নিরব রদনে পর্ব-২০

0
1108

#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:২০
.
.
.
রাত পেরিয়ে সকাল হলো। সকালের আলো পৃথিবীতে পরতেই মানুষের ছুটে চলা শুরু হলো। বাগানে বসন্তের ফুল ফুটলো। কোকিলের কুহুরবে চারদিক মুখরিত হলো। সেই সাথে কঙ্কাও শুরু করলো আবারও নতুন একটা পথে যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি। জীবন তাকে কোন পথে নিয়ে যাবে তা কেবল জীবনের অধিকারীই জানেন।
কঙ্কা আজ সকাল থেকেই সমস্ত কাজকর্ম বিশেষ উৎসাহ নিয়ে করছে। তার মনের রাজ্যের উদ্বেগ, উৎকন্ঠা আর দোটানার ঢেউকে মনের ভেতরেই চাপা দিয়ে রেখেছে সে। মনে মনে নিজেকেই বাহবা দিচ্ছে বারবার। “দারুণ, কঙ্কা! অভিনয়ে তুই অনন্য।” কঙ্কা খুব মনোযোগ দিয়ে নাস্তা বানাচ্ছিল। অযাচিনী বাগান থেকে ভেতরে ঢুকেই চমকে গেল। কঙ্কাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
–আপনি নাস্তা বানাচ্ছেন?
কঙ্কা একবার চোখ তুলে তাকালো। তারপর হাসিমুখে বলল,
–হ্যাঁ। এখন মা আমার হাতের রান্না খেতে আপত্তি করবেন না।
অযাচিনী হাসলো। এগিয়ে গিয়ে কঙ্কার পাশে দাঁড়ালো। কঙ্কার শাড়ির আঁচলটা ধরে বলল,
–ভাবি, আপনাকে এই শাড়িতে খুব মানিয়েছে।
কঙ্কা নিজের সাদা জামদানির দিকে একবার তাকালো। তারপর মুখে হাসি টেনে বলল,
–এটা আমাকে মা দিয়েছেন।
অযাচিনী হকচকিয়ে বলল,
–মা! মানে ম্যাডাম?
–হ্যাঁ, তোমার ম্যাডাম।
–ম্যাডামের শরীর এখন কেমন?
–জ্বর নেই। শরীর কিছুটা দুর্বল। তুমি বাবাকে চা আর মেহগনি বীজ ভেজানো পানি দিয়ে এসেছ?
–হ্যাঁ, দিয়েছি। আমি কি আপনাকে একটু সাহায্য করে দেবো?
কঙ্কা এ প্রশ্নের উত্তর দিলো না। কড়াইয়ে তেল দিতে দিতে হুট করে প্রশ্ন করে বসলো,
–অযাচিনী, নিজের বাবাকে বাবু সাহেব ডাকার অনুভূতিটা আসলে কেমন?
প্রশ্নটা কানে যেতেই অযাচিনী হতভম্ব হয়ে গেল। এক মুহূর্তেই তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। বিস্ফারিত নেত্র স্থির হলো সামনের ভাবলেশহীন মানুষটার দিকে। কাঠের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল পুরো শরীর। কঙ্কা কিন্তু অযাচিনীর এই বিমূর্ত ভাবটাকে গুরুত্বই দিলো না। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল,
–তুমি একদিন বলেছিলে এই বাড়িতে অনেক রহস্য। আমি বলেছিলাম, আমার অনেক বুদ্ধি। আমি সবটাই একদিন বুঝে ফেলবো। আমি বোধহয় বুঝে ফেলেছি, অযাচিনী।
অযাচিনীর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। অশ্রু চোখের গন্ডি পেরোতেই সে মাথা নিচু করে ফেললো। কঙ্কা কোমল গলায় বলল,
–কেঁদো না, অযাচিনী। তোমার চোখে জল মানায় না। আমি তোমাকে একটা কথা বলি। শুনবে?
অযাচিনী চোখ মুছতে মুছতে বলল,
–বলুন।
কঙ্কা শীতল গলায় বলল,
–বাবাকে এখন থেকে বাবা বলেই ডেকো। উনি তোমার মুখে বাবা ডাক শোনার জন্য ভীষণ ছটফট করেন।
অযাচিনী কঠিন গলায় বলল,
–কখনো না। এই পৃথিবীতে উনাকেই আমি সবথেকে বেশি ঘৃণা করি।
–যতই ঘৃণা করো না কেন, নিজের জন্মপরিচয় তো আর মুছে ফেলতে পারবে না। তাই না?
অযাচিনী অসহায় দৃষ্টিতে কঙ্কার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই চোখেমুখে কঠিন ভাব এনে বলল,
–কে বলেছে পারবো না? আমি পেরেছি। আমি কখনো উনার মেয়ে বলে নিজেকে পরিচয় দেই না।
কঙ্কা মৃদু হেসে বলল,
–অযাচিনী, তুমি তো পড়াশোনা করেছ। এখনো পড়ছো। তোমার নিশ্চয়ই বার্থ সার্টিফিকেট, পরিচয়পত্র, এসব আছে। সেসবে তোমার বাবার নামের জায়গায় কার নাম লেখা আছে?
অযাচিনীর মুখ কালিবর্ণ হয়ে গেল। সে কথা বলতে পারলো না। কঙ্কার পরোটা ভাজা শেষ। সে চুলা বন্ধ করলো। অযাচিনীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
–চাইলেই পিতৃ পরিচয় মুছে ফেলা যায় না, অযাচিনী। তুমি অস্বীকার করলেই তো আর এটা মিথ্যা হয়ে যাবে না যে তুমি উনারই সন্তান।
অযাচিনী দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–আপনি ঠিক বলেছেন, ভাবি। এটাও কখনো মিথ্যা হয়ে যাবে না যে আমি উনার অবৈধ সন্তান। এটাও মিথ্যা হয়ে যাবে না যে আমার জন্মের পরে আমাকে নিয়ে এলাকায় থাকতে না পেরে আমার মা আত্মহত্যা করেছিলেন ওই লোকটার জন্য। কোনোকিছুই মিথ্যা হবে না। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন উনাকে এত ঘৃণা করা সত্ত্বেও কেন আমি উনার আশ্রয়েই রয়েছি। আমি আছি কারণ আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এই একটা মাত্র জায়গাতেই আমার আর ম্যাডামের ভীষণ মিল। আপনি ঠিকই বলেছেন, ভাবি। কোনো সত্যিকেই মুছে ফেলা যায় না। মানুষ যতই বদলাক, তাদের পাপগুলো যতই অতীত হয়ে যাক, তাদের পাপের তাপে অন্যদের যে ক্ষতিগুলো হয়েছে সেগুলো কখনো মোছা যায় না। কখনো না।
অযাচিনী চলে গেল। কঙ্কা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কি গভীর একটা কথা মেয়েটা বলে গেল! সত্যিই তো! আবির অতীতে যাদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাদের সেই ক্ষতির কি পূরণ আছে? বিয়ের আগে আবির তাকে অচেতন করে সুযোগ নিয়েছিল। এই সত্যই বা কঙ্কা মুছে ফেলবে কি করে? কিছুতেই যে সম্ভব নয়! কঙ্কার মুখে চিন্তার ছাপ। অযাচিনীর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তার শাশুড়ি মায়েরও নেই। তার নিজের কি আছে? সে তো নিজের মা বাবার কাছে ফিরে যাবে বলে ভেবেছে। কিন্তু সত্যিই কি তার সেখানে জায়গা হবে? যদি না হয়, তবে কোথায় যাবে সে?
_______________________
আশরাফউদ্দিন সাহেব সবেমাত্রই মেহগনি বীজ ভেজানো পানিটা শেষ করেছেন। বাগানে হাঁটতে হাঁটতে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন তিনি। ডালিয়া ফুলগুলো ভীষণ সুন্দর হয়ে ফুটেছে। সেদিকে এগিয়ে যেতেই মূল দরজার কাছে কিঞ্চিৎ শোরগোলের শব্দ কানে এলো উনার। আশরাফউদ্দিন সাহেবের ভ্রু কুঁচকে গেল। সকাল সকাল কিসের এত হট্টগোল? উনি চায়ের কাপ বকুল গাছের নিচে পাতা টেবিলে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। আশরাফউদ্দিন সাহেবের বাড়িটা কিছুটা জাপানি ধাঁচের। মূল দরজার পরে মূল বাড়ি, আর বাড়ির পেছনে প্রশস্ত বাগান। বাগান থেকে মূল দরজা দেখা যায় না। আশরাফউদ্দিনকে বাগান থেকে হেঁটে আসতে হলো দরজা পর্যন্ত। লোহার গেইট এখনো তালাবন্ধ। ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি গলা ভেসে আসছে। ভেতর থেকে দারোয়ান বিরক্ত গলায় কিছু বলে চলেছে। আশরাফউদ্দিন সাহেব দারোয়ানকে ডাকলেন। দারোয়ান প্রায় ছুটে গেল। আশরাফউদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন,
–হয়েছে কি?
দারোয়ান কাঁচুমাচু করে বলল,
–এক অল্পবয়সী মেয়ে আসছে, স্যার। নাম বলছে পানশি। বাসার ভেতরে ঢুকতে চায়। সাথে একটা বাচ্চা আছে।
–কি দরকার কিছু বলেছে?
–জ্বি না। খালি বলতাছে ভেতরে এসে বলবে।
–যতক্ষণ না বলছে কি দরকার, ততক্ষণ ভেতরে ঢুকতে দেবে না।
–জ্বি আচ্ছা, স্যার।
আশরাফউদ্দিন আবার বাগানের দিকে চলে গেলেন। অল্পবয়সী একটি মেয়ে কোন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে একটা বাচ্চাকে নিয়ে এ বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সেটা একবার ভেবে দেখারও প্রয়োজন বোধ করলেন না তিনি। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বাগানের ফুল পরিদর্শনে পুনরায় মনোনিবেশ করলেন। গোলাপ গাছগুলো মরে গেছে। মালিকে ডেকে কিছু কঠিন কথা শোনানো দরকার। অসুবিধা হলো মালি আজ আসে নি। এই মালিকে কাজ থেকে বাদ দেওয়া দরকার। এমন বেখেয়ালি আচরণের পরে আর রাখা যায় না। একজন দায়িত্বরত মালি থাকা সত্ত্বেও মরা গাছ বাগানে থাকে কি করে? উনার মা বলতেন, মরা গাছ বাড়ির বাগানে রাখলে মান সম্মানের জলাঞ্জলি হয়। আশরাফউদ্দিন সাহেব নিজেই গাছ দুটো উপড়ে ফেললেন। তারপর গলা উঁচিয়ে মজনুকে ডাকলেন,
–মজনু, শুনে যা।
মজনু অনতিবিলম্বে এসে উপস্থিত হলো। আশরাফউদ্দিন সাহেব বললেন,
–এই জায়গাটা একটু পরিষ্কার করে দে।
মজনু মাথা নেড়ে বলল, “জ্বি আচ্ছা”।
আশরাফউদ্দিন বকুল গাছের তলায় গিয়ে বসলেন। টেবিলে রাখা কাপ হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, খেতে ভালো লাগছে না।
বাইরের হট্টগোল থামে নি। বরং আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আশরাফউদ্দিনের ভ্রু কুঁচকে গেল। দারোয়ান দূর থেকে দৌড়ে আসছে। সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল,
–স্যার, বিরাট ঝামেলা হয়ে গেছে। একটু বাইরে আসেন।
আশরাফউদ্দিন বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দরজার কাছে যেতেই তিনি কিছুটা ধাক্কার মতো খেলেন। বাসার সামনে একটা জটলা পেকেছে। আশেপাশের প্রতিবেশিরা এসে জমা হয়েছে। রাস্তার কিছু উৎসুক জনতাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। নানান রকম শোরগোল শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। আশরাফউদ্দিন সাহেব পানশির শেষ কথাটা শুনতে পেলেন। পানশি মেয়েটা কাঁদছে আর সামনে জড় হওয়া মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে বলছে,
–এখন আমি আমার মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাব আপনারাই বলুন? আমার নিজের জন্য কিছু চাই না কিন্তু আমার সন্তানের অধিকার আমি চাই।
সামনে দাঁড়ানো প্রত্যেকটা মানুষ পানশির কথায় সায় জানালো। অনেকে কানাঘুঁষা করছে। কয়েকজন মুরুব্বি বেশ শক্ত গলায় বলছেন,
–আমরা তোমার পাশে আছি। তুমি কিচ্ছু ভেবো না।
আশরাফউদ্দিন সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যাপারটা দেখছিলেন জাহানারা। কথাবার্তাগুলো শুনে তিনি জ্ঞান হারালেন।
_______________________
বেলা পরে এসেছে। আজ আকাশটা বেশ মেঘলা। বিকালের সূর্য ঢাকা পরে আছে মলিন মেঘে। সুরমা রান্নাঘরে খাবার সাজাচ্ছে। ফতি তাকে সাহায্য করে দিচ্ছে। আয়েশার শরীর খারাপের কথা শুনে সুরমা আজ সকালে এই বাসায় এসেছে। শাদাব অফিস যাওয়ার আগে তাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে। আয়েশা বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন। আজ সারাটা দুপুর তিনি ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। বিকালের দিকে ঘুম ভাঙার আগে তিনি একটা স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নে দেখেছেন এই বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে। খুব ধুমধাম করে বিয়ে হচ্ছে কঙ্কার। কঙ্কা হাসিহাসি মুখ করে কনের সাজে বসে আছে। তিনি যখন কঙ্কার কাছে গিয়ে বসলেন তখন কঙ্কা হুট করে বলে উঠলো,
–মা, আমার ছেলেটাকে সাজিয়ে দিয়েছ তো? ওকেও তো আমার সাথে নিয়ে যাব।
আয়েশা আঁতকে উঠে বললেন,
–এসব কি বলছিস? তোর ছেলে মানে? তোর তো বিয়েই হচ্ছে আজকে।
কঙ্কা হাসতে হাসতে বলল,
–যাও, মা! আমার যে ছেলেসহ বিয়ে হচ্ছে সেটা বুঝি তুমি জানো না?
এই জায়গায় এসে আয়েশার ঘুম ভেঙে গেছে। স্বপ্নের মানে উনি বুঝতে পারেন নি। সুরমা বলেছে দিনের বেলায় ঘুমালে এমন উল্টোপাল্টা স্বপ্ন আসে। এটা খুবই তুচ্ছ বিষয়। কিন্তু আয়েশা বেগম কিছুতেই এই স্বপ্নের কথাটা ভুলতে পারছেন না। উনার দাদি বলতেন, বিয়ের স্বপ্ন দেখলে বাড়িতে মৃত্যু আসে। কার মৃত্যু আসবে এ বাড়িতে?
সুরমা খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো। বিছানায় বসে তাড়াহুড়ো করে বলল,
–খালা, নাও। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।
আয়েশার ভাবনা ভাঙলো। তিনি অস্থির হয়ে বললেন,
–একি? তুই এত ছোটাছুটি করছিস কেন এই অবস্থায়?
–কই? ছোটাছুটি করছি না। ফতিই সব রান্না করেছে। আমি শুধু নিয়ে এসেছি।
আয়েশা বেগম সুরমার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন,
–কোথায় তোর এই সময় আমি তোর যত্ন করবো? তা না, তুই আমার খেয়াল রাখছিস!
সুরমা হাসলো। খালার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলল,
–আগে সুস্থ হও। আমার খেয়াল রাখতে না পারলেও যে আসছে, তার খেয়াল কিন্তু তোমাকেই রাখতে হবে।
আয়েশা হেসে বললেন,
–আল্লাহ আমাকে সে সুযোগ দেবেন কিনা বুঝতে পারছি না।
সুরমা হকচকিয়ে গেল। স্থির দৃষ্টিতে আয়েশার মুখের দিকে তাকালো। আয়েশা বেগম বললেন,
–আজ বিকালে কি জামাই আসবে?
সুরমা আচ্ছন্নের মতো মাথা নেড়ে বলল,
–উঁহু। আজ আসবে না। আমি এখানে কয়েকদিন থাকবো। ও কাল বিকালে আসবে।
–একটা ব্যাপার নিয়ে ওর সাথে একটু কথা বলবো আমি।
সুরমা বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
–কি ব্যাপার?
–আমার নামে যেটুকু সম্পত্তি আছে, সেটা আমি তোকে আর তোর বাচ্চাটাকে দিয়ে যাব। যদি কখনো কঙ্কা ফিরে আসে, তাহলে তুই ওকে কিছু অংশ দিস।
সুরমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে কেন কথা হচ্ছে? খালার অসুখটা আসলে কোন পর্যায়ের?
__________________________
কঙ্কা থম মেরে অযাচিনীর ঘরে বসে আছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাইরে বৃষ্টি পরছে। ভরসন্ধ্যাবেলা হঠাৎই ঝমঝম করে বৃষ্টি পরতে শুরু করলো; মুষলধারায় বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে কঙ্কা কোনো কাজী সাহেবকে এনে হাজির করতে পারে নি। তাই ঠিক করা হয়েছে পানশি আর আবিরের বিয়ে হবে কাল দুপুর জোহরের নামাজের পরে।
পানশির প্রত্যেকটা অভিযোগের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছে আবির। পানশি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরে আবির যে এর দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল এবং বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, সে অভিযোগও আবির অস্বীকার করতে পারে নি। সমস্ত প্রমাণ যখন সবার সামনে, তখন আর অস্বীকার করবেই বা কি করে? কঙ্কা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজলো। জানালা গলে বৃষ্টির ঝাপটা আসছে। উপরের ঘরে জাহানারা থেমে থেমে কাঁদছেন। হাউমাউ করে কান্না। বসন্তের একটানা বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের সাথে জাহানারার কান্নার শব্দ মিলে অদ্ভুত সুরের মতো তৈরি হচ্ছে। অযাচিনী ঘরে ঢুকলো। জানালা বন্ধ করে দিয়ে কঙ্কার দিকে তাকিয়ে বলল,
–ভাবি, আপনি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। চলুন, বসবেন।
কঙ্কা সাথে সাথেই বিছানায় গিয়ে বসলো। অযাচিনী পাশে বসে বলল,
–আপনার কথামতো উপরের একটা ঘর পানশিকে দিয়ে এসেছি।
–ভালো করেছ। আবিরের মেয়েটা কোথায়? কি যেন নাম ওর?
–ওর নাম সন্দেশ। ওর মা ওকে খাইয়ে দিচ্ছে।
–বেশ! খাওয়া শেষ হলে আমি নিজে গিয়ে সন্দেশকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।
–এতটুকু বাচ্চা কি রাতে মাকে ছেড়ে থাকবে?
–থাকবে। আমি বাচ্চাদের ভালো সামলাতে পারি। আর তাছাড়া কাল আবির আর পানশির বিয়ের পরে তো সন্দেশকে আমার কাছেই রাখতে হবে। বাসর রাতে কি আর ওদের সাথে মেয়েটাকে রাখা যায়?
অযাচিনী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আলতো হাতে কঙ্কার হাত স্পর্শ করলো। কোমল গলায় বলল,
–ভাবি, আপনি কিছু খাবেন? বানিয়ে দেব?
কঙ্কা মৃদু হেসে বলল,
–না, অযাচিনী। এসো, আমি আর তুমি গল্প করি। তোমার ছোটবেলার গল্প বলো।
অযাচিনী কিছু বলার আগেই হুট করে ঘরের দরজা খুলে গেল। আবির এসেছে। কঙ্কা হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আবির ভারী গলায় বলল,
–অযাচিনী, বাইরে যাও।
অযাচিনী সঙ্গে সঙ্গে বাইরে চলে গেল। আবির দরজা বন্ধ করে দিয়ে কঙ্কার কাছে এগিয়ে গেল। তীক্ষ্ণ চোখে কঙ্কার দিকে তাকালো। কঙ্কা নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। আবির আহত গলায় প্রশ্ন করলো,
–তুমি ইচ্ছে করেই এসব করেছ। তাই তো?
কঙ্কা স্বাভাবিক গলায় বলল,
–ভুল কিছু তো করি নি। পানশি তোমার সন্তানের মা। সন্দেশ তোমাদের দুজনের মেয়ে। তোমাদের দুজনের কি দায়িত্ব নয় ওকে একটা সুস্থ পরিবার দেওয়া? তুমি কি বাবা হিসেবে নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করতে চাও?
আবির কঙ্কাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,
–আমি বাবা হিসেবে নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করছি না। তুমি দেখো, আমি সন্দেশের চোখে ভালো একজন বাবা হয়ে উঠবো। কিন্তু প্লিজ, আমাকে এই বিয়েটা করতে বলো না। আমি তোমাকে হারাতে চাই না।
–পাগলামি করো না। তুমি বিয়ে করবে না মানে? তুমি যদি বিয়েটা না করো তাহলে পানশির কি হবে ভেবে বলো তো? মেয়েটার ওইটুকু বয়স। ওর অন্য কোথাও বিয়ে হবে? ওর জীবনটা নষ্ট হবে না? তোমার অপকর্মের দায় তোমাকেই নিতে হবে, আবির। তুমি এড়িয়ে যেতে পারবে না।
আবির অস্থির হয়ে বলল,
–কঙ্কা, আমি…..আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ! প্লিজ, কঙ্কা!
কঙ্কা আবিরকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
–সম্ভব নয়। সন্দেশের কথা ভাবো। আর পানশি খুব ভালো মেয়ে। দেখবে, একদিন তুমি ওকেও ভালোবেসে ফেলবে।
আবিরের চোখে পানি এসে গেছে। সে উন্মাদের মতো বলল,
–কঙ্কা, আমার সাথে এত নিষ্ঠুরতা করো না। আমাকে ছেড়ে যেও না। প্লিজ!
কঙ্কা মৃদু হেসে বলল,
–মনে পড়ছে, আবির? কত মেয়ে এভাবে তোমাকে অনুরোধ করেছে যাতে তুমি তাদেরকে ছেড়ে না আসো? তাদের কষ্টটা আজ বুঝতে পারছো?
আবির স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,
–ও! তার মানে তাদের সবার হয়ে প্রতিশোধ নিতেই তুমি আমার কাছে এসেছিলে?
কঙ্কা শক্ত গলায় বলল,
–হ্যাঁ, তাই। এই কষ্টের অনুভূতিটাই আমি তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম। এই যে আজ পাড়াপ্রতিবেশি তোমাদের ছিঃ ছিঃ করছে। এই যন্ত্রণাটাও আমি তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম। এটাই চেয়েছিলাম আমি।
আবির আবার কঙ্কার কাছে এগিয়ে গেল। শক্ত করে কঙ্কাকে নিজের সাথে চেপে ধরলো। হিসহিসিয়ে বলল,
–তুমি সত্যি করে বলো, আমাকে কখনো ভালোবাসো নি তুমি?
কঙ্কা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বলল,
–বেসেছিলাম। কিন্তু সেটা তোমার স্বরূপ জানার আগে। যেদিন আমাকে অচেতন করে আমার সর্বনাশ করেছিলে, সেদিনই সব ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে।
আবির হিসহিসিয়ে বলল,
–মিথ্যা কথা! সত্যি করে বলো, কঙ্কা। বিয়ের পরে এক মুহূর্তের জন্যও কি আমাকে তুমি ভালোবাসো নি?
কঙ্কা আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। কড়া গলায় বলল,
–না, ভালোবাসি নি। তোমাকে আমি ঘৃণা করি। আমি প্রতি মুহূর্তে তোমার সাথে গড়া এই সংসার নামক খেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রহর গুনেছি। তোমার স্পর্শ আমার ঘৃণা লাগে। বারবার মনে হয় এই হাতে তুমি আরও অসংখ্য মেয়ের শরীর ছুঁয়েছ। আমার ভেতরটা কষ্টে ভেঙেচুরে যেতো প্রতি মুহূর্তে।
আবির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। কঙ্কার দিকে এগিয়ে গিয়েও আবার পিছিয়ে এলো। তার স্পর্শকে কঙ্কা ঘৃণা করে। এই কথার পর সে আর কঙ্কাকে ছুঁতে পারলো না। শুধু শীতল গলায় বলল,
–তুমি সত্যিই আমাকে ঘৃণা করো?
–হ্যাঁ, সত্যিই তাই। তোমার সম্পর্কে সব জেনেও তোমার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু পানশি তোমার সাথে আজীবন সংসার করবে। আর ও সেটা করবে নিজের সন্তানের জন্য। এটাই তোমার ভবিষ্যৎ, আবির। এটাই তোমার জীবন। এই বিয়েটা তোমাকে করতেই হবে। আর পিছিয়ে আসতে তুমি পারবে না।
আবির কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর আবার বলল,
–আমায় একটুও ভালোবাসো না, কঙ্কা?
কঙ্কা এবার চিৎকার করে বলে উঠলো,
–বললাম তো না। ভালোবাসি না তোমাকে আমি। কেন বারবার এক প্রশ্ন করছো? দয়া করো, দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করো না। তোমাকে আমার সহ্য হয় না।
আবির আচ্ছন্নের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো কঙ্কার দিকে। তারপর ব্যথিত গলায় বলল,
–বেশ, আর বিরক্ত করবো না তোমাকে।
কথা শেষ করে আবির টলমল পায়ে দরজার দিকে এগোলো। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আবির চলে যেতেই কঙ্কা মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এমনটা কেন হলো?
.
#চলবে………
( শেষ পর্যন্ত আমি আবার ফিরে এসেছি। আর রিচেইক করা হয় নি। ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here