#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_২৪
#Saji_Afroz
তায়শা সারা আলমারি খুঁজেও কাল পরার মতো একটা জামা পেল না। মনে হচ্ছে কাল আরও ভালো কিছু পরা উচিত। এই ভেবে সে নিহিরকে ফোন দিয়ে বলল, কাল আমি কী পরি তো বলো তো? একটা জামাও ভালো লাগছে না।
-যা পরো তাই মানাবে তোমায়।
-কিপ্টামি না করে শপিং এ চলো। আমার কালকে পরার জন্যে জামা দরকার।
-কিন্তু আজ যে আমার সময় নেই। তবে একটা কাজ করা যায়।
-কী?
-তুমি যাও। পছন্দ করে নিয়ে নাও। আমি টাকা বিকাশ করে দেব।
.
তায়শা খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয় শপিং মল এর উদ্দেশ্যে। কাল তাকে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতে হবে!
.
.
এদিকে নিখিলকে না জানিয়ে জন্মদিনের এত আয়োজন করা হচ্ছে জেনে সে খুবই রেগে গেছে। এই বছর এইসব করতে তার মোটেও ইচ্ছে করছে না। তার প্রিয় বন্ধু মারা গেছে। আর সে কী না জন্মদিনের উৎসব পালন করবে?
সে মা এর সাথে রাগারাগি করে বলল, একটাবারও আমার মনের অবস্থা জানতে চেয়েছ? আমার পারমিশন এর প্রয়োজন ছিল না তোমার? নিজেই সব করে নিলে।
-প্রতিবারই তো করা হয়।
-এইবার আর প্রতিবার একই হলো? সবসময় মানসিকতা ভালো থাকবে কথা নেই। আমি এসব করতে পারব না। সরি।
-সবকিছুর আয়োজন হয়ে গেছে! এত মানুষকে কীভাবে নিষেধ করি?
.
প্রথমে কথা কাটাকাটি হলেও মা এর অনুরোধে কাল জন্মদিনের অনুষ্ঠানে থাকতে রাজি হয় নিখিল। কিন্তু সে ঠিক করে, কেক কাটার পরেই বাড়ি ছেড়ে বাইরে কোথাও চলে যাবে সারা রাতের জন্য। আর এইবার তার কোনো বন্ধুকেও দাওয়াত দেবে না। তারাও বা শুনে কী বলবে! এই বছর এই আয়োজনের কী খুব বেশি দরকার ছিল?
.
.
আজ নিখিলের জন্মদিন। বাড়িতে এত আয়োজন চলছে। অথচ নিখিলের কোনো আগ্রহ নেই এই বিষয়ে। সে নিজের রুমেই মেজাজ খারাপ করে বসে আছে।
বুশরা তার জন্য পায়েস বানিয়ে নিয়ে আসে। তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলল, আমার তরফ থেকে এটা আপনার জন্য জন্মদিনের উপহার। ছোটবেলায় ফুফুকে দেখতাম, জন্মদিনের দিন বোনদের সকাল সকাল পায়েস খাইয়ে মিষ্টিমুখ করাতেন।
-আপনাকে করাতেন না?
.
নিখিলের প্রশ্নে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বুশরা বলল, করাতেন।
.
নিখিল বুঝতে পারলো সে মিথ্যে বলছে। সে বুশরার হাত থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে খেতে শুরু করে৷
নিখিল বলল, অনেক মজা হয়েছে৷ ধন্যবাদ।
-একটা কথা বলব?
-বলুন?
-আপনার মা অনেক শখ করে এত আয়োজন করছেন। তার মনটা খারাপ হতে দিয়েন না। একটু ম্যানেজ করে নিন। আমি জানি আপনার এসব ভালো লাগছে না।
-হুম।
.
কথাটি বলে বুশরা চলে যায়। একটু পরে নিখিলের কাছে আসে নিহির। তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা বাক্স দেয় হাতে। এতে কী আছে জানতে চাইলে নিহির বলল, তোর মন যা চায়ছে তা আছে এটাতে।
.
নিখিল খুলে দেখলো, তাতে একটি চাবি রয়েছে। এটি কীসের চাবি তার আর বুঝতে বাকি রইলো না। নিজের জন্য কারের শখ ছিল নিখিলের। আজ নিহির সেটাও পূরণ করে দিলো। সত্যিই নিহির তার ভাইকে অনেক ভালোবাসে।
নিখিল তাকে ধন্যবাদ জানায়। এরপর বলল, ভাবীকে ইনভাইট করেছ তো?
-চাচীই করেছে।
-শুনলাম আজ তোমাদের বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করা হবে?
-হু।
-ভালোই হলো। আজ ভাবীর সাথে দেখাও হয়ে যাবে। দু’দিন হতে হতেও হয়নি।
-আমার শালিকাও আসবে কিন্তু।
.
নিখিল হেসে বলল, আচ্ছা!
.
.
সন্ধ্যে হয়ে যায়। মেহমানরা আসতে শুরু করেছে। বেশিরভাগই আত্নীয় স্বজন ও সেনোয়ারা বেগমের বন্ধু-বান্ধবী।
সবাইকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত বুশরা। তাকে এক নাগাড়ে এভাবে কাজ করতে দেখে কাছে ডাকলো নিহির। সে বলল, আপনি এইবার তৈরী হয়ে নিন।
-হয়েছি তো। ভালো লাগছে না?
-লাগছে। তবে সেদিন যে গাউনটা নিয়ে দিয়েছি সেটা পরলে আরও ভালো লাগবে।
-মানে?
-ওটা আপনার জন্যই নিয়েছি।
-আমি ভেবেছি আপনার হবু বউ এর জন্য। আর আমাকে সেটি রাখতে দিয়েছেন!
-তার জিনিস তাকেই দিতে পারি আমি। ওটা আমার তরফ থেকে আপনার জন্য ছোট্ট একটা উপহার। প্লিজ পরে আসুন। আমার ভালো লাগবে।
.
কেনো যেন নিহিরকে না বলতে পারলো না বুশরা৷ সে গাউনটি পরে রুম থেকে বেরুই। নিখিলের সাথে দেখা হলে সে বলল, বাহ! আপনাকে বেশ ভালো লাগছে।
-কিন্তু আমার কেমন যেন লাগছে। অনেক বেশি গর্জিয়াস ড্রেস পরে ফেললাম না?
-বন্ধুর জন্মদিনে বান্ধবী এমন ড্রেসই তো পরবে।
-বন্ধু?
-ইয়েস। বন্ধু হতে পারি?
.
এই বলে বুশরার দিকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দেয় নিখিল। সেও হেসে হাত বাড়িয়ে বলল, কেনো নয়!
-ওকে! আজ থেকে আমাদের ফ্রেন্ডশিপ হলো।
-সবই ঠিক আছে। আপনি এখনো তৈরী হননি কেনো?
-উহু!
-কী হলো?
-আপনি না। বলো তুমি।
.
বুশরা আমতাআমতা করে বলল, তুমি?
-হু। বন্ধু হলাম না?
-থাক না!
-নো নো। তুমিই বলতে হবে।
.
বুশরা এক চোখ বন্ধ করে বলল,তুমি তৈরী হয়ে আসো।
.
নিখিল হেসে বলল, আচ্ছা।
.
.
তানিশার আকদের পর নওয়াজ একটাবারও নিজ থেকে তাকে ফোন দেয়নি। কোথাও বেরুতেও বলেনি। এই নিয়ে তার বোনেরা বেশ খেপায় তাকে। খেপানোরই কথা। তারা দেখে নতুন দম্পতিরা কত হাসিখুশি থাকে, এদিক সেদিক ঘুরে আর সারাদিন ফোনে কথা বলে। এদিকে তানিশা নওয়াজকে ফোন করেও পায় না। আজ সে নওয়াজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। সারপ্রাইজ দেবে ঠিক করেছে সবাইকে৷ কিন্তু নিজে যে এতবড়ো একটা সারপ্রাইজ পাবে ভাবেনি। সে বাসায় পৌঁছতেই জানালা দিয়ে মা ছেলের উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। ভেতরে ঢুকবে কী না ভাবতে ভাবতে জানালায় উঁকি দিলো সে। আর এটাই ছিল তার জীবনে করা সবচেয়ে বড়ো ভুল!
নওয়াজ তার মা এর সাথে ঝগড়া করছে। কেনো বুশরা কে নিয়ে তিনি বানিয়ে এত আজেবাজে কথা বলেছে তা জানতে চায়ছে। এদিকে তার মা বারবার বলছেন, আমি সব শোনা কথাই বলেছি।
-তুমি ইচ্ছে করেই তোমার বোনের মেয়েকে বিয়ে করার জন্যে এসব বলেছ। এখন লাভ টা কী হলো? সব সত্যিটা আমি জেনেছি। আর সব জেনে অন্য কাউকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব না।
-তবে কী করতে চাইছিস তুই?
-ডিভোর্স দেব আমি তানিশাকে।
-এমনটা করলে মরা মুখ দেখবি তুই আমার।
.
মা ছেলের মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়। তানিশার পা এর তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে! তার স্বপ্ন পূরণ হয়েও হলো না! নওয়াজ তাকে ভালোবাসে না। আলাদা হতে চায় সে?
নিজেকে সামলে নেয় তানিশা৷ ভেতরে প্রবেশ করে সে। তাকে দেখে সকলে নিশ্চুপ হয়ে যায়। তানিশা বলল, প্রথমেই আড়াল থেকে কথা শোনার জন্যে আমি দুঃখিত।
.
তার খালা ও খালাতো বোন তাকে শান্তনা দিতে আসলে বাধা দিয়ে বলল সে, আমার কাছে সবটা লুকিয়ে আপনারা ভুল করেছেন। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমিই ডিভোর্স দেব নওয়াজ ভাইকে।
.
এই বলে এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। তার পিছু নেয় নওয়াজের মা ও বোন। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই নওয়াজের। বরং ভাবলো, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।এইবার বুশরাকে খুঁজে বের করতেই হবে!
.
.
বাইরে থেকেই এতবড়ো বাড়ি দেখে নিজেকে সামলাতে পারছিল না তায়শা। ভেতরে প্রবেশ করে তো তার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। এরইমধ্যে নিহির এসে উপস্থিত হয় তার সামনে। তায়শাকে দেখে সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। শুধু সে নয়। আশেপাশের সকলে তায়শাকে দেখছে। দেখার মতোই মেয়ে সে।
কিছুক্ষণ কথা বলে তায়শাকে নিয়ে উপরে আসে সে।
সেনোয়ারা বেগম বলেছেন উপরের কোনো রুমে তাদের বসাতে৷ এনাউন্সমেন্ট এর আগে যেন কেউ কিছু জানতে না পারে। নিহির তাদের তার রুমে বসিয়ে বুশরার কাছে এলো। তাকে বলল, তাহরিমাদের আপ্যায়ন করতে। আর কেউ তো ওর বিষয়ে জানেনা। তাই ঘরের মানুষ হিসেবে সেই যেন কাজটি করে।
বুশরা খুশিমনে তাদের জন্য নাস্তা নিয়ে নিহিরের রুমে আসে। নিহির মেহমানদের দেখাশোনা করার জন্য নিচে যায়। এদিকে বুশরা রুমে এসে যেন আকাশ থেকে পড়লো। নাফিশা আর তায়শা এখানে! তারাও তাকে দেখে বেশ অবাক হয়। তবে মুহুর্তের জন্য সবকিছু ভুলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো।
.
এদিকে নিখিল নিচে আসতেই তাকে সবাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ সেনোয়ারা বেগম দেখলেন, সবাই চলে এসেছেন। নিখিল মত পাল্টানোর আগে কেক কেটে নেওয়া ভালো। এই ভেবে সে নিখিলকে কেক কাটতে বলে। নিখিল বলল, শুনলাম ভাবী এসেছে? তাকেও ডাকো। সে কোথায়?
.
নিহির বলল, আমার রুমে আছে।
-ফাইন! আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসি ভাবীকে। পরিচয়ও হয়ে নিই সাথে।
.
নিহির হেসে বলল, আচ্ছা।
.
.
বুশরা অবাক হয়ে বলল, তোরা এখানে?
.
তায়শা বলল, তুমি এখানে কী করো?
-আমি এখানে জব করি। নিহির স্যারের মা কে দেখাশোনা করি। কিন্তু তুই এখানে কীভাবে?
.
তায়শা লাজুক হাসি দিয়ে বলল, নিহির স্যার? আরে উনার সাথেই আমার বিয়ে হবে। আমি উনার হবু বউ।
.
এই রুমে নিহিরের হবু বউ-ই থাকবে, বিষয়টি মাথা থেকে একদমই চলে গিয়েছিল বুশরার। এখন সবটা বুঝতে পেরে তার কেমন যেন অগোছালো লাগছে। নিখিলের ভাইকে তায়শা কীভাবে বিয়ে করতে পারে?
তায়শা বলল, ভালোই হলো তুমি এখানে আছে। মা তো তোমাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। বিয়ের পর আমার সাথেই থাকবে তুমি। কোনো কাজ করতে হবে না তোমাকে।
.
বুশরা উত্তেজিত হয়ে বলল, কীসের বিয়ে?
-কীসের বিয়ে? বললামই তো নিহিরের সাথে।
-তুই কী জানিস না, নিখিলের ভাই নিহির?
.
তায়শা ও নাফিশা একসাথে বলে উঠলো, কী?
-হ্যাঁ এটা সত্যি। সেদিন যখন ঘর থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়, তখন নিহির স্যার আমাকে এখানে নিয়ে আসেন। আর আমাকে কিডন্যাপ তিনিই করেছিলেন তুই ভেবে। তোর কী মনেহয়, উনি সবটা জেনে তোকে বিয়ে করতে রাজি হবে? যে কি না ভাই এর খুশির জন্য মেয়ে কিডন্যাপের মতো জঘন্য কাজ করেছিল!
.
তায়শার কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। চারদিক যেন ঝাপসা দেখছে সে। তায়শা কাঁপাস্বরে বলল, না না আপি। এমন বলোনা প্লিজ। কেউ কিছু জানবে না। আমি জানতেই দেব না।
-কীভাবে দিবি না? আজ কার জন্মদিনে তুই এসেছিস তুই? নিখিলের।
-আমি থাকব না এখানে। থাকব না।
.
এই বলে তায়শা ছুটে বেরিয়ে যেতে চায়। দরজা অবধি এসে কারো সাথে ধাক্কা লেগে মেঝেতে পড়ে যেতে চায় সে। কিন্তু ব্যক্তিটি তাকে ধরে ফেলে। আর সেই ব্যক্তিটি আর কেউ নয়। নিখিল! তায়শা ও নিখিল একে অপরকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে। নিখিল বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল, তুমি এইখানে?
.
চলবে