পার্থক্য
২৫ পর্ব।
#রিফাত_হোসেন।
ছেলেটা তারিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘তুমি এখানে?’
তারিনের কথা শুনে সবাই খুব বড় একটা ধাক্কা খেলো। রিফাত মনে মনে ভাবছে তারিন এটা কী বলল। ও এই ছেলেটা কে কীভাবে চিনে৷ আবার তুমি করে বলছে। নিশ্চয়ই খুব ভালো করে চিনে তারিন। কিন্তু কীভাবে? কী সম্পর্ক হতে পারে ওদের মাঝে। রিফাতের মাথায় নানান রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ ছেলেটার কথায় রিফাতের ভাবনার ছেদ পড়লো। ছেলেটা বলল – ‘আপনি কী বললেন ঠিক বুঝতে পারলাম না।’
ছেলেটার কথায় তারিনের মাথা আরো গরম হয়ে গেল। রেগে গিয়ে ছেলেটার শার্টের কলার ধরে বলল – ‘এখন কিছু বুঝতে পারছো না, তাই না।’
– ‘দেখুন, আপনি হয়তো ভুল করছেন।’
– ‘দেখো আশিক, আমার মাথা গরম করাবে না। আমি ইচ্ছে করলেই সেদিন তোমাকে পুলিশে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি। তাই বলে এখনো যে কিছু করবো না তেমনটা ভেবো না।’
রিফাত একবার তারিনের দিকে তাকাচ্ছে আবার ছেলেটার দিকে তাকাচ্ছে।
আশিক নামটা শুনেই রিফাতের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ভিতরটা কেঁপে উঠলো রিফাতের। ভয়ে বুকের ভিতর চিনচিন ব্যাথা করতে শুরু করলো।
তারিনের কথায় ছেলেটা ও একটু রেগে গেল। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল – ‘আমি কোন আশিক নই। আর আপনার সাহস কী করে হলো এভাবে এত মানুষের সামনে আমার কলার ধরার।’
তারিন ও চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুতেই বুঝতে পারছে না আশিক কেন নিজেকে অচেনা বলে পরিচয় দিচ্ছে। কেন নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। হয়তো বোনের সামনে নিজের ভয়ংকর রূপ ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে।
তারিন ছেলেটা কে উদ্দেশ্য করে বলল – ‘বাহ্, নিজের চরিত্রহীন রূপ বোনের সামনে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে এখন পরিচয় গোপন করছো। আমাকে না চেনার অভিনয় করছো।’
পাশ থেকে মিম বলল – ‘ভাবী আপনার কোথায় ভুল হচ্ছে হয়তো। ওর নাম আশিক নয়। ওর নাম অয়ন।’
– ‘বাহ্, এখন আপনি ও ওর মতো নাটক করছেন। এই যে সামনে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। ও আপনাদের সামনে ভালো আচরণ করলেও ও মোটেও ভালো নয়। ওর মতো নীচু স্তরের মানুষ আর নেই। ও যে কতটা ভয়ংকর তা শুধু আমি জানি। ও একটা চরিত্রহীন মানুষ।
আর আমি ওকে মানুষ বলছি কেন? ও তো কোন মানুষ নয়। ও মানুষ রূপে হিংস্র পশু। যার মধ্যে আছে মেয়েদের প্রতি লোভ, লালসা।’
ইরা এতক্ষন চুপ করেই ছিলো। কিন্তু নিজের ভাইয়ের নামে কোন খারাপ কথা শুনলে যে কেউ রেগে যাবে। যে কেউ প্রতিবাদ করবে। ইরা ও তার ব্যাতিক্রম নয়। হোক সে মামাতো ভাই। ইরা রিফাতের দিকে তাকিয়ে রাগি কন্ঠে বলল – ‘রিফাত তোর স্ত্রী এইসব কী বলছে। উনি শুধু শুধু আমার ভাই কে অপমান করছে।’
রিফাত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল – ‘আসলে আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। কেন তারিন উনার সাথে এইরকম ব্যবহার করছে।’
– ‘কিন্তু আমার চোখের সামনে আমার ভাই কে কেউ অপমান করবে, সেটা আমি কীভাবে সহ্য করবো।’
– ‘অনেকদিন আগে তারিন একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলো। সেখানেই আশিক নামে একটা ছেলে তারিনের সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি এখনো শিউর নই এটাই সেই আশিক কিনা।’
তারিন রিফাতের দিকে তাকিয়ে বলল – ‘আমি এই মুখটা এত সহজে ভুলে যাবো না। আমি খুব ভালো করেই জানি এই সেই আশিক। আর এটাও জানি এখন ও সবার সামনে ভালো সাজার চেষ্টা করছে।
অয়ন বলল – ‘আপনি হয়তো অন্য কারোর সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন। আমি আশিক নই। ইনফ্যাক্ট আমি আশিক নামে কাউকে চিনি ও না।’
রিফাত তারিনের কাছে গিয়ে বলল – ‘তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো।’
তারিন চিৎকার করে বলল – ‘আর কতবার বলবো আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না।’
– ‘ভাইয়া আমার মনে হয় আপনার স্ত্রী অসুস্থ। তাই উনাকে কোন ভালো ডাক্তার দেখান।’
রিফাত রাগি কন্ঠে বলল – ‘জাস্ট শেটাপ।’
ইরা বলল – ‘রিফাত শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে সিঙ্ক্রিয়েট করার কোন মানে হয় না৷ ইতিমধ্যেই সবাই মঞ্চের অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাই আমাদের এখান থেকে বের হওয়া উচিত।’
রিফাত শান্ত কন্ঠে বলল – ‘ঠিক আছে তোরা এখন বাড়ি যা। আমি তারিন কে শান্ত করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি।
ইরা, মিম আর অয়ন ওদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
তারিন অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিফাত বলল – ‘তো ম্যাডাম এবার বাড়ি চলুন।’
তারিন কোন কথা না বলে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। রিফাত পিছন থেকে অনেকবার ডাকার পরেও তারিন কোন কথা না বলে একা একাই হেঁটে যাচ্ছে। রিফাত একটা রিক্সা তে উঠলো। রিক্সাওয়ালা কে বলল তারিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। রিক্সাওয়ালা ও ঠিক তাই করলো। তারিনের সামনে গিয়ে রিক্সা থামালো। তারিন চোখ বড় বড় করে রিফাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। রিফাত মুখে কোন কথা বলে না রিক্সার একপাশে বসে পড়লো। আর অন্যপাশে তারিন কে বসার জন্য জায়গা করে দিল। তারিন ও কোন কথা বলেনি। রিক্সাতে উঠে চুপ করে বসে রইলো। বাড়িতে ফিরে তারিন রিক্সা থেকে নেমে হনহনিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল। রিফাত রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে ভিতরে এলো। ঘরে গিয়ে দেখে তারিন নেই। রিফাত বেলকনিতে গেল। কিন্তু তারিন সেখানে ও নেই।
বেশ চিন্তায় পড়ে গেল রিফাত। এইটুকু সময়ের মধ্যে মেয়েটা গেল কোথায়। মাত্রই তো বাড়ির ভিতর ঢুকলো। তাহলে কী ছাদে গেছে তারিন। কিন্তু সেটা কীভাবে হয়, তারিন তো একা একা ছাদে যায়। পাশের বিল্ডিংয়ে একজন ব্যর্থ প্রেমিক আত্নহত্যা করেছিলো। আর তারিন এটা শোনার পর থেকে একা একা তো দূরে থাক আমার সাথে ও যেতে চায় না ছাদে। তাই তারিনের ছাদে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। একমাত্র একটা জায়গায় বাকি আছে। যেখানে তারিন যেতে পারে।
রিফাত দৌড়ে আয়শা বেগম এর ঘরে চলে গেল। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে দেখে আয়শা বেগম এর কোলে মাথা রেখে শান্তিতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে তারিন। তারিন নিজের বাবা-মা’র জায়গায় নতুন করে রিফাতের বাবা-মা কে পেয়েছে। তারিনের যখন মন খারাপ থাকে। তখন ঠিক এভাবে আয়শা বেগম এর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে।
এই বাড়িতে আসার পর রিফাত অনেকবার এটা খেয়াল করেছে। কখনো অতিরিক্ত পাগলামির জন্য রিফাতের কাছে ধমক খাওয়ার পর মন খারাপ। তো কখনো নিজের বাড়ির মানুষদের কথা ভেবে মন খারাপ।
আয়শা বেগম এর কোলে শুয়ে থাকলেই মন ভালো হয়ে যায় তারিনের। যেন সব মন খারাপের অবসান ঘটে এই কোলে।
আয়শা বেগম রিফাত কে দেখতে পেয়ে বলল – ‘কি রে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
– ‘এমনি দাঁড়িয়ে আছি।’
তারিন চোখ মেলে রিফাতের দিকে তাকিয়ে আছে। রিফাত ও তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়শা বেগম বলল – ‘হঠাৎ করে মেয়েটার কী এমন হলো। যে বাহির থেকে এসেই আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। কতবার জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। কিন্তু কোন উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।’
রিফাত মনে মনে ভাবলো, মা কে এখন কিছু জানানো যাবে না। তারিনের সাথে ঘটে যাওয়া অতীত মা অনেক আগে থেকেই জানে। তারিন নিজেই মা কে সব বলেছে। অবশ্য মা এটা নিয়ে কখনো তারিন কে কথা শোনায়নি। কারণ আমার মা সব সময় বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে। তার অতীত নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু আজকের ঘটনা মা কে বলা যাবে না। তাহলে শুধু শুধু চিন্তা করবে।’
আয়শা বেগম আবার বলল – ‘কি রে চুপ করে আছিস কেন?’
– ‘ওর বাড়ির কথা মনে পড়ছিলো হয়তো। তেমন কিছু না।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। ওকে এখন ঘরে নিয়ে যা।’
রিফাত তারিন কে উদ্দেশ্য করে বলল – ‘ঘরে আসো।’
তারিন আয়শা বেগম এর কোল থেকে উঠে ঘরের দিকে গেল। রিফাত তারিন কে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে দু’গালে হাত দিয়ে বলল – ‘এই পাগলী হঠাৎ এইরকম চুপ হয়ে গেলে কেন?’
তারিন কান্না স্বরে বলল – ‘তুমি ও কী আমাকে অবিশ্বাস করছো। আমি শুধু শুধু একজন কে দোষারোপ করছি।’
– ‘তোমার উপর আমার সম্পুর্ন বিশ্বাস আছে। কিন্তু আমি চাই না এই আশিক নামটা আমাদের ভালোবাসার উপর পরুক। তাই এই নামটা আর কখনো বলবে না। মনে কর আজকে এইরকম কোন ঘটনা ঘটে নি।’
তারিন বলল – ‘ঠিক আছে।’
রিফাত তারিনের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল – ‘তুমি বসো আমি একটু আসছি।’
– ‘এখন আবার কোথায় যাবা?’
– ‘একটু আরিয়ানের সাথে কথা বলে আসি।’
– ‘আরিয়ান ভাইয়া কে এখন কোথায় পাবা। তিনি তো অনেক রাতে বাড়ি ফিরে। সকালে বলল তার পি.এ. নাকি কয়েকদিন ধরেই খুব অসুস্থ। তাই তাকে বেশি করে কাজ করতে হয়।’
– ‘হুম। আমার সাথে কথা হয়েছে।কিন্তু আজকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসেছে। ছেলেটা একা একা সব কাজ করছে দেখি কিছু সাহায্য করতে পারি কি না।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে যাও।’
রিফাত রুম থেকে বেড়িয়ে আরিয়ান এর রুমে গেল। রুমে গিয়ে দেখে ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে। হয়তো মিমের সাথে কথা বলছে। রিফাত ভিতরে ঢুকে বলল – ‘মিম এর সাথে কথা বলছিস?’
আরিয়ান একবার রিফাতের দিকে তাকালো, তারপর বলল – ‘হ্যাঁ,।
– ‘ফোনটা আমাকে একটু দে তো। মিম এর সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
আরিয়ান রিফাতের হাতে ফোন দিয়ে ল্যাপটপ এ কাজ করতে শুরু করলো।
রিফাত ফোন হাতে নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। তারপর বলল – ‘মিম আমি রিফাত।’
– ‘হুম, বুঝতে পেরেছি বল।’
– ‘আজকের ব্যাপার টা নিয়ে সত্যিই আমি খুব লজ্জিত। তোদের সাথে এতদিন পর দেখা হলো, কিন্তু ভালো করে কথা ও বলতে পারলাম না।’
– ‘আরে এটা নিয়ে আর কিছু ভাবিস না তো।’
– ‘আচ্ছা তুই অয়ন কে কতদিন ধরে চিনিস।’
– ‘অনেক আগে থেকেই চিনি। আগে যখন ইরার বাড়ি যেতাম। তখন মাঝে মাঝে এনাকে দেখতাম। সেখান থেকেই পরিচয় হয়েছে।’
– ‘ছেলেটার কেমন? মানে স্বভাব চরিত্র কেমন?’
– ‘আমি যতদূর দেখেছি ভালোই।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে এখন রাখি আবার পরে কথা হবে।’
– ‘ওকে বাই।’
রিফাত ফোন কেঁটে দিয়ে রুমে আসলো। আরিয়ান এর হাতে ফোন দিল। আরিয়ান জিজ্ঞেস করলো – ‘কোন সমস্যা হয়েছে।’
রিফাত আরিয়ান কে আজকের ঘটনা টা বলল। সব কিছু শুনে আরিয়ান নিজেই অবাক হয়ে গেল।
৩৯.
তারিন ঘরে চুপ করে বসে ছিলো। হঠাৎ করে টেবিলের উপর থাকা তারিনের ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। হঠাৎ করে ফোন বেজে উঠায় তারিন অনেকটা ভয় পেয়ে যায়।’
চলবে……..?
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
সবার কমেন্ট একি রকম – ভাইয়া ওটা নিশ্চয়ই আশিক ছিলো।