পদ্মফুল #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা |৪৩|

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪৩|

পাঁচ বছর পর দেশের মাটিতে আবার পা রাখল আদিদ। সেই চেনা মাটির ঘ্রাণ, বাতাসে মিষ্টি ফুলের সুবাস আর ভেজা পাতার উটকো গন্ধ, এই সবকিছুই যেন আবার তার শরীরে শিহরণ জাগাচ্ছে। এই তো সেদিন সে এখান থেকে বিদায় হয়েছিল। আজ আবার ফিরে এসেছে সেই প্রিয় জায়গায়..

আদিদ কে রিসিভ করতে অভি আর নিঝুম এসেছে। দুপুর তিন’টায় আদিদের এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার কথা। কিন্তু মালপত্র সব গুছিয়ে বের হতে হতে তার বাজল পাঁচ’টা। আদিদ এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই অভি কে দেখল। অভি এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আদিদও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অনেকক্ষণ দুই বন্ধু ওভাবেই ছিল। তারপর আদিদ অভি কে ছেড়ে নিঝুমের সাথে কথা বললো। তার কোল থেকে নিশা কে নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ আদর করলো সে। তারপর সেখান থেকে সবাই একটা রেস্টোরন্টে গেল দুপুরের খাওয়া দাওয়া করতে।
অভি আর আদিদ অনেক গল্প করছে। এতদিনের জমানো অনেক কথা আজ মন খুলে দু’জন দু’জনকে বলতে পারছে। তাদের কথার মাঝেই আদিদ অভি কে পদ্ম’র কথা জিজ্ঞেস করলো। অভি তাকে আশ্বস্ত করে বললো,

‘পদ্ম ভালো আছে। ওর নিজের একটা ছোট্ট বিজনেস আছে আর তাছাড়া আমার একটা কাজিনের পাঠশালাতে ও শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত।’

আদিদ ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘এখন কোথায় থাকে ও?’

‘আলাদা একটা বাসায় থাকে। ওর সাথে রাণী ও থাকে।’

আদিদ তখন অবাক কন্ঠে বলে,

‘রাণী? তোর আশ্রমের ঐ বাচ্চা মেয়েটা?’

‘হ্যাঁ।’

আদিদ হেসে বলে,

‘মেয়েটা নিশ্চয়ই এখন খুব বড়ো হয়ে গেছে। এখনও কি আগের মতো চঞ্চল আছে নাকি বদলেছে কিছুটা?’

অভিও হেসে বললো,

‘আগের মতো নেই, পদ্ম’র টাইটে এখন কিছুটা মানুষ হয়েছে। আগে তো একটা বাদর ছিল।’

তারপর তারা আরো অনেক কথা বললো। সাথে খাওয়া দাওয়াও করলো। সন্ধ্যার দিকে সকলে সেখান থেকে রওনা দিল। অভি আদিদ কে অনেকবার জোরাজুরি করছিল আজকের রাত টা অন্তত তার বাড়িতে থাকার জন্য। কিন্তু আদিদ রাজি হলো না। সে অভি কে বিদায় জানিয়ে তার হসপিটালে চলে এল। হসপিটালের সবাই আগে থেকেই জানতো যে আদিদ আসছে। তাই সবাই ফুলের তোড়া নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছিল আদিদের জন্য। আদিদ সেখানে গেলে সবাই তাকে সাদরে গ্রহণ করলো। অনেকগুলো দিন পর প্রিয় একটা জায়গায় আবার এসেছে সে। হসপিটালের ঘ্রাণ টা নাকে যেতেই তার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো জেগে উঠল। পুরোনো স্মৃতিগুলো আবার তাজা হয়ে উঠল। এই হসপিটাল জুড়েই রয়েছে তার আর সুজানার সুন্দর মুহুর্তগুলো। এই হসপিটালেই পদ্ম’র সাথে তার প্রথম পরিচয়। আর এই হসপিটালেই সে করুন সত্যির মুখোমুখি হয়েছিল। সবকিছু হয়েছিল এই হসপিটালেই। সব মনে পড়ছে তার। এতদিন নিজেকে খুব ব্যস্ত রাখায় এসব স্মৃতি খুব একটা মস্তিষ্কে বিচরণ করতে পারেনি কিন্তু আজ এগুলো মাথার ভেতর কিলবিল করছে।

সবার সাথে দেখা করে আদিদ তার কেবিনে যায়। আগের মতোই আছে সবকিছু। তবে কিছু মুখ বদলেছে। কিছু চেনা মানুষ হারিয়ে গেছে। সময়ের স্রোতে হয়তো ভেসে গিয়েছে এসব কিছু। তবু তার কেবিন টা রয়ে গেছে আগের মতো। ঐ তো তার বইগুলো। আদিদ সেগুলো ছুঁয়ে দিল। তারপর সে তার চেয়ারটাতে গিয়ে বসল। মাথার ভেতর যেন কিছু ভনভন করছে। মনে পড়ছে অনেক মুহুর্ত। যা ভুলতে চেয়েও কখনো ভুলা হয়ে উঠেনি।

সেদিন রাতে আদিদ আর তার কেবিন থেকে বের হয়নি। পরদিন সকালে হসপিটালের সকল স্টাফদের সাথে দেখা করে সে বেরিয়েছে তার একটা জরুরি কাজে। সে অভি কেও কল করে আসতে বলে। তারপর দু’জনেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় কোনো এক উদ্দেশ্যে। আর সেই গাড়ি গিয়ে থামে, থানায়। আদিদ আর অভি গাড়ি থেমে নামে। অভি আগে না বুঝলেও এখন বুঝেছে আদিদ আসলে কী করতে চাইছে।

আদিদ বেড়াল পায়ে থানার ভেতরে গেল। ওসির রুমের কাছে গিয়ে থামল সে। ন্যামপ্লেট টা দেখে কপাল কুঁচকাল। পেছন থেকে অভি বললো,

‘নতুন ওসি এসেছেন। আগের জনের ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে।’

আদিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে গেল। ওসি তাদের চিনলেন না। দু’জনেই তাদের পরিচয় দিল। ওসি এবার তাদের বসতে বললেন। আদিদ ছোট্ট একটা ঢোক গিলে বললো,

‘আসলে ওসি সাহেব, আমরা দু’জন মানুষের সাথে দেখা করতে এসেছি।’

আদিদের কথাটা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। অভি সেটা বুঝতে পেরে নিজ থেকে বললো,

‘পাঁচ বছর আগে এখানে আকবর হোসেন আর রুবি হোসেন নামে দু’জন ব্যক্তিকে আনা হয়েছিল। উনাদের বিশ বছরের জেলের রায় হয়েছিল। উনারা কি এখন এখানে আছেন? আমরা উনাদের সাথেই দেখা করতে এসেছি।’

ওসি সাহেব একটু চিন্তিত কন্ঠে বললেন,

‘পাঁচ বছর আগের গেইসের ফাইল তো এখন আমার কাছে নেই। আচ্ছা, আপনারা একটু বসুন আমি দেখে আপনাদের জানাচ্ছি।’

তারপর অফিসার পুরোনো কিছু ফাইল নিয়ে বসলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অফিসার সেই ২০২২ সালের ফাইলটা পেলেন। সেটা চেক করে তিনি বললেন,

‘উনাদের তো আরো এক বছর আগেই জামিন হয়েছে। বার্ধক্যজনিত কারণে দু’জনেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই হাইকোর্টের বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে উনাদের জামিন দেওয়া হয়। বাই দ্যা ওয়ে আপনারা উনাদের কী হোন?’

অভি আর আদিদ একজন অন্যজনের মুখের দিকে তাকাল। আদিদ জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে আস্তে করে বললো,

‘আমি উনাদের ছেলে।’

‘ওহ, আপনার মা বাবা এখানে নেই। তাই উনাদের ব্যাপারে আর কোনো ইনফরমেশনও আমাদের কাছে নেই।’

আদিদ থানা থেকে বেরিয়ে হতাশ কন্ঠে অভিকে বলে,

‘মানুষ দু’টো কোথায় গিয়েছে বলতো? আচ্ছা, উনাদের কি আমার কথা মনে আছে? নাকি ভুলে গিয়েছেন? আমার না উনাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একবার যাবো ঐ বাড়িতে? তুই কী বলিস অভি।’

অভি আদিদের কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘চল যাই।’

তারপর দু’জন আবারো বেরিয়ে পড়ল। এবার তারা গেল আদিদের বাড়িতে। আদিদ সেখানে গিয়ে বিস্মিত হলো। সে যেভাবে বাইরের গেইটে তালা দিয়ে এসেছিল এখনো সেখানে সেইভাবেই তালা টা ঝুলছে। তারমানে আদিদের মা বাবা এখানে আসেননি। আদিদ যেন চিন্তায় পড়ে যায়। দেশে আসার আগ থেকেই মা বাবার কথা তার খুব মনে পড়ছিল। নিজের মনের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মা বাবার সাথে এবার দেখা করবে সে। কিন্তু আজ উনাদের না পেয়ে ভীষণ অস্থির লাগছে মনটা। মা বাবা হাজার অন্যায় করলেও বোধ হয় কোনো সন্তান তাঁদের ঘৃনা করতে পারে না। আদিদ ও হয়তো তাই পারেনি।

আদিদের অস্থিরতা দেখে অভি বললো,

‘এত অস্থির হোস না। আংকেল আন্টি হয়তো তোদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। সেখানে একবার গিয়ে খোঁজ করে আয়। আমার মন বলছে উনারা সেখানেই থাকবেন।’

অভির কথা মতো আদিদ তার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার দুপুর হয়ে গেল। এতদিন পর গ্রামে আসায় পথ চিনতে একটু কষ্ট হচ্ছিল তার। আশেপাশের মানুষদের বলে বলে পথ চিনতে হয়েছিল তাকে। আর এইভাবেই পথ চিনতে চিনতেই সে তার বাড়ি এসে পৌঁছাল। গাড়িটা এক পাশে পার্ক করে সে ধীর পায়ে বাড়ির ভেতরে গেল। চারপাশ টা কেমন নিরব যেন। আদিদ এবার ডাকল,

‘বাড়িতে কেউ আছেন?’

কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তাই আবারো সে বললো,

‘কেউ আছেন বাড়িতে?’

তখনই একজন মহিলা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। তারা পরনে একটা তাঁতের মলিন শাড়ি। চুলগুলো উস্কোখুস্কো আর বিষন্ন চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি কে দেখে বুকের ভেতর টা কেঁপে উঠল তার।

মহিলা’টাও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর হঠাৎ করেই তিনি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বললেন,

‘আদিদ, বাবা তুই এসেছিস?’

তিনি এসে আদিদকে জাপটে জড়িয়ে ধরলেন। আদিদ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কেবল। মায়ের এই অবস্থা দেখে এখনো তার বুক কাঁপছে। সবসময় যিনি নিজেকে চকচকে করে রাখতেন আজ তার একি করুন দশা। আদিদও আর থাকতে না পেরে মা’কে জড়িয়ে ধরে। বুকটা ফেটে গেলেও আজ আর কাঁদে না সে। অনেকক্ষণ মা’কে ওভাবে জড়িয়ে ধরে থেকে সে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘কেমন আছো…মা?’

রুবি হোসেন জবাব দিলেন না। তিনি কেঁদেই চলছেন। আদিদ আবার অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে,

‘বাবা কোথায়?’

আদিদের এই প্রশ্নে রুবি হোসেনের কান্না যেন আরো বেড়ে গেল। আদিদ মা’কে শান্ত হতে বলছে কিন্তু তিনি থামছেন’ই না। আদিদের কিছু একটার ভয় হলো। তার মা কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে বললেন,

‘তোমার বাবা মা,রা গেছেন, আদিদ।’

চলবে…

(একজন কমেন্ট করেছেন, গল্প’টা একঘেয়ে লাগছে কারণ গল্পটাতে রোমান্টিকতা নেই। উনার উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, গল্পটা রোমান্টিক গল্প নয়। তারপরও যদি মনে হয়, আমি তখন কাহিনী অনুযায়ী ব্যাপারটা ভেবে দেখবো। আর দয়া করে সব গল্পের মধ্যে রোমান্টিকতা খুঁজতে আসবেন না।

আর যারা এই একঘেয়ে গল্পটাকেও এত ভালোবাসা দিচ্ছেন আমি সত্যিই তাদের প্রতি আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ। আপনারা ভালোবাসা নিবেন❤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here