প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব-২০

0
643

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২০.

-প্রাপ্ত, মাহীম কোথায় গেছে রে সাফোয়ান? আর তুই হঠাৎ এ বাসায় কেনো? অরি কল করে বললো তোর নাকি…

রুমে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো বলছিলো মিষ্টি। কিন্তু কথা শেষ না করেই থামতে হলো ওকে। সাফোয়ান উদোম গায়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে। শার্ট খুলে কাধের দিকের ক্ষতটায় ওয়েন্টমেন্ট লাগাচ্ছিলো ও। মিষ্টির আওয়াজ‌ শুনেই ধরফড়িয়ে উঠলো সাফোয়ান। তরিঘড়ি করে গায়ে জড়ালো শার্টটা। ওর হাত থেকে ওয়েন্টমেন্টও নিচে পরে গেছে। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো মিষ্টি। সাফোয়ান শার্ট আঁকড়ে ধরে বললো,

-একবার নক করে আসবি না?

কুঁচকানো কপাল আরো কুঁচকে ফেললো মিষ্টি। সাফোয়ান বিপাকে পরে গেছে। রুমটা তো মিষ্টিরই। ও ভেবেছিলো এ সময় আসবে না ও। তাই ফার্স্ট এইড বক্স নিতে মিষ্টির রুমেই ঢুকে পরেছে ও। সাফোয়ান বেশ বুঝতে পারলো, ওকে ওই অবস্থায় দেখে মিষ্টি বিন্দুমাত্রও লজ্জা পায়নি। উল্টো লজ্জা যেনো ওরই পুরুষভূষণ হয়ে উঠেছে। আমতাআমতা করে বললো,

-ক্ কিছু বলবি?

মিষ্টি নিশব্দে ঘরে ঢুকলো। সাফোয়ানের পেছনে দাড়িয়ে ওর কাধের দিকে তাকিয়ে বললো,

-কি হয়েছে এখানে?

-ও কিছু না। তুই বল কি বলছিলি। আমি…

মেঝে থেকে ওয়েন্টমেন্ট তুলে মিষ্টি নিজেই সাফোয়ানের কাধে হাত লাগালো। সাফোয়ান সরে যাচ্ছিলো। মিষ্টি ওর হাতের কবজি আঁকড়ে ধরে বললো,

-একচুলও নড়বি না। কিভাবে লাগলো?

মিষ্টি ঔষুধ ছোয়ালো ওর ক্ষততে। সাফোয়ান আর বাধা দিলো না। ব্যথায় চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নিয়ে বললো,

-রাস্তায় দুই গ্রুপের মারামারি হচ্ছিলো। সামলাতে গিয়ে কেটে গেছে কিছু একটাতে।

আর কিছু বললো না মিষ্টি। সামনে এসে সাফোয়ানের হাতে ওয়েন্টমেন্ট ধরিয়ে দিয়ে‌ বললো,

-সাবধানে কাজ করবি তো।

-বিনামুল্যে নার্সিং সেবা পেলে আর সাবধানে কাজ করতে ইচ্ছা করেনা রে মিষ্টি!

সাফোয়ানের কথায় ঠাট্টার আভাস। মিষ্টি হাসলো না। সাফোয়ান হাসি থামিয়ে‌ শার্ট পরতে পরতে বললো,

-আজ এতো আগেআগে চলে এলি কি জন্য?

-পিয়ালী কল করেছিলো আমাকে। সাদিক আঙ্কেল নাকি খই নামের একটা মেয়েকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে। গিয়েছিলাম ওখানে। মেয়েটা তো…

-তুই গিয়েছিলি? তো মেয়েটাকে এখনো মিষ্টিঘরে আনিস নি কেনো?

মিষ্টি আবারো কপালে ভাজ ফেলে তাকালো সাফোয়ানের দিকে। বললো,

-তুই জানিস খইয়ের বিষয়ে?

-তো তোর কি মনে হয়? পুলিশকে ইনভল্ব না করেই সাদিক আঙ্কেল একটা মেয়ের দায়ভার নিয়ে নেবে? আইনি ঝামেলা নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান আছে তার। আগে থেকেই জানিয়েছে আমাকে মেয়েটার ব্যাপারে। ওই গ্রাম ছাড়ার সময়ই।
নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।
একদম স্বাভাবিক গলা সাফোয়ানের। মিষ্টির কিঞ্চিত অভিমান হলো। সবটা জেনেও সাফোয়ান ওকে জানায় নি কিছুই। অবশ্য প্রাপ্তর কল্পনার সে রুপ সত্যিই ওর জীবনে এসেছে, এ নিয়ে যথেষ্ট খুশী ও। পিয়ালীও কতো খুশি! সাদিক সাহেব তো মনেমনে খইকে বৌমা মেনেই নিয়েছেন হয়তোবা। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে সাফোয়ান পেছন ফিরলো। বললো,

-কিরে? চুপ করে আছিস যে?

-হুম? কিছুনা। দেখনা! অতঃপর আমাদের প্রাপ্তর কল্পনায় থাকা সেই শ্যামাকন্যা সত্যিসত্যিই ওর জীবনে এন্ট্রি নিলো‌ বল? ভালোই হলো। এবার আর অস্বীকারের সুযোগ নেই। ঠিকই এই খইয়ের সাথে প্রেমনোঙরে বাধা পরতে চলেছে সাদমান ইনাব প্রাপ্ত। আফটার অল, ও যেমনটা চেয়েছিলো, তেমন কাউকেই পেয়ে গেছে বলে কথা!

-আর যদি সে প্রেমনোঙর আমার চাওয়ার বিপরীত স্রোতে আটকে যায়, সে দায় কার মিষ্টি? সেই বিপরীত স্রোতস্বীনির? নাকি নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পারা এই আমিটার? কার?

প্রাপ্তর গলা শুনে থমকে উঠে পেছন ফিরলো মিষ্টি। দরজায় দাড়িয়ে প্রাপ্ত। ওর ঠিক পেছনে ঝুকে হাটু ধরে দাড়িয়ে আছে মাহীম। প্রাপ্তর কথা শুনে অবুঝভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো সবগুলো। মাহীম একটুপরেই ব্যথায় কুকড়ানো কন্ঠে বললো,

-ওয় সিস্টার? নিজের সিস্টাররুপ নয়তো মাদার তেরেসা ফর্মে আয়। আমার পা দেখ আগে! বাচা আমাকে ভাই! দেখ কতোখানি ছড়ে গেছে!

মিষ্টি এগোলো। খানিকটা ঝুকে মাহীমের হাটু পরখ করে নিয়ে বললো,

-এখানে ঔষুধ লাগালে ঔষুধকে অপমান করা হবে। কিছুই হয়নি। বাসায় গিয়ে ডেটল দিয়ে ধুয়ে নিস। আমার বাসার ফার্স্ট এইড বক্স পুরো মিষ্টিঘরের বাচ্চাকাচ্চার কাজে লাগে। ওয়েস্ট করবো না।

মাহীম হতবিহ্বলের মতো তাকিয়ে রইলো ওর‌ দিকে। মিষ্টি ওর সে চাওনিকে পাত্তা না‌ দিয়ে প্রাপ্তর দিক ফিরে‌ বললো,

-হ্যাঁ, কিছু বলছিলি তুই। আবার বলতো?

-কিছুনা।

সাফোয়ান এগিয়ে এসে বললো,

-খইয়ের‌ সাথে কথা বলেছিস?

-সেভাবে না।

-তো কথা বল প্রাপ্ত! মেয়েটা আর কতোদিন ওভাবে ঘরের কোনে আটকে রাখবে নিজেকে? আর কতোদিন ওভাবে গুমড়ে গুমড়ে মরবে? আমাদের সবারই ওকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে হবে তো! সাদিক আঙ্কেল‌ একা আর কতো করবে বল?

প্রাপ্ত কিছুই বললো না। হাতে বাধা স্কার্ফের টুকরোর দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। মিষ্টি বললো,

-মেয়েটাকে‌ স্বাভাবিক‌জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে প্রাপ্ত। ওকে দেখলে মনে হয়, যেনো বেচে থেকেও মরে গেছে, মরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

-তোর হাতে কি হয়েছে আবার?

প্রাপ্তর দোটানা আরো গাঢ়তর হলো। অস্থিরতা বাড়লো আবারো। বেরিয়ে আসলো ও মিষ্টির বাসা থেকে। সোজা নিজের বাসায় ঢুকে খইয়ের রুমের দিকে তাকালো। দরজা লকড্ না। পিয়ালীর রুমে এখনো লাইট অন। পড়ছে হয়তো। প্রাপ্ত এগোলো খইয়ের ঘরের দিকে। দরজায় দুবার টোকা দিয়ে বললো,

-খই?

সাড়া এলো না। প্রাপ্ত দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। খই দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে। এবার মুখটা দেখা যাচ্ছে ওর। কাদতে কাদতে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে একদম। প্রাপ্ত আরো এগোলো। মিহিস্বরে বললো,

-আর কতো কাদবে?

-তুমি এভাবে কাদলে তোমার মা ফিরবে না খই।

-নিজেকে আর কষ্ট দিও না প্লিজ। আমি, পিয়ালী, বাবা, মিষ্টিঘরের সবাই আছি তো তোমার পাশে। জীবন তো এভাবে চলে না বলো?

-তুমি যদি চাও, আমি বাবাকে কালই‌ বলবো তোমার পড়াশোনা নিয়ে কিছু ভাবতে। তোমার যে বিষয়ে পড়াশোনার ইচ্ছে…

ইচ্ছে শব্দটা উচ্চারনের পরপরই থেমে গেলো প্রাপ্ত। দুহাত মুঠো করে নিলো তৎক্ষনাৎ। খই তখনো একধ্যানে নিচদিক তাকিয়ে।‌ নিজেকে সামলে প্রাপ্ত বললো,

-যেমনটা তুমি চাও, তেমনটাই হবে।

-হু।

পুরোটা শুনে এই এটুকোই বললো খই। প্রাপ্ত আর একমুহুর্ত দাড়ালো না। শান্তনা দেওয়ায় যে ও সনদপ্রাপ্ত কাচা, তা টের পেলো বেশ। আর তার সাথে ইচ্ছের নাম জুড়ে আরো সবটা এলোমেলো করে দিয়েছে। প্রাপ্ত বেরিয়ে যাবার অনেকটা সময় পর খই চোখ তুলে জানালায় তাকালো। খোলা জানালার‌ পর্দার আড়ালে একফালি চাঁদ‌ দেখা‌ যায়। তারা কি আছে? পাশের দালানের জন্য আকাশের পুরোটা দেখা‌ যায় না। চোখের কোনের জল শুকিয়ে উঠেছে খইয়ের। সবাই দয়া করছে ওকে। এ শহরে সবার শান্তনা পর দয়ার পাত্রী ও। আচমকাই খইয়ের কি হলো, বেরিয়ে এলো নিজের‌ ঘর থেকে। ড্রয়িংরুমে এসে আবছা আলোয় চোখ বুলালো আশেপাশে। কেউই‌ জেগে নেই। গুটিগুটি পায়ে এগোলো দরজার‌‌ দিকে। দম বন্ধ লাগছে ওর‌ এ বাসায়। এক ঘরে। ভাদুলগায়ের বটতলা, শুকমরার পাড় ছেড়ে এই ইটপাথরের দালানের মাঝে শ্বাস নিতে‌ কষ্ট হচ্ছে ওর।

দরজায় কাপাকাপা হাত লাগালো খই। কয়েকবার চেষ্টার পরও খুলতে পারলো না ওটা। চোখ গেলো উপরে উঠে‌ যাওয়া‌ সিড়িটার দিকে। একটা বড়সর দম নিলো খই। আজ ও বেরোবেই। যে করেই হোক! সিড়ি‌ বেয়ে উপরে উঠে‌ এসে নিজেকে ছাদে আবিষ্কার করলো খই। দ্বিতল ভবনের ছাদ থেকে রাতের শহরের উপরে আকাশে জ্বলতে থাকা তারা, নিচে জ্বলতে থাকা হাজাররঙা বাতিগুলো দেখে বিস্ময় জাগলো না ওর চোখে। বরং অচেনা জায়গার অনুভবে কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আসতে লাগলো গলায়। চোখ এদিকওদিক সরিয়ে খানিকটা দুরেই‌ জলাধার দেখতে পেলো খই। চাঁদের আলোর‌ প্রতিফলনে ঝিলমিল করছে সে জলাধারের পানি। শুকমরার কথা‌ মনে পরে গেলো খইয়ের। এভাবেই কতো রাত জেগে শুকমরার তীরে বসে চাঁদ তারার সাথে আড্ডা দিতো ও। মায়ের কোল ছেড়ে উঠে আসতো নিজের সময় বের করবে বলে। আর আজ ওর মনপ্রান শুধু সেই ছত্রতলটাই খুজে চলেছে। একটু শান্তি, একটু স্বস্তির একটা জায়গা।

খই ছাদের রেলিং ঘেষে দাড়ালো। নিচ অবদি লাফিয়ে পরলেও খুবএকটা ক্ষতি হবে না‌ ওর। এর চেয়ে আরো উচু পেয়ারগাছ, গাবগাছ, আমগাছ থেকে পরার অভিজ্ঞতা আছে ওর। এমনটা ভাবনা মস্তিষ্কে আসলেও‌ তাতে‌ সায় দিলো না খই। নিচে তাকিয়ে‌ দেখলো উপরের ছাদ থেকে পাইপলাইন একদম নিচ অবদি চলে গেছে। অনায়াসে সেটা ধরেই নেমে যাওয়া‌ যাবে। খই ওর কামিজের ওড়না কোমড়ে‌ গিট দিলো। পাইপ ধরে ছাদ থেকে নিচতলায় নেমে আসলো অতি সহজেই। একটা শুকনো ঢোক গিলে আশেপাশে তাকালো আরেকবার। আগের খই হয়তো মনেমনে নিজেকে প্রশ্ন করতো, ব্যস্ত শহরও বুঝি রাতে ঘুমায়? কিন্তু এই খই নিজেকে বোঝালো, ভালো হয়েছে কেউ‌ জেগে নেই। ভালো হয়েছে, আমাকে দয়া করার জন্য কেউ‌ জেগে নেই।

খই এগোলো। ছাদ থেকে যেদিকে ঝিলটা দেখেছিলো, ঠিক সেদিকেই। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরদুটোকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। এরা অন্তত ওকে দয়া দেখাবে না। এরা মানবতা বোঝে। কয়েককদম হাটতেই খই দেখতে পেলো সে ঝিলের সামনে একটা কালো গাড়ি দাড়িয়ে। আর গাড়ির বাইরে কোনো এক পুরুষ অবয়ব বুকে দুহাত গুজে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে। খই থামার পরিবর্তে সে মানুষটার দিকে তাকিয়ে থেকেই একপা দুপা করে এগোতে লাগলো। মধ্যবর্তী দুরুত্ব কমার সাথেসাথে হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো খইয়ের। আরো খানিকটা এগোনোর পর পেছন থেকে‌ স্পষ্ট হলো সে অবয়ব। চোখ ফেটে জল‌ বেরিয়ে এলো খইয়ের। একছুটে গিয়ে পেছন থেকে জরিয়ে ধরলো সে মানুষটাকে। তার বুকের শার্ট সর্বশক্তিতে খামচে ধরে, হুহু করে কাদতে কাদতে বললো,

-এইডা কি সত্যই তুমি? নাকি তোমার জ্বী’ন নকশাদার? কও না তুমি সত্যই আইছো! কও না! দয়ার পরিবর্তে আমারে একটু শান্তি দেও না এইডা কইয়া নকশাদার! একটু শান্তি দেও? দেখো না! আমি যে কাইন্দাও শান্তি পাইতাছি না! কান্দার মতোন জায়গাডা‌ নাই আমার! মা যে আর নাই! আমার চেনা আর‌ কেউ‌ নাই এই বিরাট দুনিয়ায়। এই অচেনা শহরে আমি একা। আমি ভালো নাই নকশাদার! ভালো নাই!

খইয়ের আচমকা আলিঙ্গনে কেপে‌ উঠেছিলো সে অবয়ব। তবে ওর কথাগুলো শুনে আলতোভাবে ওর হাতে হাত রাখলো সে। সময়ের‌ অতিবাহন আর খইয়ের কান্না শুনে‌ শক্ত করে‌ মুঠো করে‌ ধরলো সে খইয়ের হাতজোড়া। শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,

-আমিও ভালো নেই খই। একদমই ভালো নেই।

#চলবে…

[ রিচেইক হয়নি। 🙁 ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here