#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-২৩
ঘড়ির কাটা দেড়টা ছুঁই ছুঁই! আয়ন্তিকা লম্বা হাই তুলে অহর্নিশের মুখশ্রীতে দৃষ্টি দেয়। বিরক্তিকর দৃষ্টি! অহর্নিশ সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিঃশব্দে হেঁসে বাহিরে তাকায়। আয়ন্তিকা তপ্তশ্বাস ফেলে! সেই কখন থেকে অহর্নিশ তাকে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে। রুমে যেতে নিলেই উল্টোপাল্টা কাজ করে বসছে নয়তো ধমক দিচ্ছে। এমন বেহাল পরিস্থিতিতে পড়ে আয়ন্তিকা পরিশেষে বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে থাকে। সময় বাদে বিরক্তি কেটে গেলো! জুড়ে এসে বসলো ভালোলাগা, প্রশান্তি! কতদিন পর সে অহর্নিশের সাথে একান্ত সময় কাটাতে পারছে। লোকটাকে একটু সময় নিয়ে কাছে পেয়েছে। আহ! এতো প্রশান্তি!
অহর্নিশ আয়ন্তিকার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যাথা করে ফেলেছে। ব্যাথায় চোখদুটো নিশ্চিত ফুলে গিয়েছে। সামনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও মন নিশপিশ করছে আয়ন্তিকা কে দেখার জন্য। ইশ! কি এক জ্বালা! কেনো আসলো এই প্রাননাশিনী তার জীবনে?কেনো এসে তাকে এলোমেলো করে দিলো পুরোপুরি? অহর্নিশ ছটফট করে। মন চাচ্ছে তার আয়ন্তিকা কে আদর করার। একটু অদ্ভুত আদর! যে আদরে শুধু ভালোবাসা মিশ্রিত কষ্ট থাকবে। সেই কষ্টতে জর্জরিত হয়ে আয়ন্তিকা অহর্নিশ কে ভালোবাসি বলবে! বুঝতে পারবে অহর্নিশের মনের কথা, ব্যাথা, বিরহ যন্ত্রণা!
অহর্নিশ শেষে পারে না নিজেকে আটকাতে।এগিয়ে যায় আয়ন্তিকার সামনে। হুট করে অহর্নিশ আয়ন্তিকার সামনে এসে থম মেরে দাঁড়াতে একটু ইতস্তত হয়ে পড়ে আয়ন্তি! অহর্নিশ তার সন্নিকটে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ন্তিকা এবার নরমাল হয়ে বলল,
‘ কি চাই আবার?’
অহর্নিশ মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। রুমে চলো! ‘
আয়ন্তিকা কিছু সময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অহর্নিশের দিকে। বোঝার চেষ্টা করে ঠিক কি করতে যাচ্ছে এই লোক ভবিষ্যতে! তবে অনুমান করা হলো না। অহর্নিশ কে আয়ন্তিকা আজও পড়তে পারলো না। নিউটনের গতির সূত্রর মতো অহর্নিশ কে মনে হয় আয়ন্তিকার। নিউটনের গতীর সূত্র বেশ কঠিন লাগে তার কাছে। তার মতোনই অহর্নিশ কেও! আয়ন্তিকা উগ্র ভাব নিয়ে বলল,
‘ কি সারপ্রাইজ? ‘
অহর্নিশ বিরক্ত হয়ে বলে, ‘ আসো তো রুমে! কিছু বললেই ভাবনার সাগরে ডুবে হাবুডুবু খাও। এটা আমার নিকট প্রচন্ড বিরক্তিকর লাগে! অভ্যাস বদলাও। নয়তো ঠাটিয়ে কবে জানি চড় মেরে তোমার দাঁত ভেঙে ফেলি। ‘
আয়ন্তিকা অহর্নিশের কথার পরিপ্রেক্ষিতে চিবিয়ে বলল,
‘ এ্যাহ্…আসছে! আপনি মারলে আমি কি চুপ থাকবো নাকি?আসুন মারুন। ছুঁয়ে তো দেখুন। একদম মেরে ফেলবো আপনাকে। ‘
অহর্নিশ আগের থেকে দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে তাকায় আয়ন্তিকার দিকে। বিড়বিড় করে সে বলল,
‘ এই আন্ডাবাচ্চাদের এই এক প্রবলেম! নরমাল কথায় অতিরিক্ত হাইপার হয়ে যায়। কাজের কথায় তো খবর নাই। উল্টা কথা ধরে ভাব দেখায়! ডাফার একেকটা! ‘
অহর্নিশ চারপাশ না দেখে আয়ন্তিকার হাত শক্ত করে ধরে রুমে নিয়ে আসে। রুমে আসার পর সে আয়ন্তিকার হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায় কার্বাডের নিকট। একেক করে তার এবং আয়ন্তিকার জামা- কাপড় নামিয়ে নিয়ে বিছানায় রেখে সে ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে রাখা শুরু করে! পুরো সময়ে আয়ন্তিকা মৌনতা রূপে অহর্নিশের কাজকর্ম দেখতে থাকে। এক সময় পারে না শেষে মৌন রূপে অবস্থান করতে। অস্থির হয়ে উঠে বলল,
‘ কাপড় – চোপড় ব্যাগে ঢুকাচ্ছেন কেনো?আমরা কি কোথায় যাচ্ছি? ‘
অহর্নিশ ব্যাগে জামা – কাপড় ঢোকানো শেষে ললাটে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম শার্টের হাতা দিয়ে মুছে নেয়। পূর্ণ দৃষ্টি আয়ন্তিকার দিকে মেলে দিয়ে বলল,
‘ হ্যা! আমরা গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। ফুপি দেখতে চাচ্ছে তোমাকে। কাল সকালেই যাবো। এখন জলদি ঘুমিয়ে পড়ো। ‘
আয়ন্তিকার নেত্রে অশ্রু এসে জমে! মূর্হতেই সিক্ত হয়ে দুই আঁখিপল্লব। কাঁপা ওষ্ঠাধর কিছু বলার প্রয়াস চালালে সে ব্যার্থ রূপে কম্পমান অবস্থাতেই থাকে। হটাৎ পাওয়া বিরাট খুশির খবরটা আয়ন্তির হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তা অহর্নিশ আয়ন্তিকার চেহারা দেখেই বুঝে যায়। সে হাসে আলত! তবে মনে কষ্টও অনুভূত হয়। আহারে! মেয়েটাকে এতদিন কতোটা কষ্টের মাঝে রেখেছে সে। ভাবতেই ইচ্ছে করে অহর্নিশের নিজেকে ছুরিকাঘাত করার! অহর্নিশ পদচারণা এসে বন্ধ করে আয়ন্তিকার সামনে দাঁড়িয়ে। নম্র কন্ঠে বলে,
‘ রিলেক্স আয়ন্তিকা! কান্নাকাটি করো না। আমি জানি তুমি খুশিতে কাঁদছো কিন্তু তবুও! থামো! আর হ্যা তোমাকে কাঁদলে পেত্নী পেত্নী লাগে ইউ নো? পরিশেষে দেখা যাবে আম্মু বা আব্বু এখন আসলে তোমায় দেখে পেত্নী বলে চিল্লিয়ে হার্ট অ্যাটাক ও করতে পারে। গড! কি সাংঘাতিক ব্যাপার না?থামো, থামো! ‘
অহর্নিশের কথা বলার ধরন দেখে আয়ন্তিকা কান্না করার মাঝে হেঁসে দেয়। এই মানুষটা সিরিয়াস টাইমে প্রচুর হাসাতে পারে। নিশ্চিত আয়ন্তিকা! অহর্নিশের সাথে যে থাকবে সে কখনোই মন খারাপ করে থাকতে পারবে না। কারণ তার সঙ্গে স্বয়ং একজন ‘জোকার ‘ ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে কথা। মন খারাপ করে থাকা যায়?উঁহু!
আয়ন্তিকা নাক টেনে বলল,
‘ আপনি সত্যি বলছেন তো?কাল আমাকে বাবা মার কাছে নিয়ে যাবেন?’
‘ অবশ্যই! আমি মিথ্যা কেনো বলতে যাবো?আরনাফ অহর্নিশ কখনো মিথ্যা বলেনা। গট ইট?’
অহর্নিশ বুক ফুলিয়ে ভাব নিয়ে বলল কিছুটা। আয়ন্তিকা তা দেখে এবার নিভৃতেই হাসে। চোখের কার্নিশে জমে থাকা পানি দু’হাত দিয়ে মুছে নেয়। অতঃপর উৎসাহ নিয়ে বলে,
‘ কখন, কয়টায় যাচ্ছি আমরা?’
‘ সকাল ৬ টায়! অলরেডি অনেক রাত হয়ে গেছে। যাও ঘুমাও। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি। ‘
‘ এতো রাতে গোসল করবেন আবারও?’
‘ হু! ‘
‘ ঠান্ডা লেগে যাবে তো। ‘
‘ উঁহু! আমার অভ্যাস আছে। ‘
অহর্নিশ টাওয়াল নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে। তা দেখে লম্বা শ্বাস ফেললো আয়ন্তিকা। বিয়ের পর হতেই সে দেখে আসছে অহর্নিশ রাতে গোসল করে সবসময়। রাতে এবং দিনে দুইবেলাই! এমন কর্মে আয়ন্তিকা মাঝেমধ্যে বিরক্তি পেশ করে। তো কখনো হু- হুতাশ! কিছুক্ষণ আশপাশে চোখ বুলিয়ে বিছানায় গিয়ে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ে। আজ কি ঘুম আসবে তার?মনে হয়না! কতদিন পরে বাবা মার কাছে যাচ্ছে। ছোট বোনটার সাথে ঝগড়া হবে কতদিন পর। ইশশ! ভাবতেই পরম শান্তিতে শিউড়ে ওঠে আয়ন্তিকা।
.
অহর্নিশ সিক্ত চুলগুলোকে টাওয়ালের সাহায্যে মুছতে মুছতে বেড়িয়ে আসে ওয়াশরুম হতে! চারপাশ অন্ধকার দেখে বুঝতে বাকি নেই আয়ন্তি ঘুমিয়ে পড়েছে। চটজলদি অহর্নিশ হাতের টাওয়াল সোফায় ছুঁড়ে মেরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। আয়ন্তিকার ঠিক একহাত পাশে। লম্বা শ্বাস টেনে নিলে তার মনে হলো আয়ন্তিকার শরীরের গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খেলো। অহর্নিশ আর কিছুক্ষণ অনুভব করে। পরিশেষে আয়ন্তিকার ওপর হাত পা তুলে দিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করে!
এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আয়ন্তিকার ওপর হাত পা তুলে না দিলে, মাঝরাতে আয়ন্তিকা কে কাতুকুতু দিয়ে ঘুম থেকে না উঠালে তার ঘুম পরিপূর্ণ হয়না। আয়ন্তিকা কয়েকদিন যেই রেগে গিয়েছিলো তার ওপর..! কিন্তু তারপর হতে সেও চুপ হয়ে গিয়েছে। বুঝে গিয়েছে এই লোককে কিছু বলে লাভ নেই।
অহর্নিশ আয়ন্তিকা কে জরীয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আমার শান্তির ঘুম কেঁড়ে নিয়ে নিজে এতো আরামে ঘুমাও কি করে?শরম করে না?উফফ! তোমার আবার লজ্জা করবে কি করে?মির্জাফর দের তো আবার লজ্জা টজ্জা নেই। ‘
অহর্নিশ নিজের আবুল মার্কা কথায় বকা বনে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা বেশি আমলে না নিয়ে চেষ্টা করে ঘুমানোর। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো কই?আজও তার রাত কাটবে আয়ন্তিকা কে দেখে দেখে!
__________________
ভোরের হিম শীতল বায়ু! পূর্ব আকাশে হলদেটে সূর্যের কিরণ দেয়ার ব্যাস্ততা। পাখিদের উড়ে বেড়ানোর মোক্ষম সময়। ঘাসের ওপর শিশিরের কণা। সব মিলিয়ে চমৎকার এক ক্ষনের জন্য ‘ভোরবেলা’ কে বলা যায় পার্ফেক্ট! আয়ন্তিকা ড্যাবড্যাব করে চারপাশ দেখছে। বাস শো শো করে চলছে যাত্রীদের নিজ গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য। বাসের সবাই মোটামুটি ঘুমে বিভোর! শুধুমাত্র আয়ন্তিকা বাদে। সে প্রতিটা মূর্হত অনুভব করার চেষ্টা করছে। সেভ করে নিচ্ছে ম্যামরিতে। তার পাশেই অহর্নিশ ঘুমে মগ্ন।
দুপুরের রৌদ্দুরের আনাগোনা হতেই অহর্নিশের ঘুমের রেশ কেটে যায়। পাশে আয়ন্তিকা কে ক্লান্ত দেখে সে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘ ঠিক আছো? ‘
আয়ন্তিকা পাশে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল,
‘ হুম! আপনার ঘুম কখনল ভাঙলো?’
‘ মাত্রই। আচ্ছা বাসে যেতে প্রবলেম হচ্ছে? হুট করেই গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেলো। টাকাও ছিলোনা ঠিক করার। তাই আরকি…! সরি! ‘
শেষোক্ত কথাটা মিনমিন করে বলল অহর্নিশ। তা দেখে আয়ন্তিকা রেগে গিয়ে বলল,
‘ এই আপনি সবসময় এক লাইন বেশি বুঝেন কেনো হ্যা? আজাইরা! আমি কি একবারও বলেছি আমার খারাপ লাগছে? আমার তো বাস জার্নি করেই অভ্যাস। গাড়িতে উঠলে বমি আসে! ‘
অহর্নিশ স্বস্তির শ্বাস ফেলে। এটলিষ্ট আয়ন্তিকা তো ঠিক আছে। এদিকে বাসে উঠে অহর্নিশের নাজেহাল অবস্থা প্রায়। কোনোরকম ইজ্জত বাঁচাতে স্বাভাবিক ব্যাবহার করছে। অতিষ্ঠ গরমে দুটো মাস্ক পড়ে আছে সে। এমপি মানুষ! বাসে উঠেছে লোকে দেখলে কি বলবে?তাছাড়া আয়ন্তিকা তার পাশে! তাই এই পথ অবলম্বন করা।
.
আয়ন্তিকা বাসায় এসে প্রায় আধাঘন্টা মায়ের গলা ধরে কেঁদেই কাটালো। অতঃপর বাবার সাথে তাদের বাগানে হওয়া বিভিন্ন ধরনের গাছের গল্প শুনে কেটে গেলো দুপুর। বিকেলে ছোটবোনের সাথে দুষ্টুমি করে মায়ের একটু আধটু বকুনি খেয়ে তার হাতে খাওয়া দাওয়া করে কাটলো। রাতে পুরে বাড়ির মিষ্টি ঘ্রাণ নিয়ে কাটিয়ে দিয়ে পরবর্তী দিনের অপেক্ষায় ঘুমে তলিয়ে গেলো সে রাত ১১ টাতেই!
এদিকে অহর্নিশের বেহাল, কুপোকাত দশা! পুরো দিন সে আয়ন্তিকা কে না দেখে কোনোরকম টিকে ছিলো। রাত হতেই ছটফট বেড়ে যায়। অহর্নিশ ভেবেছিলো আয়ন্তিকা রাতে হলেও তার সাথে ঘুমোবে। কিন্তু না! সে ঘুমিয়েছে তার মায়ের সাথে।
পরিশেষে পারে না অহর্নিশ নিজের অস্থিরতা কে দমন করতে। রুম থেকে বেড়িয়ে ফুপির রুমে গিয়ে আয়ন্তিকা কে ঘুমের মধ্যেই কোলে তুলে নিয়ে বাহিরে চলল! আয়ন্তিকার মা অহর্নিশ কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসে। সে ঘুমায়নি। জেগে ছিলো।
হাওয়ায় ভাসছে বলে অনুভব করে আয়ন্তিকা! চট করে চোখ খুলে নিজেকে অহর্নিশের কোলে আবিষ্কার করে যেইনা চিৎকার দিতে যাবে তখনি অহর্নিশ চটজলদি নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের সাহায্যে আয়ন্তিকার আগত চিৎকার দমন করে! অতঃপর মিনিট দুয়েক পর সরে এসে বলল,
‘ ফেলে দেবো কোল থেকে যদি চিল্লিয়েছো আয়ন্তিকা! ফাজিল মেয়ে! আমাকে কষ্ট দিয়ে ঘুমানো?আজ ছুটাবো তোমার ঘুম। অহর্নিশের স্পেশাল টর্চার দেখতে প্রস্তুত হয় সাইরিশ আয়ন্তিকা! আজ আমার হাত থেকে তোমায় কে রক্ষা করে দেখি! ‘
চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা