তারিন আর রিফাত আবার হাঁটতে শুরু করলো। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখতে পেলো রাস্তার পাশে একটা টং দোকান। রিফাতের খুশি দেখে কে।রিফাত আর তারিন দোকানের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। কিন্তু দোকানের সামনে গিয়ে তারিনের হাসি মুখটা মুহূর্তের মধ্যেই মলিন হয়ে গেলো।তারিন হতাশ হয়ে থেমে গেলো।
রিফাত তারিনের থেমে যাওয়া দেখে জিজ্ঞাসা করলো..
– কী হলো থেমে গেলেন কেন??
– আরে আপনি দেখতে পাচ্ছেননা এটা একটা চায়ের দোকান।
– হ্যাঁ চায়ের দোকান তো কী হইছে??
– এই চা খেয়ে কী পেট ভরবে??
– আপনি কখনো শীতের রাতে টং দোকানে বসে চা খেয়েছেন??
– আমি কেন টং দোকানে বসে চা খেতে যাবো??
– ‘তাহলে এর মজা বুঝবেন কীভাবে?’
শীতের রাতে টং দোকানে বসে চা খাওয়ার ভাগ্য সব সময় পাওয়া যায় না। এই খোলা আকাশের নিচে, ঠান্ডা বাতাসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার মজাই আলাদা।
রিফাতের কথায় তারিনের খুব অবাক হলো। তারিন ভাবতে শুরু করলো এই লোকটা বেশ অদ্ভুত। খুব সহজেই সবার সাথে মিশে যেতে পারে। এমন ভাবে কথা বলছে যেন আমার সাথে কতদিনের পরিচয়।
যেহেতু আর কোন উপায় নেই। তাই এই চা ছাড়া কপালে আর কিছু জুটবে না।
তারিন ও রাজি হয়ে গেলো।
– ‘চলুন তাহলে, আপনার শীতের রাতের চা এর মজা নেই।’
রিফাত আর তারিন চায়ের দোকানের ভিতর গেলো। দোকানদার কে দু’কাপ চা দিতে বলে ওরা দোকানের ছাউনি থেকে বের হলো।
দু’জনেই রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদের আবছায়া আলো রাস্তায় পড়ে যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু রাস্তা। আশেপাশে কোন বাড়ি নেই। এইরকম জায়গায় যে, একটা চায়ের দোকান পেয়েছে সেটাই অনেক । চায়ের দোকানে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
খুব ঠান্ডা হাওয়া আসছে। তারিন শীতে কাঁপছে। রিফাত শরীর থেকে ব্লেজার টা খুলে দিয়ে তারিনের দিকে এগিয়ে দিলো।
তারিন রিফাতের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।আর বলল.
– আপনি এটা আমাকে দিচ্ছেন কেন??
– আপনি তো শীতে কাঁপছেন।
– আমাকে এটা দিয়ে দিলে আপনার শীত লাগবে না?
– আমার অভ্যাস আছে।
– কিন্তু..
রিফাত আর কোন কথা না বলে ব্লেজার টা তারিনের হাতে দিয়ে দিলো। তারিন ও আর কিছু না বলে ব্লেজার টা পড়ে নিলো। ব্লেজার টা পড়ে তারিনের খুব ভালো লাগলো। এখন আর তারিনের তেমন শীত করছে না। রিফাতের শরীর থেকে আসা ব্লেজারের মিষ্টি গন্ধে তারিনকে পাগল করে দিয়েছে।
দু’জনেই নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দোকানদার এসে দু’জনকে চা দিলো।
রিফাত দোকানদার কে জিজ্ঞাসা করলো..
– আচ্ছা এই দোকান কী সারারাত খোলা থাকে??
– হ্যাঁ পাশেই তো নদী। আর দূরদূরান্ত থেকে অনেক লোক এখান দিয়ে যাওয়ার সময় এই দোকানে চা খেয়ে যায়। তাই এই দোকান সব সময় খোলা থাকে।
– আচ্ছা আজকে কোন গাড়ি দেখতে পাচ্ছি না কেন?
– সামনের রাস্তায় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই সব গাড়ি বন্ধ করে দিছে । কালকে সকালের আগে কোন গাড়ি চলবে না।
দোকানদারের কথা শুনে রিফাত খুব চিন্তায় পড়ে গেলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে লাগলো কালকে সকালে তো পোগ্রাম আছে। আজ রাতের মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে সকালে কীভাবে গান গাইবে?
রিফাত যখন কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করে। তখন ওর মুখটা একদম বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়।
আর রিফাতের এই বাচ্চাদের মতো মুখ দেখে তারিন হাসতে শুরু করলো।
রিফাত তারিনের এই হাসিব কারণ না জানলেও তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কী সুন্দর তারিনের হাসি। যে কেউ এই হাসিব প্রেমে পড়ে যাবে।
একটু আগেও মেয়েটার মুখে ভয়ের ছাপ ছিল। আর এখন কত সুন্দর করে হাসছে। রিফাত তারিনের হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো। এক দৃষ্টিতে তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
তারিন বুঝতে পারলো রিফাত ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তাই হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,– ‘এভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন??’
তারিনের কথায় রিফাত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। তারিনের দিক থেকে চোখ নামিয়ে বলল– ‘কিছুনা।’
তারিন রিফাত কে বলল, – ‘আচ্ছা সকালের আগে যদি গাড়ি না পাওয়া যায় তাহলে আপনার গানের পোগ্রামের কী হবে?’
– ‘সেটা তো আমিও ভাবছি। যদি আমার বন্ধুদের একটা খবর দিতে পারতাম তাহলে অন্তত একটু নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। ওরা নিশ্চয় আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা করছে। বলেছে বাসে উঠে একটা ফোন দিতে। কিন্তু আমার ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে। ওদের কোন খবর দিতে পারছি না।’
রিফাতের কথা শুনে তারিন ও খুব চিন্তায় পড়ে গেল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই মনে পড়ে গেল দোকানদারের মোবাইলের কথা। তাই রিফাত কে বলল — ‘আচ্ছা ওই দোকানদারের মোবাইল দিয়ে আপনার বন্ধুদের একটা ফোন করলে কেমন হয়।’
এই কথা শোনার পর রিফাতের মুখে হাসি ফিরে এলো। রিফাত নিজেকে বোকা ভাবতে লাগলো। এই সহজ কথাটা আগে কেন মাথায় আসলো না। রিফাত তাড়াতাড়ি করে দোকানদারের মোবাইল আনতে গেলো। তার কাছে থেকে মোবাইল নিয়ে বন্ধু আরিয়ানের কাছে ফোন দিলো। – ‘হ্যালো, আরিয়ান।’
ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল– ‘হ্যালো, কে??’
– আমি রিফাত।
রিফাত নাম শুনতেই আরিয়ান বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠলো।
– ‘রিফাত তুই কোথায় এখন, আর তোর ফোন বন্ধ কেন??’
– আরে ফোনে চার্জ শেষ হয়ে গেছে।
– তোকে একটা খবর জানানোর জন্য বার বার করে ফোন দিচ্ছিলাম।
– কীসের খবর?
– কালকের গানের পোগ্রাম টা ক্যান্সেল হয়ে গেছে।
রিফাত অবাক হয়ে আরিয়ান কে প্রশ্ন করলো – ‘কেন??’
– আরে এখানে কী যেন একটা সমস্যা হয়েছে। তাই এখানকার স্থানীয় লোকগুলো এসে বলল এই পোগ্রাম টা তিনদিন পর হবে। আর আমরা এই তিনদিন এখানেই থাকবো।
রিফাত কোন কিছু না বলে আরিয়ান কে একটা থ্যাংকু দিয়ে ফোন কেটে দিলো।
৪.
আরিয়ান সবাইকে বলল, ‘রিফাত ফোন দিয়েছিল।’
রাফি আরিয়ান কে বলল – রিফাত এখন কোথায় আছে। আর ওর ফোন এতক্ষন বন্ধ ছিল কেন??
– সেসব তো কিছুই বলল না। শুধু বলল ফোনে চার্জ শেষ হয়ে গেছে। আর আমি কালকের পোগ্রাম ক্যান্সেলের কথা বলাতে আমাকে একটা থ্যাংকু দিয়ে ফোন কেটে দিলো।
৫.
রিফাত মনে খুব আনন্দ নিয়ে তারিনের সামনে গেলো।
তারিন রিফাত কে জিজ্ঞেস করলো.
– ‘কী ব্যাপার এত খুশি খুশি লাগছে আপনাকে??’
– এই মাত্র এক বন্ধু বলল কালকের পোগ্রামটা তিনদিন পর হবে।
– কেন?
– ওখানে কী যেন একটা সমস্যা হয়েছে।
– বাহ্। এটা তো খুব ভাল কথা।তাহলে আর এত তাড়া নেই।
রিফাত বলল,- আমার তাড়া নেই তো ঠিক আছে। কিন্তু আপনার বাবা- মা তো খুব চিন্তা করছে??
বাবা-মা’র কথা শুনেই তারিনের মন খারাপ হয়ে গেলো। সত্যিই তো বাবা-মা তো খুব চিন্তা করবে। বাড়িতে বলেছিলাম কলেজ শেষ করে এক ফ্রেন্ড এর বাসায় যাবো কিছু নোটস্ আনতে। সন্ধ্যা পেড়িয়ে অনেক রাত হয়ে গেছে কিন্তু আমার কোন খবর তারা পায়নি।
তারিনের এইরকম চিন্তা করতে দেখে রিফাত দোকানদারের মোবাইল টা হাতে দিয়ে বলল,- ‘এই নিন আপনার বাসায় ফোন দিন।’
– বাসায় ফোন দিয়ে কী বলবো বলবো??
– ফোন দিয়ে বলুন, আপনার বন্ধু খুব অসুস্থ তাই আজকে রাত তার বাসায় থাকবেন। কালকে বাড়িতে চলে যাবে।
তারিন আর দেরী না করে ওর বাবা কে ফোন করলো।
তারপর রিফাতের বানানো দু’টো লাইন মিথ্যে কথা বলে দিলো।
তিনিও খুব সহজে মেনে নিলেন। কেননা তারিনের উপর তার অগাধ বিশ্বাস ছিল।
তারপর ওরা চা শেষ করলো। শীতে রিফাত শরীর কাঁপতে শুরু করলো। তারিন রিফাতের দিকে তাকিয়ে দেখে রিফাত শীতে কাঁপছে।
তাই নিজের শরীর থেকে রিফাতের দেওয়া ব্লেজার খুলে বলল।- “এই নিন আপনি পড়ে নিন??”
– এটা তো আমি আপনাকে পড়তে দিলাম।
– আপনি তো শীতে কাঁপছেন।
– আমার কোন সমস্যা হবে না।
রিফাতের কথায় তারিন কিছুটা রাগ করলো। তারিন ভাবতে লাগলো লোকটা কী পাগল নাকি। এভাবে শীতে কাঁপছে,আবার বলছে কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু এভাবে দু’জনেরই কষ্ট হবে। তাই, – “আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়। ওই যে দোকানের পাশে লোকগুলো আগুন ধরিয়েছে, আমরাও সেখানে চলে যাই।”
– আমরা ওখানে গিয়ে কী করবো।
– আরে আগুনের তাপ শরীরে লাগলে আর শীত করবে না।
– “ভাল কথা বলেছেন তো।”
– “আমি সব সময় ভাল কথাই বলি।”
রিফাত আর তারিন দোকানে চায়ের কাপ টা রেখে আগুনের কাছে চলে গেলো। দু’জনের শরীরে আগুনের তাপ লাগতেই কাঁপুনি বন্ধ হয়ে গেলো। কেউ কোন কথা বলছে না। দু’জনে চুপ করে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। রিফাত আড়চোখে তারিনের দিকে তাকায় আবার দু’জনের চোখাচোখি হতেই রিফাত চোখ নামিয়ে নেয়। চাঁদের আবছায়া আলো আর আগুনের আলো তারিনের মুখকে একদম উজ্জল করে রেখেছে। রিফাত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। রিফাত আস্তে আস্তে তারিনের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। রিফাতের এভাবে তাকিয়ে থাকা তারিন কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে । তারিন মনে মনে হাসতে লাগলো।
তারপর যা বলল তা শুনে রিফাত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
পার্থক্য
২য় পর্ব
#রিফাত_হোসেন
চলবে……