হৃদমাঝারে_আছো_তুমি
নবম_পর্ব
#তাসনূমা_ফারেহীন
তারিন অস্থির হয়ে চারদিকে অপ্সরাকে খুঁজতে থাকে। তখনি পেছন থেকে কারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তারিনের বিস্ময় যেন দ্বিগুণ মাত্রা লাভ করে। পেছন ঘুরে কাউকে দেখতে পেয়ে তারিন স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।
তারিনের সন্দেহই সঠিক প্রমাণিত হলো।
কিছু দূরেই সোহান তারিনের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দূর থেকে দেখেও ঠিকি চিনতে পারলো তারিন। সোহানকে দেখে অপ্সরা সোহানের দিকে ছুটে গেলো। তারিনের বুঝতে বাকী নেই, তার প্রতিবেশীদের এভাবে বাসস্থান পরিবর্তন এবং সোহানের এখানে আসা কাকতালীয় নয় বরং দুটো ঘটনার মাঝে কোন যোগসূত্র রয়েছে। অর্থাৎ সোহান পরিকল্পনা করেই এখানে এসেছে। তারিন সামনে এগিয়ে সোহানকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অপ্সরা ছুটে এসে বললো,
– ‘আন্টি বন্ধু খুব ভালো। আমার সাথে খেলার জন্য বন্ধু এখানে চলে এসেছে। এখন অনেক মজা করে লুকোচুরি খেলবো।’
অপ্সরার মাথায় হাত বুলিয়ে তারিন মুচকি হেসে বললো,
– ‘হ্যাঁ, তাতো অবশ্যই, অনেক মজা হবে।’
তারিন অপ্সরাকে ঘরে পাঠিয়ে দিলো।
– ‘তবে আমাদের সবসময় চোখ কান খোলা রেখে খেলা উচিত। যাতে চারপাশে রহস্যময় লুকিয়ে থাকা প্রতিপক্ষ এবং ছদ্মবেশীদের সহজে শনাক্ত করা যায়। একবার অসতর্ক হলেই সবকিছু হারিয়ে ফেলতে হয়!’
সোহান বরারবরের মতোই মুচকি হেসে বললো,
– ‘তবে বাস্তব খেলাধুলা থেকে কিছুটা আলাদা। এখানে কেবল সতর্ক থাকা যথেষ্ট নয় বরং নিজের বুদ্ধিমত্তার সাহায্যেও সবকিছু পরখ করে দেখতে হয়। কেননা অনেক সময় আমাদের চোখের সামনে এমন এক অদৃশ্য মিথ্যের জাল বিছানো হয় যাতে সত্য আড়ালেই রয়ে যায়!’
তারিন প্রত্যুত্তরে সোহানকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। এতে সোহান বেশ অবাক হয়। হঠাৎ তারিন চিৎকার করে বললো,
– ‘সরে দাঁড়াও!’
তারিন ছুটে এসে সোহানকে সরিয়ে নিতে উদ্যত হয়। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ দূর থেকে কেউ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে মারে। গুলি সোহানের হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। সোহানের হাত গলিয়ে রক্ত পড়ছে। তারিন তা দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যায়।
দ্রুত ফার্স্ট-এইড বক্স নিয়ে আসে। খুব একটা বেশি লাগেনি। তারিন সঠিক সময়ে সোহানকে সরিয়ে না নিলে অনেক বড় বিপদ হতে পারতো। তারিন ধীরে ধীরে সোহানের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগে।
– ‘আমার আঘাতে তোমার অস্থিরতা দেখে ভীষণ অবাক হচ্ছি! শত্রু হিসেবে তোমার তো এতে আনন্দ পাওয়া উচিত। তার বদলে তুমি নিজেই আমাকে বাঁচিয়েছো!’
তারিন বললো,
– ‘শত্রুতার সম্পর্কের পূর্বে আমি একজন মানুষ। আমি কেবল মানুষ হিসেবে মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছি। শত্রু বলে নিজের চোখের সামনে আমি কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না।’
সোহান বললো,
– ‘ভালোবাসা কত আজব তাইনা? যে ভালোবাসায় দুটো হৃদয় মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়, সেই ভালোবাসাই আবার হৃদয়কে খন্ড-বিখন্ড করে। সেই ভালোবাসা আবার আঘাত করে আঘাতে ওষুধের প্রলেপও লাগায়!’
সোহান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। তারিন বললো,
– ‘আমি জানি সেদিনের ঘটনায় অনেক কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু আমার দিকটাও তোমার ভাবা উচিত। অপ্সরাকে খুঁজে না পেয়ে মাথায় আজব সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সবকিছু এত আকস্মিক ভাবে ঘটে গেলো যে বুঝার সুযোগই হয়নি!’
সোহান বললো,
– ‘পাঁচ বছর আগেও কিন্তু আমাদের আকস্মিক ভাবেই দেখা হয়েছিলো। জীবনের কী আজব নিয়ম! প্রতিবার আমরা জীবনকে নিয়ে এক রকম পরিকল্পনা করি আর জীবন আমাদেরকে অন্যরকম কিছুর-ই সম্মুখীন করায়! মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি আমাদের কখনো দেখাই না হতো! তাহলে হয়তো আমাদের প্রত্যেকের জীবন এতটা ছন্নছাড়া হতো না।’
তারিন দ্রুত তার ঘরে প্রবেশ করলো। কোনো কারণে তারিন বেশ রেগে রয়েছে। পলে সোহানের কথারও কোন জবাব না দিয়েই চলে এসেছে। প্রথমে লক্ষ্য না করলেও একটা বিষয় তারিনকে বেশ ভাবাচ্ছে। হঠাৎ এভাবে তাদের উপর কে আক্রমণ করলো? তাদের উদ্দেশ্যে-ই বা কী?
তারিন বেশ রেগে দ্রুত কদমে রায়হানের ঘরে প্রবেশ করলো। রায়হান তার হাতের কাটা অংশে এন্টিসেপটিক লাগাচ্ছিলো। তারিনকে দেখামাত্র রায়হান বললো,
– ‘আরে তারিন! কী হয়েছে? তোমাকে এতটা অস্থির লাগছে কেন?’
– ‘আমার অস্থিরতা, ক্রোধের কারণ তুমিই।’
রায়হান বিস্মিত কন্ঠে বললো,
– ‘মানে?’
– ‘রায়হান তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি তোমাকে কিসের কথা বলছি।’
– ‘আমি কোন অন্যায় করিনি। আমি কেবল সেটাই করেছি যা আমার আগেই করা উচিত ছিলো।’
– ‘তুমি অবশ্যই অন্যায় করেছো। তুমি একজনকে মেরে ফেলতে চলেছিলে।’
– ‘অন্যায় তুমিও করেছো তারিন। তুমি একজন খুনির পক্ষে থেকে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছো।’
– ‘কেউ খুনি তার মানেই তুমি তাকে মেরে ফেলবে? তাহলে তার এবং তোমার মাঝে কী পার্থক্য রইলো? ভাগ্যিস আমি সেসময় তোমার হাতের ঐ দাগটি দেখতে পেয়েছিলাম। নয়তো তো চিনতেও পারতাম না কে আমাদের উদ্দেশ্যে গুলিটা ছুঁড়েছিলো।’
.
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৬
নিশীথের অন্ধকারে পেরিয়ে ভোরের সূর্যের আগমন ঘটে। আড়মোড়া ভেঙ্গে শোয়া থেকে উঠে বসলো তারিন। খানিক বাদে ক্যালেন্ডারে চোখ পড়তেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো। মন্থর গতি তড়িৎ গতি লাভ করলো যেন। দ্রুত উঠে তৈরি হয়ে নিচে চলতে থাকলো দ্রুত গতিতে। মন্থর গতি তড়িৎ গতি লাভ করলো যেন।
টি-টেবিলের সামনে বসে সাইফ চৌধুরী খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিলো। সবে মাত্রই চা-দিয়ে গেলো। চায়ের কাপে এক চুমুক দিতেই তারিনকে সামনে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। চোখের হাই-পাওয়ারের গ্লাসটি একবার মুছে নিয়ে আরেকবার ভালো করে দেখলেন, নাহ্! তিনি তারিনকেই দেখেছেন।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে তারিনকে দেখতে পেয়ে মিসেস. রিমির প্রতিক্রিয়াও কিছুটা এরকমই ছিলো। দুজনেই অবাক হয়ে বললেন,
– ‘তারিন তুই!’
সাইফ চৌধুরী এবং মিসেস. রিমির প্রশ্নে তারিন নিজেও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
– ‘আমার বাবার বাড়িতে আমি ব্যতীত আর কে থাকবে!’
রিমি বললেন,
– ‘না মানে, যে মেয়েকে এক বালতি পানি ঢেলে দিলেও কখনো ঘুম থেকে উঠেনি। আজ হঠাৎ সে নিজে থেকেই এত সকাল ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে এসেছে! দেখে ভীষণ অবাক হচ্ছি!’
তারিন বললো,
– ‘মা…! তুমিও না। রাত জেগে পড়ার কারণে আমি সকালে উঠতে পারতাম না। কিন্তু আজকে তো উঠেছি। বাবা তুমি তো কিছু বলো!’
সাইফ চৌধুরী চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে বললেন,
– ‘তোদের মা-মেয়ের ব্যাপার। আমি আর কী বলবো?’
তারিন বললো,
– ‘ছাড়ো। আচ্ছা বাবা, বলতো আজকে কী?’
– ‘আজকে তো শুক্রবার। ছুটির দিন। কেন?’
– ‘না কিছুনা। বাদ দাও। আমি আসছি।’
রিমি বললো,
– ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
তারিন অভিমানী সুরে জবাব দিলো,
– ‘অধরার বাড়িতে যাচ্ছি।’
তারিন বেরিয়ে পড়ে অধরার বাড়ির উদ্দেশ্যে। তারিনের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয় অধরার বাড়ি। মিনিট কয়েকের ব্যবধানেই অধরার কাছে পৌঁছে যায় তারিন। সকালবেলা হঠাৎ তারিনকে দেখে অধরা খুব খুশি হয়। দুজন কুশল বিনিময় করলো।
তারিন অধরাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– ‘কেমন আছিস?’
অধরা মুচকি হেসে বললো,
– ‘আলহামদুলিল্লাহ্ তুই কেমন আছিস? আজ এত সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়লি!’
তারিন রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো,
– ‘কারণ তো আছেই! আজ কিছু একটা বিশেষ জিনিস আছে।’
অধরা জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বললো,
– ‘আচ্ছা? আজ সত্যিই বিশেষ কিছু আছে? কিন্তু সেটা কী? আমার তো মনে পড়ছে না।’
অধরার কথা শুনে তারিন মন খারাপ করে ফেললো। অন্তত নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর থেকে এমনটা সে আশা করেনি। কিন্তু তারপর সত্যিই এমন কিছু ঘটলো যা তারিন কল্পনা করেনি!
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১
স্মৃতিচারণের মাঝেই আনমনে হেসে ফেললো তারিন। বর্তমানে সে তার ঘরের ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাঁচ বছর পেরিয়ে আবারো একি দিন এলো। তবে এখন সময় এবং পরিস্থিতি দুটোই ভিন্ন, বদলে গেছে নানা সম্পর্কের সমীকরণ। কিছু মানুষের সাথে এখন আর সামনাসামনি কথা হয় না। ফ্রেমবদ্ধ ছবির সাথেই নিজের মনোভাবের আদান-প্রদান চলে। তারিন তার পাশে রাখা ফ্যামিলি ফটোতে একবার হাত বুলিয়ে নিলো।
এক বিন্দু অশ্রুজল নিঃশব্দে গাল গড়িয়ে বেয়ে পড়লো ছবিটির উপর। তারিন নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– ‘কোন এক সময় আজকের দিনটিকে নিয়ে আমি খুব আনন্দিত থাকতাম। কিন্তু আফসোস হয়, যদি ওই দিনটাই আমার জীবনে না আসতো। তাহলে হয়তো বাস্তব কিছুটা অন্যরকম হতো।’
তারিন যখন তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখময় সময় অতিবাহিত করছিলো, তখনি অপ্রত্যাশিত কিছুর সম্মুখীন হতে হলো তাকে।
চলবে…