বেলির_কথা (২৫)

#বেলির_কথা (২৫)

শাহেদ বেলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘তোকে ছোটবেলায় অনেক মে*রেছি,বকেছি।আমি ও তোকে কালি বলে আ*ঘা*ত করেছি।আম্মা অনেক কষ্ট পেতো।রাগের মাথায় কি বলতাম বুঝতাম না।কিন্তু মৃ*ত্যুশয্যায় আম্মা যখন বলল ‘আমার মেয়েকে কখনো কষ্ট দিস না’ বিশ্বাস কর সেদিনের পর থেকে তোকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছিলাম।কিন্তু দেখ তবুও ভাগ্যে কষ্ট লিখা আছে বলেই অকালে হাসনাত চলে গেলো।’

বেলি ভাইয়ের হাত ধরে বলে,
‘আমি তো আমার রবের সীদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট নই।তাহলে তুমি কেন অসন্তুষ্ট বলো?’
‘অসন্তুষ্ট না।তোকে এমন দেখতে ভাল লাগেনা এই আরকি।তবুও তুই যেভাবে সুখী হোস সেভাবেই থাক।’
‘আমি এরকম ই সুখী ভাই।আমার কলিজাকে নিয়ে বাকি জীবন টা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে পার করে দিবো।তবুও যদি দুঃখ আমার পিছু না ছাড়ে,সেই জান্নাতের লোভের জন্য হলেও আমি আমার রবের প্রতি নিরাশ হবোনা।’
‘আল্লাহ তোকে আরো ধর্য্য দিক।মেয়েকে নিয়ে সুখী হ।’

বেলি ভাইকে জড়িয়ে ধরে ফুফিয়ে কাদে।
.
কয়েকদিন গ্রামে থেকে তারপর বেলিরা চলে আসে।মিরার সে কি কান্না।মিরার স্কুল ও বন্ধ হওয়ায় বেলি মিরাকে সহ শহরে নিয়ে আসে।কয়েকদিন বেড়াইয়ে যাক।মিরা ফুফির আশেপাশে ই থাকে সবসময়।সামনে শীতকাল আসতেছে হেনা আর মিরার জন্য শীতের কাপড় প্রয়োজন।তাই বেলি হেনা আর মিরাকে নিয়ে শপিং এ যায়।একই দেখে দুইজনের জন্য সুইটর কিনে।তবে হেনার টা লাল মিরার টা গোলাপি।হেনা লালটা নিবেনা।মিরার কালারটায় তার পছন্দ।এদিকে মিরার টা সাইজে ছোট।সেখানে ও হেনা মন খারাপ করে বসে।

বেলি হেনাকে বুঝায়,
‘যে অল্পতে সন্তুষ্ট হয় সেই প্রকৃত সন্তুষ্ট।’

হেনা তখন সুইটর টা নিতে রাজি হয়।মনে মনে বলে বড় হলে সে নিজের ইচ্ছেমত চলবে।মায়ের কথা ই শুনবে না।

রাস্তার ধারে দুইহাতে দুইজনের হাত ধরে বেলি হাটছে।রাস্তায় একটা বাচ্চামেয়ে দুই কি তিনবছরের হবে খালি গায়ে বসে আছে।মিরা বেলিকে থামিয়ে বলে,
‘ফুফি?এদের শীত লাগেনা?’

বেলি বাচ্চাটির দিকে তাকায়।
‘হুম লাগেতো।’
‘আচ্ছা ফুফি তারা কি শীতের আগে শপিং করেছে?
‘নাহ।’

মিরার চিন্তিত মুখ দেখে হেনা বলে,
‘তোর এত ভাবনার কি প্রয়োজন?’

বেলি তখন হাটুগেরে বসে মিরার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ওদের ও শীত করে।কিন্তু ওদের কেনার সামর্থ্য নেই যে।’
‘ওদের কষ্ট হয়না ফুফি?’
‘হ্যা খুব কষ্ট হয়।ওদের কষ্টের কথা যদি আমরা অনুভব করতে পারতাম,তবে কখনো ই নিজেকে অসুখী ভাবতাম না’

হেনা চুপ করে মায়ের দিকে তাকায়।মিরা তখন বলে,
‘আমরা কি এই বাচ্চাকে একটা সুইটর কিনে দিতে পারিনা ফুফি?’
‘অবশ্যই পারি।’

মিরা তালি দিয়ে খুশি হয়।বেলি বলে,
‘দোয়া করি।তোর ছোট মস্তিস্কে এমন দিতে পারার যে আকুতি,সেটা যেন বড় হয়েও থেকে যায়।তুই সত্যিই আমার আম্মার মতো ই হয়েছিস।আমি তোকে আম্মা ডেকে ভুল করিনি যে।’

মিরা বলে,
‘আমি বড় হয়ে তোমার মতই সুন্দর হবো ফুফি।’

বেলি রাস্তার ধারে যত বাচ্চা ছিল সবার জন্য সুইটর কিনে এনে তাদের মাকে দেয়।তারপর বাসায় চলে আসে।
.
মিরাকে কয়েকদিন পর শাহেদ এসে নিয়ে যায় গ্রামে।

প্রতিদিন রাতে হাবিবা বেলিকে কল করে।ভালমন্দ খোজ রাখে।
.
রাতের দিকে বেলি হেনাকে খাইয়ে উপন্যাসের বই নিয়ে বসে।অবসরে বই পড়তে বেলির ভালই লাগে।হাবিবা তখনি কল করে।বেলি বলে,
‘আপু কি করছো?’
‘আর বলো না ভাবি,হাসিব আমার একটা কথা ও শুনেনা।’
‘কি করছে?’
‘সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে রাখে।’
‘বই পড়া তো ভালো।’
‘খাবার খাওয়াতে পারিনা,ডিম দুধ কিছুই খেতে চায় না।’
‘আমাদের হাসিব একদিন অনেক বড় কিছু হবে।দেখিও?’
‘আল্লাহ ভরসা।হেনা কি করে?’
‘এইতো ঘুমাচ্ছে।’

বেলি হাবিবার সাথে কথা বলে কল কেটে দেয়।সময় যে কিভাবে চলে যাচ্ছে বেলি টের ই পায়না।মেয়ের কপালে চুমু একে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।আর বলে,
‘তুই আমার একমাত্র স্বপ্ন রে।’

হাসনাতের একটা ছবি নিয়ে একনজর দেখে নেয়।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে বেলির।
_____
দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে যায় বেলির জীবন থেকে।হাবিবার শশুড়-শাশুড়ি মারা যায়।সবার জীবনে পরিবর্তন আসে।সবাই যার যার বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

হেনা যেমন সুন্দরী হয়ে উঠে,তেমনি বেলির মতো লম্বা চুল তার।দেখতে অনেক মায়াবি হয়।হেনা কলেজে ভর্তি হয়।কিন্তু ও হোস্টেলে ফ্রেন্ডদের সাথেই থাকবে এ নিয়ে মায়ের সাথে বাড়াবাড়ি শুরু করে কিন্তু বেলি রাজি না।বেলি হেনাকে বুঝায়,
‘শুনো?তোমাকে আমি চোখের আড়াল করতে পারবো না।আমি একা থাকতে পারব না।’
‘মাম্মাম তাহলে আমাকে বিয়ে দেয়ার পর থাকবে কিভাবে?’

বেলি তখন ভেবে বলে,
‘তখন আমি না হয় বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব।’
‘তাহলে এখন চলে যাও বৃদ্ধাশ্রমে প্রাক্টিস হোক।আমি হোস্টেলে ই থাকবো।’

বেলি আহত হয় মেয়ের কথায়।তবুও বেলি বলে,
‘আজকাল পরিস্থিতি খুব খারাপ।মেয়ে হয়ে জন্মেছো তার উপর বড় হয়েছ তোমাকে নিয়ে আমার কত চিন্তা থাকে জানো?কতদিকে কত বিপদ উৎ পেতে থাকে,আল্লাহকে সহায় হতে বলি সারাদিন।’

‘এসব অযতা চিন্তা।সবাই খারাপ না বুঝলে?’

‘অযতা না।তোমার অভিজ্ঞতা অনেক কম।এ বয়সে অনেকে কে আপন কে পর বুঝতে পারেনা।তাছাড়া অনেকে মুখোশ পড়া ব্যাক্তির সাথে পরিচিত হয়।এ বয়সে প্রায় অনেকে ভুল সীদ্ধান্ত নেয়।আমার কথা বুঝার চেষ্টা করো?তুমি মায়ের কাছেই সেইফ।দরকার হলে গাড়ি নিয়েই কলেজ যাও?’

হেনা তখন রেগে বলে,
‘কিছুই ভাল লাগেনা আমার।’

হেনা রাগ করে ছাদে গিয়ে বসে থাকে।জীবনে মা তাকে একটু স্বাধীনতায় দেয়নি।তার ভাল ই চায়না মা।তার ভাল চায়লে তাকে কখনো কষ্ট দিত না।

মেঘ গর্জন করে উঠে।সাথে বেলির মন ও কেপে উঠে।মুহুর্তে ঝরঝর করে বৃষ্টি চলে আসে।কান্নারত বেলি ছুটে যায় ছাদে।হেনা তবুও বসে আছে।ভিজে যাওয়ার পর ও নড়ছে না।বেলি গিয়ে হেনার হাত ধরে বলে,
‘চলো অসুখ করবে।’
‘হোক অসুখ।তুমি আমার ভাল ই চাওনা।’

বেলি জোর করে হেনাকে নিয়ে আসে।তারপর কাপড় বদলে নিতে বলে।
.
তবুও হেনার গায়ে জ্বর আসে।বেলি বিড়বিড় করে বলে,
‘ফুটা কলিজাটা ফুটা করার ধান্দা তোর হ্যা?’

বেলি কাথা গায়ে জড়িয়ে হেনার পাশে বসে থাকে আর কিসের ঘুম তার?

বেলি নিজে নিজেই কথা বলে,
‘জানিস তোর ভাই যখন আল্লাহর কাছে চলে গেছিল,তখন তোর মুখের দিকে তাকিয়ে সেদিন কলিজা ঠান্ডা করেছিলাম।আর তুই ভাবিস আমি তোকে ভাল বাসিনা?মায়েরা সত্যি কি সন্তানদের খারাপ চায়তে পারে?সন্তানরা কেন বুঝেনা?আমি যে তোর জন্য জীবন ও দিতে পারি রে।দুনিয়ার সব কষ্ট আমার হোক তবুও তুই কলিজা ভাল থাক।’
.
.
বেলি চেয়েছিল হেনাকে তার কলেজেই ভর্তি করতে কিন্তু ভাগ্যগুণে অন্যকলেজে গিয়ে পড়ে।কলেজটা বাসা থেকে একটু দূর।

কয়েকদিন বেলিসহ গিয়ে দিয়ে আসে।তখন হেনা বলে,
‘আমি এখন আর ছোট নেই।একায় ফ্রেন্ডদের সাথে যেতে পারবো।’

তখন থেকে হেনা একায় যায় কলেজে।বেলি অনেক বলেছে ড্রাইভার চাচার সাথে গাড়ি করে যেতে কিন্তু হেনা রাজি না।সকালে যায়,ক্লাস করে আসতে আসতে বিকেল হয়।
হেনা যাওয়ার পর ই বেলি কলেজে যায়।


আজ বেলি কলেজ থেকে ফিরে হেনা আসার জন্য অপেক্ষা করে।সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়।কিন্তু হেনা ফিরেনি এখনো।বেলি হাবিবাকে কল করে।হাবিবা হাসিবকে হেনার কলেজে পাঠায়।
হাসিব হেনার কলেজে গিয়ে জানতে পারে অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছিল।তাহলে হেনা কই গেলো?কলেজের ভিতরের কেউ জানেনা।হাসিব হেনার ফ্রেন্ডদের কাউকে চিনে ও না।শেষমেশ হাসিব চলে আসে।

এদিকে বেলি হেনার সব ফ্রেন্ডকে কল করে কিন্তু কেউ হেনার সন্ধান দেয়নি।

বেলি ওযু করে সেজদায় পড়ে যায়।আর কেদে কেদে বলে,
‘হে আল্লাহ! আমার এই একটা মেয়ে।তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বেচে আছি।আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও।যেখানে থাকুক নিরাপদে থাকুক।ফিরিয়ে দাও মেয়েটাকে।’

হাবিবার বুক কেপে কেপে উঠছে।হেনা বড় হয়েছে।এই বড় হওয়াটা আরো চিন্তার কারণ।

_________________

হোস্টেলে বান্ধবীর সীটে হেলান দিয়ে হেনা পুরানো একটা ডায়েরি অনবরত উল্টাচ্ছে আর প্রতিটা পৃষ্টা পড়ছে।বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আলমারিতে লুকায়িত ডায়েরিটা চোখে পড়েছিল।কৌতুহল চাপতে না পেরে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো।

হেনা ডায়েরির প্রতিটা পাতা পড়ে শেষ করে।তারপর মুখ চেপে চেপে কান্না করে।পাশে বান্ধবি নেহা ছিল।সে হেনাকে শান্তনা দেয়ার জন্য বলে,
‘এভাবে কাঁদিস না।যা হবার হয়েছে।’

হেনা কেদে কেদে বলে,
‘সরি মাম্মাম।আমি ই খারাপ।তুমি আমার অনেক ভালো মাম্মাম।আমি আসছি তোমার কাছে।আর কখনো আমি তোমায় কষ্ট দিবো না।যা বলবে তাই শুনবো মাম্মাম।’

চলবে…..

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

#তাহরীমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here