সাপলুডুর সমাপ্তিতে- পর্ব-০৬

0
1179

#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম

০৬

অন্যদিকে মৃদুল বলে উঠলো
“যদি এই মুহূর্তে আমার সাথে না আসো, তাহলে সারাজীবনের মত আমাকে হারাবে। তোমাকে ছাড়া তো আমি বাঁচতে পারবো না, তাই সুইসাইড করে হলেও তোমার ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে যাবো। কি করবে তুমি তনু?
নিজের ফ্যামিলির সাথে থাকতে চাও নাকি ভালোবাসাকে আপন করে আমার হাত ধরতে চাও?

একদিকে বাবা মায়ের আকুতি… অন্যদিকে ভালোবাসার হাতছানি.. কি করবো আমি?
আমি পরলাম মহা ফ্যাসাদে। আমি কোনো একজনকে চাই না, সবাইকে চাই। বাবা মাকেও চাই, আবার আমার ভালোবাসার মৃদুলকেও চাই।।

আমি মাথা নিচু করেই আব্বুকে বললাম
“আমি কাউকেই ছাড়তে পারব না আব্বু। তোমরা আমাকে জন্ম দিলে, এতো কষ্ট করে বড় করলে, মানুষের মতো মানুষ বানালে, আমি কি করে তোমাদেরকে ভুলে যাব তুমিই বলো?
আব্বু হুংকারে বলে উঠলো
“তাহলে ওই ছেলের মায়া কাটাও।
আমি আবারও নতস্বরে বললাম
“আমি ওকেও চাই আব্বু।

আচমকা ভাইয়া এসে আমার দুগালে ঠাটিয়ে চর বসিয়ে দিলো। হিংস্র কন্ঠে বলে উঠলো
“এতটা নির্লজ্জ কি করে হতে পারলি? আব্বুর মুখে মুখে এইসব বলছিস, মুখে বাধে না একবারও?

ভাইয়ার দিকে অশ্রুভেজা চোখে তাকালাম আমি, তার চোখে আগুন ঝরছে। আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম
“যে লাজ আমাকে আমার ভালোবাসার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিবে, সে লাজ আমার চাই না। ও আমার শুধু প্রেমিকই না, ও আমার বর। আমার প্রাণপ্রিয় স্বামী, আমি কি করে তাকে ছেড়ে দিতে পারি?

তখন মৃদুল আমার দিকে তার প্রসস্থ হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে বললো
“তুমি কি যাবে আমার সাথে?
আমি ওর হাতপানে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। চোখ দিয়ে পানি পরছে টুপটুপ করে। মা এসে তৎক্ষনাৎ আমার দুবাহু তে চেপে ধরে বললেন
“তোর বাপ ভাই তোর খারাপ চায় না রে মা। তুই এমন টা করিস না। যদি তোরা দুজন সত্যিই ভালোবেসে থাকিস তাহলে ওর মাকে নিয়ে আসুক। আমরা কোনো আপত্তি করবো না।
আমি মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলাম মায়ের সামনে। মা আবারও মৃদুলের দিকে তাকিয়ে বললো

“তোমার মাকে খবর দাও, উনাকে আসতে বলো এখানে। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
মৃদুল নরম হয়ে বললো
“আমি আগেই তো বলেছি, মা আসবে না এখানে।
“তাহলে আমরা কি করে আমাদের মেয়েকে এভাবে তোমার হাতে দিয়ে দেবো? আর কোন ভরসাতেই বা দিবো?

মৃদুল আমার দিকে তাকিয়ে বললো
“আমার প্রতি ভরসা আছে তোমার?
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানান দিলাম।। আব্বু এবারে বেশ রেগে গেলেন আমার প্রতি। তিনি তেড়ে আসলেন আমাকে মারতে, মা আটকাতে গেলে তাকে এক ধাক্কায় ঘরের কোনে ফেলে দিলেন। যখনই আব্বু আমাকে মারবে ঠিক তখন আর সামনে এসে দাঁড়লো মৃদুল। ভাইয়া চটে গেলো এতে। সে মৃদুলের কলার চেপে ধরে বললো
“তোর সাহস কি করে হয় আমার আব্বুর পথ আগলে দাঁড়ানোর?
সে শক্ত গলায় বললো
” উনি তনুকে মারতে চাইছিলেন তাই আটকেছি।
“তাতে তোর কি? আমার বোনকে আমার আব্বু মারবে কাটবে, নয়তো আরো কিছু করবে।

মৃদুল রক্তচক্ষু নিয়ে বলে উঠলো
“ও আমার বউ, তাই ওর গায়ে আমি কাউকেই হাত উঠাতে দিবো না।

আমাকে বউ বলায় ভাইয়া আরো ক্ষেপে গেলো, সে রাগের মাথায় মৃদুলের বুকে ঘুষি বসিয়ে দিলো দুইটা। আমার আর সহ্য হলো না। অনেক হয়েছে, নিজের ভালোবাসার হেনস্তা আর দেখতে পারছি না আমি। সিন্ধান্ত নিলাম যা হবার হবে, আমি মৃদুলের সাথেই চলে যাবো। আমার সিদ্ধান্ত শুনে মা চমকে উঠলো, তিনি বার বার আমাকে বুঝাতে লাগলেন। কিন্তু আমার কানে সে-সব কথা যাচ্ছেনা। বারবার মনে হচ্ছে, আমার কারণে মৃদুল যদি এতটা অপমান সহ্য করতে পারে, আমি কেন তার জন্য তার মায়ের দুটো কটু কথা হজম করতে পারবো না!

বাড়ি থেকে চলে আসার আগে দেখলাম আব্বু কিছুটা নির্জীব হয়ে বসে আছে, মাকেও পাথরের মতো বাবার পাশে বসে থাকতে দেখলাম। ভাইয়া হুংকারে বলে উঠলো
“জীবনে এ বাড়িমুখো হবার সাহস দেখাবি না।
আমি শক্ত গলায় বলে আসলাম
“তার প্রয়োজন হবে না বোধহয়।

সেদিন সারাটা রাস্তায় আমি অনেক কান্নাকাটি করলাম, মৃদুল আমাকে বার বার শান্তনা দিচ্ছে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমার মন মানছে না। যে বাবা মা আমাকে এতটা বড় করলো, আমার জন্য এতো কষ্ট করলো, তারাই আজ আমার ভালোবাসাটা বুঝলো না।

মৃদুলদের বাড়ি পৌছানোর পর হলো আরেক ঝামেলা। আমাকে দেখার পর ওর মায়ের মাথা গেলো গরম হয়ে। উনি সারা বাড়ি চিল্লাপাল্লা করে মাথায় তুলে নিলেন৷ ওর বোনেরাও দেখলাম আমাকে দেখার পর চোখমুখ বাকাচ্ছে। তিনটে বোন ওর, তিনজনই ওর ছোট, তবে স্বাস্থ্য, লম্বা, দেহের গড়নে আমার চেয়ে বড় মনে হয়। এদের মধ্যে একজনের বিয়ে হয়ে গেছে, একজন ক্লাস টেনে পড়ে এবং অপরজন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।

মৃদুল আমাকে তার ঘরে নিয়ে বসালো। আমি চুপচাপ বসে আছি। ততক্ষণে হন্তদন্ত হয়ে পাড়া প্রতিবেশিরা এসে জমা হয়েছে ঘরের সামনে। মৃদুলের মা আমাকে উদ্দেশে করে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছেন। ফকির মিসকিনের ঘর থেকে উঠে এসেছি, তাই খালি হাত পা নিয়েই চলে এসেছি। ছেলেকেও অনেক কটুক্তিকর কথা বলছেন তিনি, মুখের ভাষা অত্যন্ত বিশ্রী। এতো বড় ছেলের সামনে কি করে একজন মা এইসব ভাষা বলতে পারেন আমার বুঝে আসেনা।

মৃদুল আমার পাশেই বসে আছে, বার বার আমাকে বলে যাচ্ছে তার মা আগের দিনের সহজ সরল মানুষ। উনার কথায় যেনো আমি কিছু মনে না করি। রাগ কমে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি মৃদুলের কথায় জোরপূর্বক হাসলাম, তবে এইটুকু ঠিকই বুঝলাম ওর মা ততটাও সহজ সরল না। আমাকে বসিয়ে রেখে মৃদুল বাইরে ওর মায়ের কাছে গেলো। ওকে দেখার পর ওর মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিতে লাগলো, সাথে আমার জাত বংশ, বাপ ভাই নিয়েও কথা বলছে।

আমি শুনে যাচ্ছি নিরবে। প্রতিবেশিরা এমনভাবে আমাকে দেখে দেখে যাচ্ছে যেনো আমি চিড়িয়াখানায় খাচার ভেতর আটকে থাকা কোনো প্রাণি। আমাকে দেখার পর একেকজন একেক রকমের মন্তব্য করছে। কেউ কেউ বলছে ছেলের সাথে মানিয়েছে ভালো, কেউ বলছে শুধু এভাবে মানালেই হয় না, টাকা দিয়েও মানাতে হয়। কেউ কেউ তো সরাসরি মুখের উপর বলে দিচ্ছে, “কিগো, বিয়ে করে যে এলে, তা তোমার বাপ মা কি কি দিয়ে দিলো সাথে করে?

আমি নিরবে শুনে গেলাম কথাগুলো, উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা আমার মুখে থাকলেও তখন ছিলাম আমি নতুন বউ। তাই সবকটি কথাই নিরবে হজম করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না আমার।।

মৃদুল যখন বাইরে গেলো তখন ওর এক চাচী ওকে প্রশ্ন করলো,।
“কিরে মৃদুল, শুনলাম শশুরবাড়ি গিয়েই বউ রে আনছিস, তা কেমন যত্ন পাইছিস? শশুড়ে কি দিলো তোরে? বউরে গয়না গাটি সব দিয়ে দিছে তো নাকি?
মৃদুল হেসে বললও
“আমাদের বিয়েটা তো তেমন ভাবে হয় নাই চাচী, তাইলে দেওয়ার কথা কেন আসছে এখন?

তখনই ফুসে উঠলেন শাশুড়িমা। তিনি তার জা কে উদ্দেশ্য করে বললেন
“ওর মুখের মইধ্যে ঝাড়ু দিয়া দুইটা বাড়ি দে হালিমা । সবেমাত্র বউ আনছে, এই মইধ্যেই বউ এর গোলাম হইয়া গেছে। কত বড় সাহস, ওয় আমার সামনে বউ এর হইয়া উকালতি করে।

এরপর খানিক থেমে তিনি আমার উদ্দেশ্যে বললেন
“তা আমার পুলাডারে কি জাদুটুনা কইরা দিলো তোর বাপ মা মিইলা? ওতো তারাতাড়িই তোগো কথা কয় যে?
মৃদুল তখন হেসে হেসে বললো
“ও মা, তুমি মাথাটারে ঠান্ডা করো তো। কেউ আমারে জাদু করে নাই, আমি ঠিকই আছি।

এ কথার পর তিনি আগের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণে ক্ষেপে গেলেন, তবে আর কোনো কথা না বলে মাটিতে বসে বিলাপ করা শুরু করে দিলেন। মায়ের এমন অবস্থা যেনো মৃদুলকে ভেতর থেকে কষ্ট দিচ্ছে। সে আর যাইহোক, মায়ের কান্না সহ্য করতে পারেনা। সে মায়ের পাশে বসে খুবই বিনয়ের সাথে মাকে থামানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু মায়ের বিলাপ থামছেই না। এক সময় সে ব্যর্থ হয়ে তার বোনদের ডাকে। বোনেরা তাকে সাফ সাফ বলে দেয়
“আমরা কেন থামামু, তুমি আকাম করছো, এখন তুমিই মায়েরে সামলাও। আগে মনে আছিলো না মায়ের কথা?
মৃদুল বোনদেরকেও মুখের উপর কিছু বলতে পারেনা। মা বোনদের ব্যাপারে সে অত্যন্ত নরম মনের মানুষ।

অতঃপর আমি গেলাম উনার কাছে। ততক্ষণে আশাপাশের অধিকাংশ মানুষ চলে গেছে, তবে গুটিকয়েক রয়েছে। আমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম তার কাছে। খুবই ধীর গতিতে তার পাশে বসে হাতে ধরতেই তিনি এক ঝটকায় আমার হাত সরিয়ে দিলেন। আমি পুনরায় তাকে ধরতে যাবো তার আগেই তিনি মাটিতে নিজ থেকে পরে গিয়ে চিৎকার করে বললেন

“মৃদুল রে, বাপ তুই কই? তোর বউ আমাকে ধাক্কা দিয়া ফালাইয়া দিছে, আমার কোমড় টা শেষ বুঝি আইজ। উনার এমন কথায় আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আশেপাশে তাকালাম ভয়ার্ত চোখে। সবাই কেমন যেনো ফিসফিস করছে। আমাকে তার মায়ের দিকে আসতে দেখে মৃদুল সেখান থেকে উঠে গিয়ে বারান্দায় তার বোনদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। তার মায়ের চিৎকারে সে আবারও হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। পেছন থেকে তার বোনেরা তখন সমস্বরে বলে উঠলো
“তোমার এতো গুণের বউ আসতে না আসতেই আম্মারে ধাক্কা দিয়া ফালাইয়া দিলো, কোন জমিদারের ঘর থেকে তুলে আনছো তারে? এখনই এতো পাওয়ার, বাকি দিন তাইলে কি করবো!

সে কিছু বললোনা। আমি একবার তাকালাম তার বোনেদের দিকে। তারা মুখ বাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।। মৃদুল খুবই যত্নসহকারে তার মাকে ধরে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আমাকে বললো উনার সেবাযত্ন করতে। প্রথম দিনেই আমার উপর এতবড় একটা বদনাম দিলেন তিনি, যার কারণে ইচ্ছে হলোনা তার পাশে দ্বিতীয় বার যাওয়ার। কিন্তু যেতে তো হবেই। আমি গেলাম, তার সেবাযত্ন করলাম। তিনি তখন আর কিছু বললেন না।।

সেদিন রাতে ছিলো আমাদের বাসর রাত। ছোট বেলা থেকেই প্রচুর স্বপ্ন ছিলো আমার বাসর ঘড়টা সুন্দর সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো থাকবে। তবে বাস্তবে হলো তার উলটো। বড় ঘরে দুটো বিছানা। একটাতে আমার শাশুড়ি গিয়ে শুয়ে পরলেন। আরেকটায় আমার দুই ননদ। মৃদুলের ঘরেও আমার যায়গা হলো না। আমার আরেক ননদ তার স্বামীকে নিয়ে এ ঘরে শোবার বায়না করলও তার ভাইয়ের কাছে। এ ঘরের বিছানাটা নাকি খুব নরম, তার বরের ইচ্ছে হয়েছে এখানে থাকার। মৃদুল এমতাবস্থায় আমার দিকে একবার অসহায়ের মতো তাকিয়ে তার বোনকে বলেলো
“আজ হঠাৎ আমার রুমে থাকতে ইচ্ছে হলো তোর বরের। তোরা এখানে থাকলে তনু থাকবে কোথায়?

আমার ননদ হেসে বললো
“আম্মা বলছে আজকের রাতটা ভাবীরে নিয়া বারান্দার রুমে থাকতা। তাছাড়া কাল তো ও চলেই যাবে। আর তাছাড়া সারাজীবন ভাবিরে নিয়া তো এই ঘরেই থাকবা, আইজ নাহয় আমরাই থাকি।

মৃদুল হাসিমুখে সেটা মেনে নিলো। যাই হয়ে যাক, মা বোনের মনে কষ্ট দেওয়া যাবে না আর। এমনিতেই অনেক বড় একটা কষ্ট মাকে দিয়ে বসেছে অলরেডি।

মৃদুল আমাকে সাথে করে বারান্দায় রুমটায় গেলো। ভাবলাম, ছোটখাটো একটা রুম বুঝি। কিন্তু রুমের ভেতরে গিয়ে থ মেরে গেলাম।। এটা কি করে একজন মানুষের থাকার রুম হতে পারে। রুমের এক কোনে একটা সিঙ্গেল চকি পাতা। তার উপর পাতলা একটা কাথা বিছানো, আর তেল চিটচিটে একটা বালিশ রাখা। আমি অবাক হয়ে মৃদুলের দিকে তাকালাম, বিস্ময় নিয়ে বললাম
“এ রুমে এ কে থাকতো?
” কেউ থাকে না এখানে। পুরনো জিনিসপত্রই পরে থাকে এখানে
“তাহলে এই কাথা বালিশ?
” আমাদের জন্যই বোধহয় রেখে গেছে ওরা।
আমি অবাক হলাম তার কথায়। এমন নোংরা বিছানায় মানুষ কি করে থাকতে পারে? তার উপর একটা মাত্র বালিশ, তাও আবার তেল চিটচিটে। উপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম মাথার উপর কোনো ফ্যান নেই,এই গরমের দিনে ফ্যান ছাড়া কি করে থাকা যায়?

সে আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মৃদু গলায় বললো
“আজকের রাতটাই তো, একটু কষ্ট করে সয়ে নাও। কাল থেকে তো আমরা আমাদের রুমেই থাকবো। ছোট বোনের আবদার, ফেলি কি করে বলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here