ফেললো। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আবিরের দিকে। আবির আবার বলল,
–হঠাৎ করেই তোমাকে পাবার জন্য কেমন যেন তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠছি। কিন্তু তোমাকে যে কিছুতেই পাচ্ছি না।
কঙ্কা হেসে ফেলে বলল,
–সিনেমার সংলাপ কেন বলছো? তুমি আজ অব্দি যত মেয়েকে চেয়েছ সবাইকেই তো কোনো না কোনো কৌশলে পেয়েছ। আমাকেও তো পেয়েই গিয়েছ।
–এযাবৎ সব মেয়ের শুধুমাত্র শরীরটা চেয়েছি। সেটা পেয়েছিও। তোমার ক্ষেত্রেও তাই পেয়েছি। কিন্তু মন পেয়েছি কি?
কঙ্কা হেসে উঠে বলল,
–মন চাও নাকি?
–যদি চাই তাহলে কি দেবে?
–মন তো দেওয়া যায় না, আবির। মন ছিনিয়ে নিতে হয়। তুমি ছিনিয়ে নিতে পারো নি। বরং আমার মন তুমি ভেঙেছ।
–শোধরানো যায় না?
–আমি ছাড়াও যে আরও অনেক মেয়ের মন ভেঙেছ। তাদের সাথে অন্যায় করেছ। সেগুলো শোধরাবে কি করে?
আবির অধৈর্য হয়ে বলল,
–আমি সেসব ছেড়ে দেবো, কঙ্কা। ইতোমধ্যে ছেড়েও দিয়েছি।
–কিন্তু তোমার জন্য যে অনেক মেয়েরা সমাজে অপমানিত হয়েছে। তার প্রতিকার কি হবে?
আবির বিরক্ত গলায় বলল,
–যারা অপমানিত হয়েছে, তাদের নিজেদের কি কোনো ভুল নেই? তারা আমায় বিশ্বাস করেছিল কেন?
–নিশ্চয়ই আছে। তারা তোমাকে ভালোবেসে বিশ্বাস করেছিল। এতটা বিশ্বাস যে একটা বড় ধরণের অনৈতিক কাজও করে ফেলেছে। তবে এর শাস্তি কিন্তু তারা পাচ্ছে। শুধু তুমিই কোনো শাস্তি পাও নি।
আবির শীতল গলায় বলল,
–অনেকে কিন্তু স্বেচ্ছায়ও আমার কাছে এসেছিল।
–তাদের কথা বাদ দাও। তারা তো সমাজে লাঞ্ছিত হচ্ছে না। তারা নিজের মতো আনন্দে ফূর্তিতে আছে।
–কঙ্কা, তুমি কেন সবসময় এই কথাগুলো টেনে আনো আমাদের নিজেদের মধ্যে?
কঙ্কা হেসে বলল,
–আচ্ছা, যাও। আর এসব বলবো না। নিজেদের কথাই বলি। বিয়ের আগে আমাকে অচেতন করে রেপ করেছিলে তুমি। চেতনা ফেরার পর নিজেকে যে অবস্থায় দেখেছিলাম সেটা এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। ওই স্মৃতি আমার মস্তিষ্ক থেকে মুছে দাও, আবির।
আবিরের মুখ কালিবর্ণ হয়ে গেল। কঙ্কার চোখে পানি চিকচিক করছে। আবির হঠাৎ কঙ্কাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ব্যথিত গলায় বলল,
–ক্ষমা করে দাও, কঙ্কা। আমি তো তোমাকে বিয়ে করেছি বলো?
কঙ্কা অস্পষ্ট গলায় বলল,
–তুমি অন্যরকম হলেও পারতে। তাহলে তোমার বুকেই হয়তো শান্তি খুঁজে পেতাম।
দরজায় টোকা পরলো। কঙ্কা আবিরের থেকে দূরে সরে গেল। চোখ মুছে ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। অযাচিনী এসেছে। দরজা খোলাই আছে, তবুও অযাচিনী টোকা দিয়েছে। হুট করে ঘরে ঢুকে পরে নি। ব্যাপারটা কঙ্কার ভীষণ ভালো লাগলো। অযাচিনীর হাতে খাবার। সে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–আপনাদের খাবার।
কঙ্কা খাবারের ট্রে হাতে নিলো। অযাচিনী চলে গেল। কঙ্কা খাবারটা বিছানার পাশের টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
–আবির, এসো। নাস্তা করে নাও।
আবির বিছানায় বসে বলল,
–আমাদের খাবার ঘরে কেন দিয়ে গেল?
–কারণ তোমার মা আমাদের সাথে একসাথে বসে খেতে চান না।
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কঙ্কা আবিরের দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বলল,
–আমি একটু বাইরে যাবো।
–কোথায়?
–মায়ের গয়নাগুলো ফেরত পাঠাবো।
–ও আচ্ছা। ভালো।
আবির আর কথা বলল না। সে খেতে শুরু করলো। কঙ্কা উঠে আলমারি থেকে গয়নাগুলো বের করলো। ব্যাগে সেগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে বলল,
–তোমার বাবার অনেক টাকা। তবুও পালিয়ে বিয়ে করার নাম করে অনেক মেয়ের টাকাপয়সা তুমি নিয়েছ। কেন বলো তো?
আবির উত্তর দিলো না। কথাটা শুনতে পায় নি এমন ভঙ্গিতে বসে রইলো। তার সমস্ত মনোযোগ খাওয়ার দিকে। কঙ্কা নিজেই বলল,
–কারণ আমিই বলছি। তুমি যে এতগুলো মেয়ের পিছনে টাকা উড়াও সেটা যাতে কিছুতেই তোমার মা বুঝতে না পারে সেজন্যই তুমি এমনটা করতে। তাই না?
আবির খাবার চিবাতে চিবাতে জবাব দিলো,
–বুঝেই তো ফেলেছ। আবার জিজ্ঞেস করছো কেন?
কঙ্কা হাসলো। তারপর জিনিসগুলো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আবির খেয়ে যাওয়ার জন্য ডাকলেও কঙ্কা শুনলো না।
_________________________

প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে। কলিমউদ্দিন সাহেব আজ বাসা থেকে বের হোন নি। উনার শরীর কিঞ্চিৎ খারাপ। ঠান্ডায় সর্দি কাশি বাঁধিয়ে ফেলেছেন। উনি নিজের ঘরের বারান্দায় মোড়ায় বসে রোদ পোহাচ্ছেন। ফতি উনাকে এককাপ চা দিয়ে গেছে। উনি চা খাচ্ছেন না। নীলয়কে ডেকে পাঠানো হয়েছে। সে এখনো আসছে না। আয়েশা বেগম কলিমউদ্দিন সাহেবের বুকে সরিষার তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। কলিমউদ্দিন সাহেব জানতে চাইলেন,
–আয়েশা, নীলয়ের সাথে নাকি কোন এক মেয়ে দেখা করতে এসেছিল?
–হ্যাঁ, এসেছিল। ওর কবিতা পড়ে নাকি খুব ভালো লেগেছে।
–হু।
আয়েশা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। কলিমউদ্দিন সাহেবের গায়ে মোটা চাদর জড়িয়ে দিয়ে পাশে বসলেন। তখনই রান্নাঘর থেকে ফতির গলা পাওয়া গেল। সে চিৎকার করে বলছে,
–আম্মা, এলাচ কই রাখছেন? খুঁইজা পাই না তো।
আয়েশা বিরক্তি নিয়ে বললেন,
–ফতি বড় যন্ত্রণা করে। চোখের সামনে থাকা জিনিসও সে খুঁজে পায় না।
উনি উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। উনি যেতেই নীলয় এসে ঘরে ঢুকলো। কলিমউদ্দিন সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
–আমাকে ডেকেছেন, চাচা?
–হ্যাঁ, বোস।
নীলয় সামনের মোড়ায় বসলো। কলিমউদ্দিন সাহেব বললেন,
–নীলয়, আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কটাদিন তুই আমার ব্যবসার কাজগুলো একটু দেখ।
নীলয় হকচকিয়ে উঠলো। হতভম্ব হয়ে বলল,
–আ..আমি?
–হ্যাঁ, তুই। ম্যানেজার তোকে কাজ বুঝিয়ে দেবে।
–চাচা, আমি ব্যবসার কাজ বুঝি না। আমি পারবো না।
–পারবি। রাইসমিলগুলোতে যাবি, তাহলেই কাজ বুঝে যাবি।
–কিন্তু চাচা…
নীলয় কথা শেষ করতে পারলো না। কলিমউদ্দিন সাহেব থামিয়ে দিয়ে বললেন,
–তোর মতামত জানতে চাই নি। তোকে যা বললাম তাই করবি।
নীলয় ঘাড় কাত করে বলল,
–ঠিক আছে, চাচা।
–এখন যা।
নীলয় উঠে দাঁড়ালো। দরজার কাছে যেতেই কলিমউদ্দিন সাহেব ডাকলেন,
–নীলয়, শোন।
নীলয় দাঁড়ালো। পিছনে ঘুরে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। কলিমউদ্দিন সাহেব বললেন,
–কঙ্কা যাকে বিয়ে করেছে তার নাম আবির। আবিরের ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা তুই আমাকে দিয়েছিলি।
–হ্যাঁ, চাচা। আপনি কি ওদের খোঁজ পেয়েছেন?
–না। ওরা ওখানে নেই। কিন্তু আবিরের বাড়ির খোঁজ পেয়েছি। মানে ছেলেটার মা বাবা যেখানে থাকেন সেই বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করেছি। আবির আর কঙ্কা সেখানে আছে কিনা, সেই খোঁজটা তোকে নিতে হবে।
–ঠিক আছে, চাচা। আমি খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাবো।
–টেবিলের উপরে ঠিকানা লেখা আছে। নিয়ে যা।
–আচ্ছা।
নীলয় ঠিকানাটা নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। তখনই কলিং বেল বাজলো। আশেপাশে আর কেউ নেই। তাই নীলয়ই গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। দরজায় পুতুল দাঁড়িয়ে আছে। সে হাসিমুখে বলল,
–কবি সাহেব, আপনি নাকি খসরু ভাইয়ের কাছে আমার ঠিকানা চেয়েছিলেন কলম ফেরত দেবেন বলে? কেন বলুন তো? কলমটা কি পছন্দ হয় নি?
নীলয় থতমত খেয়ে বলল,
–না, মানে…আমি আসলে….
পুতুল হেসে ফেলে বলল,
–খসরু ভাই আপনাকে ঠিকানাটা দেন নি। তাই আমিই চলে এলাম। ভেতরে আসতে বলবেন না?
নীলয় মাথা নিচু করে হাসলো। তারপর বলল,
–আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।
________________________________

সুরমা সাবিনা বানুকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। সে মাত্রই গোসল সেরে এসেছে। মাথায় এখনো তোয়ালে পেঁচানো। সাবিনা বানু বললেন,
–তুমি খাবে না, বৌমা?
সুরমা গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে বলল,
–হ্যাঁ, মা। আমি ভেজা কাপড়গুলো ছাদে মেলে দিয়ে এসেই আপনার সাথে বসবো।
–শাদাব ফিরবে কখন?
–আজ তো তাড়াতাড়িই ফিরবে বলেছিল।
–তোমাকে নিয়ে তোমার খালার বাসায় যাবে শুনলাম।
–হ্যাঁ, মা। আর আজ আমি আপনাকেও সাথে নিয়ে যাবো।
সাবিনা বানু হেসে ফেললেন। সুরমা বলল,
–আপনি ধীরে ধীরে খান। আমি ছাদ থেকে আসছি, মা।
সুরমা প্রথমে ঘরে গেল। শাদাবকে একবার ফোন করলো। শাদাব ফোন ধরলো না। সুরমা রোজ দুপুরেই একবার শাদাবকে ফোন করে। শাদাব খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করে। আজ হয়তো শাদাব ব্যস্ত আছে। সুরমা ফোন রেখে দিলো। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করবে।
বাথরুম থেকে বালতি নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ছাদের দিকে পা বাড়ালো সে। তখনই কলিং বেল বাজলো। সুরমা বিরক্ত হলো। এই ভরদুপুরে কে এলো? সে বালতি নামিয়ে রেখে ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিলো। দরজা খুলে একজন অপরিচিত মানুষকে দেখতে পেলো। ঢোলা প্যান্ট আর সোয়েটার পরা মধ্যবয়সী একজন মানুষ। সুরমা প্রশ্ন করলো,
–কাকে চান?
অপরিচিত ব্যক্তি উত্তর দিলেন,
–আমি পোস্ট অফিস থেকে আসছি। শাদাব সাহেবের নামে একটা চিঠি আছে।
–আপনি আমাকে দিয়ে যান। আমি উনার স্ত্রী।
পোস্টম্যান চিঠি দিয়ে বিদায় নিলেন। সুরমা দরজা বন্ধ করে প্রেরকের ঠিকানা দেখলো। প্রেরকের নাম দেখে সুরমার বুক ধুক করে উঠলো। চিঠি এসেছে একজন উকিলের কাছ থেকে। সুরমার যতদূর মনে পড়ছে এই উকিলের সাথেই শাদাব ওদের ডিভোর্স নিয়ে কথা বলেছিল। কিন্তু সেই উকিলের থেকে এখন কেন চিঠি আসবে? সুরমা ধৈর্য রাখতে পারলো না। খাম ছিড়ে ভেতরের কাগজটা বের করলো। সাথে সাথেই তার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এলো। দু’হাতে কপাল চেপে ধরে মেঝেতে বসে পরলো সে।
.
#চলবে………
(গল্প দিতে কেন দেরি হচ্ছে? আমি ধারাবাহিক গল্প বা উপন্যাস পোস্ট করার ক্ষেত্রে এত অনিয়মিত কখনো ছিলাম না। এবারও চাইছি না। কিন্তু আমার বর্তমান সময় কাটছে ভীষণ ছোটাছুটিতে। আমাকে বিশেষ কাজে ঢাকায় যেতে হয়েছিল। কাজ ঢাকায় থাকলেও আমি উঠেছিলাম টঙ্গীতে আমার এক আত্মীয়ের বাসায়। নওগাঁ থেকে টঙ্গী,টঙ্গী থেকে ঢাকা, আবার ঢাকা থেকে টঙ্গী, তারপর টঙ্গী থেকে নওগাঁ—টানা তিনচার দিন এই ভ্রমণ চক্রে কেটেছে আমার। আমি বাসায় ফিরেছি গতকাল সন্ধ্যায়। তার উপর আমার মোশন সিকনেস আছে। বাস জার্নিতে তা প্রবল। এত শরীর খারাপ হয়েছিল যে আমি মোবাইল স্ক্রিনের দিকে দু’মিনিট তাকিয়েই থাকতে পারছিলাম না; লেখা তো দূর। সেকারণেই এই দেরি।আর আমার ব্যস্ততা কিন্তু এতেই শেষ নয়। আপনারা হয়তো অনেকে জানেন যে আমি এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। আমাকে ভাইভা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যেতে হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। আজ এখানে, তো কাল সেখানে। তার উপর কোথায় ভর্তি হবো, সে নিয়েও চিন্তার শেষ নেই। আবার বগুড়াতে আমার কলেজেও যেতে হবে কিছু কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য। সব মিলিয়ে আমি রীতিমতো দৌড়ের উপর আছি। সেকারণেই এত অনিয়মিত লেখা হচ্ছে। আমি দুঃখিত।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here