#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৮|
পদ্ম আজ সকাল থেকেই এদিক ওদিক ঘুরছে। তার যেন আজ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কিছু একটা করতে মন চায়ছে। কিন্তু করবে টা কী সে? রুবি হোসেন তো তাকে কোনো কাজই করতে দেন না। এইভাবে আর কত বসে বসে খাবে? শরীরে তো জং ধরে যাচ্ছে। পদ্ম তাই সিদ্ধান্ত নিল, আজ কিছু একটা করবে সে।
কিছুদিন ধরে তার মন মেজাজ খুব ভালো। আকবর সাহেব সত্যিই নিজেকে বদলে নিয়েছেন। তিনি আর পদ্ম’র দিকে অমন করে তাকান না। খুব প্রয়োজন না পড়লে পদ্ম’র সাথে তেমন একটা কথাও বলেন না। পদ্ম খুশি তাতে। সে যেন এখন প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। অবশ্য তার এই মন ভালো রাখার পেছনে আরেক জনের ও বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি হলেন, “আরাফাত”। আজকাল তার সাথে পদ্ম’র প্রায়ই কথা হচ্ছে। সময়ে অসময়ে দুজনেই মেতে উঠছে ফোনালাপে। আরাফাতের সাথে কথা বললে পদ্ম ভীষণ শান্তি পায়। মানুষটা তাকে বোঝে, তাকে বোঝায়। দুজনের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে বটে।
.
.
পদ্ম রুবি হোসেনের দরজায় নক করে বললো,
‘বড়ো মা, আসবো?’
‘হ্যাঁ পদ্ম, এসো।’
পদ্ম রুমের ভেতরে গেল। রুবি হোসেন চোখে চশমা এঁটে বই পড়ছিলেন। পদ্ম-কে দেখে চশমা নামিয়ে বললেন,
‘কিছু বলবে?’
পদ্ম অসহায় মুখে উনার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘বড়ো মা, আমার না আর এইভাবে বসে বসে খেতে ভালো লাগছে না। আমাকে কিছু কাজ দাও। যেকোনো কিছু। এত অবসর সারাদিন থাকা যায় বলো? আমি খুব বোর হচ্ছি, বড়ো মা।’
‘এক কাজ করো, আরাফাতকে নিয়ে বাইরে থেকে একটু ঘুরে এসো, দেখো সমস্ত বোরিংনেস কেটে যাবে।’
‘ধ্যাত, তুমি যে কী বল। আমি এত ঘুরাঘুরি করতে পারবো না। তার চেয়ে বরং আমি আজ একটু পুরো বাড়িটা পরিষ্কার করি, কী বলো?’
‘আরে মেয়ে, এসব করার জন্য তো খালা আছেই। তুমি কেন এসব করতে যাবে বলতো?’
‘প্লীজ বড়ো মা, এমন করো না। করি না একটু কাজ, কী হবে তাতে?’
রুবি হোসেন কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,
‘ঠিক আছে বাবা, করো গিয়ে পরিষ্কার।’
পদ্ম খুশিতে গদগদ হয়ে গলায় বললো,
‘থ্যাংক ইউ, বড়ো মা।’
যদিও পুরো বাড়ি যথেষ্ঠ পরিষ্কার তাও পদ্ম কোমরে ওড়না বেঁধে তার কাজে নেমে পড়লো। এই কাজটা তার ভীষণ পছন্দের। সবকিছু নিজের হাতে পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখার মাঝে একটা প্রশান্তি আছে।
পদ্ম একটা কাপড় নিয়ে সব রুমের আসবাবপত্র গুলো ভালো ভাবে মুছল। তারপর বিভিন্ন জায়গায় রাখা শো-পিস গুলোও ভালো ভাবে পরিষ্কার করলো। দেয়ালে টানানো ছবিগুলো মুছল। ড্রেসিং টেবিলের আয়না’টা পরিষ্কার করে সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ঢং করলো। তারপর সে গেল আদিদের রুমের কাছে। এই রুম পরিষ্কার করার কোনো উপায় নেই। বাইরে থেকে লক করা। আদিদ আসলেই কেবল এই লক খোলা হয়। অন্যথায় এখানে হরহামেশাই এই লক বিদ্যমান থাকে। পদ্ম ঠোঁট উল্টে লিভিং রুমে চলে গেল। সেখানের কিছু সাফ সাফাই করে সে গেল ডাইনিং রুমে। ডাইনিং টা খুব ভালো ভাবে পরিষ্কার করলো সে। ড্রয়িং রুমের সোফাগুলোও মুছল। এদিকের সব কাজ শেষে সে রুবি হোসেনের রুমে গেল। রুবি হোসেন তাকে দেখে বললো,
‘আমার রুম পরিষ্কার করতে হবে না, পদ্ম। তুমি বাকি রুমগুলো পরিষ্কার করো।’
পদ্ম বললো,
‘কিন্তু ওগুলো তো শেষ। আর কী পরিষ্কার করা যায়…উমম।’
ভাবতে ভাবতেই পদ্ম’র হঠাৎ মনে পড়ল, ছাদের রুমটা তো খুব অপরিষ্কার। এত অপরিষ্কার যে বাইরে থেকেও খুব বাজে গন্ধ টের পাওয়া যায়। ঐ রুম’টা পরিষ্কার করলে কেমন হয়? পদ্ম কিছু না বলে রুবি হোসেনের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রুবি হোসেনও ব্যাপারটায় এত পাত্তা না দিয়ে নিজের বই পড়ায় আবার মনোযোগ দিলেন।
পদ্ম একটা ঝাড়ু আর কিছু কাপড় নিয়ে ছাদে উঠে গেল। সেই রুম’টার কাছে গিয়ে দেখল সেটা তালা দেওয়া। ধুর, এটার চাবি এখন আবার কই পাবে সে। বড়ো মা’র কাছে চাইলে বড়ো মা জীবনেও দিবে না সেটা সে জানে। উল্টো বলবে, ঐ রুম তোমার পরিষ্কার করতে হবে না, ঐখানে কেউ যায় না, অযথা কষ্ট করার কোনো দরকার নেই। পদ্ম তাই ঠিক করলো সে বড়ো মা’র কাছে আর যাবে না। বরং রুম’টা একেবারে সুন্দর করে গুছিয়ে তারপর বড়ো মা’কে এনে সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এখন আগে তাকে এই তালা খুলতে হবে। আর তার মাথায় যে ক্লিপ আছে সেটা দিয়ে সে ইজিলি এই তালা খুলতে পারবে। এর আগেও এইভাবে সে অনেক তালা খুলেছে। এটা তার জন্য কোনো ব্যাপারই না। যেই ভাবা সেই ভাব। ফট করে মাথা থেকে চিকন ক্লিপ’টা খুলে তালার ভেতর ঢুকালো সে। তারপর খুব কৌশলে তালার প্যাঁচ ভাঙতে লাগল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শেষ পর্যন্ত গিয়ে সফল হতে পারলো না সে। পুরোনো তালা, জং ধরে আছে। এই তালা এইভাবে খোলা যাবে না। তাও পদ্ম আরো দুবার চেষ্টা করলো। কিন্ত, পারলো না। পদ্ম তাই বিরক্ত হয়ে তালা’টা ধরে দু একবার জোরে টান দিল। সে মনে মনে ভাবল, না সে আর হয়তো তার পরিকল্পনা সফল করতে পারবে না। কিন্তু, হয়তো সৃষ্টিকর্তা এখানে অন্যকিছু ভেবে রেখেছেন। পদ্ম চমকে গেল, যখন সে দেখল যে তালা’টা খুলে গিয়েছে। পদ্ম’র মুখে হাসি ফুটে উঠল। তালা’টা এত পুরোনো ছিল যে দু একবার টানা টানিতেই সেটা খুলে গিয়েছে। যাক ভালোই হয়েছে, এবার সে কোমর বেঁধে তার কাজে নামতে পারবে।
পদ্ম আস্তে করে রুমের ভেতর উঁকি দিল। ইশ, কী বিচ্ছিরি গন্ধ। নির্ঘাত ইঁদুর টিঁদুর মরে টরে পড়ে আছে। কেমন উটকো একটা গন্ধ। পদ্ম’র গা যেন গুলিয়ে উঠছে। সে তার ওড়না’টা নাকে মুখে বেঁধে নিল। তারপর ঝাড়ু’টা নিয়ে রুমের ভেতর ঢুকল। রুমে আলো নেই। আর অন্ধকারে কিছু দেখাও যাচ্ছে না। সে রুমের দেয়াল হাতড়ে সুইচ খুঁজে চলছে। অনেকক্ষণ খোঁজার পর হয়তো এবার পেল সে। সেখানে চাপ দিতেই ঢিম ঢিম আলোয় একটা লাইট জ্বলে উঠল। পদ্ম এবার বড়ো বড়ো চোখে তাকাল। রুম’টা তো বেশ বড়ো। কিন্তু এত ময়লা হয়ে আছে চারদিক যে এইখানে কী কী আছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। পদ্ম ঝাড়ু’টা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক ঝাড়তে লাগল। অনেক্ষণ ঝেড়ে ঝুড়েও কিছুই তেমন পরিষ্কার করতে পারলো না সে। না, তার একার পক্ষে এটা সম্ভব ও না। খালাকে ডাকতে হবে, দুজনে মিলে করলে খুব তাড়াতাড়ি হবে কাজ’টা। এইভেবে পদ্ম নিচে নেমে গেল। রান্নাঘরে খালা কাজ করছিলেন। পদ্ম তাকে গিয়ে বললো,
‘খালা, আমার একটু সাহায্য লাগবে।’
খালা গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন,
‘কী সাহায্য?’
‘আসলে, আমি ঐ ছাদের রুম’টা পরিষ্কার করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রুমে প্রচুর ময়লা, আমার একার পক্ষে ঐ রুম পরিষ্কার করা সম্ভব না। তাই তুমিও চলো না প্লীজ, আমাকে একটু সাহায্য করবে।’
খালা যেন ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেন। ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন,
‘ছাদের রুম? ঐ তালা দেয়া রুম’ডা?’
‘হ্যাঁ খালা, ঐটাই।’
খালা যেন এবার আঁতকে উঠলেন।
‘এইডা কী করসো, মাইয়া? তুমি কি খালাম্মার অনুমতি নিসো? খালাম্মার অনুমতি না নিয়ে এই কাজ করে থাকলে, তুমি শেষ। খালাম্মা জানে মাইরা ফেলবো তোমারে।’
পদ্ম যেন বোকা বনে গেল। সে হা করে তাকিয়ে বললো,
‘এসব কী বলছো, খালা? একটা সামান্য রুম খোলায়, বড়ো মা আমাকে মারতে যাবে কেন? তুমি যে কী বলো না।’
খালা ভীষণ আফসোসের সুরে তখন বললেন,
‘তোমার বোধ হয় নিজের জানের মায়া নাই। তাই তো এসব করতাছো। মাইয়া, সময় থাকতে চুপচাপ ঐ রুম আটকায় দিয়া আইসা চুপচাপ বইসা থাকো। কাউরে কিছু বলার দরকার নাই। যাও যাও, আমি যেডা কইছি ঐডা করো। নয়তো বাঁচতে পারবা না।’
পদ্ম’র এবার খটকা লাগে। খালা নিশ্চয়ই এমনি এমনি এসব বলছেন না, উনার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি নিশ্চয়ই মারাত্মক কিছু জানেন। যার জন্য উনি এমন করছেন। কিন্তু, ঐ রুমে কী এমন আছে যার জন্য খালা এমন করছেন? বড়ো মা জানলে কী হবে? ঐ রুমে দরজা খোলা নিষেধ কেন? ঐটা কি খুব স্পেশাল রুম? পদ্ম ভেবে পায় না। তবে এইটুকু বুঝে কিছু একটা রহস্য তো আছেই। আর সেটা তাকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। আপাতত সে খালার কথামতো চুপচাপ গিয়ে রুম’টা আটকে দিয়ে চলে এলো। এখন না, সময় আর সুযোগ মতে ঐ রুমের রহস্য উদ্ঘাটন করবে সে…
চলবে…