সখি ভালোবাসা কারে কয় শেষ পর্ব-১৪

0
1074

#গল্প—-
#সখি ভালোবাসা কারে কয়?
শেষ পর্ব
কানিজ ফাতেমা

দুপুরে সাবরিনা ভাবী এ বাসার কাজের মেয়ে কাজুলিকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিল আমাকে ডাইনিংয়ে গিয়ে খেয়ে আসার জন্য। আমি বলে দিয়েছি কিছু খাবো না।এখন দেখতে দেখতে রাত সারে নয়টা বাজে।
মিথিলা আপুরা সেই দুপুরেই বেরিয়ে এইমাত্র ফিরলো, আপুদের কথার শব্দ পেলাম, কিন্তু হুট করে আপুদের রুমে যেতে ইচ্ছে হলো না, নিজেদের ঘরে হয়তো ফ্রেস হচ্ছে ভেবে।এদিকে শুভ এখনো বাড়ি ফিরেনি বলে বাসার সবার মধ্যে শুভ শুভ রব উঠেছে সেটা এই ঘরে বসে আমার কানও স্পষ্ট শুনতে পারছে।
আমিও মনে মনে শুভর বাসায় ফেরার অপেক্ষা করছি কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছি না।

দুপুরে মিথিলা আপু চিঠির কথাটা বলে যাওয়ার পর থেকে আমি উসখুস করেই যাচ্ছি শুভ ফিরলে আসল সত্যিটা কি আমাকে জানতে হবে। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যেতে যেতে সারে দশটা কিন্তু শুভ এখনো ফিরছে না দেখে কেমন টেনশন হচ্ছে আমার ।এর মধ্যে হঠাৎ বড়খালামনি কাঁদতে কাঁদতে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল” শুভ কি তোকে কিছু বলে গেছে নিধি?”
“সুজয়, শুভর আব্বা কখন থেকে ফোন করছে কিন্তু ফোন বন্ধ। আমি এখন কি করবো, আমার শুভর খারাপ কিছু হয়নি তো?”
বড়খালা উৎভ্রান্তের মত আমার সামনে দাঁড়িয়ে এক মনে কথাগুলে বলে চলে গেলে ঠিকই, সাথে আমার হৃদস্পন্দনও বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন।

কেমন অজানা আশংকায় আমিও অস্থির হয়ে উঠলাম। শুভ কি আমার উপর রাগ করে বাসা থেকে চলে গেছে?
বড়খালামনির পেছন পেছন ধীর পায়ে ডাইনিংয়ে এসে দাঁড়াতেই বড়খালু রাগে রাগে আমার দিকে তাকিয়ে কাকে যেন ফোন দিতে লাগলেন।
একটু পরেই বলতে শুরু করলেন “নাজমা তোমাকে সারা জীবন নিজের আপন বোন ভেবেছি। তাই কেনে কিছু না ভেবে তেমার মেয়েকে শুভর বৌ করে নিয়ে এলাম। আগে যদি জানতাম তোমার মেয়ে এসেই আমার সংসারে আগুন ধরিয়ে দেবে তাহলে কোনোদিন এই ভুল আমি করতাম না।”

ওই পাশ থেকে আম্মু কি বলল কে জানে তবে বড়খালু জোড়ে জোড়ে বলে উঠলেন “নির্ঝরকে বলো কাল সকালেই এসে যেন তোমার মেয়েকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। আমার এত অশান্তি সহ্য হচ্ছে না”-কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে সোফা থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন বড়খালু।
বড়খালুর কথা শুনে আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগলো। আমি ডাইনিংয়ের চেয়ারটা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। মাথাটা কেমন ঝিম ধরে যাচ্ছে চোখটাও ঘোলা লাগছে।
চোখ খুলে দেখতে পালাম মিথিলা আপু ডেকে বলছে “এই নিধি এখন কেমন লাগছে?”

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছি বাসার সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর বিছানায় শুয়ে থাকা আমার পা বরাবর শুভ দাঁড়িয়ে।
সাবরিনা ভাবী হেসে বলল “তুমি তো আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে, সারাদিন না খাওয়া তাই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলে। তোমার সুজয় ভাইয়া স্যালাইনের সাথে রিল্যাকজেশনের ইংজেকশন দিয়েছে ঘুমানোর জন্য, এখন ঘুমিয়ে বিশ্রাম নাও পরে সেলাইনটা শেষ হলে শুভ খুলে দিবে।”
সাবরিনা ভাবীর দিকে তাকিয়ে আমি হালকা হাসি মুখ করার চেষ্টা করলাম।
সাবরিনা ভাবী বড়খালামনি সহ সবাইকে বলল “এখন নিধি বিশ্রাম করুক আর কোনো সমস্যা নেই, সুজয় আমি দুজনেই চেক করেছি। শারিরিক দূর্বলতা। আব্বা আম্মা আপনারাও এখন একটু ঘরে গিয়ে ঘুমান । রাত দুইটা বেজে গেছে আম্মা, আর তাছাড়া শুভ তো ঘরে আছেই”
আমি সাবরিনা ভাবীর কথা শুনতে শুনতে কখন যে আবার ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতেই পারিনি।

সকালে ঘুম ভাঙলে খেয়াল করলাম স্যালাইনটা খুলে রাখা হয়েছে। কাত ফিরে উঠতে গেলে খেয়াল করলাম পাশে শুভর পড়ার টেবিলে কেউ নাস্তা রেখে গেছে। শুভ জানালার পাশে চেয়ারে বসে বসে ঘুমেচ্ছে।
আমি উঠে বসতেই বড়খালামনি ঘরে ঢুকে আমাকে জেগে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন “এখন ভালো লাগছে নিধি?”
মাথা কাত করে হ্যাঁ বললে বড়খালামনি বলল “সুজয় বলেছে এখন ভালে করে নাস্তা করতে কদিন ঠিক মত খাওয়াদাওয়া করোনি বলে শরীর দূর্বল হয়ে গেছে”

বড়খালামনির গলার আওয়াজে শুভও জেগে উঠেছে দেখে খালামনি বললেন “নিধিকে খাবার গুলো খাইয়ে নিয়ে তুমিও ডাইনিংয়ে এসে নাস্তা করে যাওয়। আর একটু বুদ্ধি নিয়ে চলাফেরা করে বুঝেছো” বলে বড়খালামনি ঘর থেকে চলে গেলে শুভ থম থমে মুখ নিয়ে আমার সামনে এসে বলল এখন নাস্তা করবে?
হুম,
ফ্রেশ হতে যাবে?
হুম।
একা বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারবে?”
“মাথা কাত করে শুভর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বললাম হুম”
তারপর বিছানা থেকে নামে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে আসতেই শুভকে খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকতে দেখে কোনো কথা না বলে বিছানায় এসে বসে পরলাম আমি।

স্যালাইন দিয়েছে সেই কারণেই হয়তো গতরাতের মত দূর্বল বোধ হচ্ছে না। আর খিদেও পেয়েছে আমার।
শুভ প্লেটে সবকিছু তুলে দিয়ে প্লেটের পাশে একটা চামচ দিয়ে প্লেটটা নিয়ে এসে বিছানাতে একটা পেপার বিছিয়ে দিয়ে আমার সামনে রাখলো।
আমি খুম শান্ত ভাবে বললাম “তুমি খাবে না?”
“হুম খাবো তোমার আর কিছু লাগবে? “
“না।”
“ঠিক আছে আমি কাজুলিকে ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি কিছু লাগলে নিয়ে আসতে বলবে।”
“হুম” বলে ঘর থেকে শুভর চলে যাওয়ার দিকে এক পলকে তাকিয়ে রইলাম। শুভ চলে গেলে আমি একটু করে খেতে শুরু করলাম ঠিকই কিন্তু মনের মধ্যে কেমন অস্থিরতা অনুভব করছি এখনো।

খেতে খেতেই বাইরে থেকে মিথিলা আপুর গলার আওয়াজ পেলাম।
দরজার সামনে থেকে নিধি আসবো বলে শেয়েব ভাইয়ার সাথে হাসি মুখে রুমে এসে বলল “এখন কি অবস্থা আর খারাপ লাগছে?”
“না আপু।”
“আরে মিথিলা বিয়ের পর পর একটু আধটু শরীর খারাপ করেই। ওসব নিয়ে তোমরা এতো ভাবছে কেনো? আর তাছাড়া ডাক্তার শুভ তো নিধির সেবায় সার্বক্ষনিক নিয়োজিত । তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই, কি তাই তো নিধি?- শোয়েব ভাইয়ার হাসি মুখে বলা কথাগুলো শুনে আমাকেও হেসে উঠতে দেখে মিথিলা আপু বলল-
“যাক তোর হাসি মুখ দেখেছি এখন শান্তি লাগছে।গতকাল যে ভয় দেখিয়ে দিয়েছিলি। শোন আর কেনো পাগলামি করবি না, সাবজধানে থাকবি আর শুভর সাথে একদম ঝগড়া করবি না ঠিক আছে?”
মাথা কাত করে বললাম “হুম।”

“আমাদের দশটার বাসের টিকেট এক্ষুনি বের হতে হবে রে, তুই রেস্ট নে আসছি রে নিধি “-বলে মিথিলা আপু আর শোয়েব ভাইয়া বেরিয়ে যাচ্ছে তক্ষুনি কাজুলিও ঘরে ঢুকলে মিথিলা আপু একশে টাকার একটা নোট কাজুলির হাতে দিয়ে বলল- “ছোটভাবীর খেয়াল করবে।”
কাজুলি জ্বলজ্বলে চোখে হেসে বলল “আমি সারাদিন ছোটোভাবীর কাছে কাছেই থাকবোয়েনে”
“খুব ভালো” বলে মিথিলা আপু আমার দিকে তাকিয়ে হেসে “আসছি নিধি” -বলে দ্রুত চলে গেলো।
কাজুলি কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো “ছোটভাবী আর কিছু লাগবো?”
না, সামনের খাবারগুলো দেখিয়ে বললাম-“এগুলে নিয়ে যাওয়।”
কাজুলি সব কিছু গেছাতে গোছাতে বলল “ছোটভাবী আপনার আব্বা মা আসছেন। চাচাজানের ঘরে কথা বলতেছে। আপনি কি আজই চলে যাবেন?”

কথাগুলো শুনে কেমন যেন চমকে উঠলাম আমি। মুহুর্তেই কাজুলিকে বললাম “তোমার শুভ ভাইকে গিয়ে বলো ছোটভাবী ডাকছে?”
“ক্যান খারাপ লাগতেয়াছে আপনের?”
“তুমি তাড়াতাড়ি যাও।”
কাজুলি প্রায় দৌড়ে চলে গেলো একটু পরেই শুভ হাতে খাবার মাখা অবস্থাতেই দৌড়ে আমার সামনে এসে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো “নিধি খারাপ লাগছে ?”
আমি কথার উত্তর না দিয়ে বিছানা থেকে দ্রুত নেমে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম।
শুভ অবাক চেখে আমাকে দেখে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো কি হয়েছে।
আমি দ্রুত নিজের লাগেজ খুলে চিঠির ব্যাগটা বের করে শুভর সামনে এসে চিঠিগুলো ধরে জিজ্ঞেস করলাম।
“এগুলে তুমি লিখেছিলে?”
শুভ অপ্রস্তুত হয়ে বলল “কেন জানতে চাইছো?”
“তুমি লিখেছিলে কি না বলো?”
“বললে কি হবে?”
“সেটা আমি বুঝবো।”
শুভ আমাকে পাশ কাটিয়ে বাথরুমের বেশিনে গিয়ে হাত ধুতে লাগলো।
হাত ধুয়ে বেরহতেই বললাম “কি বলছো না কেনো? “
“কি বলবো?”
“সত্যিটা বলবে”
শুভ রাগে রাগে নিজের ব্যাগপ্যাক থেকে আরও কয়েকটা চিঠি সহ খাম বের করে বলল “এগুলোও লিখেছিলাম। অপরাধ করেছিলাম। যাও সবাইকে গিয়ে বলে আমাকে শাস্তি দেয়াও।”

আমি চিঠিগুলো একটা একটা করে খুলে দেখছি। শুভ আবার জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিই থাকলো।
চিঠিগুলো রেখে শুভর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে খুব শান্ত ভাবে বললাম-“ ভালোবাসো আমায়?”
আমার আকষ্মীক প্রশ্নে শুভ অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো। শুভর চোখে পানি দেখে কেমন যেন বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলো”
কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম “ভালোবাসো আমায়?”
শুভকে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলাম “এখনো বেলবে না?”
“বাইরে কিন্তু বাবা মাকে ডেকে আনা হয়েছে আমারে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য।”
“তুমি যেতে চেয়েছিলে বলেই না ডেকে এনেছে?” শুভ অভিমান করে বলল।

“তুমি বলোনি কেনো তুমি চিঠি দিয়েছিলে?”
“বললে কি হতো ? সামনে থাকে আমার মনে কথা বুঝতে পারোনি তো চিঠির ভাষা কি করে বুঝবে? বলেছিলাম তো চিঠির মানুষটাকে ভালোবাসো? তুমি তো না করেছিলে।”
“তাহলে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে কেনো?”
“তোমাকে হারাতে চাইনি তাই।”
“আর এখন যদি বাবা মা আমাকে নিয়ে যায়?”
“গেলে যাবে।”
“তুমি কিছু বলবে না?” শুভর শার্টের কলার ধরে বললাম।
“তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাই না।” তাছাড়া কি বলবো খালা খালুকে?”

“ ও এখন তোমার মনে হচ্ছে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে অথচ বিয়ের দিন বলার কথা মনে ছিল না?”
কলার ঝাকিয়ে কথাগুলো বলতেই শুভ রেগে গিয়ে বলল- “কি বলতে হবে বলো? বলবো সব দোষ আমার এইতো ? ঠিক আছে চলো আমি বলছি।”
“আমি তোমাকে সে কথা বলতে বলেছি?”
“তাহলে কি বলবো?”
“কেনো বলবে আমার বৌ কোথায় থাকবে সেটা আমি সিদ্ধান্ত নিব।কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় আমার গলাটা জড়িয়ে আসছিল । প্রচন্ড আবেগে আচমকা শুভকে জোড়িয়ে ধরে ছোটবাচ্চাদের মত কাঁদতে শুরু করেছি আমি।”

কতক্ষণ এভাবে ছিলাম মনে নেই যখন শুভর মুখমুখি হলাম কেমন লজ্জায় শুভর মুখের দিকে তাকাতে পারিনি আমি।
এর মধ্যে বাইরে থেকে সাবরিনা ভাবীকে অস্থির হয়ে শুভ নিধি বলে ডাকতে শুনে শুভ আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল “ভাবী আমার বৌ এখন আমার জিম্মায়। তোমরা নিশ্চিন্তে নিজেদের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো”- বলে হাসি মুখে দুই হাত দুয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমায়। তারপর মুখটা ধরে আলতো করে কপালে শুভর ঠোঁট ছোঁয়ালো।
শুভর কথা শুনে দরজায় টোকা দিয়ে সাবরিনা ভাবী বাইরে থেকে হেসে বলল -“বৌকে সারাজীবন ধরে দেখো শুভ এখন একটু শ্বশুর শাশুড়িদের সাথে দেখা করে যাওয় দুজন। তারপর আর কেউ বিরক্ত করতে আসবে না।” বলে ভাবী চলে গেলো আর আমি শুভর বাহুডোরে আবদ্ধ হলাম।😊

————সমাপ্ত———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here