বৃহন্নলার ডিভোর্স পর্ব-দশ মাহাবুবা বিথী

#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব-দশ
মাহাবুবা বিথী

মানুষের জীবনের পথ অনেক দীর্ঘ হয়। এই দীর্ঘপথে কত খানাখন্দ চড়াই উৎড়াই থাকে। চলার পথে কেউ কেউ হোঁচট খেয়ে তার পদস্খলন ঘটে। কিন্তু পদস্খলনের কথা আড়ালে রেখে অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানোই ওদের জীবনের মুল লক্ষ্য হয়। মানুষকে কথার ছুরিতে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। যাকে আঘাত করে সে হয়ত অনেক আহত হয়। তবে অলক্ষে তার জীবন অনেক পরিশুদ্ধ হয়। রুমি আজকাল ঐ সব মানুষের কটুকথা ignore করতে শিখে গেছে।

রাশেদের শ্বশুরবাড়ি থেকে আকদ এর পর সবাই বাড়ি ফিরে আসলো। যদিও রাশেদের শ্বশুর ওকে থাকতে বলেছিলো কিন্তু রাশেদ রাজি হয়নি। ওর ইচ্ছা অনুষ্ঠান করেই জয়াকে নিজের বাড়িতে তুলে নিবে এবং সেদিনেই ওর বাসর হবে।
অবশেষে রাশেদ মা বোনদের জন্য ওদের পছন্দ মাফিক শপিং করে কনের জন্য শাড়ি গয়না কিনে বেশ ঘটা করে বিয়েটা করে ফেললো। রুম্মান রুমিরও ভাইয়ের বিয়েতে অনেক আনন্দ হলো।
অনেক অতিথির মধ্যে রায়হানদের পরিবারও বিয়েতে এসেছিলো। রায়হান রুমির দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারেনি। আড়ালে গিয়ে রুমিকে বললো,
—-আপনাকে খুব মিষ্টি লাগছে। চোখ সরানো যাচ্ছে না।
—-সমস্যা নেই, চোখ সরাতে হবে না,আমিই সরে যাচ্ছি।
—–আমি কি তাই বলেছি নাকি?
—-আমাকে ওদিকটায় এমনিও যেতে হবে। এখনি ভাইয়া ভাবির রুসমত হবে।
রায়হানের সাথে রুমির কথা বলার সময় রায়হানের
মা ও রুমিকে দেখে নিলো।
রুমিকে আসলেই খুব সুন্দর লাগছিলো।

বিয়ের আসরে অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছিলো। এখানে রুমির দূরসম্পর্কের এক ফুপুও এসেছিলো। উনি একটা এনজিওতে জব করেন। রুমির ব্যাপারটা রুমির মার কাছে জেনে ওনার অফিসে রুমিকে একটা সিভি জমা দিতে বলেন।
যাক খুব সুন্দরভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হলো।
ওদের বিয়ের পর রুমির মা রুমি আর রুম্মানকে বললো,
—–তোমাদের দু,বোনকে একটা কথা বলি আমার অবর্তমানে তোমাদের জীবনে সবচেয়ে আপন হলো তোমাদের ভাই আর ভাবি। ওরা হয়ত তোমাদের সাথে থাকবে না তারপরও একটা সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। বড় ভাবিকে মায়ের মতো সম্মান দিবে।

মায়ের কথা শুনে রুম্মান বললো,
—-তুমি আমাকে আর আপুকে ডেকে তোমার ছেলের পক্ষে ঝোল টেনে কথা বললে। তেমনি আমাদের সম্পর্কেও ভাইয়া আর ভাবিকে তোমার কিছু বলা দরকার। কারণ অনেক সময় ভাইরা বিয়ের পর দুলাভাইদের মতো আচরণ করে। নিজের বোনকে নিজের বোন মনে হয় না। তোমার ছেলে আর ছেলের বউ যেন সেটা আমাদের সাথে না করে।
—তোকে আমায় জ্ঞান দিতে হবে না।তোদের মতো এতো বিদ্যাধারী না হতে পারি কিন্তু সংসারে চলার মতো বুদ্ধি আমার আছে। আমি রাশেদকেও যা বলার বলব।

খুব সকালে উঠে রুমি সবসময় সবার জন্য নাস্তা বানায়। প্রেসারের কারনে ওর মা সকালে উঠতে পারে না। সেদিনও ভোরে নাস্তা বানানোর সময় জয়াও কিচেনে চলে আসলো। রুমি জয়াকে বললো,
—-তুমি এতো সকালে উঠেছো কেন ভাবি? নাস্তা রেডী হলে আমি তোমাদের ডাকবো। তুমি ভাইয়াকে সময় দাও।
—–দু,দিনপর কানাডায় চলে গেলে সারাক্ষণ তোমার ভাইয়াকে সময় দিবো। তখন তোমাদেরকে তো কাছে পাবো না। তাই তোমার সাথে গল্প করতে কিচেনে চলে আসলাম। গল্পও করা যাবে আর কথার ফাঁকে তোমাকে সাহায্য করতে পারবো।
রুমি চা বানিয়ে জয়ার হাতে দিয়ে বলে,
——ভাবি, চা টা মাকে দিয়ে এসো।
রাশেদের মা জয়ার হাতে চা পেয়ে খুবখুশী হলেন।
জয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—-চা তুমি বানিয়েছ?
—–না মা,রুমি বানিয়েছে। তবে আমার চা টাও খুব ভাল হয়।
—–বস,তোমার সাথে কথা বলি
—–মা,রুমিকে একটু কাজে সাহায্য করে আপনার কাছে আসছি।
ননদ ভাবি মিলে সকালের নাস্তা রেডী করলো। তারপর রুম্মান রাশেদ আর ওর মা সবাই মিলে নাস্তার পর্ব শেষ করলো।
রাশেদের মা জয়ার আচরণে মুগ্ধ হলেন। ভাবলেন ছেলে আমার যোগ্য মেয়েকেই আমার ঘরের বউ করে এনেছে। রুমির জীবনে এমন ঘটনার পর কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। আল্লাহর কাছে দোয়া করি রাশেদের বিবাহিত জীবন যেন খুব সুখের হয়।
রুমির মা রাশেদ বড় সন্তান হিসেবে ওকে আগেই সব বলেছেন। বাবার অবর্তমানে ওই তো ওর বোনদের সবচেয়ে আপনজন।
কানাডায় চলে যাবার দুদিন আগে রাতের বেলা রুমি বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলো। রাশেদ এসে রুমির মাথায় হাত রেখে বললো,
—–তোর এতো বড় বিপদে আমি পাশে দাঁড়াতে পারিনি। তবে আমার বিশ্বাস তুই ঠিক সামলে উঠতে পারবি। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো খুব শক্ত হয়। কারণ ওরা লড়াই করে বেঁচে থাকে। পরিস্থিতি পরিবেশ অনুযায়ী তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সামর্থ না থাকার কারনে অনেক ইচ্ছা অকালেই ঝরে যায়। জীবনের কঠিন পথগুলিতে চলার অভিজ্ঞতা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো শুধু উপলব্ধি করে।
—-ভাইয়া তুমি আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করো না। এখানে আমরা সবাই আছি। বিদেশ বিভুঁয়ে তুমি আর ভাবি একা। আমাদের খুব চিন্তা হয়। রাত অনেক হলো শুয়ে পড়ো।
দু,দিন পর রাশেদ আর ওর জয়া কানাডায় চলে যায়। ভরভরান্ত বাড়িটা হঠাৎ খালি হয়ে যায়। রুমির মারও মনটা বিষাদে ভরে থাকে। কারণ এছাড়া আর কোন অপশন ও নেই। রাশেদ বিদেশে থাকে বলে টাকা পাঠাতে পারে। ও বলেছে সামনে টাকার পরিমান আরও বাড়িয়ে দিবে। জিনিস পত্রের যে দাম বেড়েছে। কুলানো যাচ্ছে না।

রুমির ফোনটা বেজে উঠলো। ব্যারিষ্টার রাবেয়া ফোন দিয়েছে।
—-হ্যালো রুমি দুদিন পর কেসের ডেট পড়েছে। ওইদিন সব ফয়সালা হবে। ওরা আরও পেছাতে চাচ্ছিলো। আমি রাজি হইনি। আবীরের বাবা মারা গিয়েছে। ডেভেলপারের বিজনেসে কি একটা ঝামেলা হওয়ায় সাব্বির জেলে রয়েছে। ওসব শুনে আমাদের কি লাভ। আমরা আমাদের পাওনাটুকু চাই। ওই দিন দেনমোহরের টাকাও দিবে আর একটা পিকআপ নিয়ে মালপত্র আনার জন্য ওদের বাসায় যেতে হবে।
—-আপু আমি কি যাবো?
—-হ্যাঁ তোমাকেই যেতে হবে। আমিও যাব। তবে দুটো পুলিশ সাথে নিবো।
ফোনটা রেখে রুমি ভাবছে, পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। তারপর মানুষ একই পাপ বারবার করে যায়। আর যুগ যুগ ধরে পাপের শাস্তি ভোগ করে।

অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিনে রুমি যথাসময়ে ব্যারিষ্টার রাবেয়ার কাছে চলে যায়। তারপর মামলার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ওরা একটা পিকআপ ভাড়া করে। ব্যারিষ্টার রাবেয়া দুটো পুলিশ আগেই রিকুইজিশন দিয়ে রাখে। তারাও সঠিক সময়ে চলে আসে। তারপর সবাই মিলে আবীরদের বাসায় চলে যায়। ওর মা শুধু বাসায় ছিলো। দরজা খুলে দিয়ে ব্যারিষ্টার রাবেয়া হাতে দেনমোহরের একলক্ষ টাকা তুলে দেয়। সে সময় আবীরদের উকিল ও উপস্থিত ছিলো। আবীরের মাকে দেখে রুমির খুব খারাপ লাগে। দোর্দন্ড প্রতাপশালী মহিলাকে আজ বড় অসহায় মনে হলো।
রুমি ওর আলমারীর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। আলমারীর দরজাটা ভেঙ্গে গেছে। কারণ চাবি তো রুমির কাছে ছিলো। ওরা নিশ্চয় দরজা খোলার চেষ্টা করেছে। খুলতে না পেরে ভেঙ্গে ফেলেছে। রুমি ব্যারিষ্টার রাবেয়ার পেমেন্ট দিতে চায়। তখন উনি বলেন
—–রুমি আমি তোমার কাছে কোন পেমেন্ট নিতে পারবো না। তোমার সাথে সহযোদ্ধা হয়ে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছি এটাই আমার জীবনের অনেক বড় সৌভাগ্য। আর তুমি কোন প্রাইভেট ভার্সিটিতে ল,তে ভর্তি হয়ে যাও। পড়াশোনা করো দেহ মন ভাল থাকবে। আমি আসি।পরে আবার দেখা হবে।
রুমির কাছে বিদায় নিয়ে রাবেয়া বাড়ির পথে রওয়ানা হয়।
রুমি ভাবে এদের মতো পরোপকারি মানুষগুলো পৃথিবীতে বাস করে। আবার আবীরের মায়ের মতো জল্লাদও বাস করে। এটাই দুনিয়া। শয়তান আর ফেরেস্তার পাশাপাশি নিবাস।

মালপত্র নিয়ে পুলিশ সহ রুমি ওদের বাসায় চলে আসে। সন্ধা হয়ে যায়। ঘরে মালগুলি তোলার পর কিছু বখশিস দিয়ে পিকআপের ড্রাইভার আর পুলিশকে বিদায় করে দেয়। মাগরিবের আযান শোনা যায়। রুমির মা রুমিকে বলে,
—-তোর গয়নাগাটি টাকা সব ঠিক মতো বুঝে নিয়েছিস।
—-নিয়েছি মা।
—–জিনিসপত্রগুলো ফেরত পেয়ে এতো খারাপ লাগার মধ্যেও কিছুটা ভাল লাগছে।রুমি মা তুই ওগুলো যত্ন করে রেখে দে।
—-মা আমি গয়নাগুলো রুম্মানকে দিয়ে দেই।
রুম্মান শুনে বলে,
—-ওগুলো তোমার। তোমারি থাক।ভাইয়া ভাবির জন্য গয়না কিনতে পারলে আমার জন্য পারবে।আমিই বা কেন তোমার গয়না নিতে যাবো?
রুমির মা বলে,
—-রুম্মান সঠিক কথা বলেছে। তোরা নামাজ পড়ে নে আমি চা বানিয়ে আনছি।
সারাদিন অনেক ঝক্কি ঝামেলা গিয়েছে। তাড়াতাড়ি ডিনার শেষ করে রুমি শুয়ে পড়ে। হঠাৎ মোবাইলের টুংটাং শব্দে রুমির ঘুম ভেঙ্গে যায়। ওয়াশরুম ঘেকে এসে মোবাইল ওপেন করে দেখে রায়হান মেসেজ পাঠিয়েছে।
—-ভাইয়ের বিয়ে খেতে গিয়ে ডুমুরের ফুল হলেন নাকি?
—-তা আর হতে দিলেন কই। ঠিক তো খুঁজে বার করলেন।
—-আপনার মামলার ফয়সালা হয়েছে
—হুম
—–আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই।
—–আমি খুব ব্যস্ত। আজরাইল ও এসে যদি দেখা করতে চায় তাহলে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
—-আপনি কি জানেন? আপনি একজন রসকষহীন মানুষ।
—গাছে যখন একটা ফল পাকে সঠিক সময়ে না খেলে ফলটা শুকিয়ে যায়। ফলটা রসহীন হয়ে পড়ে। প্রেম প্রীতি ভালবাসা সঠিক সময়ে গ্রহন করতে হয়।তানা হলে সব অতলান্তিক গহ্বরে হারিয়ে যায়। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার অবস্থাটা অনেকটা সেরকম। খুব ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।

“আমার শহরটা আজ বড় নির্জন
একাকীত্বের মাঝে আমার বাস
হৃদয়ের জমিনটাতে হয়নি ভালবাসার চাষ
একদিন তোমার কাছে আমি ছিলাম মুল্যহীন
আজ তুমি আমার কাছে বড্ড অর্থহীন”।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here