জীবনে তুমি সেরা সত্যি পর্ব -১০

0
1972

#জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি

পর্ব ১০

কাল সকালে ফ্লাইট নেহালের। বাসার পরিবেশ তাই থমথমে । রাতে ডিনারের পর বেশ খানিকটা সময় নেহাল আম্মু – আব্বুর সাথে তাদের রুমে কাটিয়ে এলো। নিজেদের রুমে ঢুকে দেখে দিশান মাথায় এত বড় করে ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিয়ে বই সামনে নিয়ে বসা। একদিন পর পরীক্ষা আছে। নেহাল টুকটাক গোছগাছ করতে করতে খেয়াল করলো দিশান বই সামনে নিয়ে বসে থাকলেও পড়ছে না। এতক্ষণ ধরে বইয়ের এই একটা পাতা ই খোলা। পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
– আমি তো শুয়ে পড়বো এখন,তুমি কি এই পড়ার অভিনয় চালিয়ে যাবে নাকি শুয়ে পড়বে? ঔষুধ খেয়েছো তুমি?
– জানি না, বলবো না।
ঘোমটার ভিতর থেকে উত্তর দিলো দিশান।
– বাব্বা!এমন ঝাঁঝাল উত্তর। কি হলো বউয়ের?দেখি।
বলে চেয়ার ঘুরিয়ে ঘোমটা তুলতে তুলতে বললো,
– যেভাবে ঘোমটা তুলছি,পুরা বাসরঘর টাইপ ফিল হচ্ছে। আরে, এই মেয়ে তো কেঁদে নাক মুখ লাল করে ফেলেছে। সাদা খরগোশের বাচ্চা তো লাল টমেটো হয়ে আছে।
দিশান হাত সরিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বললো,
– আপনার কালকের যাওয়া কি কোনভাবেই আটকানো যায় না?
– না রে সোনা, কোনভাবে যে আটকানো যায় না।
– ধরেন,আমি খুব অসুস্থ হয়ে গেলাম তবুও আপনি জানাতে পারবেন না যে আমার ওয়াইফ অসুস্থ, আমি আসতে পারছি না।
চোখ নাচিয়ে নেহাল বললো,
– তা কি অসুস্থ বলবো? স্যার,আমার ওয়াইফ তো প্রেগন্যান্ট,তার লেবার পেইন উঠেছে, স্যার কিভাবে আসবো আমি? এটা বললে মানতে পারে।
দিশান আগপিছ না ভেবে মানতে পারে শুনে বলে উঠলো,
– তবে তাই বলে দিন প্লিজ। থেকে যান আরো কয়টাদিন।
– তারপর তো অফিস থেকে আমাকে অ্যাওয়ার্ড দেবে যে বিয়ের দেড় মাসের মাথায়ই একেবারে বাচ্চা ডেলিভারি!! এই ছেলে তো আগুনের গোলা। প্রোমোশনও দিয়ে দিতে পারে, কি বলো!!
দিশান এবার বুঝতে পারলো।
– আপনি এত খারাপ!
হো হো করে উঠলো নেহাল। গাল টেনে দিয়ে বললো
– পাগলীটা!বাস্তবতা মেনে নিতেই হয়, সুতরাং যত সহজে গ্রহণ করবে,তত মনের ভার কমবে। তাই ঘোমটা টেনে কান্না নয়,এসো শুয়ে পড়ি,কাল থেকে তো একাই ঘুমাবে আর কাঁদবে, আজ বরং গল্প করতে করতে ঘুমাই চলো । আজ কাঁদলে কালকের কষ্ট তো আর কমবে না,তাই আজকের রাতটা সুন্দর করে কাটাই যেন কাল তা মনে করে একটু হলেও হাসি ফোটে মুখে।
– আমার একটুও হাসি আসবে না কাল,কষ্ট আরো বাড়বে। আমি থাকবো না আজ আপনার সাথে,একদম না।
– ভালোভাবে না আসলে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু৷ এমন করলে কি করে যাবো বোকা। আমার কষ্টের কথাটা তো একটু ভাবো। তোমার তো শুধু আমি যাচ্ছি,আর আমি সবাইকে রেখে একা যাচ্ছি। কাল এই সময় ফ্লাইটে থাকবো আমি, তার পরদিন যখন আমার ওখানকার বাড়িটাতে ঢুকবো, আমার কেমন ফাঁকা লাগবে বলো। আমার মায়ের হাসি মুখ,নায়রার দুষ্টামি, তোমার আহ্লাদী সব যে আমাকে একেবারে ভেঙেচুরে দেবে সেটা বুঝো? আমি যখন ঐদিন রাতে ঘুমের মাঝে হাত বাড়িয়ে এই বিল্লিটাকে পাবো না আমার কি কষ্ট হবে না? তখন ভিডিওকলে যদি তার কান্না মুখটাই দেখি আমি কি করে ঐখানে একা টিকবো বলো তো?
এবার পাশে গিয়ে শুয়ে অভিমানী স্বরে বললো,
– আপনি আমাকে ফোন দেন নাকি? আমি যে কথা,শাবানাও একই,ভদ্রতা করে সামনে থাকলে কেমন আছি জিজ্ঞেস করেন আর কি!!
হাসতেই থাকলো নেহাল,
– এবারো তাই করবো মনে হচ্ছে তোমার? কথা দিচ্ছি ছয় ঘন্টা টাইমজোন পার্থক্যে থেকেও তোমার সাথে লেগে থাকবো সারাটাদিন৷ এবার আমরা চুটিয়ে প্রেম করবো দিশান৷ প্রেমের ব্যাপারে আমরা দুই আনাড়ি মিলে খুব ভালোবাসাময় সময় কাটাবো। এই সময়টা প্রেম করে সামনের বার এসে না হয় স্বামী হবো তোমার, এই কদিন তোমার কিটক্যাট হয়েই থাকবো।
– আপনি জানেন কিভাবে আমি আপনার নাম কিটক্যাট দিয়ে সেইভ করছি?
– এক সাধুবাবা এসে বলে গেছে” সাবধান,তোর নাম কিন্তু কিটক্যাট রাখছে তোর বউ,তোর মাথা কিন্তু কিটক্যাটের মতোই চাবায়া খেয়ে ফেলবে এই মেয়ে। ”
নেহালের কথার ঢঙে দিশান হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো। দিশানের হাসিমুখটা দেখে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নেহাল। এই চঞ্চল হাসিমুখটা আবার কবে দেখতে পাবে। মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। শাহ আব্দুল করিমের একটা গান নেহাল কলেজ জীবনে প্রায়ই গীটারে তুলে গাইতো,
“বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে,
দেওয়ানা বানাইছে,
কী যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে।”
এই গানটার অর্থ আজ বুঝতে পারছে। মেয়েটা তার মায়া দিয়েই ওকে দিওয়ানা বানিয়েছে, প্রেম পিরিতের কি অনুভূতি শিখিয়েছে। নেহালের ইচ্ছে করছে খুব মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু যাবার আগের দিন অনভিপ্রেত কিছু হলে মেয়েটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে,প্রথমবারের মতো এই নতুন অভিজ্ঞতা মেয়েটা নেহালকে পাশে ছাড়া সামলাতে পারবে না। তার উপর দিশানের একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপারগুলো নেহালের সম্পূর্ণ অজানা৷ কোনভাবে কনসিভ করে গেলে সামনে এইচএসসি পরীক্ষা, অনেক বিপদ হয়ে যাবে। নিজেকে তাই কড়াভাবে শাসন করলো নেহাল। তাড়াতাড়ি গুডনাইট বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো নেহাল।
দিশান পারছে না ঘুমাতে। তার পাগল পাগল লাগছে। এই মানুষটা কেন তার সাথে প্রতিদিন থাকবে না? কী ভালো লাগে নেহাল তার পাশে থাকলে,কী যত্ন করে লোকটা তার৷ আরেকটা খুব অদ্ভুত ইচ্ছে খুব সুড়সুড় করে তার মনে। তার নেহালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে যে কী মন চায়! কিন্তু সে কী বেহায়া নাকি যে এরকম করে কোন ছেলে মানুষকে জড়িয়ে ধরতে মন চাইবে? নিজেকে খুব খারাপ মেয়ে মনে হয় দিশানের। ঐসব সিনেমাতে দেখা যায় যে জড়িয়ে ধরতে,কই, বাস্তবে তো কাউকে এমনটা করতে দেখেনি দিশান, তবে তারই কেন ইচ্ছে করে? নেহালের জন্যই তার এই বেহায়াপনার কারণ খুঁজে পায়না সে।
ভোরে নেহালের অ্যালার্মেই দিশানও ধড়মড় করে উঠে বসে। যেটুকু সময় নেহাল আর আছে,কাছ ছাড়া হবে না সে। একসাথে নামাজ পড়ে রুম থেকে বের হয় তারা। ডাইনিং এ বসে দৃশ্যটা দেখে মনটা ভরে উঠলো নেহালের আম্মুর। এইবার দিশানের প্রতি নেহালের দায়িত্বের যে রূপ দেখেছেন উনি,তাতে এটা বুঝে গেছে যে নেহালের মনে দিশান স্ত্রী হয়ে উঠেছে।
হালকা কিছু খেয়ে নিয়েই তৈরী হয়ে গেলো নেহাল। পাশে বসে আম্মুর মাথাটা তার বুকে নিয়ে অনেকক্ষণ বুঝালো,আব্বু,নায়রা,দিশানের মা-বাবা সবার কাছ থেকেই বিদায় নিলো। রুমে গিয়ে লাগেজটা বের করে আনার সময় দিশান নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। নেহালকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। নেহাল লাগেজ ছেড়ে দিশানকে হাতে ধরে তার সামনে নিয়ে এলো। কান্নার রোলে দিশান বলতে থাকলো,
– আপনি কেন এলেন এই অল্প দিনের জন্য, আপনাকে কে বলেছে বিদেশে পোস্টিং নিতে,দেশে থাকলে কি হয় আপনার? আপনি সব ছেড়ে দিয়ে চলে আসবেন,আমি কিচ্ছু জানি না, আপনি এবারই এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে আগেরমতো দেশে থাকবেন,আমি আর একবারও আপনাকে যেতে দিবো না। কক্ষনো না, ভুলেও না। আপনি খুব খারাপ ভাবছেন আমি এভাবে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছি বলে, কিন্তু বিশ্বাস করুন,আমি কেন জানি এত চেষ্টার পরও নিজেকে আটকাতে পারিনি, আমার মনে হচ্ছিলো একবার আপনাকে জড়িয়ে না ধরলে আমি পাগল হয়ে যাবো। ছিঃ ছিঃ, আপনি কি ভাবলেন আমাকে….
নেহাল দিশানকে আর বলতে দিলো না। মুখটা দুই হাতে তুলে ধরে ঠোঁট ডুবালো দিশানের ভেজা ঠোঁটে। দিশান নেহালের শার্ট খামচে ধরে সরতে চাইলেও নেহাল দিলো না। নরম হয়ে গেলো দিশান৷ খানিক পরে নেহাল ছেড়ে দিতেই লজ্জায় আবেশে নেহালের বুকে মিশে রইলো।
– আমাকে এখন তাহলে কতটা খারাপ ভাবছো শুনি?
দিশান মুখ ডুবিয়েই রইলো,কোন উত্তর করলো না।
– আমাকে তুমি ধরবে না তো কে ধরবে শুনি। অন্য কোন মেয়ে এসে জড়িয়ে ধরতে দিবে?
দিশান মুখ তুলে কটমট করে তাকালো।
– এটাই প্রথমদিন এসে তোমাকে বলা অধিকারবোধ দিশান৷ আমি তুমি একে অপরকে জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া এসবই আমাদের একে অন্যকে লিগ্যালি দেয়া অধিকার। এসব তো কিছুই না,আরো কি করতে পারি আমরা তা তোমাকে সামনেরবার এসে বুঝাবো,তার জন্য অপেক্ষা করো শুধু। আর অপেক্ষা করো আমার কাছে যাবার৷ সামনেরবার আসতে আসতে তোমার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। তখন তোমার স্পাউস ভিসার প্রসেসিং আর স্কলারশিপের সব কাজ করে যাবো। পেপার্স রেডি হলেই আমার কাছে উড়ে চলে আসবে তুমি। তারপর থেকে আর একদিনও আলাদা থাকতে হবে না আমাদের। দিনটার জন্য অপেক্ষা করো দিশান।আমি তো তোমারই আছি,শুধু দূরে আছি। কয়টাদিন শুধু বিরহে কাটুক,ভালোবাসাটাও মজবুত হোক আরো। রঙিন দিনগুলো কত ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবো দেখো।
দিশান কাঁদতেই থাকে। নেহাল নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দিশানের কপালে একটা চুমু খেয়ে লাগেজ হাতে বেরিয়ে পড়ে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here