নিরব রদনে পব-১৬

0
939

#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:১৬
.
.
.
কঙ্কা এই প্রচন্ড শীতের ভরসন্ধ্যাবেলায় গোসল করেছে। তার ঠান্ডা লাগছে বলে মনে হচ্ছে না। তার শরীর এতটুকু কম্পিত হচ্ছে না। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ আয়েশ করে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে সে। অদূরে বিছানায় আবির বসে আছে। সে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে কঙ্কাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কঙ্কার হাবভাব অন্যরকম লাগছে। কঙ্কার ঠোঁটে হাসির রেখা। হাসিটা কেমন যেন। আনন্দের নয়, আবার ভান করা হাসিও নয়। কেউ একইসাথে আনন্দে এবং কষ্টে থাকলে হয়তো এভাবে হাসে। কিন্তু একইসাথে কি দুটো বিপরীত অনুভূতি অনুভব করা সম্ভব? পদার্থ একটা বিশেষ তাপমাত্রায় একইসাথে তিনটা অবস্থায় থাকতে পারে; যাকে বলে ট্রিপল পয়েন্ট। মানব অনুভূতি কি পদার্থের মতো?
ঘরে আবছা একটা হলুদ আলো জ্বলছে। এই আলোয় ঘরের সব আসবাবপত্র অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে যেন অন্য কোনো ঘর। কঙ্কার চুল মোছা হয়েছে। সে তোয়ালে পাশের চেয়ারে রাখলো। তারপর হাসিমুখে আবিরের দিকে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলো। আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
–দেখো তো, আমাকে কেমন লাগছে?
আবির অনেকক্ষণ থেকেই তাকে দেখছিল। আলাদা করে বলতে হতো না। তবুও কঙ্কা বলল। আবির তখনো তাকেই দেখছিল। কঙ্কা সাদা রঙের ফিনফিনে শাড়ি পরেছে। এতে শরীর ভালোমতো ঢাকা যায় নি। শরীরের অনেকাংশই দৃশ্যমান। কঙ্কাকে ভীষণ আবেদনময়ী লাগছে। আবিরের ভীষণ অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। চিরকাল সব মেয়েকে দেখে চট করে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পরতেই ইচ্ছা করেছে। কিন্তু কঙ্কার ক্ষেত্রে তেমন ইচ্ছা আবিরের হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে, এই রূপবতী তরুণীটি ধীরে ধীরে তার কাছে আসুক, হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকুক, ভালোবেসে নিজে থেকেই খুব কাছাকাছি যাক। সে বেশ বুঝতে পারছে যে কঙ্কা মেয়েটা ধীরে ধীরে তার সর্বনাশ করে দিচ্ছে। অবশ্য এই সর্বনাশে হয়তো ক্ষতি নেই। বিয়ে করাটা শাপে বর হয়েছে তার জন্য।
এই পাতলা শিফনের শাড়িটা আবির কঙ্কার জন্যই কিনেছিল। বিয়ের আগে উপহার হিসেবে এনেছিল শাড়িটা। কিন্তু কঙ্কা নেয় নি। বরং এমন একটা শাড়ি আনার অপরাধে আবিরের সাথে তুমুল ঝগড়াও করেছিল। শাড়িটা আবির আর অন্য কোনো মেয়েকে দেয় নি। রেখে দিয়েছিল আলমারিতে। সে হালকা কেশে জিজ্ঞেস করলো,
–শাড়িটা পরে ফেললে?
কঙ্কা হেসে ফেলে বলল,
–ফেললাম। ভালো লাগছে না?
আবির কঙ্কাকে কাছে টেনে আনলো। গলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বলল,
–খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু সাধারণ সুতির শাড়িতে তোমাকে আরও বেশি সুন্দর লাগে।
কঙ্কা কিঞ্চিৎ চমকালো। এমন কথা আবির আগে কখনো বলে নি। কঙ্কা আবিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
–আগে তো সাধারণ শাড়ি, সাদামাটা পোশাক তোমার পছন্দ ছিল না। তখন তো রাতদিন বলতে আমি নাকি আধুনিকা নই। অতি আধুনিক পোশাক কেন পরি না সেটা নিয়ে তো তোমার সাথে কম ঝগড়াঝাটি হয় নি।
–পোশাকে আধুনিকতা থাকে না, কঙ্কা। আধুনিকতা মননে হয়, মানসিকতায় হয়।
–এই, এটা তো আমার কথা! তোমার আবার এত বুদ্ধি হলো কবে থেকে?
আবির মাথা তুলে কঙ্কার দিকে তাকালো। অবলীলায় বলে দিলো,
–এই বুদ্ধি আমার আগেও ছিল, কঙ্কা। শুধু স্বীকার করতাম না। কারণ আমি আমার তথাকথিত প্রেমিকাদের এমন পোশাকে দেখতে চাইতাম।
কঙ্কা মলিন হেসে প্রশ্ন করলো,
–আমাকে এমন পোশাকে দেখতে চাও না?
–না।
–কেন?
–কারণ তুমি আমার স্ত্রী। প্রেমিকা নও। অতি সাধারণভাবে থাকলেও তুমি আমার চোখে সুন্দর।
কঙ্কা ভ্রু কুঁচকে বলল,
–ব্যাপারটা কি তোমার? আজকাল অন্য সুর গাইছো যে?
আবির মৃদু হেসে বলল,
–ব্যাপারটা নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি বোধহয় বদলে যাচ্ছি।
–মানুষ এত সহজে বদলায় না।
–হয়তো তাই। আমি ঠিক জানি না। তবে তুমি যদি মাঝেমধ্যে এমন পোশাক পরে ফেলো, তাহলে খুব একটা অসুবিধা নেই।
কঙ্কা হেসে ফেললো। সাথে আবিরও হাসলো। খানিক পরেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
–কঙ্কা, একটা সত্যি কথা বলো।
কঙ্কা ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কি?
আবির কঙ্কার দুই গালে হাত রাখলো। চোখের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় প্রশ্ন করলো,
–সারাটাদিন কোথায় ছিলে? আমি জানি, শুধু গয়না ফেরত পাঠাতে তুমি যাও নি। আর কোথায় গিয়েছিলে, কঙ্কা? বলো আমাকে।
কঙ্কা কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থাকলো আবিরের দিকে। তারপর হঠাৎ হেসে উঠলো। হেসে ভেঙে পরতে পরতে বলল,
–তোমার সর্বনাশ করতে। শুধু তোমার নয়, অন্যদিক থেকে ভাবলে আমারও সর্বনাশ বটে। তবে কিছু মানুষের এতে ভালোও হবে। কথায় বলে না? কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ।
আবির ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কঙ্কার কথার একবিন্দু সে বুঝলো না। কঙ্কা বিছানায় শুয়ে পরলো। সে এখনো হাসছে। কেন যেন এই হাসিটা আবিরের খুব কানে লাগছে। অসহ্য বোধ হচ্ছে। আবির প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল,
–কঙ্কা, হাসি বন্ধ করো।
আবিরের কথাটা কঙ্কার হাসির রিনিঝিনি শব্দের নিচে চাপা পরে গেল। আবির এবার কঙ্কার কাছে এগিয়ে গেল। হুট করে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে কঙ্কার হাসি বন্ধ করে দিলো। কঙ্কা প্রথমটায় চমকালো। কিন্তু ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আবির ধীরে ধীরে কঙ্কাকে ছেড়ে দিলো। কঙ্কা চোখ খুলে আবিরের দিকে তাকালো। আবির ফিসফিস করে বলল,
–তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, কঙ্কা।
কঙ্কা হতভম্ব হয়ে গেল। অত্যাশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো সে। এই কথা আবির আগেও বহুবার তাকে বলেছে। কিন্তু এমন অনুভূতি আগে কখনো হয় নি, যা এইমাত্র হলো। আবির কি ভান করছে? কই? ওর চোখে তো কোনো কপটতা নেই। কঙ্কা তাকিয়েই রইলো। তার গলা থেকে স্বর বেরুলো না। আবির নিজে থেকেই বলল,
–অনেক আগেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। বুঝলাম এত দেরিতে। আমার সাথে আজীবন থেকে যাও, কঙ্কা। তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমাকে শুদ্ধ করো।
কঙ্কার চোখে জল এসে গেল। সে আধভাঙা গলায় বলল,
–ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে শুদ্ধ করা যায়?
–যায়। নিশ্চয়ই যায়।
কঙ্কা মুখ ঘুরিয়ে হাসলো। আবির আবারও এগিয়ে যাচ্ছিলো কঙ্কার দিকে। হঠাৎই দরজায় টোকা পরলো। অযাচিনী এসেছে। সে বাইরে থেকে ডাকছে।
–ভাবি, আপনাদের খাবার এনেছি।
আবির বিরক্তি নিয়ে বলল,
–আসার আর সময় পেলো না।
কঙ্কা হেসে ফেললো। আবিরকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো। গলা উঁচিয়ে বলল,
–আসছি, অযাচিনী।
কঙ্কা বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
___________________________
সুরমা সকাল সকাল তার খালার বাসায় এসেছে। সাথে শাদাবও আছে। বেশ কিছুদিন পরে এসেছে বলে ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে সুরমা ভেতরে ঢুকলো। কিন্তু ভেতরে যেতেই সুরমার মুখ কালো হয়ে গেল। কারণ আয়েশা বেগম হাহাকার করে কাঁদছেন। কলিমউদ্দিন সাহেব চিন্তিত মুখে বসে আছেন। বিষম গভীর ব্যথার চিহ্ন উনার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে। পাশেই নীলয় মুখ কালো করে বসে আছে। সুরমা থমথমে গলায় বলে উঠলো,
–কি হয়েছে?
সুরমার গলা পেয়ে সবাই দরজার দিকে তাকালো। আয়েশা বেগম তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ালেন। চোখমুখ মুছে ফেলে হাসার চেষ্টা করলেন। হঠাৎ করে বাড়ির জামাই সামনে চলে আসায় তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন। উনার অস্বস্তি কাটাতে শাদাব হাসিমুখে বলল,
–আসসালামু আলাইকুম, খালা। ভালো আছেন?
আয়েশা কোনোরকমে জবাব দিলেন,
–ওয়া আলাইকুম সালাম। এসো, বাবা। ভেতরে এসো। সুরমা, ভালো আছিস মা?
সুরমা শাদাবকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। শাদাব এগিয়ে গিয়ে কলিমউদ্দিন সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
–আসসালামু আলাইকুম, খালুজান।
কলিমউদ্দিন সাহেব মুখে হাসি টেনে হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন,
–ওয়া আলাইকুম সালাম, বাবা। ভালো আছ?শাদাব উনার হাত ধরে উত্তর দিলো,
–আলহামদুলিল্লাহ, খালুজান। আপনাদের খবর ভালো?
–আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ রেখেছেন ভালো। কলিমউদ্দিন সাহেব এবার সুরমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–আমার বড় আম্মাজান ভালো আছে?
সুরমা এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। শুকনো গলায় জানতে চাইলো,
–আমি ঠিক আছি। তোমাদের কি হয়েছে আমাকে কি কেউ বলবে?
কেউ কোনো উত্তর দিলো না। সুরমা উত্তরের আশায় বারকয়েক সবার মুখের দিকে তাকালো। তারপর আয়েশার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,
–খালা, আমাকে বলো।
আয়েশা বেগম আমতা আমতা করে বললেন,
–কিছু না। জামাইকে নিয়ে ঘরে যা, মা। এতদূর থেকে এসেছিস। হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম কর। আমি খাবার দাবারের ব্যবস্থা করছি।
সুরমা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর হতাশ গলায় বলল,
–থাক, বলতে হবে না। বিয়ে হয়েছে বলে তো আমি এখন পর।
কলিমউদ্দিন সাহেব কোমল গলায় বললেন,
–না, মা। তোমরা মাত্রই এসেছ। আগে একটু স্থির হও, তারপর না হয় সব শুনবা। এখন ঘরে যাও, মা। আয়েশা, ওদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো।
আয়েশা মাথা নাড়লেন। তারপর ফতিকে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। নীলয় এগিয়ে এসে শাদাবের হাত থেকে ব্যাগটা নিলো। হাসিমুখে বলল,
–ভেতরে আসুন, দুলাভাই। এসো, আপা।
নীলয় ব্যাগটা সুরমার ঘরে পৌঁছে দিলো। সুরমা প্রশ্ন করলো,
–ভাই, কি হয়েছে? আমাকে বল।
নীলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–কঙ্কা চাচীর গয়নাগুলো ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে।
শাদাব বিছানায় বসতে বসতে বলল,
–গয়না ফেরত পাঠিয়েছে বুঝলাম। এটা এত বেশি কান্নাকাটির কথা নয়। গয়নার সাথে আর কি পাঠিয়েছে সেটা বলো।
নীলয় ইতস্তত করে বলল,
–একটা চিঠি পাঠিয়েছে।
সুরমা অস্থির হয়ে বলল,
–চিঠি! কঙ্কার চিঠি? কি লিখেছে, ভাই? আমাকে দেখা।
চিঠিটা নীলয়ের পকেটেই ছিল। সে নিঃশব্দে পকেট থেকে সেটা বের করে দিলো। সুরমা তাড়াহুড়ো করে সেটা নিয়ে শাদাবের পাশে বসলো। দুজন একসাথেই চিঠিটা পড়লো। চিঠিতে মাত্র পাঁচটা লাইন লেখা। কঙ্কা লিখেছে,
” বাবা,
তুমি এতদিনে নিশ্চয়ই আবির সম্পর্কে সব খোঁজখবর নিয়ে ফেলেছ এবং আমি এখন কোথায় আছি তাও নিশ্চয়ই জেনেছ। তোমরা চিন্তা করো না। আমি কাজটা নিরুপায় হয়ে করেছি। আমার কাজ প্রায় শেষ। আমি শীঘ্রই ফিরে আসবো তোমাদের কাছে।
ইতি,
কঙ্কা।
পুনশ্চ: আমাকে ফিরিয়ে নেবে তো?”
শাদাব মাথা তুলে নীলয়ের দিকে তাকালো। প্রশ্ন করলো,
–খালা কাঁদছেন কেন? আবিরের সম্পর্কে সব জেনে? নাকি কঙ্কা সংসার ভেঙে চলে আসছে বলে?
নীলয় ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–দুটোই। কঙ্কার ভবিষ্যৎ কি হবে সেই চিন্তায়। আর ও কেন জেনেশুনে আবিরের সাথে গেল, সেই আফসোসে।
সুরমা কথা বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে রইলো। মেয়েটা কোন কাজের কথা বলল?
____________________________
রিকশা চলছে উল্কার গতিতে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যার শীতল বাতাস ভেদ করে ছুটছে রিকশা। নীলয় রিকশায় বসে আছে। তার পাশে বসে আছে পুতুল। মেয়েটা আজও শাড়ি পরেছে। শাড়ির উপরে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে রেখেছে। চুলগুলো বাঁধা আছে খোঁপায়। ঠান্ডা বাতাসে তার ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে। নীলয় জড়সড় হয়ে বসে আছে। পরনের সোয়েটার শীত আটকাতে পারছে না। পুতুল তার সাথে একই রিকশায় উঠতে রাজি হয়েছে, সেটা সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। সে আচ্ছন্নের মতো বসে আছে। আজ সকালের পত্রিকায় তার যে কবিতা ছাপা হয়েছে সে কবিতা সম্পর্কে কিছু প্রশংসাসূচক বাক্য পুতুলের মুখ থেকে শোনার জন্য তার মনটা আঁকুপাঁকু করছে।
পুতুল চাদর আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে বলল,
–আপনার সমস্যার কথা শুনলাম। যা বুঝলাম তা হলো, চিন্তার কোনো কারণ নেই।
নীলয় অস্পষ্ট গলায় বলল,
–নেই?
–না, নেই। আপনি বলেছেন যে কঙ্কা বুদ্ধিমতী। সে কিছু একটা ভেবেই একাজ করেছে। তাছাড়া ও যখন বলেছে যে ফিরবে তখন ঠিকই ফিরবে।
–ও!
–আপনি চিন্তা করবেন না। কঙ্কা ঠিকই ফিরে আসবে। তখন আপনারা বিয়ে করে নেবেন।
নীলয় চমকে উঠে বলল,
–আমি কঙ্কাকে বিয়ে করতে কখন চেয়েছি?
পুতুল হেসে ফেলে বলল,
–চান না?
–না। কখনো চাইও নি।
–কেন? কঙ্কা তো আপনাকে ভালোবাসতো। আপনিও তো বাসতেন। অস্বীকার করতে চান?
–না, পুতুল। অস্বীকার করছি না। কিন্তু বিয়ে করতে চাই নি। কারণ কঙ্কার বাবা আমাকে মানুষ করেছেন। চাচা আমার কাছে ফেরেশতা। আমি এমন কিছু করতে চাই নি যাতে উনি কষ্ট পান।
–কঙ্কার সাথে আপনার বিয়ে হলে উনি কষ্ট পাবেন কেন? উনি আপনাকে ছোট থেকে জানেন। আপনার স্বভাব চরিত্র তো খারাপ নয়। আজকাল যেখানে ভালো মানুষ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল, সেখানে আপনাকে নিজেদের মেয়ের জন্য পেলে হয়তো উনারা খুশিই হতেন। আগে থেকেই কেন ভেবে নিলেন যে উনারা কষ্ট পাবেন?
নীলয় ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–আমার ভয় হতো, পুতুল। মা বাবাকে হারিয়ে যে ভালোবাসার আশ্রয় পেয়েছি, সেই ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার ভয়। আর তাছাড়া….
–তাছাড়া কি?
–আমার মতো ভবঘুরে ছেলেকে মেয়ের জামাই হিসেবে পেয়ে কষ্টই পাওয়ার কথা। কোনো মা বাবাই এতে সুখী হবে না।
পুতুল হেসে ফেললো। অবলীলায় বলে ফেললো,
–তা ঠিক। আমার বাবাকে আপনার কথা বলেছিলাম। বাবা আঁতকে উঠে বললেন, “মাই গড! ওই ভবঘুরে ছেলেকে তোর পছন্দ হলো?” বাবার চিন্তা দেখে আমি হেসে ফেললাম।
নীলয় পুতুলের দিকে তাকালো। পুতুলকে খুব সুন্দর লাগছে। রিকশা সিগন্যালে পরেছে। একটা বাচ্চা ছেলে গোলাপ ফুল বিক্রি করছে, টকটকে লাল গোলাপ। ছেলেটা তাদের রিকশার কাছে এসে বলল,
–ভাইজান, আপার জন্যে ফুল নিবেন?
নীলয় কিছু বলার আগেই পুতুল বলল,
–তোমার ভাইজান নেবেন না। আমি নেবো। আগে বলো, তোমার নাম কি?
বাচ্চা ছেলেটা উত্তর দিলো,
–ফরহাদ।
–তুমি স্কুলে যাও?
–যাই।
–কোন ক্লাসে পড়ো?
–ওয়ান।
–তোমার মা বাবা কোথায়?
ফরহাদ অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল,
–মা নাই। আব্বা ওই রাস্তায় চা কফি বেঁচে।
–বাহ! বেশ ভালো। একদিন এসে তোমার আব্বার চা কফি খেয়ে যাব। এখন বলো, তোমার ফুলের দাম কত?
–১০ ট্যাকা কইরা।
–আচ্ছা, একটা দাও।
ছেলেটা সবগুলো ফুল এগিয়ে দিয়ে বলল,
–যেইডা ভাল্লাগে নেন।
পুতুল হেসে বলল,
–তোমার যেটা ভালো লাগে সেটাই দাও।
ছেলেটা একটা গোলাপ তুলে পুতুলের হাতে নিলো। পুতুল একশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–এটা রাখো।
–ভাঙতি নাই, আপা।
–ভাঙতি নেই? আচ্ছা, থাক। আজ ভাঙতি দিতে হবে না। পরে দিয়ো। আর এখন আমাকে বলো এই ফুলটা আমি কাকে দেবো?
ফরহাদ মাথা চুলকে বলল,
–ভাইজানরে দেন।
পুতুল হেসে উঠে বলল,
–উঁহু। তোমার ভাইজানের থেকে তোমাকে আমার বেশি পছন্দ হয়েছে। এই ফুল তোমার জন্য। নাও।
ফরহাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ইতোমধ্যে সিগন্যাল খুলে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। এগোতে শুরু করেছে তাদের রিকশাও। পুতুল তাড়াহুড়ো করে বলল,
–জলদি নাও। এটা আমি তোমাকে দিতে চাই।
ফরহাদ নামক বাচ্চা ছেলেটি খুব দ্রুত ফুলটা নিলো। রিকশা এগিয়ে গেল। নীলয় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো পুতুলের দিকে। তার মনে হলো, মেয়েটা অদ্ভুতভাবে অসাধারণ।
পুতুল নীলয়ের দিকে না তাকিয়েই বলল,
–কবি সাহেব, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আসলে আমি আপনার কবিতার প্রেমে পরেছি। আর আমি জানি আপনিও আমার প্রতি কিছুটা দূর্বলতা অনুভব করছেন।
নীলয় অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কি বলবে ভেবে পেলো না। পুতুল অবশ্য উত্তরের অপেক্ষাও করলো না। আবার বলল,
–কবি সাহেব, আপনি আসলে আমার প্রতি দুর্বল নন। আপনি দুর্বল আমার করা প্রশংসার প্রতি। সব কবিই চান তার কবিতার প্রতি কেউ মুগ্ধ হয়ে থাকুক। আপনার অবচেতন মনও তাই চাইছে। সে কারণেই আপনি বারবার আমার কাছে আসছেন। কিন্তু আমার সাথে থাকলে আমার প্রতিও আপনি দুর্বল হয়ে পরবেন। তাই আপনার সাথে আমার আর কথাবার্তা না হওয়াই ভালো। কারণ আপনাকে থাকতে হবে কঙ্কার জন্য। বুঝতে পারছেন?
নীলয় অস্ফুটে বলল,
–না।
–বুঝতে হবে না। আপনি রিকশা থেকে নামুন। অন্য একটা রিকশা নিয়ে বাসায় চলে যান।
পুতুল রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে বলল,
–মামা, দাঁড়ান।
রিকশা রাস্তার ধারে দাঁড়ালো। পুতুল নিষ্ঠুরের মতো বলল,
–নামুন, নীলয় সাহেব।
নীলয় নিঃশব্দে রিকশা থেকে নেমে পরলো। ততক্ষণ পর্যন্ত তাকিয়ে থাকলো যতক্ষণ না রিকশাটা অদৃশ্য হয়ে যায়।
.
#চলবে……….
(এই কয়েকদিনের ঘটনাগুলো আপনাদের একটু সংক্ষেপে বলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ভর্তির ঝামেলা শেষ হওয়ার দুদিনের মধ্যে ক্লাস শুরু। ইউনিভার্সিটির আশেপাশে আমার কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। আর ইউনিভার্সিটির হলে এক্ষুনি সিট পাওয়া সম্ভব নয়, সেটা আপনারা কম বেশি সবাই জানেন। কাজেই আমাকে খুঁজতে হলো একটা হোস্টেল। তারপর বাসায় গিয়ে একদিনের মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়ে আবার আসতে হলো ঢাকায়। তাড়াহুড়ো করে যে হোস্টেলে উঠেছি সেখানে আবার নিজে নিজে রান্না করে নিতে হয়। নতুন জায়গায় মানিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। পাশাপাশি পরিবার ছেড়ে প্রথমবার থাকছি। কাজেই মন ভীষণ অস্থির হয়ে ছিল। তার উপর গত দু’দিন থেকে জ্বরে পরে আছি। বাসায় থাকাকালীন জ্বরে পরা আর হোস্টেলে একা থাকাবস্থায় জ্বরে পরা, দুটো দুরকম জিনিস। এই সবকিছু মিলিয়ে আমি গল্প লিখে উঠতে পারছিলাম না। মানুষ সহানুভূতিশীল প্রাণী। কাজেই আমার পাঠকগণ নিশ্চয়ই আমার অসুবিধাগুলো বুঝে আমার প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন এবং অনেকে যে ইতোমধ্যে হয়েছেন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আর এই পর্ব জ্বর নিয়েই লিখেছি। কাজেই ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।)
বি.দ্র: পেইজের রিচ শূন্য। আপনারা আজকের পর্বে দয়া করে রিয়্যাক্ট কমেন্ট করার চেষ্টা করবেন। রিচ বাড়লে প্রতিদিন ছোট করে হলেও একটা করে পর্ব দেবো ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here