নিরব রদনে পর্ব-২১

0
1320

#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:২১
.
.
.

গত রাতের বৃষ্টি এখনো কমে নি। সকাল শুরু হয়েছে বৃষ্টিস্নাত হয়ে। জাহানারা জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছেন। বাগানের গাছগুলোর উপরে বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে পরছে। ছোট ছোট পাতাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে কেউ এক সমুদ্র পানি মাটিতে ঢেলে দিচ্ছে। অদ্ভুত একটা ঝুমঝুম আওয়াজ কানে আসছে। জানালার ধারে বসে বৃষ্টি দেখার শখ জাহানারার কোনোকালেই ছিল না। বৃষ্টি উনার খুব একটা প্রিয়ও নয়। তবুও আজ উনি খুব মনোযোগ দিয়ে বৃষ্টির ঝরে পরা দেখছেন, মন দিয়ে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ শুনছেন। এই মুহূর্তে এই ঝুম বর্ষা ছাড়া বাকি সমস্ত কিছুকেই ভ্রম মনে করার চেষ্টা করছেন।
নিচতলায় আবির আর পানশির বিয়ের আয়োজন চলছে। পাড়া প্রতিবেশীরা বাড়ি বয়ে এসে নানান ভালো মন্দ কথা বলে যাচ্ছেন। জাহানারা সেসবে থাকতে চান না। তাই ঘরে এসে বসেছেন। বলে দিয়েছেন উনার ঘরে যেন কেউ না আসে। কিন্তু কঙ্কা উনার ঘরে ঢুকলো। হাতে খাবারের থালা। খাবার টেবিলে রেখে কঙ্কা ঘরের জানালা বন্ধ করে দিতে শুরু করলো। জাহানারা চোখমুখ কুঁচকে বললেন,
–একি? আমার ঘরে কেন এসেছ এখন?
কঙ্কা রুক্ষ গলায় বলল,
–আপনাকে খাওয়াতে এসেছি। সময়মতো তো ছেলেকে মানুষ বানাতে পারেন নি। লোকজনের কটুকথা শোনার মতো সন্তান জন্ম দিয়ে রেখেছেন। তাহলে কথা শুনতে হবে না? এখন না খেয়ে বসে থেকে কি কোনো সমাধান হবে?
জাহানারার চোখে পানি এসে গেল। গলায় আটকে আসা কান্নাটা চেপে তিনি বললেন,
–আমার সাথে এভাবে কথা বলছো কেন, বৌমা?
কঙ্কা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জাহানারার পাশে গিয়ে বসলো। আলতো হাতে জাহানারার হাত স্পর্শ করে কোমল গলায় বলল,
–মা, বাস্তবকে মেনে নিন। সন্দেশের জন্য মেনে নিন। তারপর দেখবেন ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর তো কোনো উপায় নেই। একটু বুঝুন।
জাহানারা কথা বললেন না। উনার চোখের পানি গড়িয়ে পরলো। কঙ্কা শান্ত গলায় বলল,
–একদিন দেখবেন, আপনার আর পানশিকে মেনে নিতে অসুবিধা হবে না। ছেলের বউ বলতে পানশির মুখটাই ভেসে উঠবে আপনার চোখের সামনে।
জাহানারা এবার ঠান্ডা গলায় বললেন,
–আর তোমার কি হবে?
কঙ্কা মৃদু হেসে বলল,
–আমার জীবনও ভাগ্যের রেখায় এগিয়ে যাবে, মা। আজ আমি এ বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি। খুব শীঘ্রই আবিরকে তালাক দেবো।
জাহানারা কাঠের মূর্তির মতো কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। অনেকক্ষণ নীরবে কাটলো দুজনের। একসময় জাহানারা শীতল গলায় বললেন,
–আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাবে, বৌমা?
কঙ্কা হাতের মুঠোয় ধরে রাখা জাহানারার হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
–মা, আপনি চলে গেলে যে এই সংসারের সব এলোমেলো হয়ে যাবে। সন্দেশ তার দাদির আদর কি করে পাবে বলুন?
জাহানারা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বললেন,
–আর পারছি না আমি। আমার সারাটা জীবন মেনে নিতে নিতে কেটে গেল।
কঙ্কা জাহানারার চোখ মুছে দিলো। খাবারের থালা এগিয়ে দিয়ে বলল,
–খেয়ে নিন, মা। আপনাকে শক্ত হতে হবে। আমি একটু পানশিকে দেখে আসছি।
কঙ্কা চলে গেল। জাহানারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে রইলেন।
______________________________
আবির নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বসন্তের নির্ঝঞ্ঝাট বৃষ্টি বারান্দার ধার ঘেঁষে নিচে পরছে। বাইরে ঝড় না হলেও, আবিরের ভেতরে ঝড়ের তান্ডব চলছে। ভেতরটা ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে তার। অবশ্য এটাই তার প্রাপ্য ছিল। কতগুলো জীবন তার জন্য তছনছ হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেসবের কাছে তার এই কষ্ট কিছুই নয়। কাল রাতে কঙ্কার কাছ থেকে চলে আসার পরে যখন বিধ্বস্ত আর ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে আবির বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল, তখন বালিশের কোণায় এক টুকরো চিরকুট খুঁজে পেয়েছিল সে। চিরকুটে কঙ্কার হাতের লেখা। কঙ্কা লিখেছিল,
“আবির,
তোমাকে চূড়ান্ত একাকীত্বের ভেতর ডুবিয়ে দিয়ে চলে যাওয়াই আমার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু আমি সেই উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারি নি। কেন জানো? তোমার মেয়ের জন্য। ওর জন্যই আমি তোমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে যাচ্ছি না। তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি তোমার জন্য এই পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, তোমার সন্তান। সেই সাথে দিয়ে যাচ্ছি তোমাকে ভালোবাসতে পারবে, এমন একজন স্ত্রী। তোমাকে শাস্তি দিতে এসে তোমার জীবনটাকে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে দিলাম। ব্যাপারটা দারুণ না?
মেনে নাও, আবির। সত্যিকে গ্রহণ করো। আর মনে রাখো, বর্তমানটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটুকু মনে রাখলেই দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার জন্য ভেবো না। আমি ভালো থাকবো।
ইতি,
কঙ্কা।”

চিঠিটা পড়ার পর থেকে সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারে নি। অদ্ভুত অস্থিরতায় রাত কেটেছে তার। কখনো কখনো মানুষের হাতে আর কিছুই থাকে না। পুরো খেলাটাই ঠিক হয় উপর থেকে। মানুষকে খেলতে হয় সুতার টানে। আবির চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হঠাৎই তার টি শার্টের কোণায় টান পরলো। আবির চমকে উঠে চোখ খুললো। সামনে কাউকেই দেখতে পেলো না। পাশ ফিরতেই সে থমকে গেল। একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা অসম্ভব রকমের ছোট্ট, অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটার মুখ, পরনে সাদা ফ্রক। যেন আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো পরী, যখন তখন উড়াল দেবে আকাশে। আবির তাকাতেই মেয়েটা অসম্ভব মিষ্টি করে হেসে বলল,
–আমি তন্দেশ!
আবির হেসে ফেললো। হাঁটু গেড়ে মেয়ের সামনে বসলো। কন্যার ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চুমু খেলো। আদুরে গলায় বলল,
–আচ্ছা? তুমি সন্দেশ?
সন্দেশ উত্তর দিলো না এই কথার। আবিরের গালে হাত রেখে বলল,
–এতা তোমাল বালি?
আবির মৃদু হেসে বলল,
–না, মা। এটা তোমার বাড়ি। এই বাড়িতে যা কিছু আছে, সেসবও তোমার।
সন্দেশ কি বুঝলো কে জানে? সে খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসির ধাক্কায় ছোট্ট শরীরটা দুলে দুলে উঠছে। আবির মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে। তার মেয়েটা কি ভীষণ সুন্দর! সন্দেশ হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–তুমি কে?
এই প্রশ্নে আবিরের চোখ ছলছল করে উঠলো। তার নিজের সন্তান তাকে চিনতেই পারছে না। চিনবেই বা কি করে? এই সন্তানকে তো সে স্বীকারই করে নি। কথাটা মনে পড়তেই লজ্জায় তার মরে যেতে ইচ্ছা করলো। সে মেয়েকে কাছে টেনে নিলো। কপালে চুমু খেয়ে বলল,
–আমি বাবা!
সন্দেশ ফিক করে হেসে বলল,
–বাবা?
–হ্যাঁ, মা। আমি তোমার বাবা।
কথাটা বলে আবির সন্দেশকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। সাথে সাথেই তার বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে গেল। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। মনে হতে লাগলো, পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট যন্ত্রণা এক মুহূর্তে দপ করে নিভে গেছে। মানুষ ঠিকই বলে, সন্তানের চেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে কিছু হয় না।
.
আড়াল থেকে এই দৃশ্য দেখলো কঙ্কা। তার চোখ ছলছল করছে, ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে,
“আমি দেখেছি, আবির। তোমাকে বাবা হতে আমি দেখেছি।”
_______________________________
দুপুর হয়ে আসতেই বৃষ্টি থেমেছে। এক মুহুর্তেই৷ সব মেঘ কেটে গিয়ে চড়া রোদ উঠেছে। রাত থেকে যে একটানা বৃষ্টি পরেছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে তা আর বোঝার উপায় নেই। সুরমা অস্থিরতা নিয়ে আয়েশার বিছানায় বসে আছে। আয়েশার শরীরটা ভীষণ খারাপ করেছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ফতি উনার পায়ের কাছে বসে পায়ের তলায় তেল মালিশ করছে। বাসায় আর কেউ নেই। নীলয় বাইরে গেছে। সুরমাকে বলে গেছে পুতুল নামের মেয়েটার আজ বিয়ে। সে পুতুলের বিয়েতেই যাচ্ছে। কিন্তু সুরমা জানে যে নীলয় সেখানে যাবে না। নীলয় আজ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে। কলিমউদ্দিন সাহেবও বাসায় নেই আজ। অনেকদিন ব্যবসার দিকে নজর দেওয়া হয় নি। ব্যবসার দিকে খেয়াল করতে হবে, এই কথা মনেও আসে নি। স্ত্রী অসুস্থ হওয়ার পরে যখন টাকার দরকার পরলো তখনই উনার টনক নড়লো।
সুরমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। একা একা সে কি করবে এখন? খালাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। সুরমা কিছুক্ষণ মাথা ঠান্ডা রেখে নিজের করণীয় ঠিক করার চেষ্টা করলো। তারপর ফতির দিকে তাকিয়ে বলল,
–ফতি, তুই একটু বস। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি।
সুরমা উঠে বারান্দায় গেল। ফতি আয়েশার মাথার কাছে উঠে এলো। পাশে বসে বুকে তেল মালিশ করতে শুরু করলো। আয়েশা বেগম নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। উনার কষ্ট দেখে ফতির চোখে পানি এসে যাচ্ছে। ফতি কোমল গলায় বলল,
–আম্মা, ঠিক হইয়া যাইবো।
সুরমা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো। তাড়াহুড়ো করে বিছানার পাশের টেবিল থেকে একটা ওষুধ খুঁজে বের করে আয়েশা বেগমকে ওষুধটা খাইয়ে দিলো। ফতি জিজ্ঞেস করলো,
–কি ওষুধ, আপা?
সুরমা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–ডাক্তার সাহেব এই ওষুধ খাওয়াতে বলেছেন। খালা ঠিক হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে আয়েশার শ্বাসকষ্ট কমে এলো। ধীরে ধীরে উনি চোখ বন্ধ করলেন। ফতি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–আপা, আমি রান্না করি গিয়া। আপনি গিয়া আরাম করেন।
সুরমা মাথা নাড়লো। ঘর থেকে বেরোতেই কলিং বেল বাজলো। সুরমা ক্লান্ত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে কিঞ্চিৎ অবাক হলো। শাদাব এসেছে। সুরমা হেসে বলল,
–তুমি? তোমার তো বিকেলে আসার কথা ছিল। ছুটি নিয়েছ?
শাদাব কাঠকাঠ গলায় বলল,
–চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।
সুরমা হকচকিয়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো স্বামীর মুখের দিকে। প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল,
–মানে?
শাদাব উত্তর না দিয়ে ভেতরে চলে গেল। সুরমাও পিছু পিছু গেল। শাদাব সুরমার ঘরে গিয়ে বিছানায় বসলো। সুরমা পাশে বসে বলল,
–কোনো সমস্যা হয়েছে অফিসে?
শাদাব মুখভার করে বলল,
–কোম্পানি আমাকে এক সপ্তাহের জন্য বাইরে পাঠাতে চায়। আমি বসকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। বলেছি যে আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। তাকে একা রেখে আমি এখন কোথাও যেতে পারবো না। কিন্তু উনি কিছুতেই বুঝছেন না। তাই আমি ঠিক করেছি চাকরিটা আর করবো না।
সুরমা হতাশ গলায় বলল,
–কি পাগলামি করছো? একটা সপ্তাহের ব্যাপার, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আর আমি এখানে একা কোথায়? সবাই তো আছে।
শাদাব মাথা নাড়িয়ে বলল,
–না, তুমি যাই বলো। আমি তোমাকে ফেলে এখন কোথাও যেতে পারবো না।
সুরমার এবার ভীষণ রাগ হলো। সে চিৎকার করে বলে উঠলো,
–কি পেয়েছটা কি? আর কত যন্ত্রণা দেবে? এদিকে খালা অসুস্থ, ওদিকে মা বাসায় একা, আর তুমি এসেছ একটা সামান্য কারণে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার বায়না নিয়ে? এত চিন্তা আর নিতে পারছি না। অসহ্য লাগছে আমার।
শাদাব সুরমার হাত ধরে বলল,
–আরেহ! এভাবে চিৎকার করছো কেন? তোমার শরীর খারাপ করবে। শান্ত হও।
সুরমা শাদাবকে সরানোর চেষ্টা করে বলল,
–সরে যাও। একদম ধরবে না আমাকে। চাকরি ছেড়ে দেবেন উনি! বাচ্চাদের পুতুল খেলা পেয়েছ এটা? এখন চাকরি ছেড়ে দেবে, তারপর কি হবে ভেবেছ? কয়েক মাস পর যখন আমাদের বাচ্চাটার জন্ম হবে, তখন কি করবে তুমি? এর ওর কাছে হাত পেতে টাকা চেয়ে বেড়াবে?
শাদাব অসহায় দৃষ্টিতে সুরমার দিকে তাকিয়ে রইলো। সুরমা বড় করে নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর শাদাবের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার বুকে মাথা রাখলো। মৃদু গলায় বলল,
–সংসারের সাথে টাকার একটা সম্পর্ক আছে। সংসার মানে শুধু ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা, প্রেম, দায়িত্ব, কর্তব্য, সবকিছুর ভারসাম্য। তাই না? এক সপ্তাহের জন্য তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার কি কম খারাপ লাগবে? কিন্তু সেটুকু মেনে নিতে হবে আমাদের। ধরো, তুমি চাকরিটা এখন ছেড়ে দিলে। তার ফলাফল কি হবে? আমরা আমাদের নবজাতক শিশুটাকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো? ওর ভবিষ্যতের কথা আমাদেরই তো ভাবতে হবে। আমরা যে ওর বাবা মা!
শাদাব মৃদু হাসলো। স্ত্রীর মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
–বুঝতে পেরেছি আমি তোমার কথা। তোমাকে টেনশন দেওয়ার জন্য সরি।
সুরমা হেসে ফেললো। মানুষটা মাঝেমধ্যে এমন পাগলামি করে!
________________________________
বিকাল গড়িয়েছে। ঘড়ি জানান দিচ্ছে এখন বিকাল পাঁচটা। বসার ঘরে গম্ভীরমুখে বসে আছেন আশরাফউদ্দিন সাহেব। কঙ্কা একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজার কপাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে অযাচিনী। তার ভয়ংকর মন খারাপ।
কঙ্কা মুখে হাসি টেনে বলল,
–আমি চলে যাচ্ছি, বাবা। আবির আর পানশির বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজটুকু অযাচিনী করে নেবে।
আশরাফউদ্দিন সাহেব হালকা কেশে বললেন,
–চলেই যাবে তাহলে?
–জ্বি, বাবা।
আশরাফউদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন। কঙ্কার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ভারী গলায় বললেন,
–তুমি যে আমার ছেলেকে আর আমার পরিবারকে অপদস্ত করার একটা পরিকল্পনা করেছ, সেটা আমি আগেই টের পেয়েছিলাম। চাইলে আমি তোমাকে আটকাতে পারতাম। কিন্তু আটকাই নি আমার নাতনির কথা জানতে পেরে। তুমি আমার বংশধরকে নিয়ে ভাবছো, তাকে একটা সুন্দর পরিবার দিতে চাইছ, এটা জানতে পারার পর আমি নিজেই তোমার কাজে সাহায্য করেছি। লোকজনের কটুকথা, অপমান, অসম্মান, এসব নিয়ে তখন আর ভাবি নি। কারণ ধনীদের কলঙ্ক বেশিদিন স্থায়ী হয় না।
কঙ্কা মৃদু হেসে বলল,
–আমি জানি, বাবা। পানশির মা বাবার সাথে আপনি নিজে কথা বলেছিলেন। সেজন্যই উনারা রাজি হয়েছেন।
আশরাফউদ্দিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–আমরা দুজনেই দুজনের কাজের খোঁজখবর রেখেছি। কিন্তু ভান করেছি যেন কিছুই জানি না।
কঙ্কা নিচু গলায় বলল,
–আমি আসি, বাবা?
–যাবে? যাও। যদি কখনো প্রয়োজন মনে হয়, তাহলে নির্দ্বিধায় আমাকে বলো। আমি জানি তোমার এর পরের জীবনটা মসৃণ হবে না। এই সমাজ সেটা হতে দেবে না। তোমার সাহায্যের দরকার পরবে। আমি সর্বাবস্থায় তোমাকে সাহায্য করবো, মা।
কঙ্কার চোখে পানি এসে গেল। সে দৃষ্টি নত করে বলল,
–আমার জন্য দোয়া করবেন, বাবা।
আশরাফউদ্দিন সাহেব কঙ্কার মাথায় হাত রাখলেন। কোমল গলায় বললেন,
–আল্লাহ তোমার ভালো করবেন, মা। তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে।
কঙ্কা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো উনার চোখ ভরা পানি। সে অভিভূত হলো। এতখানি ভালোবাসা সে পাবে এমনটা আশা করে নি।
আশরাফউদ্দিন সাহেব মজনুকে ডাকলেন। উঁচু গলায় বললেন,
–মজনু, কঙ্কা মার ব্যাগটা গাড়িতে তুলে দে।
মজনু আশেপাশেই ছিল। সাথে সাথেই ঘরে ঢুকে ব্যাগটা নিয়ে এগিয়ে গেল। কঙ্কা শেষবারের মতো বিদায় নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো। দরজার কাছে যেতেই অযাচিনী ডুকরে কেঁদে উঠলো। কঙ্কা অযাচিনীর মাথায় হাত রেখে বলল,
–ধুর, বোকা মেয়ে! কাঁদছো কেন তুমি?
অযাচিনী উত্তর দিলো না। কঙ্কা কোমল গলায় বলল,
–কেঁদো না, অযাচিনী। আমাকে হাসিমুখে বিদায় দাও।
অযাচিনী থামতে পারলো না। তার কেন এত কষ্ট হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। কঙ্কা অযাচিনীর চোখ মুছে দিলো। তারপর এগিয়ে গেল নিজের পথে। গোটা একটা বাড়িকে এক সমুদ্র মায়ায় ডুবিয়ে রেখে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠে বসলো গাড়িতে। এতক্ষণের চেপে রাখা যন্ত্রণাগুলো এবার ঝরঝর করে ঝরতে শুরু করলো চোখ থেকে।
________________________
কলিমউদ্দিন সাহেব বাড়ি ফিরলেন সন্ধ্যায়। বাসায় তখন ফতি ছাড়া আর কেউ নেই। বিকালের দিকে আয়েশা বেগমের শরীরটা আবার খারাপ হয়েছিল। শাদাব আর সুরমা উনাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে। নীলয় নাকি কিছুক্ষণ আগে বাসায় এসেছিল। খবর শুনে সেও ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে গেছে।
কলিমউদ্দিন সাহেব ফতির কাছে সমস্ত বিবরণ শুনে হাসপাতালের দিকে যাওয়ার উদ্যোগ করছিলেন। কিন্তু দরজায় যেতেই উনাকে থমকে দাঁড়াতে হলো। কারণ দরজায় কঙ্কা দাঁড়িয়ে আছে।
কলিমউদ্দিন সাহেব অত্যাশ্চর্য হয়ে গেলেন। ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে কঙ্কা। এক মুহূর্তের জন্য উনার মনে হলো উনি বোধহয় অন্ধকারে ভুল দেখছেন। তিনি অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন,
–কে? কে ওখানে?
দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো,
–বাবা!
কলিমউদ্দিন সাহেব চমকে উঠলেন। উনার মাথা ঘুরে উঠলো। উনি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় বললেন,
–ফতি, বাইরের আলোটা জ্বালিয়ে দে।
আলো জ্বালিয়ে সে দ্রুত বাইরে ছুটে এলো। আলো জ্বালাতেই কঙ্কাকে স্পষ্ট দেখা গেল। কলিমউদ্দিন সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটা কথাও উচ্চারণ করতে পারলেন না। ফতি শুধু অস্পষ্টভাবে বলল,
–ছোট আপা! আপনি?
কঙ্কা কাছে এগিয়ে এলো। শান্ত গলায় বলল,
–বাবা, আমি ফিরে এসেছি। আমাকে তোমরা ফিরিয়ে নেবে তো?
কলিমউদ্দিন সাহেবের গলায় কথা জড়িয়ে আসছে। তিনি থেমে থেমে বললেন,
–ফতি, আমার আম্মাজানকে ঘরে নিয়ে যা।
কথা শেষ করে কলিমউদ্দিন সাহেব টলমল পায়ে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। অনেকদিন পরে তিনি আবার কাঁদলেন, শিশুর মতো কান্না। বারংবার অস্ফুটে বলতে লাগলেন,
“আমার আম্মাজান ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে।”
.
#চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here