#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ১৮ ( স্পর্শ)
বেশ কিছুক্ষণ নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আইজা। এক পা দুই পা করে পিছিয়ে যেতেই মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। ক্ষুব্ধ আঁখি জোড়া সীমান্তর দিকেই বিদ্যমান।
-“আপনি ওদের ব্যবহার করে আমাকে কন্ট্রোল করতে চান!”
-“আমি দ্বিতীয়বার কথা রিপিট করা পছন্দ করি না। চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসুন। নাকি এবারও আমাকেই উঠিয়ে গাড়িতে বসাতে হবে!”
সীমান্তর সোজা কথা। আইজার সেসব উপেক্ষা করেই বলে বসলো,
-“কথা যেহেতু বলেছেন রিপিটও করতে হবে!”
ভ্রু কুচকে তাকালো সীমান্ত। বিরক্তির ভঙ্গিতে সে বলে উঠলো,
-“আমি আমার জবাব পেয়ে গেছি।”
কথাটা বলে আইজাকে কোন সুযোগ না দিয়ে আবারও কোলে তুলে নিলো সে।
হঠাৎ কাঁধে তীক্ষ্ণ ধারালো দাঁতের আক্রমণে চোখ মুখ কুঁচকে এলো সীমান্তর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি গিয়ে পড়লো আইজার ওপর। যদিও সেদিকে কোন হেলদোল নেই আইজার। সে তার কাজে ব্যস্ত। কাঁধের একাংশ রক্তাক্ত না করলে যেন ক্ষান্ত হবে না এই মানবী। তবুও আইজাকে নামালো না সীমান্ত। অনেকটা ছুঁড়ে মারলো গাড়ির সিটে। ওভাবেই সাথে সাথে চেপে ধরলো সিটের সাথে। আইজা হাল না ছেড়ে সীমান্তকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে সরানোর চেষ্টা করছে ক্রমাগত। একসময় ক্ষান্ত হয়ে নিঃশব্দে সীমান্তর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো সে। সীমান্ত একটা পুরোনো জঙধরা হ্যান্ডক্যাপ বের করে আইজার এক হাতে পড়িয়ে গাড়ির সাথে আটকে দিলো। আইজা এই মুহুর্তে না কোন বাঁধা দিচ্ছে আর না কোন আওয়াজ করছে। নিরব হয়েই সীমান্তকে দেখে যাচ্ছে সে। এতোক্ষণ ধস্তাধস্তি করতে থাকা নারীর হঠাৎ এই শান্ত পরিবর্তনে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো সীমান্ত। পরক্ষনেই আইজার কানের কাছে গিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“এর শাস্তিটা জমা রইলো!”
নিজের কাঁধের দিকে ইশারা করলো সীমান্ত। আইজা একবার সেদিকে চোখ রেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। সীমান্ত মিহি হেসে সরে এলো আইজার কাছ থেকে। ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসে পড়লো ও। বাইকের চাবি টা রিয়াদের কাছে রেখে এসেছে। গাড়ি স্টার্ট করতে যাবে তখনই আইজার পায়ের দিকে নজর গেলো সীমান্তর। জুতো ছাড়া এ পা জোড়া এতোক্ষণ জঙ্গলে দৌড় লাগিয়েছে!
সীমান্ত গাড়ি স্টার্ট না করেই গাড়িতে থাকা ফাস্টএইড বক্সটা আইজার কোলের ওপর রেখে দিলো নিঃশব্দে। আইজা সেটা দেখেও সম্পুর্ন বিষয় টা উপেক্ষা করে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। সীমান্ত কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলো। একটা ক্ষুব্ধ নিশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট করলো ও।
একটু পর পর ড্রাইভিং সীটে বসে থাকা লোকের আড়চোখে তাকানো টের পেয়ে গা জ্বলে যাচ্ছে আইজার। যদিও মুখে কিছু বলছে না। ঐ বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবলেই মনে হয় কোন জেলখানায় যাচ্ছে ও। ওর সবচেয়ে কাছের দু’জন মানুষ সেখানে বন্দী। না চাইলেও পুনরায় সেখানে যেতে হবে ওকে! হাজারবার ছটফট করলেও এই মুহুর্তে কোন লাভ নেই।
সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ গুলো বন্ধ করলো আইজা। মায়ের এক্সিডেন্ট টা যে পরিকল্পিত সে-নিয়ে কোন সন্দেহ নেই ওর। আইজার চাচা বেশ কয়েকদিন যাবৎ হুমকি দিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো আইজার মাকে কোন এক বিষয়ে। আইজাকে কিছুই জানানো হয়নি। সেদিন সিমি এ ব্যাপারে জানাতেই আইজাকে বাড়িতে আসার জন্য জোর দিচ্ছিলো। কিন্তু সে রাতই..!
আইজার কাছে তো কোন প্রমানও নেই!আইজা ওর বাবার কাছ থেকেও কোন খবর পায়নি। এতোদিন জমে থাকা চাপা রাগ টা এখন ভয়ে পরিণত হয়েছে। আইজা ওর বাবার সুরক্ষা নিয়ে নিশ্চিত না। ঐ লোকটা নিশ্চয়ই কিছু জানতো ওর বাবার ব্যপারে! বুকের ওপর যেন এক ভারী পাথর জমে আছে। আর কিচ্ছু ভাবতে পারছে না ও। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। আইজার কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় মুহূর্তগুলোর মাঝে একটি হলো নিজেকে অসহায়তার দাড়প্রান্তে খুঁজে পাওয়া। বিদঘুটে অনুভূতির ভীড়ে আঁটকে আছে ও। না মা আছে আর না বাবা। কী করবে ও!
গাড়িটা হুট করে থেমে যাওয়ায় চোখ খুললো আইজা। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এখনো ঐ বাড়িতে পৌঁছায়নি। তখনই গালের একপাশে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করায় মুহূর্তেই সে হাত সরিয়ে দিলো আইজা।
নিজের গাল বেয়ে ঝড়তে থাকা অশ্রুকণার অস্তিত্ব টের পেলো ও। কিন্তু সীমান্তর সেদিকে হস্তক্ষেপ সহ্য হলো না আইজার। এই মানুষ টা থেকে যত দূরে যেতে পারে ততই যেন স্বস্তি। ওর পরিবারের এ অবস্থায় সীমান্ত জড়িত আছে ভাবতেই গা গুলিয়ে আসছে ওর। কতবার এই লোকটাকে স্পর্শ করেছে আইজা। সবকিছুই এখন ওর কাছে এক ভয়ংকর স্মৃতি। যদিও আইজা জানে, এখন রিয়েক্ট করে কোন সুবিধা হবে না। কয়েকদিন শান্ত থাকতে হবে। আরফান আর সিমিকে এ জায়গা থেকে অনেক দূরে পাঠাতে হবে যেখানে নাজিম শিকদার আর সীমান্তর কেউই নাগাল না পায়!
-“যতই প্ল্যানিং করুন না কেন মনে রাখবেন প্রতিদ্বন্দি হিসেবে আমি মোটেও দূর্বল নই। অন্তত আপনার মতো না। চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছু করার সামর্থ্য নেই আপনার আইজা! আর একটা কথা, আমি কখনো কোন মানুষ খুন করিনি! তাই সন্দেহের কাটা আমার দিকে ঘুরালে সময়টা আপনারই নষ্ট হবে!”
সীমান্তর কটাক্ষপূর্ণ কথা কানে যেতেই আইজা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলো,
-“আমি জানি আপনি কতটা সামর্থ্যবান মানুষ! নিজের বাবার ইশারায় অন্ধের মতো নাচার সামর্থ্য বেশ আছে আপনার! এ কারণেই আমার সঙ্গ এক মুহূর্তের জন্য ছাড়েননি!”
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সীমান্ত। আইজার চোখের নিচে লেগে থাকা বিষাদের এক বিন্দু প্রমান নিজের হাত দিয়ে মুছে বললো,
-“আপনি নিজেও তো সেটাই করছেন। আপনার পাপা আপনাকে যা বলেছে তাই ধরে বসে আছেন।”
-“পাপা আমাকে কিছুই করতে বলেনি। যা করার আমি স্বেচ্ছায় করতে চেয়েছি। আজ আমাদের যে অবস্থা তার পেছনে জড়িত মানুষটাকে পথে না নামালে তো শান্তিতে ঘুমোতে পারবো না আমি!”
-“আরেকজনকে পথে নামানোর কথা ভাবার আগে নিজের ওপর নজর রাখুন। আপনি কোন পথে হাঁটছেন জানেন তো!”
সীমান্তর প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না আইজা। আগের মতো চোখ বন্ধ করে হ্যালান দিয়ে বসলো ও। এখন পর্যন্ত না ভেবেই কোন রকম পরিকল্পনা ছাড়া এগিয়েছে আইজা। এখন সেটা আর করবে না ও!
***
-“আমি বুঝতে পারছি, পাশে সুন্দরী বউ থাকলে নিজেকে সামলানো মুশকিল হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে সবার সামনে কোলে করে নিয়ে যাবেন! এতো ভালোবাসেন আমাকে মাই ডিয়ার হাসবেন্ড!”
আইজার মিহি ন্যাকা কন্ঠে ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো সীমান্তর। এতোক্ষণ তো সীমান্তকে সহ্য করতে পারছিলো না। আর এখন আগের মতো সেই বিরক্তিকর ভঙ্গিতে কথা বলছে! আইজার পায়ের দিকটা বিবেচনা করে ওকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলো সীমান্ত। কিন্তু এখন আর সে ইচ্ছে নেই। আইজার এরকম ব্যবহার বিয়ের পর থেকেই অসহ্য লাগতো সীমান্তর। ও জানতো পুরোটাই আইজার অভিনয়! এখন এই কন্ঠ শুনে ইচ্ছে করছে আছাড় মারতে!
সাথে সাথেই আইজাকে নিচে নামিয়ে দিলো সে। ছাড় পেয়েই ধীর পায়ে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলো আইজা। ও জানতো সোজা ভাষায় বললে সীমান্ত কখনোই ওকে নিচে নামাতো না। সীমান্তর স্পর্শ এখন আর নিজের শরীরে চায় না আইজা!
ব্যাথাটা সেরকম অনুভব হচ্ছিলো না এতোক্ষণ। পায়ের নিচ থেকে ছোপ ছোপ রক্তের দাগগুলো গাড়িতেই দেখেছিলো। কিন্তু তখন পাত্তা দেয়নি। কেন যেন এই যন্ত্রণা বেশ তুচ্ছ মনে হচ্ছিলো।
দরজায় কলিং বেল বাজাতে না বাজাতেই ভেতর থেকে কে যেন ঝড়ের গতিতে দরজা খুলে জড়িয়ে ধরলো আইজাকে। ফিহাকে এত উৎসাহের সাথে আইজাকে চেপে ধরার কান্ডে কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আইজা। নিজেকে ফিহার থেকে ছাড়িয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আপনাকে এখানে দেখবো ভাবিনি!”
-“সারপ্রাইজ!! আপনি আমাকে দেখে খুশি হননি কাজিন ভাবি?”
ফিহার কন্ঠে কাজিন ভাবী শুনতেই রাগের মাত্রা তড়তড় করে বেড়ে গেলো আইজার।
-“না!”
আইজার সোজাসাপটা জবাব। যদিও ফিহার মুখে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। সে হাসি মুখেই আইজাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো যেন কতদিনের পুরোনো বন্ধুকে পেয়েছে আজ। অথচ শেষবার যখন ফিহার সাথে কথা হয়েছিলো সে স্মৃতি একদমই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলো না। আর সাহিলের চাকরি যাওয়ার পর তো ফিহার এতটা হাসিমুখে আইজার সাথে কথা বলা বিন্দুমাত্র সুবিধার মনে হচ্ছে না ওর। কয়েক দিন আগে জানতে পেরেছে আইজা। সাহিলকে সেদিনই চাকরি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে! সীমান্ত বাড়িতে এসে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আইজার দিকে তাকালো মাত্র। কিন্তু কিছু বললো না। হনহন করে রুমের দিকে চলে গেলো।
রাত হয়ে আসছে। সিমি সেই কখন থেকে আইজাকে পাত্তা না দিয়ে ফিহার সাথে চিপকে আছে। আইজা খেয়াল করেছে বাড়িতে সবাই ফিহা বলতে পাগল। চটপটে স্বভাবের মেয়ে। হয়তো সেদিন সাহিলের পক্ষ নিয়ে কথাগুলো না বললে আইজার মনে ফিহাকে নিয়ে এতটা তিক্ততা থাকতো না।
সারা বাড়ি ঘুরে কোথাও আরফানকে পেলো না আইজা। ছেলেটা যে এখানে থাকতে চাইবে না সেটা খুব ভালো করেই জানে আইজা। সীমান্ত আবারও সেই স্টাডিরুমে পড়ে আছে। আইজা এ সুযোগে বেডরুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। ফোন টা হাতে নিতেই থেমে গেলো ও। এ বাড়িতে কোথাও শান্তিতে থাকতে পারবে না। সীমান্তর চশমা গুলোর কথা মনে পড়তেই দরজা খুলে বেড়িয়ে পড়লো আইজা। সীমান্ত নেই। সিমি ফিহার সাথে গল্প করছে আর কার্টুন দেখছে। সিমিকে শান্ত দেখে মেইন গেটের দিকে এগিয়ে গেলো ও। হয়তো আরফান আশেপাশেই আছে। ইদানিং কোন কিছু হলেই কেন যেন খারাপ চিন্তাটাই আগে এসে ভর করে মস্তিষ্কে। আরফানকে চোখের সামনে না দেখা পর্যন্ত শান্তি পাবে না আইজা।
দারোয়ান আইজাকে দেখতেই উঠে দাঁড়ালো। কাচুমাচু গলায় বলে উঠলো,
-“সীমান্ত স্যার আপনারে বাইরে যাইতে দিতে নিষেধ করছে!”
কথাটা শুনতেই জেদ চেপে ধরলো আইজাকে। এখন কী এ বাড়িতে আঁটকে রাখা হবে ওকে!
চলবে…
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/512029117185532/