#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_১৯
#Saji_Afroz
তানিশা কে নিয়ে শপিংমল এ এসেছে নওয়াজ ৷ তার মা বলেছে, তাড়াহুড়ো করে আকদ হলেও তানিশা কে বউ সাজতে হবে । তার যেন মন খারাপ না হয়৷ আর তাই তানিশা কে নিয়ে এখানে আসা।
তানিশা নিজের জন্যে অনেকক্ষণ যাবত খুঁজে একটি গোলাপি রঙের শাড়ি পছন্দ করেছে। সে নওয়াজ কে বলল, এই রঙে সমস্যা নেই তো? আসলে বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাবছি লাল বা খয়েরী পরব।
-তোমার যা খুশি যাও।
-আচ্ছা ভাইয়া।
.
এই বলে জিভে কামড় বসায় তানিশা। আসলে ছোট থেকে নওয়াজ কে ভাইয়া ডাকাটা অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। যদিও সে অনেক আগে থেকেই নওয়াজ কে পছন্দ করতো। কিন্তু কখনো বলা হয়নি ভয়ে। তার ছোট বেলার ভালোবাসার মানুষ কে নিজের করে পেতে চলেছে বলে মহাখুশি তানিশা। কিন্তু বিয়ের পরে তাকে কী ডাকবে? ভাইয়া বলে ডাকলে আশেপাশের সবাই হাসবে। এতদিনের অভ্যেস হুট করে বদলাবে কীভাবে। এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে তানিশা।
এদিকে তানিশার মুখে ভাইয়া ডাক শুনে কেমন যেন লাগছে নওয়াজের কাছে। কোনোদিন ভাবেনি ছোট এই বোনটাকে তাকে বিয়ে করতে হবে। বুশরার উপরে রাগ করে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে না তো সে?
.
.
তায়শার এখন খুশির দিন। কিন্তু বুশরার ফোন আসার পর থেকে তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে৷ মেয়েটা এতদিন পরে তাকে ফোন দিয়েছে, আর তার মা এমন আচরণ করলো। আসলেই নিজের মা বাবা ছাড়া কেউ আপন হয় না। বুশরার বাবা তার সাথে কথা না বললেও প্রতি মাসে মেয়ের খরচ দিতে ভুলে না। কিন্তু সেখান থেকে একটা টাকাও কী বুশরা কখনো পেয়েছে? পায়নি। উলটা নিজের বাড়িতে থেকে শত অপমান সে সহ্য করেছে। একটু আগেও বুশরার বাবার টাকা এসে পৌঁছেছে আলিয়া খাতুনের কাছে। এই বাড়িতে বুশরার ঠাঁই নেই। অথচ তার নামে পাঠানো টাকার ঠাঁই ঠিকই আছে। এসব ভেবে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললো তায়শা।
তার পাশে বসে নাফিশা বুশরার জন্য কাঁদছে। তায়শা তাকে শান্তনা দিলে সে বলল, এতদিন পর বোনটা ফোন দিলো। একটু কথাও বলতে পারলাম না। আমার খুব খারাপ লাগছে।
-খারাপ তো আমারও লাগছে রে। মা এর কী সমস্যা বুঝি না।
.
.
আজ বুশরার আনন্দের সীমা নেই। নওয়াজ দেশে আছে এর থেকে বড়ো আনন্দের খবর আর কী হতে পারে! তার জীবনের সকল দুঃখ মুছে যাবে। সে নওয়াজের কাছে ফিরে যাবে। কিন্তু নওয়াজ যদি তাকে ভুল বুঝে? এতদিনে নিশ্চয় তার মা কান ভারী করেছে। কিন্তু তায়শা তো আছে। সে সবটা তাকে খুলে বলবে, এই বিষয়ে নিশ্চিত বুশরা। একটাবার দেখা হোক নওয়াজের সাথে। সেও তাকে সবটা জানাবে। নিশ্চয় নওয়াজ তাকে অবিশ্বাস করবে না।
ইচ্ছে করছে এখুনি ছুটে যেতে। কিন্তু নিহির বাসায় নেই। তাকে না বলে বের হওয়াটা ঠিক হবে না৷ বলেই যেতে হবে। যদি নওয়াজ তাকে আর আসতে না দেয়? তাই নিহির কে বলেই সে যেতে চায়।
.
.
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। নিহিরের অপেক্ষায় সারাঘর পায়চারি করছে বুশরা। তাকে এভাবে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে দেখে নিখিল বলল, অস্থির দেখাচ্ছে আপনাকে।
-আসলেই তাইনা? অস্থির হয়ে আছি আমি।
-কেনো?
-আমার একটু বাইরে বেরুনো প্রয়োজন। কিন্তু নিহির স্যার বাসায় আসছেন না।
-বাইরে যাওয়ার সাথে ভাইয়ার কী সম্পর্ক?
-অনুমতির জন্য।
-আমি অনুমতি দিলাম।
.
বুশরা ভ্রু কুচকে বলল, জব তো আপনি দেননি আমায়। যিনি দিয়েছেন তার থেকেই নেব।
.
নিখিল হেসে তার ভাইকে ফোন দেয়। কিন্তু রিসিভ করে না। নিখিল বলল, ভাইয়া মনেহয় ব্যস্ত। ফোন রিসিভ করছে না। নাহলে ফোনেই নিয়ে নিতে পারতেন।
.
বুশরা চিন্তিত স্বরে বলল, রাত হবে না তো আসতে!
-অনেক সময় ভাইয়া অফিসেই থেকে যায়।
.
এই বলে মুচকি হেসে নিখিল নিজের রুমে চলে যায়। আর এদিকে বুশরা পড়ে যায় ভাবনায়। কী করবে সে এখন!
.
.
বর কনের কাপড় কেনা শেষ। এই কেনাকাটা ছাড়া আপাতত আর কোনো কেনাকাটা হচ্ছে না। একেবারে বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় হবে। আগামীকাল নওয়াজের আকদ হবে। একদিকে হতাশায় ডুবে রয়েছে নওয়াজ। অন্যদিকে তানিশার খুশির সীমা নেই! এখনই সে তার আকদের শাড়ি পরে বাড়ির সবাই কে দেখাচ্ছে। কখন যে রাত পার হয়ে সকাল আসবে! সুন্দর একটি সকাল। তার জীবনের সবচেয়ে মধুর সকাল হবে এটি। যে সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে অপেক্ষা করবে প্রিয় মানুষটির জন্যে। যোহরের নামাজের পর পরই কবুল বলবে সে। ভাবতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে তানিশার।
.
.
রাতে বাড়ি ফিরে নিহির। এসেই নিখিল কে খুঁজে সে। মিটিং এ ছিল বলে তার ফোন রিসিভ করতে পারেনি।
নিখিল কে এই কথা বলতেই সে বলল, বুশরা মেয়েটা খুঁজছিল তোমায়। সে না কি কোথায় যেতে চায়। পারমিশন এর জন্য।
-ও আচ্ছা।
.
নিহির বুশরার রুমের দিকে পা বাড়ালে তাকে থামিয়ে নিখিল বলল, মেয়েটাকে এত চাপে রেখেছে কেনো?
-আমি রাখিনি। সে নিজের কাজের প্রতি দায়িত্বশীল।
.
এই বলে নিহির বুশরার রুমে আসে। কিন্তু তাকে পায় না। সে মা এর রুমে আসে। দেখলো, বুশরা তার মা এর কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। নিহির ব্যস্ত হয়ে বলল, কী হয়েছে মা এর?
-জ্বর এসেছে।
-আমায় জানাবেন না?
-মাত্রই এসেছে। সেনোয়ারা ম্যাডাম কে জানালাম। উনি ডাক্তার ডেকেছেন।
.
একটু বাদে ডাক্তার এসে তাকে মেডিসিন দিয়ে বলল, চিন্তার কিছু নেই। সময় মতো মেডিসিন গুলো খাওয়ান। সেরে যাবে।
.
ডাক্তার চলে গেলে নিহির বুশরা কে বলল, আপনি যেন কোথায় যেতে চেয়েছিলেন?
-হুম। কাল যদি আন্টির ভালো লাগে আমি কী একটু বেরুতে পারব?
-নিশ্চয়। দরকার হলে যাবেন। আমায় সবসময় বলতে হবে না।
-আসলে কাল গেলে আমি আর ফিরে নাও আসতে পারি।
.
অনেকটা অবাক হয়ে নিহির বলল, বাড়ি যাবেন?
-নাহ। যার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম সে দেশে এসেছে। তার সঙ্গে দেখা করতে।
-ভালোবাসার মানুষ?
-জি।
-কীভাবে জানলেন দেশে এসেছে?
-নিখিল থেকে নাম্বার নিয়ে তায়শা কে ফোন দিয়েছিলাম তার ফোন নাম্বারের জন্যে। আসলে আমার কাছে ফোন না থাকাই নাম্বারও ছিল না। তায়শার ফোন থেকে কথা বলতাম। তায়শা বলল সে এসেছে।
-এটা তো ভালো খবর।
-হ্যাঁ। যদি যাই আমি নিশ্চিত সে আমায় আসতে দেবে না। আর যদি সময় চায় তবে আমি আবার আসব কিছুদিনের জন্যে।
-আপনার জন্য আমার ঘরের দরজা সবসময় খোলা। আপনি আমার মা এর জীবন বাঁচিয়েছিলেন, এই কথা আমি চাইলেও ভুলতে পারব না।
তবে আপনি চাইলে এখনো যেতে পারেন। নিশ্চয় তার সাথে দেখা করার জন্যে মন ছটফট করছে?
-তা করছে। কিন্তু আন্টিকে এভাবে রেখে গেলে আরও বেশি করবে। এটা আমার কাজ বলে নয়, আন্টির প্রতি গভীর মমতা অনুভব করি আমি। নিজের মা কে দেখিনি, আন্টির মাঝে মা কে খুঁজে পেয়েছি আমি। ভালোই হলো উনি এমন শিশুসুলভ আচরণ করেন। শুনেছি সন্তানের ছেলে বেলায় মা রাও না কি এমন আচরণ করেন সন্তানদের সাথে। আমিও সেই সময়টা ভেবে অনুভব করি।
.
নিহিরের মা কে দেখতে এসেছিল নিখিল। আড়াল থেকে তাদের কথোপকথন শুনে বুশরার প্রতি অন্যরকম একটা টান অনুভব করলো সে। মেয়েটা কত দুঃখী। অথচ সে কোনো দোষ না থাকার পরেও তার সাথে খারাপ আচরণ করতো। আর কাল সে চলে যাবে শুনে মনটাও খারাপ হয়ে গেছে। সত্যিই কী সে আর আসবে না এখানে?
.
.
সকাল হয়ে যায়। কিন্তু ফাহমিদা বেগমের জ্বর কমেনি। নিহির অফিসের উদ্দেশ্যে বেরুনোর আগে মা এর রুমে আসে। দেখলো বুশরা তার পাশে বসে আছে। নিহির বলল, জ্বর কমেনি?
-নাহ।
-দিপ্তীকে সব বুঝিয়ে দিয়ে আপনি যেতে পারেন।
-কিন্তু…
-আরেহ আমি বলছি তো! তাছাড়া দিনের বেলা আরও অনেকেই থাকবে। কোনো সমস্যা নেই।
-এখনো সকাল। ভাবছি দুপুর করে বেরুবো।
-আমি ড্রাইভার কে বলে রাখছি। গাড়ি নিয়ে যাবেন।
-ধন্যবাদ।
.
নিহির একটু থেমে বলল, ভালো থাকবেন। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে অবশ্যই জানাবেন।
.
কিছুটা সংকোচ নিয়ে বুশরা বলল, আমি কী মাঝেমধ্যে আন্টিকে দেখতে আসতে পারব?
-কালই বলেছিলাম, যখন খুশি আসবেন।
-ধন্যবাদ।
.
বুশরা কে বিদায় জানিয়ে নিহির বেরুলো। আজ নিজেকে অনেকটা হালকা মনেহচ্ছে তার। বুশরা তার সঠিক গন্তব্যে ফিরে যাবে। ভালো থাকুক মেয়েটা।
.
.
এদিকে ফাহমিদা বেগমেরও জ্বর অনেকটা কমে এসেছে। ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো বুশরা। সকাল এগারোটা। তার বেরুনো উচিত। সারারাত জেগে থাকায় তার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ পড়েছে। তাই সে গোসল সেরে ভালো একটা পোশাক পরে নেয়। এরপর দিপ্তি কে সব বুঝিয়ে দিয়ে বেরুই সে। যাওয়ার সময় নিখিলের মুখোমুখি হয়ে যায়। নিখিল বলল, বেস্ট অফ লাক।
-কিসের জন্যে?
-প্রিয় মানুষের কাছে যাচ্ছেন তাই।
-ও আচ্ছা! কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?
-আসলে কাল আপনাদের কথা ভুলবশত শুনেছিলাম।
-আচ্ছা! ভালো থাকবেন।
.
এই বলে বুশরা সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। তার পথের দিকে তাকিয়ে আছে নিখিল। মেয়েটা চলে যাচ্ছে বলে তার এতটা খারাপ লাগছে কেনো!
.
চলবে