#স্পর্শতায়_তুমি
#পর্ব_০২
#অধির_রায়
“ছোঁয়া ভার্সিটি থেকে না গেলে হয় না৷ তুই না থাকলে আমরা কিভাবে অকারণে হাসবো? তোর হাসি আমাদের সকলের মন ছুঁয়ে যায়৷”
তিথি মুখ গোমড়া করে বলে উঠল। অর্পি তিথির কথা কেঁড়ে নিয়ে বলল,
“এখান থেকে চলে যাওয়ায় ভালো৷ এখানে থাকলে শুধু শুধু ছোঁয়া কষ্ট পাবে৷ এখানে না থাকাটায় ব্যাটার মনে হয়৷ আমরা আস্তে আস্তে তোর কথা ভুলে কষ্ট কমাতে পারব। কিন্তু তুই পারবি না ছোঁয়া৷”
তিথি কর্কশ কন্ঠে ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“দামিমাদের মতো কথা বলবি না অর্পি৷ তুই যদি আর একটা কথা বলিস তোকে লা’থি দিব৷ আমার সামনে কথা বলার চেষ্টা করবি না৷”
ছোঁয়া চোখের জল মুছে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়৷ ভেজা গলায় কষ্টমাখা কন্ঠে বলল,
“না তিথি। এখানে আমি থাকতে পারব না৷ আমি এখানে থাকলে ঋষি নিজের জীবনে এগিয়ে যেতে পারবে না৷ আমি চাইনা আমার জন্য ঋষি কষ্টে থাকুক৷ আমি তার কষ্ট… ”
তিথি ছোঁয়ার কথা শেষ করতে দিল না৷ ছোঁয়ার মুখের উপর বলে উঠল,
“একদম নাটক করবি না৷ সব ছেলেরা একই হয়৷ প্রথমে বড় বড় কথা বলে প্রেমের জালে ফাঁসায়৷ কাজের সময় লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়৷ এজন্য আমি ছেলেদের বিশ্বাস করিনা৷”
প্রকৃতি এবার নিরবতা ভেঙে চোখ পাকিয়ে রাগী গলায় বলল,
“তিথি আমার ভাইয়ের নামে একটাও বাজে কথা বলবি না৷ আমার ভাই ছোঁয়াকে মাঝ পথে রেখে চলে যায়নি৷ বরং ছোঁয়া আমার ভাইকে দুঃখের সাগরে রেখে চলে গেছে৷ আমি চিন্তায় করতে পারছি না তোদের চিন্তা ধারনা এতোটা নিম্ন৷”
“প্রকৃতি তোর কাছ থেকে শুনতে চাইনি তোর ভাই কেমন? আমি ভালো করেই জানি তোর ভাই কেমন! সবার চোখে পর্দা পরাতে পারলেও আমার চোখে সামান্য পরিমাণ পর্দা বসাতে পারবে না৷”
প্রকৃতির মন চাচ্ছে তিথির গায়ে ঠাসস ঠাসস করে ক’ষিয়ে কয়েকটা থা”প্প”ড় বসাতে। ছোঁয়ার উপর রাগ হচ্ছে৷ পাশে ছোঁয়া বসা৷ লা”থি দিয়ে বলতো ইচ্ছে করছে, ‘সত্য কথা সবার সামনে বলতে ভয় পাচ্ছিস। তোর জন্য আমার ভাই তোর পরিবারের সাথে দিনের পর দিন যুদ্ধ করে গেছে৷’ ছোঁয়া প্রকৃতির চোখে তাকিয়ে বুঝতে পারে সবটা৷ ছোঁয়া তিথির হাত ধরে বলল,
“তোরা সবাই ভুল ভাবছিস৷ ঋষি আমাকে পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করছে৷ আমার পরিবারের কাছে অনেক অপমানিত হয়েছে৷”
অর্পি দর্শকের মতো তাদের কথোপকথন শুনে যাচ্ছে৷ অর্পির মুখে কোন কথা নেই৷ তিথি মোবাইল রেখে বলল,
“কি এমন করছে তোর ঋষি? যার জন্য তুই আমাদের সাথে এমন ব্যবহার করছিস৷ প্রকৃতির ভাই হয় সেজন্য তার গায়ে গেলেছে৷ তোর গায়ে কেন লাগল?”
“বল কি করেনি? আমাকে পাওয়ার জন্য আমার বাবার পায়ে ধরে একটা বছর ভিক্ষা চেয়েছিল৷ আমার মায়ের কাছ থেকে একাধিক অপমান, থা”প্প”ড় খাওয়ার পরও আমাকে হারাবে বলে আমার বাবার পা ছাড়েনি৷ শুধু একটা বছর ভিক্ষা চেয়েছে৷ আমি কিভাবে তার অপমান সহ্য করব? আমি কিছুতেই অপমান মেনে নিতে পারিনি৷”
ছোঁয়া কোন কথা না বাড়িয়ে নিজের ব্যাগ নিয়ে সেখানের প্রস্থান ত্যাগ করে। পিছন থেকে অর্পি ডেকে যাচ্ছে৷ অর্পির কথা প্রকৃতির কান অব্ধি পৌঁছালেও প্রকৃতি সেখানে দাঁড়ায়নি৷ প্রকৃতি দৌড়ে গেইটের কাছে আসে৷ চোখের জল মুছে রিক্সা নেয়৷ রিক্সা করে বাড়িতে ফিরে আসে৷ কোন বোনই তার ভাইয়ের অপমান সহ্য করতে পারে না৷ সেখানে থাকলে তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীদের কথা সহ্য করতে পারবে না৷ সেজন্য প্রকৃতি সেখান থেকে চলে আসা৷
ঋষি দুইদিন আর রুম থেকে বের হয়নি৷ আজ রাতে খাবারের জন্য নিচে নামে৷ ঋষিকে দেখে প্রকৃতির চোখে জল টলমল করতে লাগল৷ ঋষির চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে৷ যে ছেলে নিজের স্কিন মেয়েদের মতো যত্ন নিতো৷ আজ তার এমন অবস্থা৷ চোখ দু’টো লাল রক্ত বর্ণের মতো৷ ঋষির এমন অবস্থা দেখে ঋষির বাবা মুখের খাবার শেষ করে বলল,
“ঋষি তোমার এমন অবস্থা কেন? তুমি কি নেশা জাতীয় কোন দ্রব্য সেবণ করো?”
ঋষি ছলছল চোখে কষ্ট লুকিয়ে রেখে বলল,
“না বাবা। মাথা ব্যথার জন্য রাতে ঘুমাতে পারিনি৷ দিনে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম৷ ঘুম চোখের পাতায় আসলো না৷ সেজন্য চোখ লাল দেখাচ্ছে৷ শাওয়ার নিলে ঠিক হয়ে যাবে৷”
ঋষির মা পরোটা দিতে দিতে বলল,
“আমাদের কাছ থেকে কি লুকাচ্ছিস? দুই দিন হলো খাবার টেবিলে আসিস নি৷ রুমের দরজা লাগিয়ে রেখেছিস৷ আমি তোর রুমের দরজা নক করলেও খুলিস নি৷ কি হয়েছে?”
ঋষি কিছু বলার আগেই প্রকৃতি বলল,
“মা ভাইয়ের কিছু হয়নি৷ আমি তাদের ডিয়ার দিয়েছিলাম সে যেন দুই দিন রুম থেকে না বের হয়৷ আর দুইদিন তোমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না৷”
ঋষির বোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাঁসার চেষ্টা করল৷ কিন্তু হাসিটা বের হলো না৷ দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করল। প্রকৃতি ভাইয়ের হাতে হাত রাখে৷ চোখের ইশারায় বুঝিয়ে বলে, ‘আমি থাকতে তোকে কষ্ট পেতো দিব না৷ আমি সব সময় তোর পাশে আছি৷”
খাবারের পর প্রকৃতি ঋষির রুমে আসে৷ সমস্ত রুম অন্ধকার৷ ঋষি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে৷ প্রকৃতি ধীর পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়৷ সিগারেট ধোঁয়া সহ্য করতে না পেরে প্রকৃতির কাশি হয়৷ পিছন ফিরে প্রকৃতিকে দেখে ঋষি সিগারেট হাত থেকে ফেলে দেয়৷ রুমে এসে তাড়াতাড়ি ফ্যান অন করে৷ ফ্যানের বাতাসে নিকোটিনের ধোঁয়া তাড়াতাড়ি উধাও হয়ে যাবে৷
প্রকৃতি কাশতে কাশতে বলল,
“ভাইয়া তুই সিগারেট খাচ্ছিস৷ তোর এমন অধপাতন আমি দেখতে পারব না৷”
ঋষি প্রকৃতির কথায় রেগে ছেলে৷ ভারী গলায় বলল,
“তুই আমার রুমে কেন? এখনই বেরিয়ে যা রুম থেকে৷ কারোর রুমে ঢুকতে হলে পারমিশন লাগে, সে জ্ঞান টুকু হারিয়ে ফেলেছিস৷”
“তুই অন্যের রাগ আমার উপর দেখাতে আসবি না৷ তুই যদি সিগারেট খেতে পারিস৷ আমিও আজ থেকে সিগারেট খাবো৷”
প্রকৃতির কথা শুনে ঋষির মাথায় রক্ত চেপে বসে৷ প্রকৃতির গালে কষিয়ে একটা থা”প্প”ড় বসিয়ে দেয়৷ প্রকৃতির ফর্সা গাল মুহুর্তের মাঝেই লাল বর্ণ ধারণ করে৷ প্রকৃতি কান্না করতে করতে বলল,
“শুধু তোর একার কষ্ট হচ্ছে৷ আমার কোন কষ্ট হচ্ছে না৷ তোকে আমি এমন অবস্থায় দেখতে পারব না৷ তুই ছোঁয়াকে ভুলে যা৷”
“যাকে একবার মন থেকে ভালোবাসা যায় তাকে হাজার চেষ্টা করেও ভুলা যায় না৷ আমি তাকে কখনই ভুলতে পারব না৷ আমার পক্ষে ছোঁয়াকে ভুলা সম্ভব নয়৷”
প্রকৃতি কি বলবে বুঝতে পারছে না? প্রকৃতি জানে ভালোবাসার মানুষকে ভুলা সহজ নয়৷ ভালোবাসার মানুষ যতই কষ্ট দেখ কখনও তাকে শাস্তি দেওয়া যায় না৷ তাকে সেখানে ভুলে যাওয়া অসম্ভব৷ ছোঁয়ার নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলল,
“তোর জন্য ছোঁয়া ভালো নেই৷ ছোঁয়া তোর জন্য কষ্ট পাচ্ছে৷ তুই যত নিজেকে কষ্ট দিবি ছোঁয়া ততই কষ্ট পাবে৷ তুই ছোঁয়ার জন্য হলেও নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা কর।”
“আমার জন্য ছোয়া কেন কষ্ট পাবে? আমার সমস্ত সুখ তোর নামে লিখি দিছি৷”
“তোর যেমন কষ্ট হচ্ছে ছোঁয়ারও তেমন কষ্ট হচ্ছে৷ তোর এমন অবস্থার জন্য ছোঁয়া নিজেকে দায়ী করছে৷ সেজন্য ছোঁয়া নিজের জীবনে এগিয়ে যেতে পারছে না৷ তুই যদি নিজের জীবনে এগিয়ে যেতে পারিস তাহলে ছোঁয়া নিজের জীবনে এগিয়ে যাবে৷”
“আমাকে নীতির বাক্য না বলে তোর রুমে যা৷ অনেক রাত হয়েছে৷ আমি এখন ঘুমাবো৷”
ঋষি প্রকৃতিকে এক প্রকার টেনে রুম থেকে বের করে দেয়৷ দুইটা ঘুমের মেডিসিন খেয়ে ফোনের ওয়ালপেপারে ছোঁয়ার পিক দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে৷
এভাবে কেটে যায় এক মাস৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলেও সবটাই স্বাভাবিক। ছোঁয়া ভার্সিটিতে আসে না৷ পরীক্ষার সময় হলে শুধু পরীক্ষা দিবে৷ ফোনে কথা হয়রেগুলার৷ ছোঁয়া শ্বশুর শ্বাশুড়ি নিয়ে খুব ভালো আছে৷ প্রকৃতি, অর্পি আর তিথি পিছনে বসে প্রকৃতি মেসেঞ্জারে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছে৷ স্যারদের নামে যত বাজে কথা আছে সব বলছে৷ হুট করেই প্রকৃতি উচ্চ স্বরে হেঁসে ফেলে৷ স্যার প্রকৃতির সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রকৃতির সেদিকে খেয়াল নেই৷ এক ধ্যানে ফোন চালিয়ে যাচ্ছে৷ স্যার প্রকৃতির ফোন কেঁড়ে নেয়৷ প্রকৃতি উপরের দিকে তাকিয়ে স্যারকে দেখেই কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে। প্রকৃতি কিছু বলার আগেই পুষ্প স্যার রাগী গলায় বলে উঠল,
“ক্লাস শেষে ফোন নিয়ে যাবে৷ ততক্ষণ ফোনটা আমার কাছে থাকবে৷”
ভার্সিটির সবথেকে রাগী ভয়ংকর স্যার পুষ্প স্যার৷ পুষ্প স্যার ছাত্র ছাত্রীদের আতঙ্কের অপর নাম। গায়ের রং কিছুটা চাপা। যাকে উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের অধিকারী বললেও ভুল হবে না৷ মুখে সব সময় খুঁচা খুঁচা দাঁড়ি স্টাইল করে রাখে৷ ভার্সিটিতে একমাত্র অবিবাহিত স্যার উনি৷ ভার্সিটির রুলসের ব্যপারে ভীষণ সিরিয়াস। ইনকোর্স পরীক্ষা না দিলে ফেল করিয়ে দেয়৷ ছাত্র ছাত্রী পারেনা তাকে পিটাতে৷ মাঝে মাঝে মন বলে পিটিয়ে ভার্সিটির কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে ঝুঁলিয়ে রাখতে৷
ক্লাস শেষে সবাই চলে যায়৷ প্রকৃতির জন্য ক্যাফেডিয়ামে অপেক্ষা করছে তিথি অর্পি৷ ধীর পায়ে প্রকৃতি পুষ্প স্যারের সামনে যায়৷ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“স্যার আমার ফোনটা দেন৷ আমি বাসায় যাব।”
পুষ্প স্যার ছোঁয়ার দিকে না তাকিয়ে বলল,
“ক্লাসে ফোন ইউস করা নিষেধ থাকার সত্ত্বেও ইউস করার কারণ কি? সারাদিন মেসেঞ্জারে মেসেজ আসতেই থাকে৷ অল টাইম ফেসবুকে মুখ লুকিয়ে থাকো তা পরীক্ষা খাতা প্রমাণ দিচ্ছে৷”
প্রকৃতি জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। ভয়ে ভয়ে ভেজা বিড়ালের মতো বলল,
“স্যার এমন ভুল আর হবে না৷ প্লিজ আমাকে এভাবের জন্য ফোনটা দিয়ে দেন৷”
স্যার প্যান্টের পকেট থেকে প্রকৃতির মোবাইল বের করে৷ মোবাইল প্রকৃতির হাতে দিবে তার আগেই ফোন আবার নিজের কাছে নিয়ে আসে৷ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
“ফোনের পাসওয়ার্ড কি? আমিও দেখি কার সাথে সারাদিন কথা বলো।”
প্রকৃতির মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে৷ স্যারকে নিয়ে কতই না খা’রা’প কথা বলেছে৷ কিভাবে স্যারকে ফোনের পাসওয়ার্ড দিবে৷ প্রকৃতি আবারও বলে উঠল,
“স্যার আমি ফোনের পাসওয়ার্ড ভুলে গেছি৷ দেন আমি খুলে দিচ্ছি৷”
স্যার মুচকি হেঁসে বলল,
“মিথ্যা কথাও গুছিয়ে বলতে পারো না৷ পাসওয়ার্ড ভুললে তুমি কিভাবে খুলবে?”
প্রকৃতি জিহ্বায় কামড় দিয়ে,
“না মানে,.. আসলে স্যার আমি পাসওয়ার্ড বলতে পারব না৷”
রাগী গলায় বলল,
“ফোনের পাসওয়ার্ড বলো। না হলে বলে দিব তুমি ছেলেদের সাথে রিক্সায় ঘুরে বেড়াও৷”
প্রকৃতি মিহি কন্ঠে বলল,
“স্যার মেবাইল দেন আমি খুলে দিচ্ছি।”
“তুমি মুখে বলো। আমি খুলছি।”
K’U’T’TA’R’ B’A’C’C’A
স্যার মুহূর্তের মাঝে চিকত হয়ে প্রকৃতির দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন৷ ক্ষোভ নিয়ে বললেন,
“হোয়াট?”
“স্যার আপনাকে বলিনি৷ ফোনের পাসওয়ার্ড বলেছি৷”
“আই নো। তুমি আমাকে বলোনি৷ কিন্তু একজন সুস্থ মানুষের ফোনের পাসওয়ার্ড কখনও এমন হতে পারে না৷”
চলবে….
ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।