#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৩৬
★নূর মাত্রই ভার্সিটিতে এসেছে। হেঁটে ক্লাসের দিকে যাচ্ছিল ওমনই কোথাথেকে শিশির এসে হাজির হলো। নূরের সামনে এসে হাসি মুখে বললো।
–হায় নূর। কেমন আছ তুমি?
হঠাৎ শিশিরকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ছেলেটা কেমন যেন গায়ে পড়া টাইপের। নূরের আবার কালকের আদিত্যের কথা মনে পরতেই ভীষণ ভয়ও করছে। আবার যদি উনি এই লোকটার সাথে আমাকে দেখেন তাহলে আর রক্ষা নেই। নিশ্চয় আমাকে লবন দিয়ে গিলে খেয়ে ফেলবেন। নূরের ভাবনার মাঝেই শিশির বলে উঠলো।
–হেই নূর কি ভাবছ? চলো একটু ক্যাফেতে যাই। ক্লাসের তো এখনো সময় আছে।
নূর জোরপূর্বক হেসে বললো।
–আসলে আমার একটু নোট লিখার দরকার ছিল। আপনি যান না।
–আরে এটা কোন ব্যাপার হলো।তোমর নোট আমি লিখতে হেল্প করবো। এখন চলো। নাকি আমার সাথে যেতে চাচ্ছ না? আমার সাথে কি এককাপ কফি খাওয়া যায় না?
নূর চরম বিরক্ত হচ্ছে মনে মনে । কেনরে ভাই? তোর কি খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ নেই? ক্যাফেতে গিয়ে মরতে হবে কেন? আমি আছি আমার জ্বালায়। আর এই মহাশয় আছেন উনার কফি নিয়ে। সিনিয়র ভাই হয়। মানাও করতে পারছি না। নাহলে আবার নাজানি কি ভেজাল করে বসে। তাই অগত্যা নূর আর উপায় না পেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিশিরের সাথে কফি খেতে রাজি হয়ে গেল।
আর শিশির তো সেই খুশী। নূরকে পটানোর কোন রকম সুযোগ সে হাত ছাড়া করবে না। মেয়েটাকে তার মনে ধরে গেছে। আর যে একবার শিশিরের মনে ধরে যায় তাকে সে যেভাবেই হোক হাসিল করেই ছাড়ে। আর এই মেয়েটাকে একটু বেশিই মনে ধরেছে। তাই একেতো কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। কথাটা ভেবে শিশির বাঁকা হাসি দিল।
আদিত্য ওর অফিসের কেবিনে বসে আছে। তখনই ওর এক লোক কেবিনের দরজায় নক করলো। আদিত্য আসতে বললে লোকটা ভেতরে ঢুকলো। আদিত্যের সামনে একটা ফাইল রেখে বললো।
–স্যার আপনার দেওয়া গাড়ির নাম্বার অনুযায়ী গাড়ির মালিকের সব ডিটেইলস বের করেছি।
আদিত্য গম্ভীর কন্ঠে বললো।
–বলতে শুরু করো।
–স্যার গাড়ির মালিকের নাম শিশির আহমেদ। শামসুল আহমেদ এর একমাত্র ছেলে। এমনিতে সবদিক দিয়ে ঠিক ঠাকই আছে। পড়ালেখায়ও ব্রিলিয়ান্ট। শুধু একটা দিক প্রবলেম আছে।
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি?
–স্যার ছেলেটা সেই লেভেলের মেয়েবাজ। মানে ক্যারেক্টার লেস আরকি। যাকে একবার ভালো লেগে যায় তাকে যেভাবেই হোক তার নিজের করেই ছাড়ে। আর তারপর, বাকিটা তো বুঝতেই পারছেন।
–হুম বুঝতে পেরেছি। তুমি এখন যেতে পারো।
লোকটা মাথা ঝাকিয়ে চলে গেল।
আদিত্য ফাইলে থাকা শিশিরের একটা ছবি হাতে নিয়ে সামনে ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তড়ে।
কথাটা বলে আদিত্য একটা বাকা হাসি দিয়ে, শিশিরের ছবিটা দুমড়েমুচড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল।
_____
আয়াত ওর রুমে বসে এনজিওর কিছু পেপারস দেখছিল, তখনই ওর দরজায় কেউ নক করলো। আয়াত পেপারের দিকে তাকিয়ে থেকেই আসতে বললো। একটু পরে বিহান দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। আয়াত এখনো পেপারস চেক করছে। বিহান চুপচাপ কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে আয়াতের দিকে তাকিয়ে রইলো। আয়াত মাথাটা হালকা নিচু করে পেপার দেখছে। চুলগুলো উপরে চায়না কাটা দিয়ে আটকে রেখেছে। তবুও কিছু অবাধ্য চুল বাতাসে মুখের ওপর দিয়ে বাড়ি খাচ্ছে। পেপার চেক করতে করতে হাতের কলম টা কখনো দাঁতের মাঝে আটকে রাখছে। এই অতি সামান্য রুপেও যেন তাকে অপরুপ লাগছে। মেয়েটা যে এতো অপরুপ বিহান আগে খেয়ালই করেনি। আয়াতের ঠোঁটে চেপে রাখা কলমটার ওপর বিহানের অনেক হিংসে হচ্ছে। বিহানের আগেই বিহানের জিনিসে কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক মিনিট, বিহানের জিনিস? তুই তো দেখছি অনেক দূর চলে গেছিস বিহান। নিজের মন্তব্যে নিজের মনেই হাসলো বিহান।
আয়াত এতক্ষণ ধরে কে আসলো তার সাড়াশব্দ না পেয়ে মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো বিহান। তবে আজকের বিহানকে দেখে আয়াত বড়সড় একটা ঝটকা খেল। আয়াত হা হয়ে বিহানের দিকে তাকিয়ে রইলো।হা হওয়ায় ওর মুখের কলমটা ঠাস করে পরে গেল।
বিহান আজ একটা ব্লু জিন্সের ওপর হোয়াইট টিশার্ট পরেছে। মুখের জঙ্গল হয়ে থাকা দারি গোঁফ ট্রিম করে শেভ করেছে। চুলগুলোও সুন্দর করে জেল দিয়ে স্টাইল করে রেখেছে। হাতে রিচ ঘড়ি। সবমিলিয়ে বিহানকে আজ কিলার দেখাচ্ছে। বিহান সবসময় কেমন এলোমেলো অগোছালো হয়েই থাকে। নিজেকে আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতো পরিপাটি রাখে না। তবে আজকে বিহানকে অন্যরকম লাগছে। আয়াত যেন ওর চোখই ফেরাতে পারছে না।
আয়াতকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিহান মুচকি হেসে গলা খাঁকারি দিয়ে আয়াতের সম্ভূতি ফেরানোর চেষ্টা করলো। আয়াতের ঘোর কাটলো। ও এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। তারপর বিহানের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো।
–আ আপনি হঠাৎ এখানে? কোন দরকার ছিল?
বিহান বলে উঠলো।
–হ্যাঁ দরকার তো একটু ছিল। আসলে,,,
বিহানের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়াত কৌতুহলী কন্ঠে বললো।
–আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন? না মানে হঠাৎ এতো পরিপাটি হয়ে আছেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি।
–হ্যাঁ যাচ্ছি।
–কোথায়?
–বলবো। তার আগে বলো তুমি কি বেশি ব্যাস্ত আছ?
বিহানের মুখে আবারও তুমি সম্বোধন শুনে, আয়াতের বুকটা আবারও কেঁপে উঠল। আয়াত বলে উঠলো।
–না না তেমন ব্যস্ত নেই। বলুন না কি বলবেন?
–তুমি কি আমার সাথে এক জায়গায় যেতে পারবে?
আয়াত অবাক চোখে তাকিয়ে বললো।
–আমি? কো কোথায় যাবো?
–চলনা? গেলেই দেখতে পাবে। আমার ওপর এটুকু বিশ্বাস তো আছে তোমার তাইনা?
বিহানের কথা কাজ সবকিছু কেমন যেন অন্য রকম লাগছে আজ। আয়াত ঠিক বুঝতে পারছে না। তবুও কোনরকমে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। আপনি বাইরে গিয়ে বসুন।আমি এখুনি রেডি হয়ে আসছি।
কথাটা বলে আয়াত কাবার্ডের দিকে যেতে নিলে বিহান আবার ডাক দিল।
–আয়াত,
–আয়াতের হৃৎপিণ্ড যেন থমকে গেল। আজ এই প্রথম বিহান এতো সুন্দর করে আয়াতের নাম ধরে ডাকলো। আয়াতের হাত পা কেমন কাঁপতে শুরু করলো। গলার ভেতর দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আয়াত কোনরকমে ঢোক গিলে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–জ্বি বলুন?
বিহান ওর হাতে থাকা একটা প্যাকেট আয়াতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।
–এটা তোমার জন্য এনেছি আমি। জানিনা তোমার পছন্দ হবে কিনা। আসলে তোমাকে সেদিন শাড়ীতে অনেক সুন্দর লাগছিল। তাই আবারও তোমাকে শাড়ীতে দেখার লোভে এটা নিয়ে এসেছি। তুমি যদি কিছু মনে না করো তাহলে আজকে এই শাড়ীটা পরে আসবে প্লিজ?
আয়াত বিস্ময় ভরা চোখে বিহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিজের কানকে ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। কেমন যেন সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে। বিহান কি সত্যি আমাকে এসব বলছে? আয়াতের গলা ধরে আসছে। অনেক কষ্টে নিজের কান্না আটকে মাথা ঝাকালো। মানে সে পরবে।
বিহান একটা স্বস্তির হাসি দিয়ে বললো।
–ঠিক আছে। আমি নিচে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
তারপর বিহান বেরিয়ে গেল।
বিহান চলে যাওয়ার পর আয়াত কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেট টা খুললো। প্যাকেটের ভেতর একটা হালকা গোলাপি ইন্ডিয়ান সিল্কের শাড়ী। আয়াতের চোখের পানি এবার বাধ ভেঙে গড়িয়ে পড়লো। আয়াত শাড়ীটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর শাড়ীটা বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে খুশীর অশ্রু ঝড়ালো। এটা ওর বিহানের দেওয়া প্রথম উপহার। আয়াতের যেন খুশিতে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
কিছুক্ষণ পর আয়াত নিজেকে সামলে নিয়ে, চোখের পানি মুছে শাড়ীটা নিয়ে রেডি হতে চলে গেল।
বিহান ড্রয়িং রুমে বসে আছে। একটু পরে আয়াত সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। বিহান আনমনে পাশে তাকাতেই ওর চোখ আর হৃৎপিণ্ড দুটোই আটকে গেল আয়াতে। ওর কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে আয়াতকে।মেয়েটাকে যত দেখছে ততই যেন তার নতুন নতুন রুপের আবিষ্কার করছে। এই অপরুপ কন্যাটা ওকে এতোটা ভালোবাসে, ভাবতেই একরাশ ভালো লাগা এসে ঘিরে ধরলো বিহানের হৃদয় জুড়ে।
আয়াত বিহানের সামনে এসে দাঁড়াল। বিহানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়াতের কেমন লজ্জা লাগছে। আয়াত একটু গলা ঝেড়ে উঠলো। বিহনের এবার ঘোর কাটলো। বিহান একটু নড়েচড়ে উঠে বললো।
–তাহলে যাওয়া যাক?
আয়াত মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। তারপর ওরা দুজন বাইরে এসে গাড়িতে চড়ে রওয়ানা হলো। গাড়ীতে দুজনের ভেতর তেমন কোন কথা হলোনা। তবে বিহান বারবার আরচোখে আয়াতকেই দেখছিল। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর ওরা বনানী এলাকায় একটা এপার্টমেন্ট সামনে এসে থামলো। বিহান গাড়ি থেকে নেমে আয়াতের পাশে এসে দরজা খুলে ওর দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিল। আয়াত শুধু বিস্ময়ের ওপর বিস্ময় হচ্ছে।আয়াতের মনে পড়লো একদিন এই হাত ধরে নামার জন্য কতো জেদ ধরে বসেছিল আয়াত। আর আজ বিহান নিজে থেকেই ওর হাত ধরে নামাবে। সবকিছুই যেন স্বপ্নের মতো লাগছে আজ। যেন চোখ খুলে তাকালেই স্বপ্নটা ভেঙে যাবে।
আয়াত ওর কম্পনরত হাতটা বিহানের হাতে রাখলো। বিহান পরম যত্নে আয়াতের হাত ধরে ওকে নিচে নামিয়ে দাঁড় করালো। আয়াত সামনের এপার্টমেন্ট টা দেখে বললো।
–আমরা কি কারোর বাসায় এসেছি?
বিহান বলে উঠলো।
–হ্যাঁ তেমনই কিছু। চল গেলেই দেখতে পাবে।
কথাটা বলে বিহান আয়াতের হাত ধরে থেকেই ভেতরের দিকে পা বাড়ালো।
আয়াত শুধু বিহানের ধরে থাকা হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিহানের সাথে সাথে চললো।
এপার্টমেন্ট টা চৌদ্দ তলা বিশিষ্ট। বিহান আয়াতের সাথে লিফটে এসে টুয়েলভ বাটনে চাপ দিল। মানে ওরা তেরো তলায় যাবে। কিছুক্ষণ পরেই তেরো তলায় পৌঁছে লিফট থেকে নেমে এসে একটা ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়াল। ফ্ল্যাটের দরজায় এসে বিহান ওর পকেট থেকে একটা চাবি বের করে দরজা খুলছে। আয়াত শুধু বিহানের কার্যক্রম দেখে যাচ্ছে। ওর মাথায় আপাতত কিছুই ঢুকছে না। বিহান দরজা খুলে আয়াতকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে আয়াত অনেক টা অবাক হলো। কারণ ফ্ল্যাট টা একদম নতুন। দেয়াল থেকে এখনো রঙের ঘ্রাণ আসছে। তেমন কোন আসবাবপত্রও দেখা যাচ্ছে না। শুধু হালকা পাতলা কিছু জিনিস আছে। তবে ফ্ল্যাট টা অনেক সুন্দর। আয়াতের কাছে ভালোই লাগলো ফ্ল্যাট টা। ফ্ল্যাট টা উঁচুতে হওয়ায় জানালা দিয়ে ঠান্ডা শীতল বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। আর এই জিনিসটাই আয়াতের সবচেয়ে ভালো লাগছে। আয়াত আর কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–এটা কার ফ্ল্যাট? এখানে তো কাওকে দেখতেও পাচ্ছি না।
বিহান মুচকি হেসে বললো।
–কেন, আমাকে বুঝি চোখে পরছে না? নাকি আমাকে মানুষের তালিকা থেকে বাতিল করে দিলে?
আয়াত এবারে অত্যন্ত অবাক হয়ে বললো।
–এই ফ্ল্যাট আপনার?
–হ্যাঁ, বলতে পারো। তা কেমন লাগলো ফ্ল্যাট টা?
–অনেক সুন্দর। সত্যিই ভীষণ সুন্দর। মেনি মেনি কংগ্রাচুলেশনস।
–ধন্যবাদ। আসলে ভাবছিলাম কতকাল আর এভাবে ভবঘুরে হয়ে থাকবো। বিয়ে শাদি করে একটু সেটেল্ড হই। আর বিয়ে করতে গেলে আগে একটা ভালো ঘরের দরকার। তানা হলে আবার কোন মেয়ে বিয়েই করতে চাইবে না। তাই নিজের জীবনের কিছু জমাপুঞ্জি দিয়ে এই ফ্ল্যাট টা কিনলাম।
বিহানের কথায় আয়াত থমকে গেল। বুকটা ধড়ফড় করলে উঠলো ওর। কি বলছেন উনি? তাহলে কি উনি বিয়ে করছেন? আয়াতের এতক্ষণের সব খুশী যেন নিমিষেই মাটিতে মিশে আছে। আয়াত একটা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–আ আপনি ব বিয়ে করছেন?
–হ্যাঁ করতে চাচ্ছি। একটা মেয়েও পছন্দ করেছি। এখন সে শুধু রাজি হয়ে গেলেই হয়।
আয়াতের পায়ের নিচ থেকে যেখানে মাটি সরে গেল। নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হতে লাগলো। তারমানে উনি মেয়েও পছন্দ করে ফেলেছেন? আমার শেষ আশাটাও কি তাহলে এভাবে নিশ্বেষ হয়ে যাবে। তাহলে আমি বেঁচে থাকবো কি করে? আয়াতের ভাবনার মাঝেই বিহান আবার বলে উঠলো।
–মেয়েটা ভেতরেই আছে। তুমি একটু ওকে বুঝাও না আমাকে বিয়ে করতে যেন রাজি হয়ে যায়।
আয়াত এবার আরও বড়ো একটা ধাক্কা খেল। শেষমেশ কিনা এই দিনটাও ওকে দেখতে হলো? এখন কি আমার ওই মেয়েকে রাজি করাতে হবে বিহানকে বিয়ে করার জন্য? তাহলে এতক্ষণ ধরে এতো ভালো ব্যবহার বুঝি এইজন্য করছিলেন উনি? উনি এতটা নির্দয় কিভাবে হতে পারলেন? সবকিছু জেনেও আমাকে এই সিচুয়েশনে কিভাবে ফেলতে পারলেন উনি? এভাবে অপমান না করলেই কি হতোনা? ঠিক আছে। উনি আমাকে জ্বালিয়েই যদি শান্তি পায় তাহলে তাই হোক। আমিও আজ ধৈর্যের পরিক্ষা দেব। দেখি এর শেষ কোথায়?
আয়াতকে চুপ থাকতে দেখে বিহান আবার বললো।
–প্লিজ আয়াত? আমার জন্য একটু এই কাজটা করে দাও? প্লিজ প্লিজ প্লিজ,,,
আয়াত ঢোক গিলে কোনরকমে নিজের কান্না আটকে নিয়ে বললো।
–ঠি ঠিক আছে।
বিহান হাসি মুখে বললো।
–থ্যাংক ইউ আয়াত। থ্যাংক ইউ সো মাচ। তুমি পাশের এই রুমটাতে যাও। দেখবে রুমেই আছে ও।
আয়াত কোনরকমে মাথা ঝাকিয়ে কাঁপা কাঁপা পা জোড়া সামনে বাড়ালো। পা কেমন যেন চলতে চাইছে না ওর। হঠাৎ করেই প্রচুর ভারি হয়ে গেছে পা জোড়া। তবুও অনেক কষ্টে আয়াত রুমের দিকে এগুলো। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো ও। ভেতরে ঢুকে আশেপাশে তাকিয়ে কাওকে দেখতে পেল না আয়াত। আয়াত এবার ভ্রু কুঁচকে একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–এখানে তো কেউ নেই।
এবার বিহান ভেতরে ঢুকলো। আয়াতের কাছে এসে বললো।
–কে বলেছে কেউ নেই? আরে এখানেই তো আছে তুমিই দেখতে পাচ্ছ না।
–আরে আজব। কোথায় আছে? কাওকেই তো দেখতে পাচ্ছি না।
বিহান এবার আয়াতের হাত ধরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিয়ে এসে বললো।
–এইযে ভালো করে দেখো এখানেই আছে।
আয়াত আশেপাশে তাকিয়ে বললো।
–কই আছে আমিতো দেখতে পাচ্ছি না। আপনার হবু বউ কি ইনভিসিবল নাকি? নাকি মানুষ বাদ দিয়ে জ্বীন-ভূতকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন?
বিহান হালকা হাসলো। তারপর আয়াতের পেছনে এসে ওর পিঠ ঘেঁষে দাঁড়াল। এক হাতে আয়াতের থুতনি ধরে আয়নার দিকে তাক করলো। এরপর আয়নার দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে বললো।
–এইযে, এতো সুন্দর একটা জলজ্যান্ত মেয়ে তোমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তোমার চোখে পরছে না? এটাই তো আমার হবু বউ। ওর জন্যই তো আমি কাল এই ফ্ল্যাট কিনেছি। ওকে একটু বলনা, ও যেন আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়।
আয়াত কিছু সময়ের জন্য ব্ল্যাংক হয়ে গেল। পুরো ব্যাপার টা বুঝতে ওর কিছুটা সময় লাগলো। আর যখনই বুঝতে পারলো তখনই ওর সারা শরীর যেন অবস হয়ে আসলো। হৃৎপিণ্ডও যেন কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করা গেল।
আয়াতকে চুপ থাকতে দেখে বিহান আবার বলে উঠলো।
–কি হলো বলনা,সে করবে তো আমাকে বিয়ে?
আয়াত হঠাৎ এক ঝটকায় বিহানের কাছ থেকে এক কদমে পিছিয়ে গেল। তারপর দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিল। দরজা আটকে নিচে বসে পরে মুছে হাত চেপে কাঁদতে লাগলো। এটা ওর সুখের কান্না না দুঃখের তা জানেনা ও। শুধু জানে এখন কাঁদতে না পারলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে ও।
বিহানও আয়াতের পিছে পিছে দৌড়ে এলো। আয়াতের বন্ধ দরজার সামনে সে নিজেও বসে পড়লো। তবে আয়াতকে ডাকলো না। মেয়েটা হঠাৎ এতবড় শক নিতে পারেনি। তাই মেয়েটাকে একটু কাঁদতে দেওয়া দরকার। তাহলে মন হালকা হবে।
প্রায় দশমিনিট পর আয়াত নিজেকে একটু সামলে নিয়ে দরজা খুলে বের হলো। দরজা খুলতে দেখে বিহানও উঠে দাঁড়াল। আয়াত দরজা খুলে বিহানের দিকে না তাকিয়ে সোজা বাইরে চলে যেতে লাগলো। বিহান এবার আর চুপ করে না থেকে দ্রুত গিয়ে আয়াতের হাত টেনে ধরলো। আয়াত পেছনে না ঘুরেই হাত মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বললো।
–ছাড়ুন আমাকে। বাসায় যাবো আমি?
–তো এটা কি জঙ্গল মনে হচ্ছে তোমার? আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম তখন। সেটার উত্তর না জানা পর্যন্ত তুমি কোথাও যেতে পারবেনা।
আয়াত আর সহ্য করতে পারলোনা। এতদিনের দুঃখ কষ্ট, মান অভিমান সব মিলিয়ে এক বিস্ফোরক তৈরী হলো। আয়াত এক ঝটকায় বিহানের দিকে ঘুরে নিজের হাত ছাড়িয়ে, বিহানের বুকে দুহাত দিয়ে ধাক্কা দিল। ধাক্কা দিতে দিতে কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো।
–কি পেয়েছেন কি আপনি হ্যাঁ? সবকিছু আপনার মর্জি মোতাবেক হবে? যখন ইচ্ছে দূরে ছুরে দিবেন।আবার মন চাইলে কাছে টেনে নিবেন? আজ বলছেন বিয়ের কথা, আবার মন ঘুরে গেলে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিবেন। আমাকে কি আপনার খেলনা মনে হয়? আমি কি মানুষ না? আমার কি কোন অনুভূতি নেই? আর কতো খেলবেন আমাকে নিয়ে হ্যাঁ? আপনার কথা মেনে আপনার জীবন থেকে সরে গেছি। তাহলে আবার কেন আমাকে নিয়ে এমন খেলা খেলছেন? আমার কথা আপনি কখনো ভাবেন না। এখন কি আমাকে মেরে আপনি শান্তি পাবে,,,,
আর বলতে পারলোনা আয়াত। বিহান দুই হাতে আয়াতের মুখটা ধরে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো। এই মুহূর্তে আয়াতকে শান্ত করার জন্য এই উপায়টাই পেল বিহান। আর আয়াত,সেতো পুরো ফ্রিজ হয়ে গেল। হাত পায়ের শক্তি লোভ পেল। পুরো শরীর অসার হয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর আয়াত একটু শান্ত হয়ে এলে বিহান আস্তে করে আয়াতের ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠলো।
–আমি ভালোবাসার ক্যাচাল বুঝিনা। ক্যামতে করে তাও জানিনা। তয় একটা কথা আমি বুইঝ্যা গেছি। তোমাকে আমার প্রয়োজন। আমি আমার অন্ধকার অতীত ভুলে, তোমার সাথে নতুন করে জীবন শুরু করতে চাই। এখন তুমি বলো বিয়ে করবে আমায়? দেখ বিয়ের কথা যখন একবার মাথায় এনেছি তখন বিয়েতো করেই ছাড়বো। শারীরিক কিছু দরকারও তো আছে তাইনা? তাই তুমি বলো কি করবে? তুমি রাজি না হলে আমি অন্য কাওকে বি,,,,
এবার আয়াতও একই ভাবে বিহানের মুখ বন্ধ করে দিল। বিহান তার জবাব পেয়ে গেল। তাই খুশী মনে সে এবার আয়াতের অধরে ডুব দিল।
কিছু সময় পর আয়াত বিহানের ঠোঁট ছেড়ে বলে উঠলো।
–খবরদার আর কখনো যদি অন্য কারোর কথা মুখে এনেছেন, তাহলে আমি খুন করে ফেলবো আপনাকে। জানেন তখন কিছু সময়ের জন্য আমার ওপর কি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল? এভাবে কেউ ভয় দেখায়?
–তাহলে বলো বিয়ে করবে?
–এখনো আপনাকে বলতে হবে? এই দিনটার জন্য আমি কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি জানেন আপনি? শুধু একবার না হাজার বার রাজি আমি।
বিহান তৃপ্তির হাসি দিয়ে আয়াতের কপালে একটা চুমু খেয়ে আয়াতকে জড়িয়ে ধরলো। এক হাতে আয়াতকে জড়িয়ে নিয়ে, আরেক হাত দিয়ে ফোনটা বের করে আদিত্যের নাম্বারে ফোন দিল। আদিত্য ফোন রিসিভ করতেই বিহান বলে উঠলো।
–আদি আমিও স্বার্থপর হতে চাই। হেল্প করবি আমার।
আদিত্য বুঝে গেল বিহান কি বলতে চাইছে। তাই আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–অফকোর্স ইয়ার। তোর জন্য তো জান হাজির। তুই চিন্তা করিস না আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলবো।
বিহান খুশিমনে ফোন রেখে দিল। ও জানে আদিত্য থাকলে আর কোন চিন্তা নেই।।
_____
আবির ওর অফিসের কেবিনে বসে কাজ করছিল। হঠাৎ বাইরে কিছু হইচই এর শব্দ পেল আবির। আবির ব্যাপার টা দেখার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে কেবিনের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। বাইরে এসে আবিরের কপাল কুঁচকে এলো। বাইরে সব স্টাফ রা একজায়গায় গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিরের ভেতর থেকে কোন মহিলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এসব দেখে আবির একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–কি চলছে এখানে?
আবিরের কথায় সব স্টাফ রা দুই দিকে লাইন হয়ে সরে গেল। তখনই মাঝখানে থাকা একজন লম্বা ঘোমটা দেওয়া মহিলাকে বসে থাকতে দেখতে পেল আবির। মহিলাটা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আবিরের দিকে দৌড়ে এসে আবিরের পায়ের কাছে পড়ে বলে উঠলো।
–প্রাণনাদ(প্রাননাথ) প্রাণনাদ। আন্নে এইহানে প্রাণনাদ।
আবির যেন তব্দা খেয়ে গেল। ছিটকে সরে গিয়ে বললো।
–এই এই, কে আপনি? কি করছেন এসব?
মহিলাটি এবার দুই হাতে বুক চাপড়ে আহাজারি করে বললো।
–হায়, হায় এইয়া কিতা কয় আঁর প্রাণনাদ? আঁর প্রাণনাদ আঁরে কয় আঁই কেডা। আঁই এহন কিতা করিয়াম? এই অভাগীর কিতা হইবো অহন?
মহিলার এমন মরাকান্না দেখে আবির বেচারা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কে এই মহিলা? আর এখানে কি করছে তাই বুঝতে পারছে না ও। চেহারাটাও দেখা যাচ্ছে না। তবে মহিলার আওয়াজ কেমন যেন পরিচিত পরিচিত লাগছে ওর কাছে। অফিসের স্টাফরাও সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একজন স্টাফ আরেকজনকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো।
–এই প্রাণনাদ কি জিনিস রে? না মানে গরুর নাদ শুনেছি। তবে প্রাণনাদ কি?
আরেকজন বলে উঠলো।
–আরে হবে হয়তো কোন কিছুর নাদ।
আবির ওর স্টাফদের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি হচ্ছে এসব? এই মহিলা কে? আর উনাকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছেন কেন?
একজন স্টাফ বলে উঠলো।
–স্যার উনি বলছেন এখানে নাকি উনার হাসব্যান্ড আছেন। তাকেই খুঁজতে এসেছেন উনি।
–হোয়াট? কে উনার হাসব্যান্ড?
মহিলাটি ঘোমটার ভেতর থেকে বলে উঠলো।
–আরে আন্নেই তো আঁর হাফপ্যান্ট (হাসব্যান্ড)। আঁর প্রাণনাদ।
আবির মহিলার কথা কিছুই বুঝতে পারলো না। একজন স্টাফ বলে উঠলো।
–স্যার উনি বলতে চাচ্ছেন আপনিই উনার হাসব্যান্ড।
আবির যেন আকাশ থেকে পড়লো। অবাক হয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–হোয়াট ননসেন্স? কি বলছেন আপনি এসব? আমি তো আপনাকে চিনিই না।
আবিরের কথা শুনে মহিলাটি আরও জোরে জোরে আহাজারি করে বললো।
–হায়য় হায়য় কিতা কয় আঁর প্রাণনাদ? হ্যায় বলে আঁরে চিনেনা। হ্যায় কেমনে আরে ভুইল্যা গেলগা।
মহিলাটি এবার অফিসের স্টাফদের কাছে এগিয়ে এসে বললো।
–ও সাপ(সাব) সাপ। আন্নেরা এতোগুলান সাপেরা আছেন। কেউ আঁর এই অন্যায়ের বিচার হরেন। আঁরে ইনসাফ দেন।
মহিলাটি আবিরের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো।
–এইযে এই মরদ হান। এই আমার মরদ,আমার প্রাণনাদ আজ থাইক্কা পাঁচ বচ্ছর আগে আঁর গ্রামে আইছিল। আর গ্রামে আইসা আমার লগে ইটিস পিটিস করছিল। রাতের বেলায় চুপ কইরা আমার কাছে আইসা কয়, আই লাভলী গু (আই লাভ ইউ)। আঁইও হ্যাঁরে কইলাম, আইও তোমারে লাভলী গু করি। তারপর কি কয় জানেন সাপ?
স্টাফ রা অতি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
–কি বললো?
—আঁরে কয়, আমি হাগু(হাগ) করবার চাই। আইও হ্যাঁরে হাগু করোনের লাইগা পাট খতে
লইয়া গেলাম। তয় হ্যায় হাগু করলো না। হ্যাঁয় আঁরে পাটখেতের ভিতরে চাইপ্পা ধরলো। আই শরম পাইয়া কইলাম, কি করতাছেন আমগো অহনো বিয়া হয়নাই। হ্যায় তহন কইলো, আমি তোমারে এই রাতের তাঁরা, আর এই পাট খেত রে সাক্ষী রাইখা বউ হিসেবে কবুল বললাম। আঁইও হ্যাঁরে কবুল কইলাম। ব্যাস হইয়া গেল আমগো বিয়া। আর অহন কিনা কয় হ্যাঁয় আঁরে চেনে না। হায়য় আল্লাহ আঁই অহন কিতা করিয়াম? আঁর কি হইবে?
আবির বেচারা হতভম্ব হয়ে গেল। কোথাকার কোন মহিলা কি সব হাবিজাবি বলে যাচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। মহিলাটা নির্ঘাত পাগলা গারদ থেকে ছুটে এসেছে।
মহিলাটি এবার বলে উঠলো।
–আঁর চুন্নু মুন্নু টুন্নুর কি হইবে?
একজন স্টাফ ভ্রু কুঁচকে বললো।
–চুন্নু মুন্নু টুন্নু? এরা কারা?
মহিলাটি বলে উঠলো
–কারা আবার, আঁর প্রাণনাদের ভালোবাসার ফসল। আঁর বাইচ্চারা। আঁর বাইচ্চারা কবে থাইকা তাগো বাপেরে দেখবার চায়। আইজকা ওগো আশা পূরণ হইবো।
মহিলাটি একটু উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো।
–চুন্নু মুন্নু টুন্নু,,
একটু পরে তিনটা বাচ্চা দৌড়ে এলো। মহিলাটি তাদের কে আবিরের দিকে দেখিয়ে বললো।
–বাইচ্চারা ওই দেহ তুমগো আব্বা।
বাচ্চাগুলো আবিরের দিকে ছুটে আসতে আসতে বললো।
–আব্বাজান,,,,
আবির বেচারা এবার অজ্ঞান খাওয়ার উপক্রম। পুরো হাক্কাবাক্কা হয়ে গেছে ও। বাচ্চাগুলো কাছে আসতেই আবির হকচকিয়ে উঠে বললো।
–আরে আরে কি করছ তোমারা? আমি তোমাদের বাবা হতে যাবো কেন? আরে আমার তো এখন বিয়েই হয়নি।
মহিলাটি আবারও আহাজারি করে বললো।
–হায় হায় কত্তোবড় নির্দয় রে। নিজের বাইচ্চা গুলান রেও চেনে না। আই অহন কিতা করিয়াম?
মহিলাটি আবারও স্টাফ দের দিকে তাকিয়ে বললো।
–জানেন সাপ, আমি কত্তো কষ্ট কইরা এই বাইচ্চা গুলান রে পালছি। সবসময় কইছি তগো বাপের মতো বড়ো মানুষ হইবি। জানেন সাপ, আঁর প্রাণনাদ এতো পড়ালেহা জানে দেইখা আঁইও আঁর বাইচ্চা গুলান রে পড়ালেহা শিখাইছি। হ্যাঁগো আঁই আঙ্গার কেজি(ইংরেজি) শেখাই ছি। আঁর বাইচ্চারা অহন পটপট কইরা আঙ্গার কেজি কয়। দেহেন এহোনি কি সুন্দর আঙ্গার কেজি কইবো।বাবা চুন্নু সাপেগো তোমার আঙ্গার কেজি হুনাও তো।
মহিলাটির কথামতো ছেলেটা সবার সামনে এসে বলতে লাগলো।
–আই নেম চুন্নু। আই উঠিং সকালবেলা। আই মুখ ধুয়িং, দেন আই হাগিং। তারপর আই খাইং ভাত। আফটার ভাত খাইং আই গোয়িং ইশকুল। ইন দা ইশকুল আই করিং লেখাপড়া। দেন আই ফিরিং বাড়ি। ওয়ান ডে হোয়েন আই ফিরিং বাড়ি, আই দেখিং হোয়াট?
সব স্টাফ রা আগ্রহ নিয়ে বললো।
–হোয়াট?
–আই দেখিং মুন্নু এন্ড টুন্নু করিং মারামারি। আন্ডার দ্য গাছতলা, বিহাইন্ড দ্যা ঝোপের বেড়া।
একজন স্টাফ ভ্রু কুঁচকে বললো।
–হোয়াট ইজ ঝোপের বেড়া?
–ওয়ান বাম্বু খাঁড়া খাঁড়া, আদার বাম্বু পাতালি করা। তাহার মাঝে প্যারাগ মারা। হেইয়ারে কয় ঝোপের বেড়া।
সব স্টাফ গুলো হাসতে শুরু করে দিল। আবির পরে গেছে এক মহা মুশকিলে। কি এক আপদ এসে জুটলো কে জানে।
হঠাৎ হৈচৈ এর শব্দে আবিরের বাবা বাইরে এলো। আশরাফ রহমান কে দেখে সবাই চুপচাপ হয়ে গেল। আবিরও ঘাবড়ে গেল ওর বাবাকে দেখে। নাজানি বাবা কি মনে করে কে জানে?
আশরাফ রহমান বলে উঠলেন।
–কি হচ্ছে এখানে? এতো হইচই কেন? আর এরা কারা?
একজন স্টাফ ফট করে বলে উঠলো।
–স্যার এই মহিলার কথা অনুযায়ী ইনি আপনার পুত্রবধূ আর এই বাচ্চাগুলো আপনার নাতী।
আশরাফ রহমান আশ্চর্য হয়ে বললেন।
–হোয়াট? কি বলছ এসব? আবির এসব কি সত্যি?
আবির ভীতু স্বরে বললো।
–না না বাবা একদম না। আমিতো উনাকে চিনিই না। জানিনা কোথাথেকে এসেছেন? আর কিসব আবোল তাবোল বলে যাচ্ছেন।
আশরাফ রহমান এবার মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললেন।
–এই মেয়ে কে তুমি? আর কি বলছ এসব? তোমার কথার কোন প্রমান আছে?
মহিলাটিও হঠাৎ করে কেমন চুপ হয়ে গেল। আশরাফ রহমান আবার বলে উঠলেন।
–কি হলো কথা বলো? আর তোমার মুখ দেখাও। দেখি তুমি কে?
মহিলাটি তাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আশরাফ রহমান এবার একটা ফিমেল স্টাফ কে ইশারা করলো মহিলার ঘোমটা সরাতে। স্টাফ টি এসে মহিলাটির ঘোমটা সরিয়ে দিলেন। ঘোমটা সরাতেই আবির ৮৮০ ভোল্টের একটা ঝটকা খেল। কারণ যেমনটা আমরা সবাই জানি, মহিলাটি আর কেওনা বরং নীলা। আবির বেচারা পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল। নীলা যে এসব করবে সেটা ওর ধারনাই ছিলনা।
আশরাফ রহমানও নীলাকে দেখে অবাক হলেন। নীলা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে ও জানতোই না যে এখানে আবিরের বাবাও আছেন। জানলে কখনোই আসতো না। এখন কি করবে ও। ভয়ে গলা শুঁকিয়ে দিলেই ওর।
আশরাফ রহমান অবাক সুরে বললেন।
–নীলা? তুমি এখানে? আর এসব কি?
নীলা বেচারি কি বলবে? আবির কে মজা দেখাতে এসে নিজেই ফেঁসে গেল। এখন কি বলবে ও? আবিরও প্রচুর ভয় পেয়ে গেল। নাজানি ওর বাবা ব্যাপারটা টা কিভাবে দেখেন।
হঠাৎ আশরাফ রহমান হো হো করে হেঁসে উঠলেন। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আশরাফ রহমান হাসি থামিয়ে বললেন।
–আমার কবিনে এসো কথা আছে তোমাদের সাথে।
একটু পরে আবির আর নীলা মাথা নিচু করে ভীতু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আশরাফ রহমানের সামনে। আশরাফ রহমান একটু গম্ভীর কন্ঠে বললেন।
–কবে থেকে চলছে এসব?
আবির ভীতু স্বরে বললো।
–আ আসলে বাবা হয়েছে কি,,,
আশরাফ রহমান এবার হাসিমুখে বললেন।
–থাক আর বলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি। আমি খুব শীঘ্রই নীলার বাবা মার সাথে কথা বলবো।
আবির প্রচুর খুশী হয়ে গেল। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। বাবা যে এতো সহজে রাজি হয়ে যাবেন তা ভাবতেই পারেনি ও। যাক নীলার এখানে আসায় আমারি ভালো হলো। কথাটা ভেবে আবির নীলার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে চোখ টিপ মারলো। আর নীলাতো এমনিতেই লজ্জায় শেষ।
চলবে…..