#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৫২|
‘আজ’ই!’
দুজনে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। রুবি হোসেন তখন বললেন,
‘হ্যাঁ, আজ’ই। তোমাদের বেশি সময় দিলে তোমরা আবার উল্টা পাল্টা কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে। তাই কোনো রিস্ক নিতে চাইছি না। আমি আজই তোমাদের বিয়ে দিব। সবকিছু রেডি আছে। ছেলে পক্ষের স্বাক্ষী হবে অভি। আর মেয়ে পক্ষের স্বাক্ষী হবে রাণী। আর কাজীও আমি আগে থেকেই বলে রেখেছি। আমি একটা কল দিলেই উনি চলে আসবেন।’
পদ্ম হতভম্ব হয়ে পড়ল। আদিদ মা’কে বুঝিয়ে বললো, কিছুদিন অন্তত সময় নেওয়ার জন্য। এইভাবে হুট করেই এতকিছু না করতে। কিন্তু রুবি হোসেন তার সিদ্ধান্তে অটুট। সাথে অভি আর রাণীও সাঁই দিল। বেচারা আদিদ আর পদ্ম, একপর্যায়ে আর কোনো উপায়ান্তর না দেখে তাদেরও বাধ্য হতে হলো।
কাজী এলো। নতুন করে বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। পদ্ম’র কথায় নয়শত নিরানব্বই টাকা দেনমোহর করা হলো। পদ্ম, আদিদ দুজনেই সপ্রতিভ গলায় বললো, “কবুল”।
অন্য মেয়েদের মতো পদ্ম আর আজ কাঁদলো না। অনেক কেঁদেছে সে। তার এই পঁচিশ বছরের ক্ষুদ্র জীবনটা তার কেঁদেই পার করতে হয়েছে। তাই আজ আর কাঁদলো না সে। মনে মনে ঠিক করলো, আর কাঁদবে না। এবার হাসবে, নতুন করে বাঁচবে। নতুন মানুষকে সাথে নিয়ে নতুন ভাবে পথ চলা শুরু করবে।
রুবি হোসেন তাড়া দিতে লাগলেন। পদ্ম কে নিয়ে এখনই বাড়ি ফিরবেন তিনি। সেই মুহুর্তে রাণী হঠাৎ থমকে গেল। তার তখন মনে পড়ল, সে তো এতদিন পদ্ম’র সাথে থাকতো। কিন্তু আজ থেকে যদি পদ্ম আদিদের বাড়িতে থাকে তবে সে কোথায় থাকবে। মুহুর্তেই রাণীর চোখ মুখ কালো হয়ে গেল। পদ্ম কে ছেড়ে কোথায় যাবে সে। ঐ আশ্রমেই কি আবার তাকে ফিরতে হবে?
পদ্ম রুবি হোসেনকে শান্ত হতে বললো। সে বললো,
‘আমি আজ’ই যেতে পারবো না, বড়ো মা। আমার এইদিকে সবকিছু গোছাতে হবে। বাড়ির মালিককে বলতে হবে। হুট করেই তো আর বাসা ছেড়ে দেওয়া যায় না। তাই এই সবকিছুর জন্য কিছুদিন সময় লাগবে আমার।’
‘সমস্যা নেই পদ্ম, আপনার যতদিন খুশি সময় নিন। এত তাড়াহুড়ো করতে হবে না।’
আদিদ সম্মতি দিয়ে দেওয়ায় রুবি হোসেনকেও মানতে হলো। তিনি বললেন,
‘ঠিক আছে তাহলে, আজ যেহেতু বাইশ তারিখ সেহেতু আর আট দিন পর এই মাস শেষ হলে তোমাকে আমাদের বাড়িতে তুলবো। এর মধ্যে তুমি এইদিকের সব কাজ শেষ করো, কেমন?’
পদ্ম হাসি হাসি মুখে বললো,
‘আচ্ছা।’
তাদের কথাবার্তা শুনে রাণী আর কিছু বললো না। সে পদ্ম কে বলে রান্নাঘরের দিকে গেল। রান্নাঘরে গিয়েই কেঁদে ফেলল সে। পদ্ম কে ছেড়ে থাকতে পারবে না। এখন মনে হচ্ছে, বিয়েটা না হলেই ভালো হতো, পদ্ম আজীবন তার সাথে থাকতে পারতো। রাণী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। হঠাৎ তখন সে তার কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পায়। তাড়াতাড়ি করে চোখ মুখ ওড়না দিয়ে মুছে পেছন ফিরে তাকায়। পদ্ম কে দেখে মেকি হাসে সে। পদ্ম তীক্ষ্ণ চোখে রাণীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাণী আমতা আমতা করে বলে,
‘কী হলো আপু, কী দেখছো?’
‘কাঁদছিলি কেন?’
পদ্ম’র প্রশ্নে রাণী থতমত খায়। কী জবাব দেবে ভেবে পায় না। চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। পদ্ম আবারো প্রশ্ন করে,
‘কী হলো বল, কাঁদছিলি কেন?’
রাণী নিজেকে খুব কষ্টে সংযত করে রেখেছে। বুক ফেটে যাচ্ছিল তার। তাও ঠোঁটের কোণে সে হাসি ফুটিয়ে তুললো। হাসতে হাসতে বললো,
‘কই, কাঁদছিলাম না তো। কাঁদবো কেন, আজ তো আমার খুশির দিন। তবে একটু কষ্ট লাগছে এই ভেবে যে, আমি এতো এতো প্ল্যানিং করে রেখেছিলাম কিন্তু তার কিছুই হলো না। হুট করে এলো আর বিয়ে হয়ে গেল। আমি একটু শপিংও করতে পারলাম না, তোমাকে ভালোভাবে সাজাতেও পারলাম না।’
পদ্ম’র চোখ মুখের কঠোরতা কমলো না। সে গম্ভীর গলায় বললো,
‘খুব মিথ্যে বলতে শিখেছিস দেখি। কেন কাঁদছিলি বল?’
রাণী চোখ বুজে জোরে নিশ্বাস নেয়। বুকের ভেতরের তীব্র আর্তনাদ যেন সেই উষ্ণ নিশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে এলো। পদ্ম হুট করেই রাণীকে তখন জড়িয়ে ধরলো। রাণী এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো, শব্দ করে কেঁদে উঠল সে। পদ্ম আরো শক্ত করে চেপে ধরলো তাকে। মাথায় হাত রেখে মোলায়েম গলায় বললো,
‘কাঁদছিস কেন, বোকা? তুই তো আমার সাথেই থাকবি।’
রাণী নাক টানল। বললো,
‘তুমি তো তোমার শ্বশুর বাড়িতে চলে যাবে।’
‘তুইও সেখানে আমার সঙ্গে থাকবি।’
রাণী মাথা তুলে তাকায়। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলে,
‘এটা হয় নাকি? আমি কীভাবে তোমার সাথে তোমার শ্বশুর বাড়িতে থাকবো?’
‘কেন, হয় না কেন? তুমি তো পদ্ম কে আপু ডেকেছো। তো, বোনের সাথে থাকতে অসুবিধা কোথায়?’
রুবি হোসেনের কথা শুনে পদ্ম খুশি হলো। রাণীকে বললো,
‘এবার হয়েছে তো, বড়ো মাও বলে দিয়েছে। এখন কান্না থামা।’
রাণী চোখ মুখ মুছে রুবি হোসেনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘আন্টি, আপনি খুব ভালো।’
পদ্ম’র মনের ভেতরটা তখন ধক করে উঠল। প্রথম দেখায় এই মানুষটাকে সেও খুব ভালো ভেবেছিল, কিন্তু…
.
আদিদ সেই কবেই বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নাছরবান্দা রাণী তাকে আজ কোনোভাবেই ছাড়বে না। এইসবের মাঝে সে আবার পদ্ম আর আদিদের বাসরের আয়োজনও করে ফেলেছে। আদিদ কিছু বলতেও পারছে না সইতেও পারছে না। পদ্ম ভীষণ রাগ দেখাচ্ছে। বিয়েটা হুট করে হয়ে গিয়েছে, তাই বলে বাসরের জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত না। পদ্ম রাণীকে অনেক ধমকিয়েছে কিন্তু লাভ হয়নি। রাণীর সাথে অভি থাকায় পদ্ম আর তাকে আটকাতে পারেনি। তার উপর রুবি হোসেনও তাদের সাথে তাল মেলাচ্ছিলেন। পদ্ম আর আদিদ দুজনের জন্যই ব্যাপারটা ছিল ভীষণ অস্বস্তির। পদ্ম তো কবুল বলার পর থেকে আদিদের দিকে তাকাতেও পারছে না। কেমন যেন আদিদ কে এখন অপরিচিত অপরিচিত লাগছে। এখন আর সে শুধু তার ডাক্তারবাবু না তার স্বামীও, ভাবলেই তার গায়ে শিহরণ জাগে।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে অভি তার বাসায় ফিরে যায়। রুবি হোসেন আর আদিদকে থাকতে হয়। যদিও আদিদ এর মাঝে অনেকবারই চেয়ে ছিল কিছু বলে কেটে পড়ার জন্য কিন্তু ঐ রাণীর কাছ থেকে সে কোনোভাবেই ছাড় পায়নি।
পুরোটা সময় পদ্ম’র ব্যস্ততায় কাটে। রাণী ছাড়া তো তার কেউ নেই, সে নিজেই তাই সব রান্না-বান্না করে সবাইকে খাইয়েছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে পদ্ম তরকারিগুলো গোছাচ্ছিল। রাণী তখন পেছন থেকে এসে বলে,
‘আর কাজ করতে হবে না। এবার রুমে যাও, একটু সাজুগুজু করো। একটু পর তো…’
কথাটা রাণী শেষ করবার আগেই পদ্ম তরকারি থেকে একটা আলু নিয়ে তার মুখে পুরে দিল। রাণী হা হয়ে আছে। পদ্ম রাগি গলায় বললো,
‘তুই কিন্ত বেশি বাড়াবাড়ি করছিস রাণী। দেখছিস সবকিছু কীভাবে হুট করে হয়ে গেল। তার মধ্যে তুই আবার এইসব বাসর ঘরের আয়োজন শুরু করলি। তুই একবার ভাবতো, আমি কীভাবে আজকে উনার সামনে যাবো। এখনই যা অস্বস্তি হচ্ছে, উনার সামনে রুমে একা থাকলে আমি বোধ হয় অস্বস্তিতে ম*রেই যাবো।’
রাণী আলু টা মুখ থেকে বের করে হেসে বললো,
‘ডাক্তার মানুষ, বাঁচিয়ে ফেলতে পারবে।’
পদ্ম চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই রাণী চুপচাপ আলু খেতে লাগল।
ভেতরের রুমে পদ্ম কে রেখে রাণী বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর রাণী আবার সেই রুমে ঢুকল। একটা দুধের গ্লাস টেবিলের উপর রেখে বললো,
‘আপু, দুলাভাই আসলে দিও।’
পদ্ম আহাম্মকের মতো বসে বসে রাণীর কান্ড দেখল। মেয়েটা যে তখন থেকে কী কী করছে। উফফ, আজকের মতো এতো বকা সে জীবনেও শুনেনি হয়তো তাও তার মধ্যে বিন্দুমাত্র বিষন্নতা নেই। কত খুশি মনে এটা ওটা করেই চলছে, যেন পদ্ম তার নিজের বোন।
.
.
দরজায় দু’বার নক করে আদিদ ভেতরে ঢুকল। আদিদ কে দেখে পদ্ম বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। সে এক পা এগুতেই আদিদ বললো,
‘মুখে সালাম দিলেই হবে।’
চলবে…
(নিন, দিয়ে দিলাম আদিদ আর পদ্ম’র বিয়ে। এবার পাঠকমহল খুশি তো? এখন আবার আমাকে বলতে আসবেন না, বিয়ের দাওয়াত কেন দেইনি। যাদের বিয়ে তাদের ধরুন, আমি এসবের মাঝে নেই।
বি: দ্র: গল্পটা শেষ হয়ে গেলে কাকে/কাদের কে সবথেকে বেশি মিস করবেন?)