হৃদমাঝারে_আছো_তুমি
পর্ব_দশম+একাদশ (অন্তিম)
#তাসনূমা_ফারেহীন
রাত ১১ টা বেজে আটান্ন মিনিট। অর্থাৎ ১২টা বাজার আর মাত্র দুমিনিট বাকি। বাড়ির সকলের এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার কথা! এমন সময় দরজায় কারো কড়া নাড়তে দেখে তারিন ভীষণ অবাক হলো। তাহলে এত রাতে কে এসেছে এখানে?
বর্তমানে বাড়িতে কেবল অধরা এবং অপ্সরা রয়েছে। তারিনের জানামতে এতক্ষণ তারা জেগে থাকবেনা। রায়হান কোন বিশেষ কাজে বাহিরে রয়েছে। যাবার পূর্বে বলে গিয়েছিলো, আগামীকাল সকালের আগে বাড়ি ফিরতে পারবেনা। অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠে তারিনের। ক্ষুদ্র জীবনের আহরিত নানান তিক্ত অভিজ্ঞতা তারিনের মনে নানা ভয়ের উদ্ভব ঘটাচ্ছে।
আগত বিপদের আশঙ্কা করে তারিন ভীতগ্রস্থ অনুভব করলেও নিজেকে স্থির রাখে। বিপদের পরিস্থিতিতে মাথা যথাসম্ভব ঠান্ডা রেখে কাজ করাই হলো বুদ্ধিমানদের কাজ। পুরো ঘর জুড়ে নিকষ কালো অন্ধকার বিরাজমান। হঠাৎ ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়ায় কারণ তারিনের অজানা। তাদের বাড়িতে কখনো এমন ঘটেনি। তারিন চারদিক হাতড়ে টেবিলের কাছে পৌঁছালো। ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে একটি ধারালো ছুরি হাতে নেয়। অতি সাবধানে দরজার পেছনে অবস্থান নিলো তারিন। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দরজা খুলতেই এক বিস্ময়কর ঘটনার সম্মুখীন হতে হলো তারিন।
রাত ১২ টা ০১ মিনিট।
অন্ধকারে হঠাৎ কারো শুভেচ্ছা ধ্বনি শুনে চমকে উঠে তারিন। কয়েক সেকেন্ড সময় ব্যয়ে অনুধাবন করলো এটি অপ্সরার গলা। তারিন বিস্মিত কন্ঠে অপ্সরাকে ডাকলো। মুহূর্তেই লাইট জ্বলে উঠলো- আলোয় ঝলমল করতে শুরু করল চারপাশ।
তারিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অপ্সরাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পূর্বেই অধরাকে দেখতে পেলো- হাতে বিশেষ পেয়ালা, যা ঢেকে রাখা হয়েছে। এসবের কারণ বুঝতে না পেরে তারিন যখনই অধরাকে খিছু বলতে যাবে তার আগেই অধরা তারিনকে একটি কার্ড দিলো। সেখানে লিখা- ❛শুভ জন্মদিন! আজ তোকে মুখে উইস করতে পারিনি, তাই এতসব আয়োজন।❜
তারিনের মন আনন্দে ভরে উঠে। তবে তা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন দেখে নয় বরং তাদের বন্ধুত্বের অটল বন্ধন দেখে। দিন গড়িয়ে বছর পেরোলেও, অধরা এবং তারিন উভয়েই তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে কখনো কোন আঁচ আসতে দেয়নি।
তারিন মুচকি হেসে অধরাকে জড়িয়ে ধরলো। অধরা তারিনের জন্য পায়েস বানিয়েছে। তারিন বললো,
– ‘পরিচয়ের পর থেকে আমার জন্মদিনে সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ তুই-ই দিয়েছিস আমায়। আজো তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।’
অধরা একটা কাগজ এগিয়ে দিলো তারিনকে। তারিন পড়লো, – ‘আমি ছাড়া এই অধিকার আর কারো নেই।’
তারিন কিছু বলার আগেই অধরা তারিনকে পুনরায় একটি কাগজ এগিয়ে দিলো। সেখানে লিখা ছিলো- ‘আমি জানি তুই এখন কী বলবি। এত বছরের ফ্রেন্ডশীপ আমাদের! তুই বলার আগেই আমি বুঝতে পারি তুই আমাকে কী বলতে চাইছিস। তাই আর কোন কথা না বলে পায়েস টুকু খেয়ে নে। কেকও কাটতে হবে। অপ্সরা অনেক এক্সাইটেড!’
তারিন নিজে কিছুটা খেয়ে অধরা এবং অপ্সরাকেও নিজ হাতে পায়েস খাইয়ে দিলো।
তারিনকে বসতে বলে অধরা নিচে চলে আসে। অপ্সরাও সাথে গেলো, অধরার কেক ডেকোরেশন দেখবে বলে। তারিন স্মিত হেসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের পানে তাকালো। পাঁচ বছর আগেও অধরা তাকে এভাবেই সারপ্রাইজ দিয়েছিলো। কিন্তু তারিন জানতো না সেদিন তার জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো।
কেক কাটা শেষে তারিন এবং অধরা একে অপরকে কেক খাইয়ে দিলো। অপ্সরাকে সযত্নে কেক খাইয়ে দিলো তারিন। এর মাঝেই অপ্সরা ঘুমিয়ে পড়েছে। তারিন বললো,
– ‘এবার আমাদের ঘুমিয়ে পড়া উচিত। বেশি রাত জাগলে সকালে উঠতে পারবিনা।’
অধরা না-বোধক মাথা নাড়ে। ইশারায় বললো- সে আজ ঘুমোবে না। তারিনের সাথে সারা রাত আকাশের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রবিলাস করতে চায়। তারিন অধরার ইশারা বুঝতে পারলো। মুচকি হেসে বললো- ‘বেশ। আজ অনেক বছর যাবদ আমরা একত্রে চন্দ্র বিলাস করিনি।’
বর্তমানে তারিন এবং অধরা দুজন একত্রে বেলকনিতে বসে রাতের আকাশ দেখতে। পাশেই টেবিলে দুটো কাপে কফি রাখা হয়েছে। চারদিকে নিরবতা বিরাজ করছে। ঝিঁঝিপোকার ডাক ভেসে আসছে। রাত জাগা পাখিদের ডাকও মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে। নিরবতা ভেঙ্গে তারিনই প্রথম বলে উঠলো- ‘প্রকৃতির মাঝে মনের সকল বিষাদের অবসান করার বিশেষ ঔষধি মেশানো থাকে হয়তো। অনেকদিন পর আগেকার মতো শান্তি পাচ্ছি যা আমি বছর পাঁচেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।’
অধরা মুচকি হাসে। সে তারিনের সবকিছু সম্পর্কেই অবগত। তারিনকে এখানে এনে তার মন ভালো করা- সবই ছিলো অধরার পূর্ব পরিকল্পিত। অধরা তারিনের হাতে একটি বিশেষ নকশা সম্পন্ন ঘড়ি পড়িয়ে দিলো। তারিন অবাক হয়ে বললো-
– ‘তুই এটা খুঁজে পেলি কীভাবে?’
অধরাকে মুচকি হাসতে দেখে তারিন সব বুঝতে পারলো। তারপর বললো,
– ‘পাঁচ বছর আগে তোর গিফট করা ঘড়িটা আমার লাইফের সবচেয়ে বেস্ট সারপ্রাইজ ছিলো। হারিয়ে ফেলে কত কেঁদেছি জানিস? আর এটা কিনা তোর কাছেই ছিলো!’
অধরা হা-বোধক মাথা নাড়লো। তারিন বললো,
– ‘অনেক রাত হয়েছে, এবার আমাদের ঘুমোনো উচিত।’
অধরা এবং তারিন নিজেদের ঘরে চলে আসে। তারিন বললো,
– ‘ধন্যবাদ আজকের দিনটিকে এত বিশেষ করে তোলার জন্য, ধন্যবাদ প্রকৃতির সান্নিধ্যে এনে আমার মন ভালো করার জন্য।’
অধরা হাসলো। তারিন এবং অধরা দুজনেই যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। তারিন অতীতের কথাগুলো ভাবতে লাগলো।
অধরার কথায় সেদিন তারিন ভীষণ অভিমান করেছিলো। ভেবেছিলো- তার শ্রেষ্ঠসখা অন্তত তার জন্মদিন ভুলে যাবে না। কিন্তু অধরা তার ধারণা ভুল প্রমাণ করলো। চাপা অভিমান নিয়ে কেবল চলে যেতে উদ্যত হয়েছিলো, তার পূর্বেই অধরার ডাকে ফিরে তাকালো তারিন। কিন্তু মুহূর্তেই বিস্ময়ে তার মুখ হা আকৃতি ধারণ করলো।
অধরার হাতে একটি গিফটবক্স, যেখানে বড় বড় অক্ষরে লিখা ছিলো- “Happy Birthday Taru!”
তারিন বিস্মিত হয়ে বললো, ‘মানে! এতক্ষণ ধরে তুই আমার সাথে মজা করছিলি!’
অধরা দুষ্টুমির স্বরে বললো, ‘হ্যাঁ, তুই তো কেঁদেই দিয়েছিলি প্রায়! ভাবলাম বেচারীকে জন্মদিনে আর না কাঁদাই।’
তারিন ঈষৎ রেগে বললো, ‘তোর সাথে আমি কথা বলবো না। আরি তোর সাথে।’
– ‘তাহলে পায়েসটুকু কে খাবে শুনি?’
– ‘কী? পায়েস! কে বানিয়েছে? তোর আন্টি?’
– ‘ন্যাহ্! আমি বানিয়েছি। তোর জন্যেই করেছিলাম, কিন্তু এখন আর তোকে দেবো না।’
– ‘কেন?’
– ‘তুই-ই তো বললি! আমার সাথে আর কথা বলবি না। ভালোই হয়েছে। এবার আমি বেশ মজা করে পায়েস খাবো।’
তারিন পায়েসের বাটিটুকু অধরার থেকে কেড়ে নিলো। এক চামচ পায়েস মুখে দিয়ে বললো,
– ‘বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে তুই একদম মীর জাফরের স্বভাবের। কোথায় আমার রাগ ভাঙ্গাবি, তার বদলে আমার পায়েসেই ভাগ বসাচ্ছিস!’
অধরা সশব্দে হেসে বললো,
– ‘আমি জানি, তারিনের পায়েস কতটা প্রিয়! আর তারিন কখনো অধরার সাথে কথা না বলে থাকতেই পারবেনা!’
অধরা এবং তারিন দুজন একসাথে হেসে উঠলো। অধরা বললো,
– ‘শোন, আজকে সারাদিন তুই আমার সাথেই থাকবি।’
তারিন বললো- ‘কেন?’
অধরা প্রত্যুত্তরে বললো, – ‘কারণ তো একটা আছেই!’
জবাবে তারিন কৌতুহলী হয়ে বললো, – ‘কী কারণ?’
অধরা বিরক্তির স্বরে তারিনকে বললো,
– ‘আরে ধুর! বলে দিলে তা-কি আর সারপ্রাইজ থাকে নাকি? একটু সবুর করতে শিখো প্রিয়।’
তারিন অতীত থেকে বাস্তবে ফিরে আসলো। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারিন এবং অধরা- দুজনেই সেদিন খুব আনন্দিত ছিলো। সেদিন তাদের জন্য অপেক্ষমান তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ সম্বন্ধে দুজনেই কেউ-ই অবগত ছিলো না। তারিন পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অতীতে ডুবে থেকে নিজের অজান্তেই ঘুমে তলিয়ে পড়ে তারিন।
অধরা বার বার তারিনকে বাঁধা দেবার চেষ্টা করছে, তারিন থামছে না। কোন কারণে তারিন বেশ রেগে আছে। কারণটা তারিনের নিজেরো অজানা। অবাক করার বিষয় হলো, অধরা কথা বলতে পারছে। কিন্তু তারিনের কোন আনন্দবোধ হচ্ছে না। যেন তারিন কারো সম্মোহনে রয়েছে। আড়ালে থাকা ব্যাক্তি যা বলছে, তারিন ঠিক তাই করে যাচ্ছে।
অধরা এসে পুনরায় তারিনেথ পথে বাঁধ সাধলো। তাদের কথোপকথন ছিলো অনুরূপ:
– তুই ভুল করছিস তারিন।
– আমি কোন ভুল করছিনা। আমি সেটাই করছি যা আমার আরো আগে করা উচিত ছিলো।
– তারিন তুই কেন বুঝতে পারছিস না…!
– বুঝতে পারছিস না তো তুই অধরা। আমি যা করছি তা সঠিক। আমার এটা আরো আগে করা উচিত ছিলো। তুই আমাকে কোন প্রকার বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করবি না।
বলেই তারিন একপ্রকার ছুটে বাহিরে গেল নিজের হাতের দিকে তখনো খেয়াল করেনি সে। মুহূর্তেই সোহানের কাছে গিয়ে তাকে নিজ হাতে ছুড়ি দ্বারা আঘাত করে আহত তারিন। সোহান আবাক নয়নে তারিনের দিকে তাকায়, চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে। তারিনের তাতে কোন ভ্রুক্ষেপই করলো না। পুনরায় ছুড়িটি নিয়ে বসিয়ে দিলো সোহানের মাঝ বরাবর। তারিন পিশাচের ন্যায় অট্টহাসিতে মেতে উঠে। কিছুক্ষণ পর বললো, ‘আজ মার প্রতিশোধ পূরণ হলো।’
সোহান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রক্তে রঞ্জিত হয় তারিনের হাত। তারিনের চোখে-মুখেও রক্তের ছোপ লেগে আছে। এতক্ষণে বোধ হলো তারিন কী করেছে! সম্মোহনের ঘোর কেটে যেতেই তারিন চিৎকার করে উঠল। ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে তারিন। স্মৃতিচারণের মাঝেই তার চোখ লেগে এসেছিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বেশ চমকে উঠে তারিন। এত বেলা করে তারিন ঘুমিয়ে উঠেছে! এতটা দায়িত্বহীন তারিন কী করে হতে পারলো।
ঘরের বাহিরে থেকে পুনরায় চিরচেনা কোন সুরধ্বনি ভেসে আসতেই তারিন পুনরায় চমকে উঠে। এই সুর তারিনের খুব চেনা। একি সুর, একি স্বর। অনেকদিন পর শুনতে পেলো সেই পরিচিত গানের কন্ঠ।
“কখনো যদি আনমনে চেয়ে আকাশের পানে আমাকে খুঁজো।
কখনো যদি হঠাৎ এসে জড়িয়ে ধরে বলো ভালোবাসো।
আমি প্রতিরাত হ্যাঁ প্রতিক্ষণ খুব অজানায় কত অভিনয় করে বসি তোমায় ভেবে!
আমার অযথা সব লেখা গান সব শুনে মন করে উচাতন।
তুমি বুঝোনি কেন আমাকে?”
তারিন ছুটে বেরিয়ে আসে। তার ধারণাই সত্যি, সোহান গান গাইছে। এত বছর পেরিয়ে গেলেও সোহানের গলা চিনতে ভুল করেনি তারিন। তার মাঝে কিছুক্ষণ পূর্বে তারিনের সাথে যা ঘটেছিলো তা বাস্তব নয় বরং তার স্বপ্ন ছিলো। তারিন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সোহানের কিছুই হয়নি। আরেকটু হলে তারিনের প্রাণ বেরিয়ে আসতো। কিন্তু একটা কথা তারিনকে ভাবনায় ফেলে দিলো। তারিন হঠাৎ এমন স্বপ্ন দেখলোই বা কেন?
তারিন আড়াল থেকে কিছুক্ষণ দেখে ভেতরে চলে এলো। তার এখন অধরার সাথে কিছু সময় কাটানো উচিত। তাতে হয়তো তারিনের মন কিছুটা ভালো হবে। মনের ভয় গুলোও দূর হয়ে যাবে। অধরার ঘরে গিয়ে দেখতে পেলো, অধরা সেখানে বসে আছে।
তারিন অধরার পাশে গিয়ে বসলো। তারপর বললো,
– সরি রে! আজ ঘুম থেকে উঠতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।
অধরা মুচকি হাসলো। ইশারায় বোঝালো- এটা অস্বাভাবিক নয়। রাতে ঘুমোতে দেরি করার ফলেই এমনটা হয়েছে।
তারিন বললো,
– সার্ভেন্টরা তোকে ঠিকমতো ওষুধ, খাবার-দাবার দিয়েছে? কোন সমস্যা হয়নি তো?
অধরা না-বোধক মাথা নাড়ে। যার অর্থ- অধরার কোন সমস্যা হয়নি। তারিন কিছুটা নিশ্চিত হলো। পরক্ষণেই আবার চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলো,
– আচ্ছা অপ্সরা কোথায়?
এবার অধারাকে কিছুটা চিন্তিত দেখালো। কারণ অপ্সরা বেশ অনেকক্ষণ যাবদ বাহিরে রয়েছে।
সোহান বাহিরে বাগানে ঘোরাঘুরি করছিল। অনেকদিন পর গান করে বেশ ভালোই অনুভব হচ্ছে তার। হঠাৎ বাড়ির পাশেই একটি গাছের দিকে নজর গেলো তার। শৈশবের কথা মনে পড়ে যায় সোহানের। তারপর বললো, অনেকদিন ধরে জমিয়ে রাখা মনের সুপ্ত ইচ্ছাটিকে আজ বাস্তবের রূপান্তর করা যাক?
– মানে?
সোহানের কথা বুঝতে না পেরে মিয়াজ প্রশ্ন করলো। সোহান বললো,
– দেখতেই পাবি চল।
কিছুক্ষণ বাদেই সোহান কিছু একটা বানিয়ে আনে। মিয়াজ অবাক হয়ে বললো,
– তুই এটা পেলি কোথায়?
– কোথাও পাবোনা বলে নিজেই বানিয়ে ফেললাম।
সোহান এবং মিয়াজ বস্তুটির সাহায্যে নিশানা অনুশীলন করছিলো। হঠাৎ সেখানে অপ্সরা এলো। সোহানের হাতের অদ্ভুদ বস্তুটি দেখা অপ্সরা অবাক হয়ে বললো,
– ‘কী করছো তোমরা? আর তোমাদের হাতে এই আজব জিনিসটা কী?’
সোহান বললো,
– ‘এটি হলো “Slingshot”। আঞ্চলিক ভাষায় আমরা এটিকে গুন্তি বলে থাকি। এর সাহায্যে আমরা অতি সহজেই উঁচু থেকে ফল পাড়তে পারবে কিংবা নিজের শত্রুকে প্রতিহত করতেও কাজে লাগাতে পারবে।’
অপ্সরা উৎসুক ভঙ্গিতে বললো,
– ‘আমাকে এর ব্যবহার শেখাবে?’
সোহান বললো,
– ‘অবশ্যই। একে চালানো শিখতে হলে তোমাকে অনেক মনোযোগ সহকারে শিখতে হবে।’
ইতিমধ্যে রায়হান বাড়ি ফিরে এসেছে। তারিন রায়হানের সাথে বেশি একটা কথা বলেনি। অপ্সরাকে নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ছিলো তাই। বাহিরে এসে দেখলো অপ্সরা সোহানের সাথেই খেলাধুলো করছে। তারিন চলে যেতে নিলেও অপ্সরা তাকে যেতে দিলো না।
তারিন সোহানের বা-হাতের উদ্দেশ্যে বললো,
– হাতের অবস্থা এখন কেমন? পুনরায় ব্যান্ডেজ করিয়েছো?
সোহান বললো,
– এখন অনেকটা ভালো। আগের মতোন ব্যথা নেই।
তারিন বললো,
– এমনাবস্থায় নিশানা অনুশীলন করা হাতের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
তারিন জানে সোহান তার কথা শুনবে না। তাই তারিন আর কিছু না বলেই চলে আসে। নিজের ঘরে এসে চেয়ারে বসে দু-চোখ বন্ধ করতেই শুনতে পেলো রায়হানের কথা-
– আমাকে এভোয়েড করার কারণটা কি জানতে পারি?
– আমি তোমাকে এভোয়েড করিনি রায়হান। আমার ভালো লাগছিলো না কথা বলতে।
– কিন্তু সোহানের সাথে কথা বলতে ঠিকি ভালো অনুভব করছিলে।
– রায়হান। আমি কেবল একজন আহত ব্যাক্তির সুস্থতার খবর নিয়েছি। ভুলে যেও না, সোহান তোমার কারণেই আঘাত পেয়েছে।
– তার আঘাত পাওয়ার যথার্থ কারণও রয়েছে।
– না নেই। সোহান অপরাধ করলেও তুমি তাকে শাস্তি হিসেবে মেরে ফেলতে পারোনা।
– বাহ্! কী অদ্ভুদ তাইনা। একজন মেয়ে তার বাবার খুনীর পক্ষে কথা বলছে। তারিন তুমি বুঝতে পারছোনা, সোহান তোমার ক্ষতি করার জন্যই পুনরায় ফিরে এসেছে। নিজের কথা নাই বা ভাবো, অন্তত নিজের বাবার সাথে হওয়া অন্যায়কে ভুলে যেও না।
রায়হান সেখান থেকে চলে আসে। কিন্তু তার বলা কথাগুলো তারিন কে ভাবনায় ফেলে দেয়।
এভাবেই একটি দিন অতিবাহিত হলো। পুরো রাত নির্ঘুম কাটে তারিনের। মনের মাঝে সংশয়, অনুতাপ সকলে মিলে দানা বেঁধেছে। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সত্যিগুলোকে তারিনের মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। একদিকে তার বাবার সাথে হওয়া অন্যায়, অন্যদিকে তার ভালোবাসার উপর বিশ্বাস। এই দুয়ের মাঝে যেকোনো একটিকে বেছে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ তারিনের পক্ষে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ছিলো।
তারিন অধরার ঘরে গেলো। অধরা এখন শুয়ে রয়েছে। অধরার পাশে বসে তার হাত ধরতেই অধরা চোখ মেলে তাকালো। অধরা বুঝতে পারে তারিনের মন ভালো নেই। অধরার কিছু বলার আগেই তারিন বলে উঠলো,
– আজ আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটি সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি, অধরা।
অধরা বিস্মিত হলো। সে কখনো তারিনকে এতটা বিমর্ষ হয়ে কথা বলতে দেখেনি। অধরা জিজ্ঞাসু নয়নে তাকাতেই তারিন বললো,
– আমি আমার বাবার সাথে হওয়া অন্যায়ের শাস্তি দিতে চলেছি।
অধরার বুঝতে বাকি নেই তারিন কী বলতে চাইছে। অধরার অস্থিরতা বেড়ে গেলো। প্রাণপণে তারিন কে কিছু বলার চেষ্টা করতে থাকে অধরা। অধরা কিছুতেই সোহানকে মরে যেতে দিতে পারেনা।
– অধরা, আমি জানি তুই আমায় বাঁধা দিতে চাইবি। তাই আমি আগেই এর ব্যবস্থা করে রেখেছি। এখন থেকে আধ-ঘন্টা পর্যন্ত তুই চাইলেও আমায় আটকাতে পারবিনা। তোর পা-দুটো অচেতন অবস্থায় রয়েছে।
তারিন আর কিছু বলল না। অধরা বিস্ফোরিত নয়নে অবিশ্বাসু দৃষ্টিতে তারিনের দিকে তাকায়।
অবশেষে তারিন তার ঘরে এসে ড্রয়ার থেকে ঐ বন্দুকটি নিলো যা দিয়ে সে তার বাবার হত্যাকারীকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলো।
অপ্সরা গতকালের মতোই সোহানের সাথে রয়েছে। একটু একটু বস্তুটিকে পরিচালনা করা শিখছে অপ্সরা। তবুও নিশানা সঠিক না হওয়ায় অপ্সরা মন খারাপ করায় সোহান বললো, ‘হাল ছেড়োনা। একসময় ঠিক তুমি সঠিক নিশানায় পাথর নিক্ষেপ করতে পারবে।’
অপ্সরা বলল, ‘আমি মাকে এটি দেখাই?’
সোহান মুচকি হেসে বললো, ‘বেশ। যাও তবে।’
অপ্সরা বাড়ির দিকে ছুট লাগালো।
তারিন ধীরে ধীরে নিজের মনোঃস্থির করে নিলো। ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলো তারিন।
অধরা প্রাণপণে চেষ্টা করছে তারিনকে বাঁধা দেয়ার। কিন্তু কিছুতেই তার পা সঞ্চরণে সক্ষম হচ্ছে না। অধরা ভাবতে থাকে কী করা যায়। হঠাৎ কিছু একটা মাথায় আসতেই অধরা ফৌন নিয়ে তারিনকে মেসেজে কিছু লিখতে শুরু করে। মেসেজটি ছিলো অনুরূপ।
– “তারিন, সোহান তোর বাবার খুনী…
অধরা পরবর্তীতে আলো কিছু লিখতে যাবে তার আগেই…
কতগুলো ছদ্মবেশী কালো পোশাক পরিহিত লোক প্রবেশ করলো অধরার ঘরে। অধরার হাত থেকে ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে তারিনের জন্য লিখা মেসেজগুলো পড়লো। অসৎ হাসি হেসে মেসেজটি ঐ অবস্থাতেই তারিনকে সেন্ড করে দিলো।
– কী ভেবেছিলি? তুই তারিনকে সব বলে দিবি আর বস তোকে ছেড়ে দেবে? বসের আদেশ, ঐ ছেলেটি মরে যাবার পর যেন তোকে আমরা শেষ করে ফেলি।
অধরা কেবল সব তাকিয়ে দেখতে থাকে। চিৎকার করার ইচ্ছে জাগলেও তার ইচ্ছেকে পূর্ণ করতে অপারগ অধরা। আর কিছুক্ষণের মাঝেই হয়তো অধরাকেও তারা শেষ করে ফেলবে।
তারিনের ফোন হঠাৎ টুং করে শব্দ করে উঠলো। অধরা মেসেজ পাঠিয়েছে। প্রথমে পড়তে না চাইলো পরে পড়ার সিদ্ধান্তে মেসেজটি খুললো। সেখানে লিখা- তারিন, সোহান তোর বাবার খুনী!
তারিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অধরাও তাকে বাঁধা দিচ্ছে না! তারিন বর্তমানে সোহানের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে সোহান তাকে দেখতে পারছে না। তারিন সোহানের দিকে গান তাক করেও ফিরিয়ে নিলো। ধীরে ধীরে বন্দুকটিকে নিজের মাথায় ঠেকায় তারিন। তারিনের পরিকল্পনা কিছুটা ভিন্ন। তারিনের হাতেই এক টুকরো কাগজ রয়েছে। যেখানে লিখা-
“না পারবো নিজের বাবার খুনীকে শাস্তি দিতে আর না পারবো নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজ হাতে হত্যা করতে। বাবার মেয়ে হবার কর্তব্য পালনে অপারগ আমি! বাবার খুনীকে শাস্তি দিতে অপারগ আমি। এই গ্লানি বয়ে বেড়ানো আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই নিজেই নিজেকে এই না পারার শাস্তি দিয়ে মুক্ত করে দিতে চলেছি নিজেকে এই দায়িত্বশীলতার বন্দি শেকল হতে!”
তারিন নিজের দিকে বন্দুক তাক করতে চলেছিলো, তার পূর্বেই বন্দুকের আওয়াজ ভেসে আসলো তার কানে। সাথে সাথে অধরার ঘর থেকেও বন্দুকের গুলির শব্দ শুনতে পেলো। তারিন অধরা বলে চিৎকার করতে গিয়েও পারলোনা। শ্বাস নিতে প্রচুর কষ্ট হচ্ছে তারিনের। বুকে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো সেখান থেকে অঝোর ধারায় রক্ত ঝড়ছে। দূর থেকে সোহানকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে চোখ দুটো ধীরে ধীরে বুঝে ফেলে তারিন। হয়তো এভাবেই তার জীবনের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে।
“তোমার মৃত্যু আমার হাতেই লিখা ছিলো তারিন। তোমার বাবার খুনী সোহান কখনোই ছিলো না। আর না তো সোহান তোমার বাবার মৃত্যুর সাথে সম্পর্কযুক্ত। নিজের ভালোবাসার পর সন্দেহ করে জীবনের দ্বিতীয় বড় ভুল করেছো তুমি। আর তোমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। এই মৃত্যুখেলার উদ্ভাবক আমি, আমিই এর ইতি টানবো। কেবল তুমি নও, তোমাদের প্রত্যেকের মৃত্যুই আমি নিজের হাতে লিখবো।”
আড়াল থেকে কথাগুলো বলে সেখান থেকে চলে যায় রায়হান।
সমাপ্ত।
আসসালামু আলাইকুম।
সবকিছু স্বাভাবিকই চলছিলো। কিন্তু তীব্র মাথাব্যথার আবির্ভূত হয়ে বিপত্তি ঘটলো জীবনে। ফোন স্ক্রিনে একটানা তাকিয়ে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছিলো। তার উপর এসাইনমেন্ট+পরীক্ষা- আশানুরূপ পরীক্ষা দিতে না পেরে মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছি। এমতাবস্থায় গল্প চলমান রাখা হয়তো অসম্ভব। আজকের দুটো পর্বের মোট শব্দসংখ্যা প্রায় (২৫০০+)। প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে লিখতে সক্ষম হয়েছি। তাড়াতাড়ি সমাপ্ত করে গল্পটির সৌন্দর্য নষ্ট করতে চাইনি। গল্পের এখনো অনেক রহস্য বাকি। তাই গল্পটিকে দুটো পরিচ্ছেদে ভাগ করে নেয়া ব্যতীত অন্য পন্থা খুঁজে পেলাম না। গল্পটির দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ নিয়ে ফিরে আসবো খুব শীঘ্রই।
সকলে ভালো থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।