পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী #মম_সাহা পর্বঃ চব্বিশ

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ চব্বিশ

শুকনো মুখে মধ্যরাতে বাড়ি ফিরেছে বিপ্রতীপ। তার বাবা নিলয় কুমার জেল থেকে মোটা টাকার বিনিময়ে মাত্র ছাড়িয়ে আনলেন। পাড়ার মাঝে তাদের নিয়ে মোটামুটি একটা কলরব উঠে গেছে। এই মধ্যরাতেও কেউ কেউ জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বিপ্রতীপের ফিরে আসার দৃশ্য উপভোগ করছে। কেউবা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। এসব কিছু চোখ এড়ায় নি বিপ্রতীপের। মাথায় তার উত্তপ্ত অনল থিতিয়ে আছে। একমাত্র এই রাগের বশে মায়াকে একটা চড় দিয়েছিলো যার ফলস্বরূপ সন্ধ্যা হতে মধ্যরাত অব্দি জেলের ভিতরে কাটাতে হয়েছে সাথে প্রতিবেশীদের কটুক্তি, হাসি তামাশার পাত্র হতে হয়েছে।

নিলয় কুমার আর বিপ্রতীপ ঘরে ঢুকতেই ছুটে আসে মোহনা। ছেলের গলা জড়িয়ে আহ্লাদে কেঁদে উঠে সাথে দাঁত কিড়মিড় করে হাজার টা অভিশাপ দেয় মায়াকে। বিপ্রতীপ ক্লান্ত পায়ে সোফায় গিয়ে বসতেই বিরক্তিতে শরীর আরেকটু ঝিমিয়ে আসে। মেয়েটা তাকে সামান্য চড়ের জন্য জেলের ঘানি টানিয়ে নিজে আরামে বসে টিভি দেখছে! বিপ্রতীপের ভিতরের শব্দ কণিকা গুলো উগ্র হয়ে উঠে। দল বেঁধে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু বিপ্রতীপ নিজেকে শক্ত রাখে। সন্ধ্যাবেলা মেয়েটা যে খেলা দেখিয়েছে, এরপর আর দানবীয় রাগ দেখানোর মানে হয় না। এতে নিজের পায়ে নিজের কুড়াল মারা হবে।

বিপ্রতীপকে পাশে বসতে দেখেই মায়া কুটিল হাসলো। হাতের রিমোটটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টিভির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বললো,
“তা স্বামী,জেলের ঘানি টেনে কেমন লাগলো শুনি? ইশ,শ্বশুর বাবা যে কেন তার কুলাঙ্গার ছেলেকে এত টাকা দিয়ে ছাড়ালো আমার বোধগম্য হয় না। যার জায়গা যেখানে তাকে তো সেখানেই রাখা উচিত।”

বিপ্রতীপের রাগে শরীরের শিরা উপশিরা কাঁপছে। বর্তমানে এ মেয়েটাকে তার এক মুহূর্ত সহ্য হচ্ছে না। কেবল নিজেকে পাগল পাগল লাগছে তার। কে জানতো, মানুষ এভাবে বদলে যাবে? বিয়ের আগের মায়া আর এখনের মায়ার মাঝে এমন বিস্তর পার্থক্য দেখা দিবে,সেটাও বা কার জানা ছিলো?

বিপ্রতীপের ভাবনা গুলো বিপ্রতীপকে যেন ধিক্কার জানালো। তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“তুই কী কম করেছিলি দর্শিনীর সাথে? তুই কী বদলে যাস নি? বিয়ের আগে বিপ্রতীপ আর পরের বিপ্রতীপকে মেলাতে দর্শিনীরও তো কষ্ট হয়েছিল, তখন তুই বুঝেছিলি?”

হঠাৎ করেই বিপ্রতীপের মস্তিষ্কে দোল খেয়ে যাওয়া কথা গুলো বিপ্রতীপকে ভাবালো। প্রায় অনেক গুলো বছর পর বিপ্রতীপ ভাবতে বসলো। সত্যিই তো,সে দর্শিনীর সাথে যা যা করেছে তা-ই তো সুদে আসলে ফেরত আসছে। এটা তো এখন মানতেই হবে। এটা যে হওয়ারই ছিলো। দর্শিনীরা ছেড়ে দিলেও যে প্রকৃতি ছাড় দেয় না।

বিপ্রতীপ সোফা ছেড়ে উঠতেই মোহনা একটা শরবতের গ্লাস নিয়ে হাজির হলো। ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে নরম স্বরে বললো,
“এটা খেয়ে নে, বাবা। নিশ্চয় খিদেও লেগেছে? যা হাত মুখ ধুয়ে নে,আমি খাবার দিচ্ছি।”

বিপ্রতীপ ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো। কণ্ঠ শীতল রেখেই বললো,
“আমি এখন একা থাকতে চাই, মা। আমার কিছু খাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি রুমে যাচ্ছি। কেউ বিরক্ত করবে না আশাকরি।”

শেষ কথাটা অবশ্য মায়ার দিকে তাকিয়েই বলেছে। মায়া মুখ ভেংচি দিয়ে টিভির দিকে তাকালো। বিপ্রতীপ গটগট পায়ে চলে গেলো নিজের রুমে। সর্বস্ব শক্তি দিয়ে দরজাটা আটকিয়ে ফেললো।

বিপ্রতীপ যেতেই মায়াও উঠে দাঁড়ালো। ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মোহনার হাত থেকে শরবত টা নিয়ে একটা গা জ্বালানো হাসি দিয়ে ছাদের দিকে যেতে যেতে বললো,
“আপনার ছেলের আর শরবত খেয়ে কাজ নেই। জেলের হাওয়া খেয়েই পেট ভরেছে। আপনিও যাবেন নাকি হাওয়া খেতে? খুব শীগ্রই তবে ব্যবস্থা করবো?”

মোহনা মুখ ঝামটি মেরে চলে গেলো। মায়াও খিল খিল হাসতে হাসতে ছাঁদের দিকে গেলো। এবং তার বেসুরে গলায় গান ধরলো,
“ওরে,জীবন হইলো ইটের ভাঁটা,
ধিকি ধিকি জ্বলে রে,
সুখ যে আছে এ জীবনে,
কোন পাগলে বলে রে?”

বিপ্রতীপ মাত্র জামা বদলাচ্ছিলো,মায়ার এমন গানে তার হাত থেমে যায়। বিরক্তিতে একটা ঢেঁকুর তুলে। শব্দ করে মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকায়। আজ অনেক গুলো দিন পর দর্শিনীকে বাজে ভাবে মনে পড়ছে। মেয়েটা বাড়ি ছেড়েছে দু’মাস হবে, এ অব্দি ওর বৌদি ছাড়া কারো সাথে কথা হয় নি। বৌদির সাথেও অনেকদিন আগে কথা হয়েছিলো এরপর আর কোনো যোগাযোগ নেই। বিপ্রতীপ নিজেই অবাক হলো,দর্শিনী খারাপ মেয়ে ছিলো না, বিপ্রতীপ যথেষ্ট ভালোবাসতো দর্শিনীকে। তবে হঠাৎ করে সব বিষিয়ে গিয়েছিল কেনো? বিপ্রতীপ দিগ বেদিক খুঁজে বেড়ায় কারণ কিন্তু কোনো কারণই তার মাথায় আসে না। অতঃপর বরাবরের মতন দর্শিনীর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে শান্তির ঘুমের প্রয়াস চালায়। হয়তো দর্শিনীই শক্ত হাতে সংসার টা ধরে রাখতে পারে নি। দর্শিনী একটু শক্ত হলে হয়তো আজ সবটা সুন্দর হতো। আরও হাজারটা অভিযোগ উঠে দর্শিনীর উপর।

_

শীতের হিমশীতল বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে জীপে বসা প্রতিটি মানুষের শরীরে। গাড়ি চলছে আপন গতিতে বিশাল রাস্তা পিছে ফেলে। গাড়িতে বসে থাকা মানুষ গুলো চুপচাপ। তাদের ভয় হচ্ছে,বাড়ি গিয়ে না আবার খারাপ কোনো খবর শুনতে হয়। দর্শিনীর দুই ভাইয়ের শরীর ভীষণ অসুস্থ, কী হয়েছে জানা নেই তাদের। নেটওয়ার্ক খারাপ ছিলো বিধায় জানতেও পারে নি। কেবল কাল বিলম্ব না করে তারা ছুট লাগিয়েছে বাড়ির পথে।

জাফলং ছাড়িয়ে উত্তর দিকে দর্শিনীদের গ্রাম। যখন জাফলং এর রাস্তায় গাড়ি উঠলো তখন ঘড়িতে বাজে রাত পৌনে তিনটা। দর্শিনী চুপচাপ তাকিয়ে আছে বিশাল আকাশে। আবহাওয়া শীতল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে শরীরে। দর্শিনী ডুব দিয়েছে অতীতে। জীবনটা তার এত বিষাদময় ছিলো না। বিষাদের গল্পে ভরা জীবন সে কখনো কল্পনাও করে নি। যখন বাবার বাড়িতে ছিলো,মা-বাবা ভাইদের প্রাণ ভোমরা ছিলো। হ্যাঁ, মা অনেক রাগী ছিলো ঠিক কিন্তু দর্শিনীর গায়ে কখনো হাত তুলে নি। মাঝে মাঝে ধমক দিতো কিন্তু বড় বৌদির জন্য সেটাও তত করতে পারতো না। বড় বৌদি বরাবরই অনেক সোহাগ করতো তাকে। দর্শিনী যখন শ্বশুর বাড়িতে উঠে তখনও জীবন এতটা খারাপ ছিলো না। বিপ্রতীপ প্রতিদিন তার জন্য বেলীফুলের মালা আনতো। কখনো বা আলতা,চুড়ি, পাকোড়া, সিঙ্গারা ইত্যাদি অনেক কিছু আনতো রোজ বিকেলে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় তারা ঘুরতেও যেতো।

মোহনা বাদে কেউ দর্শিনীকে কিছু বললে বিপ্রতীপ প্রতিবাদ করে উঠতো। এইতো গত তিন বছর আগের এক শরৎ এর কথা। বিপ্রতীপদের বাড়িতে মেহমানে ভরা। দর্শিনী তখন নতুন বউ। মাসি শাশুড়ীকে চা করে দিয়েছিলো। চিনি অতিরিক্ত হওয়ায় সে ভদ্র মহিলা কত কথা শুনালো। বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে দর্শিনীর মাথা নত হয়ে যায়। কান্নায় চোখ ভরে উঠে। তন্মধ্যেই বিপ্রতীপ হাজির হয়। অফিস থেকে এসেই দর্শিনীর ক্রন্দনরত মুখ দেখে সে হিংস্র বাঘ হয়ে যায়। চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে। মাসি তো নিজের বোনের ছেলের আচরণে লজ্জায় কুঁকড়ে বাড়ি থেকে চলে যায় সেদিনই। যেতে যেতে অভিশাপ দিয়ে যায় ক’দিন এ সোনার সংসার টিকে সে ও দেখবে। এইতো আজ সে মানুষটার কথা মিলে গেলো। টিকলো না সে সংসার। দর্শিনী হেসে উঠে। সেই বিপ্রতীপ এতটা বদলে গেলো কীভাবে! এটা ভাবতেও যে বুকটা কাঁপে।

দর্শিনীকে হঠাৎ হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো তৃণা। অবাক কণ্ঠে বললো,
“প্রিয়দি,হাসছো যে?”

দর্শিনীর ধ্যান ভাঙলো। হাসি থামালো। মৃত্যুঞ্জয় গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে পিছে ঘুরে তাকালো। দর্শিনী কিছুটা অস্বস্তিতে পরলো। আমতা-আমতা করে বললো,
“কই না তো।”

কিন্তু তখন দর্শিনীর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা মৃত্যুঞ্জয় ও দৃষ্টান্তও খেয়াল করেছিলো। তৃণা সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“তোমার মুখে স্পষ্ট হাসি দেখলাম। কিছু মনে করে হাসছো তাই না? কোনো মজার ঘটনা কি?”

দর্শিনী বুঝলো,কথা ঘুরানোর উপায় নেই। তাই মলিন হেসে বললো,
“অতীত ভেবে হাসছি। আমার সাংসারিক ঘটনা মনে পড়লো।”

দর্শিনীর কথা বলতে দেরি কিন্তু জীপ গাড়ি ব্রেক কষতে দেরি নেই। মৃত্যুঞ্জয় কাঠ কাঠ হয়ে বসলো। তৃণা তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“বাহ্,ঐ মানুষটার সাথে তোমার হাসির স্মৃতিও আছে?”

“থাকবে না আবার? ছিলো তো প্রেমের বিয়ে, সুখের স্মৃতি না থেকে কোথায় যাবে? মানুষটা তো এক কালে আমায় ভালোবেসেছিল। সেটা অভিনয় ছিলো না। ভালোবাসা-ই ছিলো। সময় গড়িয়েছে, ভালোবাসায় ধূল জমে জমে মরুভূমির গহ্বরে হারিয়ে গেছে। আজ সে পাল্টে গেছে বলে অতীতের তাকে আমি স্বীকার করবো না, ততটা বেইমান আমি না।”

“এত ভালোবেসে কী পেলে, দি?”

“এই যে,হুটহাট হাসির কারণ পেয়েছি। আর কী লাগে জীবনে?”

“তাহলে সংসার টা একটু শক্ত হাতে টিকিয়ে রাখলেই পারতে।”

“শক্ত হাতে জমির হাল ধরা যায়, সংসার না। আর যে সংসারে স্বামীর মন বাহিরে চলে যায় সে সংসার শশ্মানের সমান। সংসারে শ্বশুর,শাশুড়ী, ননদ,দেবর সব এক দিকে আর স্বামী আরেকদিকে। সব মানা যায় কিন্তু স্বামীর অবহেলা সহ্য করার মতন না। মানুষ মরে একদিনে আর আমি মরছি গত কয়েক বছর ধরে। এই মৃত্যুতে শরীর লাশ হয় না, লাশ হয় হৃদয়।”

পুরো রাস্তায় থম মারা নিস্তব্ধতায় যোগ হলো দীর্ঘশ্বাস। মৃত্যুঞ্জয় নিস্তব্ধতা ঠেলে তার হাতের জ্যাকেট টা দর্শিনীর দিকে এগিয়ে দিলো। ভরাট কন্ঠে বললো,
“জ্যাকেট টা পড়ে নিন। ঠান্ডা লাগবে না হয়।”

দর্শিনী হাসে। মৃত্যুঞ্জয়ের জ্যাকেট টা জড়িয়ে নেয় শরীরে। সেও চায় আরেকটা সুন্দর বর্তমান তৈরী করতে। যে বর্তমান ভবিষ্যতে হাসাবে। যে বর্তমানে কোনো, বেইমান বিপ্রতীপ থাকবে না। স্বার্থহীন মৃত্যুঞ্জয় থাকবে। দর্শিনী জানে এটা সম্ভব। কারণ সে মৃত্যুঞ্জয়ের ঝড়ের রাতে দেওয়া আভাস বানী শুনেছিলো। দৃষ্টান্তের আর মৃত্যুঞ্জয়ের সে রাতের কথা জানালার আড়ালে দর্শিনীই শুনে ছিলো। এই বিষাদময় মরুভূমিতে দর্শিনীরও ইচ্ছে হয় মধুময় ভালোবাসা পাওয়ার। কে না চায় ভালোভাবে বাঁচতে?

_

বিধ্বস্ত অবস্থায় খাটে শুয়ে আছে দর্শিনীর বড় ভাই প্রদীপ। আর তার পাশের চেয়ারে ভাঙা হাত নিয়ে বসে আছে সুমন।

দর্শিনী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে দিকে। নিধি মিহি সুরে কেঁদে যাচ্ছে। সাথে নিপাও কাঁদছে।

দর্শিনী বড় ভাইয়ে পায়ের ব্যান্ডেজটার উপর আলতো হাত বুলায়। ঠোঁট ভেঙে আসা কান্না আটকানোর চেষ্টা করে আহত কণ্ঠে বলে,
“কীভাবে হলো এসব, বড়দা?”

“যদি বলি তোর জন্য এসব হয়েছে, প্রিয়।”

দর্শিনী চমকে উঠে। এ কথা টা মা কিংবা ছোট বৌদি বললে বোধহয় দর্শিনী স্বাভাবিক ভাবে নিতো কিন্তু কথা টা বলেছে তার বড় বৌদি। যে কিনা এ অব্দি উঁচু স্বরে একটা ধমক দেয় নি দর্শিনীকে।

দর্শিনী বড় বৌদির রুক্ষ কণ্ঠে হা হয়ে রইলো। বড় বৌদির মাঝে কেমন যেন বিরাট পরিবর্তন দেখলো। তার পরিচিত এক ভয়ঙ্কর নারীর ছায়া যেন দেখলো সে এই কোমলপ্রাণ বড় বৌদির মাঝে। দর্শিনীর মাথা ঘুরে উঠলো। হয়তো বদলাতে চলেছে অনেক কিছু।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here