#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৩৫
#Saji_Afroz
অনেকদিন পর নিজের রুমের বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয় নওয়াজ। এতদিন এখানে তানিশা থাকার কারণে কম আসা হত তার। যতবার আসতো তানিশার মুখোমুখি হতে হত। আর ওই মেয়েও কথা না বলে থাকতো না। নানা বাহানায় নওয়াজকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আটকানোর চেষ্টা করতো।
আজ রুমটা ফাঁকা দেখে তানিশাকে মনে পড়ছে তার। মন থেকে ভালোবাসলে বুঝি বেশিই কষ্ট পায়? যেমনটা সে আর তানিশা পাচ্ছে?
হ্যাঁ নওয়াজ ভালোবাসে বুশরাকে। কিন্তু সে বিয়ে করেছে তানিশাকে। তার উচিত ছিল নিজের বিবাহিত জীবনটাকে একটাবার সুযোগ দেওয়া। তা না করে সে বুশরার পেছনে ছুটেছে। বুশরাও কেনো ফিরে আসবে তার কাছে? সত্যমিথ্যা যাচাই না করেই যে নওয়াজ তাকে কষ্ট দিয়েছে।
সব কিছুর মূলে রয়েছে নওয়াজ। বুশরা, তানিশাসহ সবার চোখে সে ছোট হয়ে গেছে।
তানিশা চলে গেছে আজ দুঃখ ভরা মন নিয়ে। নওয়াজের কী উচিত না তাকে ফিরিয়ে আনা? সে কী আসবে? একটাবার চেষ্টা করলে ক্ষতি কী! একটাবার জীবনকে সুযোগ দিলে ক্ষতি কী!
.
.
বুশরা নিজে বাজারে গিয়ে বাজার করে এনেছে। বাবার জন্য আজ নিজেই রান্না করবে সে। মনমতো হরেক রকমের রান্না করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো বুশরা।
সব একা হাতে সামলানোর কারণে দেরী হলেও রান্না ঠিকঠাক হচ্ছে বলে শান্তি পাচ্ছে সে। নাফিশা ও তায়শাও সাহায্য করতে এসেছিল। তাদের পাঠিয়ে দেয় বুশরা। দু’টো এখনো কিছু জানেনা। তাদেরকে এখন শিখিয়ে করার সময়টা নেই। তাছাড়া ইদানিং তায়শার থেকে নিজেকে দূরে রাখে সে। কেনো যেন তার প্রতি আগের মতো ভালোবাসাটা কাজ করেনা।
এই ভেবে সে নিজেই সব সামলে নেয়।
রাতে সবাই খাবার খেতে বসে। বশর একে একে খাবার মুখে দিয়ে তৃপ্তি নিয়ে খেতে থাকে।
তিনি বললেন-
কিরে আলিয়া? তোর রান্না এত ভালো কবে থেকে হলো রে?
.
নাফিশা হেসে বলল-
সব রান্না বুশরা আপি করেছে।
.
আলিয়া বলল-
বুশরা আমার থেকেই তো সব শিখেছে ভাইজান।
-তাই? একটা ভালো কাজ শিখালি তুই।
.
বাবার ভালো লেগেছে শুনে বুশরাও বেশ খুশি হলো। একটু প্রশংসা পাওয়ার জন্যই তো এত কষ্ট সে করলো।
.
.
তায়শা নিজের ভুলের জন্য ভীষণ অনুতপ্ত। সে কেমন ছিল আর লোভে পড়ে কেমন হয়ে গেছে! বুশরাকে হিংসা করে তাকে কিডন্যাপ করার মতো জঘন্য প্লানও সে করেছে। যা করেছে উচিত করেনি। তার ভুল শুরু হয়েছিল আশিককে ঠকানোর মাধ্যমে। তার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেও সে নিখিলের সাথে জড়িয়েছিল। এতে করে অবশ্য নিখিলকেও ঠকানো হয়েছে। নিখিল তাকে কখনোই ক্ষমা করবে না। আর আশিক? সে তো এতকিছুর পরেও তায়শাকে নিজের জীবনে চেয়েছিল।
চট করে ফোন হাতে নিয়ে আশিকের নাম্বারে ডায়াল করলো তায়শা। এখুনি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে সবটা ঠিক করে নেবে সে। আশিক নিশ্চয় তাকে ফিরিয়ে দেবে না। কিন্তু ফোন রিসিভ করলো এক রমনী। আশিক কোথায় জানতে চাইলে সে বলল-
ও ওয়াশরুমে আছে। আপনি কে?
-আমি তায়শা। ওকে বললে চিনবে। আর আপনি?
-আমি ওর স্ত্রী।
.
তায়শার মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হলো না। চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে এলো তার। ফোন রেখে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললো সে।
তার কর্মের শাস্তি সে পাচ্ছে। এমন কেউ নেই যে তাকে আপন করে নেবে। সে খুব একা হয়ে গেল।
তায়শা নিখিলকে ফোন দেয়। কোনো আশা নিয়ে নয়। কেবলই ক্ষমা চাওয়ার জন্যে।
নিখিল তার মুখে এসব শুনে অবাক হলেও এইবার আর কঠোর হয়না। শুধু বলল-
সরি বলেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে?
-আমার কী করা উচিত?
-এত মানুষের ক্ষতি করলে কারো তো একটু ভালো করো!
-তুমি যা বলো তা করব আমি।
-নিহির ভাই আর বুশরাকে এক হতে সাহায্য করো। পারবে?
.
নিশ্চুপ তায়শার উদ্দেশ্যে নিখিল বলল-
যদি পারো তো কলব্যাক করিও আমায়।
.
.
কিছুদিন পার হয়। বুশরা তার বাবার সাথে ভালো সময় কাটাচ্ছে। একসাথে তারা বেশ কয়েকটা জায়গায় ঘুরতেও গেছে। প্রচুর শপিং করেছে। বাবার মুখে মা এর গল্প শুনেছে। বুশরা না কি দেখতে তার মা এর মতো হয়েছে। স্বভাবটাও এমন হয়েছে।
বাবাকে কাছে পেয়ে আনন্দিত বুশরা। এতদিনের দুঃখ গুলো যেন নিমিষেই ভুলে গেছে সে।
রাতে বুশরা তার বাবার রুম গুছিয়ে রাখছে। তিনি সেই সময়ে এসে বুশরাকে নিজের পাশে বসিয়ে বললেন-
একটা আবদার করি মা। রাখবি?
-বলো না মামা। আমার সাধ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই রাখব।
-আমায় যে ফিরে যেতে হবে মা, তার আগে আমি তোর একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যেতে চাই।
-তোমার সাথে কী আমায় নেওয়া পসিবল না?
-সেটা যদি হত অনেক আগে তোকে নিয়ে যেতাম রে।
.
এই বলে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে তিনি বললেন-
আমি আর আলিয়াকে ভরসা করতে পারছি না। আমি দেশে থাকতেই তোর বিয়ে দিতে চাই নিজের পছন্দের পাত্রের সাথে। হ্যাঁ, এতে তোরও সম্মতি থাকতে হবে। তোর ভালো লাগলে হবে নাহলে না। কিন্তু পাত্র বাছাই আমিসহ করে বিয়েটা দিয়ে যেতে চাই। এই আরকি! প্লিজ মা, না করিস না। আমায় চিন্তামুক্ত কর। এসব দেখে গিয়ে তোকে এইভাবে রেখে শান্তি পাব না আমি।
.
বুশরা শুনেছে, মা বাবা যা করেন সন্তানের ভালোর জন্যই করেন। তার বাবা তাকে ভালোবাসেন বলেই এত বছর পরেও হলেও মেয়ের কাছে এসেছেন। এতদিন যোগাযোগ না করেও খেয়াল রেখেছেন। সেই বাবাকে সে না করে কীভাবে? তিনি ঠিকই বলছেন, তাকে এভাবে রেখে তিনি শান্তি পাবেন না। আর শান্তি পাবে না বুশরাও। বাবা যতদিন আছে সবাই ভালো। খারাপ হতে কতক্ষণ?
তাছাড়া নিহিরের সাথে সম্পর্ক আছে ভেবে তায়শাও কুকর্ম করতে থাকবে। এর চেয়ে ভালো সে বাবার সিদ্ধান্ত কে মেনে নেবে। বুশরা বলল-
আমার আপত্তি নেই। তুমি যেখানে বলো সেখানেই আমি বিয়ে করতে রাজি।
.
বুশরার মুখে একথা শুনে মুখে হাসির রেখা ফুটলো বশরের।
.
কিন্তু বুশরা নিজের বুকে কারো জন্য ব্যথা অনুভব করছে। নওয়াজের জন্য তো অবশ্যই নয়। তবে কী নিহির? কেনো সে নিহিরের কথা ভাবছে! নিজের সাথে নিহিরকে জড়িয়ে আর কোনো অঘটন ঘটুক চায়না সে।
.
আজও তানিশার বাসায় এসে বসে রয়েছে নওয়াজ। এ কয়েকদিন প্রত্যেকটা দিন নওয়াজ এসেছে। কিন্তু তানিশা তার সাথে দেখাই করেনি। নওয়াজ ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে চলে যায়। কিন্তু আজ সে সকালে এসেছে। একনাগাড়ে ড্রয়িংরুমেই বসে আছে। তানিশার মা এই কয়েকদিন কটু কথা শুনিয়ে হাপিয়ে উঠেছেন। তিনিও এখন সিদ্ধান্ত তানিশার উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।
সকাল থেকে নওয়াজ কিছুই খায়নি। অবশ্য এই বাড়িতে আসলে তাকে খাবার দেওয়া হয় না রাগের বশে। কিন্তু আজ তানিশার মা নাস্তা দিয়ে গেছেন। হাজার হোক বোনের ছেলে সে! এতক্ষণ না খেয়ে বসে আছে।
তিনি ট্রে রেখে বললেন-
তুই চাইলে ভেতরের রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে পারিস। এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকবি?
-সমস্যা নেই খালা। একটাবার তানিশা আসলেই চলে যাব আমি।
.
তিনি বিরক্ত হয়ে নিজের রুমে চলে যান। তানিশা আড়াল থেকে খেয়াল করলো, নওয়াজ নুডুলস এর বাটি টা নিয়ে নিমিষেই সব শেষ করে ফেলেছে। হয়তো ভীষণ খিদে পেয়েছিল তার। কিছু চেয়ে নিলেই পারতো। এমন পাগলামির মানে আছে কোনো?
তানিশা নওয়াজের সামনে এসে খানিকটা রেগে বলল-
রোজ রোজ এইখানে কী?
-অবশেষে এসেছ তুমি।
-দেখেন নওয়াজ ভাই, আমার আর আপনার কোনো কটু কথা শোনার ইচ্ছে নেই।
-আমি তো তোমায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।
-দয়া দেখাতে?
-আমার উপর দয়া দেখিয়ে তো আসতে পারো?
.
নিশ্চুপ হয়ে যায় তানিশা। নওয়াজ বলল-
তুমি চলে আসার পর তোমার শূন্যতা আমি অনুভব করছি। যা করেছি ভুল করেছি। একটা সুযোগ আমায় দেওয়া যায় না?
.
শান্তস্বরে তানিশা বলল-
অপশন না পেয়ে সুযোগ খুঁজতে এসেছেন?
-এমনটা না তানিশা।
-প্লিজ নওয়াজ ভাই আপনি এখান থেকে চলে যান। আর কখনো আসবেন না। এতকিছুর পরও ও বাড়িতে ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি একাই ভালো আছি।
.
তানিশার মেজাজ খারাপ দেখে আর কিছু বলল না নওয়াজ। অন্তত আজ দেখা তো হলো!
চুপচাপ বেরিয়ে এলো সে। কিন্তু সেও পিছিয়ে যাওয়ার ছেলে না। আবার আসবে এবং তানিশাকে সাথে নিয়েই ফিরবে!
.
.
ফোনের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙে তায়শার। বান্ধবীর ফোন দেখে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল-
কীরে? এত সকালে?
-সকাল দশটা এত সকাল?
-ধুর পপি! কী বলবি বল।
-আমি যে ছেলের সাথে ফেবুতে এতদিন প্রেম করেছিলাম আজ হুট করেই বলছে দেখা করতে।
-ভালো তো।
-তার সাথে তার ভাই আসবে। ভাই হলেও তারা ফ্রেন্ডের মতোই। জমজ তো। কেউ কারও থেকে কিছু লুকোই না। আমি চাচ্ছিলাম তুই আমার সাথে যাবি। প্লিজ না করিস না। আমি একা কীভাবে যাই বল? আমার তো আর বোন নেই কোনো।
.
তায়শা শুনেছিল ছেলেটির বাবার বেশ টাকা পয়সা। বাড়ি-গাড়িও রয়েছে। ওসব ছবিতে দেখেছে সে। বড় ভাই এর সাথে যেহেতু ছোট ভাইও থাকবে একটা চান্স তো নেওয়াই যায়। এই ভেবে তায়শা বলল-
কবে বেরুবি?
-বিকেলে। তোকে ঠিকানা মেসেজে দিচ্ছি।
-ওকে।
.
তায়শাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখে পপি। তায়শা আপনমনে ধন্যবাদ জানায় পপিকে। সাথে সে বিড়বিড়িয়ে বলল-
কাল ইমোশনাল হয়ে কত কিছুই না ভাবলাম! ভেবেছি আর কোনো অপশন নেই। আর আজ দেখো! ভাগ্য নিশ্চয় আবার খুলে যাচ্ছে। এই তায়শাকে দেখে পছন্দ হবে না এমন ছেলে আছে না কি? নিহিরকে যোগ্য জবাব দেওয়ার মতো কাউকে পেয়ে যাচ্ছি। আর নিখিল কী বলেছে? বুশরা ও নিহিরকে এক হতে সাহায্য করতে? বুশরা যেহেতু সব মেনেই নিয়েছে আমি কেনো আবার সব ঠিক করতে যাব! অবশ্য নিহিরের জায়গায় অন্য কেউ হলে সে অবশ্যই করতাম। কিন্তু নিহিরের পাশে বুশরাকে মেনে নিতে পারব না আমি। কোনোদিনও না।
.
সারাদিন এসব নিয়ে কল্পনা জল্পনা করতে করতে বিকেল হয়ে যায়। সে সেজেগুজে তৈরী হয়ে রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে বের হয়। তার বান্ধবীও ওখানেই থাকবে বলেছে।
গন্তব্যে পৌঁছে যায় সে। কিন্তু তাকে নামিয়ে দেওয়া হয় রাস্তার অন্যপাশে। তায়শা অন্যমনস্ক থাকাতে তা খেয়াল করেনি।
রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পপি ও দুজন সুদর্শন ছেলেকে দেখতে পায় সে রাস্তার এইপার থেকেই। তাদের হাত দিয়ে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলল তায়শা। এরপর চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে ভাব দেখিয়ে সে রাস্তা পার হতে থাকে। খেয়াল করে ছেলে দু’টি তার দিকেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
হঠাৎ কোনো গাড়ির হর্ণ খুব জোরে শুনতে পায় তায়শা। সাথে শুনতে পায় পপির আওয়াজ-
তায়শা সর, দ্রুত সর!
.
কিছু বুঝে উঠার আগেই একটি মাইক্রোবাস তার ডান দিকে দ্রুতবেগে এগিয়ে আসতে দেখে। আর কিছু উপলব্ধি করার আগেই সেটির ধাক্কায় মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে তায়শা। ধীরেধীরে সবকিছু ঝাপসা দেখতে শুরু করে সে। মনেহচ্ছে শরীরের সমস্ত শক্তি নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে!
.
চলবে