#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২৭|
পদ্ম সহ সবাইকে নিয়ে হসপিটালে ভর্তি করা হলো। তারপর অফিসার অভিকে কল দিয়ে সবকিছু জানাল। কিন্তু থানায় অভি এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বললো না। আদিদকেও না। সে একটু আড়ালে গিয়ে অফিসারকে আবার কল করে বললো,
‘অফিসার, আপনি দেরি করবেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনি পদ্ম’র জবানবন্দী নিন। এখন ও মুখ খুললেই এই কেইসের সমস্ত ধোঁয়াশা দূর হবে। আর আমি এইদিকে কাউকে কিছু জানাইনি। আগে আপনি ওর জবানবন্দী নিন, তারপর আমি ব্যাপারটা সবাই কে জানাবো।’
‘ঠিক আছে, ডক্টরের চেক আপ শেষ হোক। তারপর দেখছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ওদের সবার জবানবন্দী নিব।’
থানা থেকে সুজানার মা বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এই মানুষ দুটো পুরোটা সময় নিস্তব্ধ ছিলেন। উনাদের আশে পাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে দেখা যায়নি উনাদের। রুমের এক কোণে বসে পুরোটা সময় শুধু তপ্ত শ্বাস ছেড়ে গেছেন।
সুজানার মা বাবা চলে যেতেই আকবর সাহেব গর্জে উঠলেন। সবাইকে যেতে দেওয়া হচ্ছে শুধু তাদেরই কেন বসিয়ে রেখেছে। এইভাবে আর কতক্ষণ? আরেকটু পর তো ভোর হবে। উনি চেঁচামেচি করে পুরো থানা গরম করে তুলছেন। উনার চেঁচামেচি শুনে রুবি হোসেন গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আদিদ বিরক্ত হচ্ছে খুব। সে চোখ মুখ কুঁচকে চেয়ারে থ মেরে বসে আছে। রুবি হোসেন এসে বললেন,
‘আমাদের কি আজকে বাড়ি যেতে দিবে না? আর কতক্ষণ?’
আদিদ বিরক্ত গলায় বললো,
‘জানি না মা।’
রুবি হোসেন রেগে বললেন,
‘কী জানো না। কই তোমার ঐ বন্ধু কোথায়? যত ঝামেলা তো ওর জন্যই লেগেছে। অবশ্য তুমিও তার সাথে সমান দায়ী। কী দরকার ছিল, ঐ রুম থেকে এত কিছু বের করার? এখন ভালো লাগছে এই ভাবে থানায় বসে থাকতে?’
আদিদ অবাক গলায় বললো,
‘মা, কী বলছো এসব? ঐ রুমে একটা মানুষের ক*ঙ্কা*ল ছিল। আর তুমি বলছো, কী দরকার ছিল এসব বের করার? তুমি কি বুঝতে পারছো মা, তুমি কী বলছো? আমি ঐ রুমে না গেলে তো ঐ ক*ঙ্কা*ল টা আজীবন সেখানেই পরে থাকতো। একটা মানুষের ক*ঙ্কা*ল আমাদের বাড়িতে পরে থাকতো আর আমরা সেটা কখনো জানতেই পারতাম না। কী আশ্চর্যজনক ব্যাপার! আর এত কিছুর পরও তুমি বলছো, আমার আর অভির দোষ? আমাদের উচিত হয়নি এসব ঐ রুম থেকে বের করা, তাই তো? কেন মা, কেন তোমার এমনটা মনে হচ্ছে? আচ্ছা মা, আমাকে সত্যি করে বলতো, ঐ ক*ঙ্কা*ল টা কী করে ঐ রুমে এলো? ঐটা কার ক*ঙ্কা*ল মা?’
রুবি হোসেন নাক মুখ ফুলিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,
‘আমি কী করে জানবো? এখন ঐ অভির মতো তুমিও আমাদের সন্দেহ করছো?’
‘সন্দেহ করতে তো তোমরাই বাধ্য করছো। আচ্ছা, এটা বাদ দাও। পদ্ম’র কথা বলো, উনার সাথে কী হয়েছে? তুমি কার সাথে উনার বিয়ে দিয়েছো? তুমি কি তাকে চেনো?’
‘আরে বাবা, এই বিয়ে তো তোমার বাবার এক কলিগ এনেছিলেন। আমাদের বলেছিলেন, একটা ভালো ছেলে আছে যে কিনা বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছে। তার খুব সাধারণ একটা মেয়ে লাগবে। বাড়ি গাড়ি কিছুই চায়না, শুধু মেয়ে ভালো হলেই চলবে। তো তখন তোমার বাবা উনাদের পদ্ম’র কথা বললেন। তারপর ছেলের মা আমার সাথে কথা হলো। আর তারপর তো আমি পদ্ম’র সাথেও ছেলের কথা বলিয়ে দিই। ওর ও তো ছেলে খুব পছন্দ হয়েছিল। নিজের ইচ্ছায় ও এই বিয়েটা করেছে। আমরা কেউ ওকে জোর করেছি নাকি? তাহলে এখন ওর দায়ভার আমরা কেন নিব?’
‘অবশ্যই নিতে হবে। কারণ, বিয়েটা আপনারাই দিয়েছেন। কোনো কিছু না ভেবে, দেখে না ভেবে হুট করেই উনাকে আপনারা বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এখন যদি উনার কিছু হয় তবে তার খেসারত আপনাদেরই দিতে হবে।’
অভির কথা শুনে রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে যেন। আকবর সাহেব অভির উপর কিছুক্ষণ খুব চেঁচালেন। এক পর্যায়ে হুমকিও দিলেন। বললেন, উনি চাইলে দুই মিনিটেই অভির চাকরি খেয়ে দিতে পারেন। শুধুমাত্র সে আদিদের বন্ধু বলে উনি তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। নয়তো, কখনোই ছাড়তেন না।
উনার কথা শুনে অভি ভীষণ মজা পেল। যেন এর চেয়ে হাস্যকর আর কিছু হতে পারেনা। রুবি হোসেন আর আকবর সাহেবকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে অভি বললো,
‘একটা কথা জানেন তো, সত্যকে কোনোদিন ধামা চাপা দিয়ে রাখা যায় না। একদিন না একদিন সত্য ঠিকই বেরিয়ে আসবে। আর তখনের সেই তিক্ত সত্যটাকে হজম করতে কিন্ত খুব কষ্ট হবে। তাই সময় থাকতে, সত্যকে সহজ ভাবে প্রকাশ করে ফেলুন। তাতে আপনাদেরই লাভ।’
আকবর সাহেব দাঁত চিবিয়ে বললেন,
‘বলেছি তো, আমরা কিছু জানি না।’
অভি হেসে বললো,
‘আমি জানি। অনেক কিছু জানি। সময় আসলে অবশ্যই আমি আপনাদের সবকিছু জানাবো। অপেক্ষায় থাকুন।’
আদিদ আর এসব সহ্য করতে পারলো না। সে উঠে বাইরে চলে গেল। আদিদ চলে যাওয়ার অভি আবার বললো,
‘আপনাদের ছেলে আপনাদের খুব ভালোবাসে। এত কিছুর পরও কিন্তু সে আপনাদের উপর থেকে ভরসা হারায়নি? এখন ভাবুন তো, যখন ও সবটা সত্যি জানবে, তখন ওর কেমন লাগবে? মেনে নিতে পারবে? উঁহু, কখনোই পারবে না।’
কথাটা বলে অভিও বেরিয়ে গেল।
.
ভোর হতে চলছে। পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গিয়েছে। আরেকটা নতুন দিনের সূচনা। পূর্ব দিকে সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে। এই সময় রাস্তায় কেউ নেই বললেই চলে। দু এক জন যারা আছেন তারা ব্যস্ত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন।
রাস্তার এক পাশে ফুটপাতের উপর আদিদ বসে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এখনও কেন আকাশ টা রোদে ঝলমল করছে না। কেন সূর্যটা তার তীক্ষ্ণ রোদে সবকিছু ঝলসে দিচ্ছে না। এই অন্ধকার যে আর ভালো লাগছে না। কবে সবকিছু আলোকিত হবে? কবে এই আঁধার কাটবে? কবে তার জীবনে শান্তি আসবে…কবে?
আদিদের ফোনটা বাজছে। কিন্তু সে ঠিক করলো সে কল রিসিভ করবে না। আর এইসব সহ্য হচ্ছে না। যখনই নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলে তখনই তাকে আবার এলোমেলো করার জন্য এসব ঘটনা ঘটে। সুজানা চলে গিয়েছে, হারিয়ে গিয়েছে, মেনে নিয়েছিল তো সে। একটা আশায় নিজেকে তো বাঁচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু, সেই আশাটা কেও এইভাবে ভেঙ্গে দিতে হলো? খুব কি দরকার ছিল এসবের? কেন…কেন ঐ ক*ঙ্কা*ল টা সে খুঁজে পেল? কেন?
আদিদ সাইড থেকে ছোট একটা পাথর নিয়ে রাগে সেটা সামনের রাস্তার উপর ছুঁড়ে মারে। তারপর উঠে দাঁড়ায় সে। অভির কলটা রিসিভ করে বজ্র কন্ঠে বলে উঠে,
‘কী সমস্যা, এত কল দিচ্ছিস কেন?’
‘কোথায় তুই?’
‘আছি কোথাও। কী হয়েছে সেটা বল?’
‘তোর হসপিটালে আয়। আমরা সেখানেই আছি। আর পদ্ম-কে ও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। তুই আয় তাড়াতাড়ি।’
আদিদ কল কেটে দিয়ে মনে মনে ভাবল, “ইশ, যদি কেউ এইভাবেই কল দিয়ে বলতো, সুজানাকেও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে..”
.
.
হসপিটালে গিয়ে আদিদ অবাক হলো। দু তালার বড়ো কেবিন’টার ভেতর অনেকগুলো মেয়ে। আর সেই রুমের ডান দিকের বেড’টাতে পদ্ম শুয়ে আছে। তার স্যালাইন চলছে। এতগুলো মেয়েকে দেখে আদিদের অদ্ভুত লাগে। অভি এসে বলে,
‘এদের সবাই কে পুলিশ উদ্ধার করেছেন।’
আদিদ ব্রু কুঁচকে বলে,
‘উদ্ধার করেছে মানে?’
‘মানে ওদের কেউ পা*চা*র করতে চেয়েছিল। ট্রাক দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়’ই ওদের পুলিশ আটকে ফেলে। সেই পাচারকারী কে অবশ্য এখনও পায়নি। তবে…’
‘তবে কী?’
অভি তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
‘তবে পদ্ম তার জবানবন্দী তে বলেছে এই সব কিছুর জন্য তোর মা বাবা দায়ী।’
‘কী!’
আদিদ চোখ বুজে জোরে নিশ্বাস ফেলে। তারপর চাপা স্বরে বলে,
‘মা বাবা কোথায়?’
চলবে…