যাত্রাশেষে (পর্বঃ১-৩)
#হালিমা রহমান।
মাস কয়েক আগে,তুষারের স্ত্রী মহিমা যখন অন্য আরেকজনের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল;তখন পুরো এলাকার মানুষ বিস্ময়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।সবার একটাই প্রশ্ন –” মহিমা কি মানুষ?যার শরীরে মানুষের রক্ত বইছে,সে কীভাবে এমন কাজ করতে পারে?তুষারের মতো একটা ঠান্ডা মানুষকে কীভাবে ফেলে যেতে পারলো?আচ্ছা,ঠিক আছে তুষারকে ছেড়ে যেতে নাহয় কষ্ট হয়নি কিন্তু নিজের নাড়ি ছেড়া ধন?তাকে কী করে মানুষ ফেলে যেতে পারে?এটা কি মা নাকি ডাইনি?
মহিমা যখন পালিয়ে গেছে,তখন তুষার বাড়ি ছিল না।মহিমা তাদের মেয়ে মৃত্তিকাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেই বেরিয়ে গেছে।মৃত্তিকার বয়স তখন মাত্র তিনমাস।মহিমা তৈরি হয়ে,হাতে একটা ছোট ব্যাগ ঝুলিয়ে, দরজায় বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল যখন,তখন সিড়ির গোড়ায় রিদিতার সাথে দেখা।রিদিতা একই বাড়ির পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। রিদিতা মহিমাকে দেখে একগাল হাসে।মহিমাকে তার খুব পছন্দ।তাই, আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” কই যান, ভাবি?মৃত্তি কই?”
—” আমি একটু সামনেই যাব ভাবি।আমার বড় ভাই আসছে চৌরাস্তার মাথায়।ওর সাথে কথা বলে চলে আসব।আপনি মৃত্তিকার দিকে একটু খেয়াল রাখতে পারবেন? ও ঘুমাচ্ছে।ঘুম থেকে উঠলে হয়তো কাঁদবে।আমি এই যাব আর আসব।”
মহিমার কন্ঠে খুব ব্যস্ততা।যেন পালাতে পারলেই বাঁচে।তার পা কাঁপে,গলা শুকিয়ে আসে,ঠোঁটের উপর ও কপালে ঘাম জমে।বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তা মুছে নেয় সে।একটু ভয় পেয়ে যায় রিদিতা।এই অবস্থা কেন ভাবির? উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করেঃ” কোনো খারাপ খবর নাকি ভাবি?”
—” না,না।কোনো খারাপ খবর নেই।আসছি ভাবি।মৃত্তিকে একটু দেখবেন প্লিজ।”
দরজা পেরিয়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায় মহিমা।রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা খালি রিকশায় চেপে হুড তুলে নেয়।রিকশাওয়ালাকে তাড়া দেয় তাড়াতাড়ি চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
মহিমাকে এভাবে চলে যেতে অনেকেই দেখেছে।কিন্তু, কেউ বুঝতে পারেনি এরকম ভরদুপুরেই সবার নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে যাবে মহিমা।তুষার যখন খবর পেয়েছে তখন বোধহয় বিকাল পাঁচটা বাজে।দুপুর দুটোর দিকে ঘুম ভাঙে মৃত্তিকার।দুধের বাচ্চা উঠেই কান্না শুরু করে দেয়।সেই কি কান্না তার! কান্না ছাড়া যার ভাষা নেই,সে আর কিইবা করতে পারে! রিদিতা ঘুমিয়ে ছিল।তার নিজেরও একটা একবছর বয়সী ছেলে আছে।মৃত্তিকার উচ্চস্বর কানে আসতে সময় লাগে না তার।ধরফরিয়ে উঠে রিদিতা।মৃত্তিকা কাঁদে কেন? তার মানে মহিমা ভাবি এখনো আসেনি? কেমন বেয়াক্কেল মানুষ! রিদিতা ছুটে যায় পাশের ফ্ল্যাটে।দরজা খুলে কোলে নেয় মৃত্তিকাকে।একদম নরম একটা পুতুল।এই কতক্ষণেই প্রস্রাব-পায়খানা করে পুরো পিঠের নিচ পর্যন্ত ভরিয়ে ফেলেছে।সব পরিষ্কার করে রিদিতা।কল করে মহিমার ফোনে।কিন্তু,ফোন বন্ধ।একদিকে মায়ের ফোন বন্ধ, অন্যদিকে মেয়ে দুনিয়া উজার করে কাঁদছে।এই দুজনের চক্করে পরে রিদিতারও হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কোনো উপায় না পেয়ে মৃত্তিকার মুখে ছেলের ফিডারের সবটুকু দুধ ঢেলে দেয়।বুভুক্ষের মতো তা গিলে নেয় মৃত্তিকা।রিদিতার খারাপ লাগে খুব।মুখ থেকে এমনিই বেরিয়ে আসে সহানুভূতির সুর।আহারে!মেয়েটার পেটে কত ক্ষিদা ছিল।
“মহিমা বাড়িতে নেই, মৃত্তিকা অনবরত কাঁদছে”— কথাটা কানে যেতেই প্রায় উড়ে আসে তুষার।আসতে আসতে শ্বশুরবাড়ি ফোন দেয় খবর নেওয়ার জন্য।মহিমা ওখানে গেল নাকি কে জানে!রিদিতা যখন তুষারকে ফোন দিয়েছিল, তখন তার কোলে ছোট্ট মৃত্তিকা কাঁদছে।কলিজার টুকরার কান্না কানে আসতে দেরি হয়নি তুষারের।তাই মনে মনে ক্ষোভ জমে মহিমার উপর।যেখানেই গেছে যাক।কিন্তু মৃত্তিকাকে নিয়ে গেলে কি হতো?আশ্চর্য মানুষ তো! এইটুকু মেয়ে কি মাকে ছাড়া থাকতে পারে?আজ মহিমা বাড়ি এলে খবর আছে তার।একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে তুষার।
তুষার ঘরে ঢুকে মেয়েকে কোলে জড়িয়ে নেয়।চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় পুরো মুখ।ছোট্ট পুতুলটাও যেন বাবাকে চিনে।বাবার কোলে যেয়েই কেমন শান্ত হয়ে গেছে!মহিমার বাবার বাড়ি থেকে কোনো খবর পাওয়া যায়নি।তারা জানে না কোথায় গেছে মহিমা।তাদের ওখানেও যায়নি সে।এই খবর পেয়ে একটু চিন্তা হয় তুষারের।কোনো বিপদ হলো না তো মেয়েটার! এই শহরে বিপদ ঘটতে দেরি লাগে না।চিন্তার ভাঁজ পরে কপালে।এমন সময় রিদিতা আসে তুষারের ফ্ল্যাটের সামনে।ঠকঠক আওয়াজ করে দরজায়।
—” তুষার ভাই,ভাবির কোনো খোঁজ পেয়েছেন?”
—” না,আপা।”
—” ভাবির বড় ভাইরে ফোন দেন।ভাবি তো দুপুরে তার সাথেই দেখা করতে গেল চৌরাস্তার মাথায়।যাওয়ার সময় আমার সাথে দেখা হয়েছিল।তখন আমাকে বলেছে।”
অবাক হয়ে যায় তুষার।ছোট বোনের সাথে দেখা করতে হলে বাড়িতে আসবে।চৌরাস্তায় কেন দেখা করতে হবে?তুষার ফোন দেয় মহিমার বড় ভাইকে।প্রথমবার কল ধরে না কেউ।দ্বিতীয়বারের বেলায় মহিমার বড় ভাইয়ের গলা শোনা যায়।
—” কি অবস্থা তুষার?”
—“এইতো ভাই।মহিমা কোথায় আছে?ওকে একটু বলবেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে।”
—” মহিমা কোথায় আছে মানে?ও বাড়িতে নেই?”
—” নাহ,ওতো দুপুরে আপনার সাথে দেখা করতে গেল।আপনি না চৌরাস্তার মাথায় এসেছিলেন ওর সাথে দেখা করতে?”
—” কি বলো এইসব! আমি তোমার ভাবিরে নিয়ে কুয়াকাটা আসছি দুইদিন আগে।”
অবাক হয়ে যায় তুষার।আজ বোধহয় তার অবাক হওয়ার দিন।এটা নিশ্চিত মহিমা অন্য কোথাও গেছে কাউকে না জানিয়ে।চিন্তায় মাথা ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়। সেই রাতে পুরোটা সময় মেয়েকে বুকে জড়িয়ে শুয়েছিল তুষার।একফোঁটা ঘুমায়নি সারাটা রাত।মাথায় বিভিন্ন চিন্তা।সবচেয়ে বেশি চিন্তা মহিমাকে নিয়ে।ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিল তুষারের।ঘুমটা হয়তো গাঢ় হতে পারতো।কিন্তু,হলো না বিস্ফোরক একটা খবরের জন্য।একটু আগে তুষারের ছোট শ্যালক ফোন দিয়ে জানিয়েছে,মহিমার পালিয়ে যাওয়ার খবর।মহিমা নাকি তাকে শেষ রাতে ফোন করে জানিয়েছে।মহিমা পালিয়ে গেছে! খবরটা কি সত্যি! প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তুষারের।আশ্চর্য! কেন পালাবে মহিমা?তাদের মাঝে তো কোনো সমস্যা হয়নি।বেশ সুখী দম্পতিই ছিল তারা।তবে?গতকাল এই সময়েও মহিমা এইঘরে ছিল।এই যে এই বিছানায় মৃত্তিকার গা ঘেষে শুয়েছিল।কালকে যেন একটু বেশি আদুরে দেখাচ্ছিল তাকে।তুষার নয়টার দিকে দোকানে যাওয়ার আগে যখন ব্যবসায়ের হিসাব-নিকাশ করছিল, তখন মহিমাও পাশে বসা ছিল।দু-তিন মাস যাবৎ কেবল ক্ষতিই হচ্ছিলো ব্যবসায়ের।চারদিকে দায়-দেনা বেড়ে গেছে গেছে।তুষারের চিন্তিত মুখ দেখে তার কাঁধে হাত বুলায় মহিমা।সান্ত্বনার সুরে বলে —” চিন্তা করছো কেন?আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।”
এইছিল তুষারের সাথে মহিমার শেষ কথা।কালকের আচরণ তবে অভিনয় ছিল!কিছু ভাবতে পারে না তুষার।মাথাটা কেমন খালি খালি লাগছে।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।অক্সিজেনের অভাব পরলো নাকি চারপাশে?বিছানায় কেঁদে উঠে মৃত্তিকা। হয়তো মায়ের শরীরের উষ্ণতার অভাব টের পেয়েছে।মেয়ের কান্না শুনে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকায় তুষার।মেয়েটা খুব কাঁদছে।হয়তো ক্ষিদে পেয়েছে।তুষার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়।ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করে শরীরের সবটুকু উষ্ণতা। রিদিতার থেকে ধার করে আনা এক ফিডার দুধ মেয়ের মুখে গুজে দেয়।তারপর মেয়ের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেঃ” কাঁদে না মা।আজ থেকে তোমার নতুন দিন শুরু।মায়ের নরম কোলের আদর ভুলে যাও।তোমার জন্য বাবা আছি,আর বাবার জন্য আল্লাহ আছে।আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।”
***
দিন আসে, দিন যায়।ছোট পুতুল মৃত্তিকা এখন আর আগের মতো ছোট নেই।তার এখন এক বছর। সে এখন বিছানায় থাকার চাইতে মাটিতে থাকতে বেশি পছন্দ করে।একটু একটু হাঁটতে পারে।এই দুপা হাঁটে আবার কিছুক্ষণ পরেই ধপ করে পরে যায়।দুটো দাঁত উঠেছে তার।এ নিয়ে তার বাহাদুরির শেষ নেই।তুষারের কোনো কথা পছন্দ না হলেই,কুট করে দাঁত বসিয়ে দেয়।আধো আধো বুলিতে যখন “বা বা,বা বা” বলে ডাকে, তুষার তখন স্বর্গীয় সুখ লাভ করে।তবে,ইদানিং মেয়েকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে।ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি একটা এক বছরের দুষ্টুকে সামলানো সহজ কথা নয়।তুষারের মা-বাবা নেই।বড় কোনো ভাই-বোনও নেই।এই শহরে অভিভাবক বলতে শুধু একটা খালা আছে।তিনি গুলিস্তানে থাকেন।এক্ষেত্রে, বেশ সুবিধা হয়েছে তুষারের।তুষার কাজে যাওয়ার আগে মেয়েকে সেখানে রেখে যায়।আবার বাসায় ফিরার সময় সাথে করে নিয়ে যায়।অনেক সময়,কাজের ফাঁকে কয়েকবার দেখতেও যায়।
তুষারের খালা-খালু বেশ কয়েকবার বলেছে তুষারের বিয়ের কথা।কিন্তু,তুষার একবারেই রাজি না।খালা-খালু যখন বিয়ের সুফল বুঝায়,প্রয়োজনীয়তা বুঝায়; তখন তুষার মুচকি হেসে বলেঃ” এখন ইচ্ছে নেই খালা।বিয়ের ইচ্ছে হলে তোমাকে জানাব।”এরপর আর কোনো কথা থাকে না।তুষারের খালাও চুপ মেরে যান।তুষারের দিকটাও বুঝেন তিনি।এরকম একটা দূর্ঘটনার পর কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করা সহজ কথা নয়।তুষারের যখন ইচ্ছা হবে তখনই নাহয় বিয়ের কথা তুলবেন।
কিন্তু,একটা কথা আছে না।মানুষের ইচ্ছা- অনিচ্ছার উপর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না।মানুষ পরিস্থিতির শিকার।পরিস্থিতির চাপে পড়ে মানুষ চরম অপ্রিয় কাজটাও করতে বাধ্য হয়।তুষারের সাথেও তাই হয়েছে।তুষারের খালা-খালু হজ্বে যাবে এইবছর।একটা দীর্ঘসময় তারা থাকবে না।তখন মৃত্তিকার কী হবে?কার কাছে থাকবে সে?প্রথমে,তুষার বলেছিল সারাদিন মৃত্তিকাকে নিজের কাছেই রাখবে।কিন্তু,এ কি হওয়ার মতো?জীবনতো আর সিনেমা নয় যে, মা-ছাড়া একটা বাচ্চা সারাদিন বাবার সাথে বাবার কর্মস্থলে থাকবে।এই পরিকল্পনা যখন কাজে এলো না, তখন তুষার ভাবলো একটা আয়া ঠিক করবে।কিন্তু এতেও তীব্র আপত্তি তুষারের খালার।তিনি চিন্তিত মুখে বলেনঃ”না,বাবা।আয়ারা টাকার জন্য কাজ করে।তার আমার নাতনির যত্ন নিবে না ঠিক মতো।তুমি তার চাইতে একটা বিয়েই করো।আজ হোক, কাল হোক বিয়েতো করবাই।সারাজীবন তো আর একলা কাটানো সম্ভব না।তাহলে,পরে করে কি লাভ?এখনই করো।মেয়েটা একটা মা পাক।তাছাড়া, বড় হওয়ার পর মিত্তি নতুন কাউরে মা ডাকতে চাইবে না।তার চেয়ে তুমি বরং এখনই একটা বিয়ে করো।”
তুষারও ভেবে দেখলো।খালার কথা মন্দ নয়।তাই অনেক ভেবেচিন্তে অবেশেষে তুষার বিয়েতে মত দিয়েই ফেললো।তুষারের খালা মনে আনন্দ নিয়ে বউ খোঁজার কাজে নেমে পড়লেন।কিন্তু,এখনকার দিনে ছেলের জন্য মেয়ে খোঁজা কি সহজ কথা! মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অভিজ্ঞ চোখে সবটা দেখে অবশেষে ছেলের জন্য মেয়ে ঠিক করলেন।মেয়ের নাম মহুয়া।আজিমপুরে থাকে। একটা স্কুলে চাকরি করে।মেয়ের পরিবারব খুব ভালো,নম্র-ভদ্র।সবই ঠিক আছে,কিন্তু একটা জায়গায় একটু গোলমেলে।মহুয়া ডিভোর্সি।তার আগের সংসার ভেঙেছে এক বছর আগে,তারপর থেকে সে বাবার বাড়িই আছে।।
#(পর্ব-২)
ঘড়ির কাঁটায় এখন বিকাল পাঁচটা।তুষার বসে আছে আজিমপুরের একটি বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে।ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে এখন রেস্টুরেন্ট। একদম ব্যাঙের ছাতার মতো।তুষার চোখ ঘুরিয়ে একবার পুরোটা দেখলো।বেশ সুন্দর করেই সাজিয়েছে পুরোটা।সবখানে আধুনিকতার ছোঁয়া।তুষার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে একবার ঘড়ির দিকে তাকালো।অনেক কাজ-কর্ম ফেলে সে এখানে এসেছে।এখানে আসার উদ্দেশ্য মহুয়ার সাথে দেখা করা।মহুয়ার সাথে বোধহয় বিয়েটা এবার হয়েই যাবে।
তুষারের খালা, রুবিনা বেগম মহুয়ার খোঁজ পেয়েছেন তুষারের বন্ধু শফিকের মাধ্যমে। শফিক বন্ধু মহলে ঘটক হিসেবে পরিচিত।কতো বন্ধুর বিয়ে যে ও ঠিক করেছে তা হাতে গোনা মুশকিল।প্রায় সপ্তাহ খানেক আগের এক শুক্রবারে, সারাদিনের কাজ শেষ করে,মৃত্তিকাকে ঘুমে রেখে, তুষার বেরিয়েছিল বন্ধুর সাথে দেখা করতে।একসময় প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ হতো শফিকের সাথে।কিন্তু, এখন আর হয় না।যে যার জীবন, ঘর-সংসার, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত।তাই সচরাচর এখন আর দেখা করা হয় না।ব্যস্ত জীবনকে পাশে রেখে তুষার আজিমপুরে গিয়েছিল শফিকের সাথে দেখা করতে।শফিক আজিমপুরের বাসিন্দা।এখানেই একটা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক।বহুদিন পর প্রাণের বন্ধুকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে শফিক।তুষারটা কেমন শুকিয়ে গেছে! চোয়াল ভেঙে চেহারাটা একটুখানি হয়ে গেছে।চোখের নিচেও বোধহয় এক আঙুল কালি পরেছে।শফিকের ভিতরটা হু হু করে উঠে, বন্ধুর এই দশা দেখে।তুষারকে দেখে কে বলবে একসময় সে বন্ধু মহলের সবচেয়ে সুন্দর যুবক ছিল!ভার্সিটির বহু মেয়ের ঘুম হারাম করেছে নিজের সৌন্দর্য দিয়ে!মনে মনে মহিমার উপর আকাশসম রাগ জমে শফিকের।ওর মতো ছলনাময়ী আর কোনো পুরুষের ভাগ্যে না থাকুক।
—” কিরে, শফিক ছাড় আমাকে।এতোক্ষণ কে মানুষকে জড়িয়ে ধরে রাখে?”
তুষারের কথায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায়।সে আরো একবার জোরে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দেয় তুষারকে।তুষারের পিঠের হাড়গোড় বোধহয় ভেঙেই গেছে।সে শফিকের পেটে একটা ঘুসি মেরে বলেঃ” শালা, গন্ডারের স্বাস্থ্য বানাইছিস।আমার পিঠটা ভেঙেই গেছে।”
শফিক মুচকি হেসে বলেঃ”তোরে আপাদমস্তক ভাঙার জন্য গন্ডারের স্বাস্থ্য লাগে না।যেই অবস্থা করেছিস নিজের! একটা কঙ্কালের চাইতেও খারাপ দেখা যায়।নিজের যত্ন-টত্ন নিস না নাকি?”
—” আরে ধুর,নিজের দিকে তাকানোর সময় আছে এখন?দোকানের কাজ,মৃত্তির খেয়াল সবকিছুর দেখাশোনার বাইরে সময় কই আর।”
—” শোন এইসব আমারে বুঝাইস না,বুঝছোছ? ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।তুই তো মনে হয় বউয়ের শোকেই দেবদাস হওয়ার পায়তারা করছিস।মানে,এটা কোনো কথা ভাই?একটা প্রতারকের জন্য কে নিজের এই হাল করে! শালা,তুই পুরুষ জাতির কলঙ্ক।তোকে এই মুহূর্তে আমাদের জাতি থেকে বহিষ্কার করা উচিৎ। ”
শফিকের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ে।তাই কথা ঘুরিয়ে ফেলে তুষার।ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাতে ল্যাম্পপোস্টের হলদে-সাদা আলোয় বহু কথা হয় দুজনের মাঝে।কখনো বাড়ির কথা,কখনো পুরোনো বন্ধুদের কথা আবার কখনো দেশের কথা।কথার এক ফাঁকেই শফিক তুষারকে প্রশ্ন করেঃ” বিয়ে-সাদি করবি না আর?মৃত্তির কিন্তু এখন একটা মায়ের দরকার।”
—” কেন? আমি কি কম নাকি? তাছাড়া, খালামনি ওর খুব খেয়াল রাখে।ওর কোনো কষ্টই হয় না।”
—” তুই আর কতটুকু খেয়াল রাখিস?তাছাড়া, দাদির আদর দাদির মতো আর মায়ের আদর মায়ের মতো।দুটো কি এক নাকি?”
—” আমার দ্বিতীয় স্ত্রীই কি ওর মা হয়ে উঠবে?যাকে নিজের মায়ই ফেলে গেছে,তাকে আর কে আপন করে নিবে?”
—” এইসব নিম্ন শ্রেণির কথা- বার্তা বন্ধ কর।সব সৎমা খারাপ হয় না। এমনও তো হতে পারে মৃত্তির দ্বিতীয় মা তাকে সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখবে।”
—” কি জানি।কিন্তু,এবার বোধহয় বিয়ে একটা করতেই হবে।খালা-খালু হজ্বে যাবে এবার।আমি একা মিত্তিকে দেখে রাখতে পারব না।”
খুবই খুশি হয় শফিক।উৎফুল্ল স্বরে জিজ্ঞাসা করেঃ” মেয়ে কি দেখেছিস নাকি?আমার কাছে খুব ভালো একটা মেয়ের খবর আছে।”
—” না,মেয়ে এখনো দেখা হয়নি।খালামনি দেখেছি খুঁজছে।”
—” তাহলে,খালামনির নাম্বার দে।আমি তার সাথে কথা বলি।”
তুষার নাম্বার দিতে দিতে বলেঃ”মেয়ে যাতে ডিভোর্সি হয়।অবিবাহিত মেয়েদের আমি বিয়ে করব না।”
খুবই অবাক হয় শফিক।অবাক কন্ঠে বলেঃ” একটা ষাট বছর বয়সী বুড়োও দ্বিতীয় বিয়ে করার সময় অবিবাহিত মেয়ে খুঁজে। তুই এমন দল ছাড়া,গোত্র ছাড়া হতে যাবি কেন?”
—” আমার বউ নয়,মেয়ের মা দরকার।দুটো ভাঙা জিনিস একসাথে জোড়া লাগতে পারে।কিন্তু একটা ভাঙা জিনিস আর একটা ভালো জিনিস কখনোই একসাথে জোড়া লাগতে পারে না।বুঝেছিস?”
—” উঁহু, কিছুই বুঝলাম না।আচ্ছা,বাদ দে।এখন মেয়ের কথা শোন।মেয়ের নাম মহুয়া।সে আমার সহকর্মী।আমাদের স্কুলের আইসিটির জনপ্রিয় শিক্ষক।ভাইরে ভাই,কি যে মেধাবী! আমাদের স্কুলের কলেজ সেকশন হচ্ছে।ওইটা হলে,এই মেয়ে নিশ্চিত কলেজের লেকচারার হতে পারবে এক চুটকিতে।”
—” এতো কিছু বাদ দে।তুই বল,সে ডিভোর্সি নাকি?”
—” হুম।এক বছর হয়েছে ডিভোর্স হয়েছে।আমি বুঝি না কোন শালা এই নম্র-ভদ্র মেয়েটারে ছারছে।ওই শালা নিশ্চিত একটা বলদ।”
তুষার বুঝলো শফিক মহুয়ার বিশাল ভক্ত।তাই সে কিছু বলল না।
—” বুঝলি তুষার,মেয়েটা এতো ভালো।আমার এতো ভালো লাগে।তোর ভাবি যদি না থাকতো, তবে আমিই ওকে বিয়ে করার চেষ্টা করতাম।”
তুষার মুচকি হেসে শফিকের পিছনে লাথি দেয়।মুখে বলেঃ” এই কারণেই ভাবি তোকে দু-বেলা জুতোপেটা করে।তোর মতো মানুষের জন্য এটাই ঠিক আছে।কত্ত বড় বদমায়েশ হলে,মানুষ ঘরে বউ রেখে বাইরের মেয়েদের দিকে তাকায়!”
বিয়ের জন্য তুষারকে আর কিছুই করতে হয়নি।রুবিনা বেগম ও শফিক মিলেই সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে।রুবিনা বেগম প্রথমে গাইগুই করেছিলেন,মহুয়া ডিভোর্সি বলে।কিন্তু,পরে যখন জানলেন তুষার ডিভোর্সি ছাড়া বিয়ে করবে না ; তখন আর কিছুই বলেননি।ছেলের জীবন,সিদ্ধান্তও সেই নেক।রুবিনা বেগম বাড়ি যেয়ে দেখে এসেছেন মহুয়াকে।পছন্দ হয়েছে তার।তুষারকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।কিন্তু,তুষার যায়নি।বাড়ি বয়ে মেয়ে দেখতে তুষারের ভালো লাগে না।তবে,তুষার শফিকের সাথে একদিন গিয়েছিল স্কুলে। সেখানে, একবারের জন্য চোখে পড়েছে মহুয়াকে।দেখতে খারাপ না।আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতোই।দুই বাড়ির কারোরই আপত্তি নেই বিয়েতে।তুষারেরও আপত্তি নেই।তাই বিয়ের আগে একবার মহুয়ার সাথে দেখা করতে চেয়েছে তুষার।মহুয়ার সাথে কিছু কথা খোলামেলা আলোচনা করতে চায় সে।মহুয়াও সায় দিয়েছে।তাই আজ বিকাল পাঁচটায় আজিমপুরের বিলাসবহুল এই রেস্টুরেন্টে বসে আছে তুষার।পাঁচটা বেজে গেছে অনেক আগেই।তুষার বিরক্ত নিয়ে বসে আছে।আশ্চর্য!এই মেয়ের কি কোনো সময়জ্ঞান নেই?সে কি জানে, তুষার কতো কাজ-কর্ম ফেলে এখানে এসেছে?সামনাসামনি দেখা হওয়ার আগেই, মহুয়ার প্রতি বিতৃষ্ণায় ভরে গেল তুষারের মন।
***
ঘড়ির কাঁটা যখন সাড়ে পাঁচটার ঘরে এসেছে, তখন রেস্টুরেন্টে টুকটুক করে ঢুকলো মহুয়া।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরটায় চোখ বুলালো।কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখে ফেললো তুষারকে।তুষারকে সে চিনে।ছবি দেখেছে এর আগে।মহুয়া ধীরপায়ে তুষারের দিকে এগিয়ে গেল।এককোনে একটা টেবিলে বসে আছে।কপাল কুঁচকে ফোন টিপছে।মহুয়া টেবিলের সামনে পৌঁছে গলায় কাশি তুলে বললঃ” আসসালামু আলাইকুম, আপনিই কি তুষার সাহেব?”
মহুয়াকে দেখে উঠে দাঁড়ালো তুষার।মুখে বললঃ” জ্বি।বসুন,প্লিজ।”
মুচকি হেসে বসলো মহুয়া।তুষার বসতে বসতে বললোঃ” আমি ভেবেছিলাম, আপনি আসবেন না।আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেই চলে যেতাম আমি।”
—” আমি অনেক আগেই আসতাম।কিন্তু,বাসায় একটু ঝামেলা হওয়ায় দেরি হয়ে গেছে।আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ”
—” ঠিক আছে,সমস্যা নেই।নিন অর্ডার করুন।”
মেনু কার্ড এগিয়ে দিলেও খুব বেশি একটা অর্ডার করলো না মহুয়া।কেবল এককাপ কফির ফরমায়েশ দিলো।তুষারও এক কাপ কফির বেশি আর কিছু অর্ডার দিলো না।এখানে তারা আজ খেতে আসেনি।খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছে।
তুষার ভিতরে ভিতরে কথা সাজিয়ে বললঃ”আপনি বোধহয় আমার সম্পর্কে সবকিছুই জানেন।তবুও আমি নিজের মুখেই বলছি।আমি তুষার আহমেদ।গুলিস্তানের সুন্দরবন মার্কেটে একটা ও পাতাল মার্কেটে একটা দোকান আছে আমার।দুটোই মোবাইলের। আমার একটা একবছর বয়সী মেয়ে আছে।মৃত্তিকা তার নাম।আপনি বোধহয় দেখেছেন ওকে।”
—” জ্বি, দেখেছি।সেদিন আপনার খালামনির সাথে সে এসেছিল আমাদের বাসায়।আপনার মেয়েটা খুব ফুটফুটে।”
—” হুম।ওর জন্যই এখন আবার বিয়ে করতে হচ্ছে আমাকে।আমি আমার প্রথম স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতাম।”
—” স্বাভাবিক।আপনার স্ত্রী কেন পালিয়ে গিয়েছিলো? ”
খুবই বিশ্রি একটা প্রশ্ন।তুষার বিরসমুখে বললঃ”সে নতুনত্বের খোঁজ পেয়েছিলো।ব্যক্তিগতভাবে, আমাদের দুজনের মাঝে কোনো সমস্যা ছিলো না।তবে,আমি সেই কয়েকটা মাস মহিমাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারিনি।”
—” কেন?”
—” মৃত্তি হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই আমার মা মারা গিয়েছিলো।দোকানগুলোর অবস্থাও তখন ভালো ছিল না।মৃত্তি হওয়ার কারণে মহিমার পিছনেও অনেক টাকা খরচ হয়েছিল।হাতে তখন বেশ টানাটানি।এসব নিয়েই মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত ছিলাম আমি।তাই খুব একটা সময় দিতে পারিনি ওকে।”
—” আচ্ছা,আপনি কি পরে খবর পেয়েছিলেন কার সাথে মহিমা পালিয়ে গিয়েছিল?”
—” হুম। আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ বিলের কাগজ বিলি করতো একটা লোক।তার সাথেই। ”
—“ওহ,আচ্ছা।”
কফি এসে পড়েছে।দুজনেই উদাস মুখে একটা চুমুক দিলো কফি কাপে।তুষার এক চুমুক কফি খেয়ে বললঃ”আমি আসলে এখন মেয়েটার জন্যই বিয়ে করছি।আমার এখন বউয়ের দরকার নেই।আমার মেয়েটার একটা মা দরকার।আপনি কি আমার মেয়ের মা হবেন, প্লিজ?”
নিঃসংকোচ আবেদন।মহুয়া মুচকি হেসে বললঃ ” আপনার কথাগুলো বেশ স্বার্থপরের মতো শুনাচ্ছে।মিত্তির জন্য বিয়ে করছেন,কিন্তু আমি যদি ওর মা না হয়ে উঠতে পারি?”
—” দেখুন ভবিষ্যতকে কল্পনা করা যায়।আমি কেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খারাপ কল্পনা করব? আমি আশা করেই নিচ্ছি আপনি আমার মেয়ের খুব ভালো মা হবেন।”
—” আরেকটা প্রশ্ন,আপনার যেই বয়স; এই বয়সে একটা অবিবাহিত মেয়েকেই বিয়ে করতে পারেন।মানে,এই বয়সে আমাদের দেশের অনেক ছেলেই প্রথম বিয়ে করে।তো আপনি কেন আমার মতো একটা ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করছেন?”
—” আমি তিন বছর সংসার করেছি মহিমার সাথে।সংসারের অলিগলি সব আমার চেনা।আমাদের দেশের মেয়েরা সংসার চিনে কোন বয়স থেকে, জানেন?যখন তারা পুতুল খেলে তখন থেকে।তখন থেকেই তারা স্বামী- সংসারের স্বপ্ন দেখে।দেখেন না, আমাদের মেয়েরা ছোটবয়সে কিন্তু বল খেলে না।তারা দুটো পুতুলের বিয়ে দিয়ে সংসার সংসার খেলে।আমি যদি একটা অবিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করি, তবে সে প্রথমেই আমার বউ হতে চাইবে।আমার বাচ্চার মা না।তাই, আমি একজন ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছি।”
মহুয়া বুঝলো লোকটা বেশ বাস্তববাদী।তাই কফি শেষ করে বললঃ” আপনার মনে প্রশ্ন জাগে না, আমার কেন ডিভোর্স হয়েছে? এমনও তো হতে পারে, আমার দোষেই আমার আগের সংসার ভেঙেছে। ”
—” আপনি যদি নতুনত্বের খোঁজে সংসার ছাড়তেন তবে নিশ্চয়ই এতোদিন বিয়ে না করে থাকতেন না।দু কারণে আমাদের সংসার ভাঙে।নতুনত্বের খোঁজ পেলে অথবা অত্যাচারের কারণে। তাছাড়া,আমি খালামনির কাছে শুনেছি, তৃতীয় ব্যক্তির জন্যই আপনার সংসার ভেঙেছে। ”
—” তৃতীয় ব্যক্তির জন্য কখোনো আমাদের বন্ধন ছিন্ন হয় না।বন্ধন ছিন্ন হয়, আমাদের নিজেদের মানুষদের জন্যই।আপনি কি শুনবেন আমার এলোমেলো সংসারের পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ার গল্প?”
খুব অসহায় দেখালো মহুয়ার চোখ।সহসা না করতে পারলো না তুষার।সবারই কিছু না কিছু গল্প থাকে
আজ নাহয় শোনাই যাক মহুয়ার পুরোনো সেইসব কথা।এক পুরোনো সংসারের কিছু ঘটনার নগ্ন উত্থান।
# (পর্ব-৩)
দুবছর আগের এক শীতের সকাল।ঘরের দরজা- জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে মহুয়া।একেবারে কম্বল মুড়ি দিয়ে, কোলবালিশ জড়িয়ে, বিছানার মাঝে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে।এখন বোধহয় সকাল নয়টা বাজে।এতোবেলা পর্যন্ত মহুয়ার এই সুখনিদ্রা পছন্দ হচ্ছে না মহুয়ার মা,সাবিনা বেগমের।তিনি তিনবার মহুয়ার বন্ধ দরজায় জোরে জোরে আঘাত করেছেন,গলা উঁচিয়ে বকাবকি করেছেন, নিজের মোবাইল দিয়ে মহুয়ার মোবাইলে কল করেছেন।তবুও, মহুয়ার ঘুম ভাঙার কোনো নাম – গন্ধ নেই।আশ্চর্য! মেয়ে কি মরে-টরে গেল নাকি?সাবিনা বেগমের এইসব কাজে চরম বিরক্ত মহুয়ার বাবা,আফজাল হোসেন।একটা মাত্র আদরের মেয়ে তার।সারা সপ্তাহ মেয়েটা বাইরে কাজ করে। অন্যান্য দিনতো সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠতে হয়।সপ্তাহে একটা দিনই একটু ঘুমানোর ফুরসত পায়।ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক।তিনি চেয়ারে বসে বিরক্ত চোখে সাবিনার দিকে চেয়ে আছেন।এই মূর্খ মহিলার কাজ- কর্মের কোনো দিকপাল নেই।সাবিনা বেগম আরো একবার মহুয়ার দরজায় আঘাত করলেন।গলা উঁচিয়ে বাংলা ভাষায় কয়েকবার গালাগালিও করলেন।তবুও যখন দেখলেন মেয়ের উঠার কোনো লক্ষণ নেই,তখন রেগেমেগে তেড়ে আসলেন মহুয়ার বাবা আফজাল সাহেবের দিকে।
—” আপনার জন্য,শুধুমাত্র আপনার জন্য আজকে আমার মেয়ের এই অবস্থা।মেয়েরে লাই দিয়ে দিয়ে এক্কেবারে মাথায় তুইলা ফেলসেন।আমি ওরে ছোটবেলা থেকে একা মানুষ করি নাই?কই তখন তো ওর এতো সাহস ছিল না।মেয়ের কত্ত পাখা গজাইছে,আমার কথা কানে নেয় না!আজকে শুধু উঠুক, ওরে যে কি করব আমি।আপনি যদি শুধু মেয়েরে সাপোর্ট করছেন,খবর আছে আপনার।”
—” সাবিনা,একটু আস্তে কথা বলো।আজকে শুক্রবার,সব বাসায় মানুষ এখনো ঘুমায়।মেয়েটা তো একটু শুক্রবারেই ঘুমায়।অন্যান্য দিন সেই সকালে উঠে রাত বারোটায় ঘুমাতে যায়।সেগুলো কি তোমার চোখে পড়ে না?আমার মেয়ের মতো কোন মেয়েটা সারাদিন এতো কাজ করে?তুমি ওর মা,কোথায় একটু মায়ের মতো আচরণ করবা,ভালোবাসবা তা না।মেয়েটা বাড়িতে থাকলেই খিটমিট শুরু করো।একদম সৎমাদের মতো।”
সাবিনা বেগম রাগে দিশেহারা হয়ে গেলেন।স্বামীর দিকে আবারো তেড়ে এসে বললেনঃ” হ্যাঁ, আমি সৎমাই।ওরে কি আমি পেটে ধরসি নাকি? আমার তো মেয়ের প্রতি আদর নাই।মেয়েটা উঠবে এগোরাটায়,সকালের নাস্তা খাবে বারোটায়,এরপর দুপুরের খাবারই আর খাবে না।এটাই আদর,তাই না?থাকেন আপনারা বাপ-মেয়ে।কিছু বলব না আর।আমি তো আপনাদের শত্রু।মেয়েরে সবকিছুতে লাই দিতে হবে।এই স্বভাব নিয়ে যদি পরের বাড়িতে যায় না,এক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে আরেক দরজা দিয়ে বের করে দিবে।আমি তো…….” আফজাল সাহেব আর কানে নিলেন না সাবিনা বেগমের কথা।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।এই মহিলার কথা শোনা মানেই স্বেচ্ছায় কানের উপর অত্যাচার করা।সব কিছুতে এতো বাড়াবাড়ি ভালো না।তাছাড়া,মেয়েরা তো একটু বাবার বাড়িতেই আরাম করবে তাই না?শ্বশুর বাড়িতে কি আর আরাম করতে পারবে?মেয়েটা একটু চলুক না নিজের মতো।কি সমস্যা হয় এতে?
আফজাল সাহেব ধীরপায়ে যেয়ে মেয়ের দরজার সামনে দাঁড়ালেন।যতটা ধীরে ধীরে মেয়ের দরজার সামনে গিয়েছিলেন, তার চাইতেও ধীরে দরজায় আঘাত করলেন।নরম গলায় ডাক দিলেন মেয়েকে।
—” মহু মা, মা।উঠো মা।নাস্তা করবা না? উঠো।মহুয়া,মহুয়া।”
খট করে খুলে গেল মহুয়ার দরজা।সকাল সকাল বাবাকে দেখে মনটাই ভালো হয়ে গেল মহুয়ার।এতোক্ষণ সে জেগেই ছিল।সাবিনা বেগম যেইহারে চিল্লাচিল্লি করেছেন,এতে কারো সাধ্য নেই ঘুমানোর।আফজাল সাহেব মেয়ের ঘরে ঢুকে বিছানায় আয়েস করে বসলেন।দূর্বল হাঁড়ের পাগুলোকে ঢুকিয়ে দিলেন মেয়ের নরম উষ্ণ কম্বলে।এতোক্ষন চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে থাকার কারণে পায়ে ব্যাথা হয়ে গেছে।মহুয়া এসে আবারো বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।আফজাল সাহেব মৃদু হেসে বিলি কেটে দিলেন মেয়ের মাথায়।
—” মা এমন করে কেন বাবা?”
—” তোকে বেশি ভালোবাসে তাই।”
—” এটা কেমন ভালোবাসা?ভালোবাসায় শান্তি থাকতে হয়।শান্তি না থাকলে কি আর তাকে আর ভালোবাসা বলে?”
—“হুম, অবশ্যই বলে।তোর কাছে যেটা অশান্তি,তোর মায়ের কাছে তা সচেতনতা।তুই যে ছুটির দিনে দুপুরে ভাত খাস না, এটা তোর মাকে বড্ড পোড়ায়।বুঝলি? সে তোর স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন।ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন।”
—” এক বেলা না খেলে কি এমন হয়? মানুষ কি মরে যায়?একটা জিনিসকে কেন্দ্র মা সেই সকাল থেকে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়।হাহ।”
—” শোন তোর মা একটু এমনই।সে সবকিছু নিয়ে বেশি বেশি ভাবে বুঝলি।তোকে একটা ঘটনা বলি।তোর ছোটবেলায় একবার খুব জ্বর হয়েছিল।একদম গা কাঁপানো জ্বর।তুই বোধহয় তখন তিন- চার বছরের বাচ্চা মেয়ে।আমি দেশে নেই।তোর মায়ের চিন্তা তখন দেখে কে!তখন তো আর এতো সহজে যোগাযোগ করা যেত না।তোর মা নাকি তোকে নিয়ে তখন খুব দৌড়াদৌড়ি করেছে।একা মানুষ হয়েও এই ডাক্তার থেকে ঐ ডাক্তারের কাছে দৌড়ে গেছে।যে যা বলেছে তাই করেছে।কখনো ঔষধ, কখনো ভেষজ লতা- পাতা খাইয়েছে তোকে।অথচ,তোর জ্বর ছিল মাত্র তিনদিন।তাও আবার সাংঘাতিক কিছু না।সিজোনাল জ্বর।তোর মা সবসময়ই একটু পাগলাটে।বুঝলি?”
—” বুঝলাম।এখন তুমি যে এখানে বসে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াচ্ছ,মা দেখলে কি করবে বল তো?”
—” আমাদের গর্দান নেবে।যা যা তাড়াতাড়ি উঠ।তুই নিজেও তোর মায়ের সাথে বেশি করিস। কি হয় একটু তাড়াতাড়ি উঠলে?”
মহুয়া উঠে বসেছিলো। বাবার কথা শুনে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললঃ” বাবা,একটা দিনই তো মাত্র।নিজের মায়ই যদি এই সুযোগ না দেয়,তবে কে দিবে আর?”
আফজাল সাহেব মৃদু হেসে উঠতে উঠতে বললেনঃ”আমার মাকে সবাই ভালোবাসবে,সুযোগ দেবে।আমার মহুয়া মায়ের জন্য আমি একটা নদের চাঁদ খুঁজে আনব।পড়েছিস না মহুয়ার পালা?নদের চাঁদকে তো চিনিস।কি ভালোই না বাসতো মহুয়াকে।নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে দিল।”
মহুয়া বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে গলা বাড়িয়ে বললঃ” নদের চাঁদরা যুগে যুগে আসে না বাবা।তারা শুধুমাত্র একবারই আসে।আর তাছাড়া, বাস্তবে কি আর নদের চাঁদ হয় নাকি?এরা সাহিত্যেই হয়।”
আলফাজ সাহেব কিছু বললেন না আর।তিনি নিজেও জানেন নদের চাঁদরা বাস্তবে হয় না।এরা সাহিত্যেই সুন্দর।তবুও বাবা-মায়ের মন।সব বাবা-মায়ই চায় ছেলে-মেয়ের জন্য রাজকন্যা বা রাজপুত্র ।তেমনি,আফজাল সাহেবও ব্যতিক্রম নয়।তিনিও মেয়ের জন্য একটা রাজপুত্রই চান।যে তার মেয়েকে তার মতোই আগলে রাখবে।মেয়েটা যে তার বড় আদরের।
মহুয়া আফজাল সাহেব ও সাবিনা বেগমের একমাত্র মেয়ে।আঁধার ঘরের একমাত্র বাতি।আফজাল সাহেবের জীবনভর মালয়েশিয়া ছিলেন।সেই যে বিয়ের একমাস পর গিয়েছিলেন সেখানে,এসেছিলেন পুরো সাত বছর পর।দেশে আসার সুযোগ ছিল না এমন নয়।অনেকবার সুযোগ পেয়েছিলেন।কিন্তু,আসেননি।মালয়েশিয়ায় একটা গ্লাস কোম্পানিতে চাকরি করতেন।বিদেশিরা সেখানে চাকরি করতো বটে,কিন্তু সুযোগ খুব কম ছিল।সারামাসে গাধার মতো খেটে নামমাত্র বেতন পেতেন।এছাড়া,অস্থায়ী চাকরি।দেশে আসলে চাকরি থাকবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই।তাই, দেশে আসেননি আফজাল সাহেব।সাতবছর পর দেশে এসেছিলেন মাত্র তিনমাসের জন্য।এরপর আবার পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশে।মহুয়ার জন্মের সময় দেশে ছিলেন না তিনি।যোগাযোগ ব্যবস্থা এতোটা উন্নত ছিল না।তাই, মহুয়ার মুখ দেখা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। সাবিনা বেগম কয়েকমাস পর পর একটা চিঠির ভাঁজে মহুয়ার একটা ছবি পাঠাতেন।সস্তা স্টুডিওতে তোলা ছবি।তাই দু-চোখ ভরে দেখতেন আফজাল সাহেব।কখনো মুখে হাসি নিয়ে দেখতেন আবার কখনো চোখে জল নিয়ে দেখতেন।কলিজার টুকরাকে দু-হাতে ধরতে না পারার ব্যর্থতা তাকে কুড়ে কুড়ে মারতো। মহুয়ার বয়স যখন পনেরো বছর,তখন দেশে এসেছেন আফজাল সাহেব।দেশে এসে রোগে পড়লেন।দীর্ঘ প্রবাস জীবনে যেই টাকা জমিয়েছিলেন,তার অর্ধেকটাই খরচ হয়ে গেল নিজের পিছনে।বাকি অর্ধেক ভাইয়ের চালের ব্যবসায়ে খাটালেন।মাস শেষে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আসে ঘরে।এই তার আয়।আফজাল সাহেব তার মেয়েকে সবকিছুতেই সমর্থন করেন।সাবিনা বেগমের ভাষায় তিনি লাই দিয়ে মাথায় তুলছেন মেয়েকে।আফজাল সাহেব কানে নেন না তার কথা।পনেরো বছর তিনি মেয়ের থেকে দূরে ছিলেন।তাই তার আচরণ ভিন্ন হবেই।তিনি মেয়েকে বেশি বেশি ভালোবাসবেন এটাই স্বাভাবিক। সাবিনাটা কেন যে বুঝে না!!
বিকাল বেলা একটু বাইরে বের হলো মহুয়া।সারা সপ্তাহে কাজে ক?