#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৫৬|
আজকাল পদ্ম’র শরীর টা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। হুটহাট করেই পেটে এক তীব্র ব্যাথা অনুভব করে সে। আদিদ তাই হসপিটালে খুব কম যায়। সারাক্ষণ পদ্ম’র সাথে সাথেই থাকে। রাণীও শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এসেছে। এই পুরো সময়টা সে পদ্ম কে দিতে চায়। পদ্ম’র ডেলেভারির আর বেশি দিন নেই। হাতে গুণা কয়েকটা দিন আছে হয়তো। আর তাই যত দিন এগুচ্ছে পদ্ম’র ভয়ও তত বাড়ছে। সবকিছু আদিদ আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছে, পদ্ম কে নানা ভাবে সাহস দিচ্ছে সে। কিন্তু পদ্ম পারছে না নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে। কিসের যেন একটা ভয় কাজ করে মনের ভেতর। সেদিন এই ভয়ের কারণে খুব কেঁদে ও ছিল সে। আদিদ আর রাণী তাকে অনেক বোঝায়। তাকে আশ্বস্ত করে। জীবনে সব লড়াইয়ে শক্ত থাকতে পারলেও এই লড়াইয়ে যেন সে কিছুতেই শক্ত থাকতে পারছে না। সবাই তার পাশে থাকলেও সেই বল কিংবা সাহসে সে আর কোনোভাবেই উজ্জীবিত হতে পারছে না।
.
.
অনেক টা রাত করেই আজ আদিদ আর পদ্ম ঘুমিয়েছে। পদ্ম’র ঘুম আসছিল না বলে সে শুয়ে শুয়ে হাঁসফাঁস করছিল। আদিদ ও তাই তার সাথে জেগে থাকে। অনেক গল্প করে দু জন। পুরনো স্মৃতিচারণ করে। তাদের প্রথম দেখার কথা মনে করে। সেই ভয়ানক দিনগুলোর কথা ভাবে। কত শত হারিয়ে যাওয়া যন্ত্রণাগুলোর কথা পুনরায় স্মরণ করে আর ভাবে তাদের ভবিষ্যত টা সুন্দর হবে। অন্ধকার অতীত টা তলায় পড়ে যাবে আর সুন্দর সুখকর একটা ভবিষ্যত মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে।
রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে তাদের তিন টা বাজে। ভোরের দিকে হঠাৎ পদ্ম’র ঘুম ভেঙে যায়। সে তখন তার তলপেটে তীব্র ব্যাথা অনুভব করে। প্রথমে ভাবে হয়তো অন্যদিনের মতো হালকা ব্যাথা করছে একটু পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, সেই ব্যাথা কমে না। বরং তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। পদ্ম আর সহ্য করতে পারছিল না। দম আটকে আসছিল তার। আদিদ কে যে ডাকবে সেই শক্তিও পাচ্ছিল না সে। কোনোরকমে আদিদ কে দুবার হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়। আদিদ ঘুরে তাকাতেই পদ্ম’র বিচলিত ঘর্মাক্ত মুখ টা দেখে ধরফরিয়ে উঠে বসে। সে উত্তেজিত কন্ঠে পদ্ম কে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, পদ্ম?’
পদ্ম কথা বলতে পারছিল না। তাও খুব কষ্টে বললো,
‘তলপেট টা খুব ব্যাথা করছে। আর সহ্য করতে পারছি না।’
আদিদ বুঝে যায়, সময় হয়তো হয়ে গিয়েছে। এক্ষুণি তাকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে। সে তাড়াহুড়ো করে রুবি হোসেন আর রাণী কে ডেকে আনে। তারপর সবাই পদ্ম কে ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসায়। ততক্ষণে ব্যাথায় পদ্ম চিৎকার করে কাঁদছে। পদ্ম’র প্রতিটা চিৎকার আদিদের যেন বুকে গিয়ে বিঁধছে। সে কোনোরকমে গাড়ি চালিয়ে পদ্ম কে নিয়ে তার হসপিটালে পৌঁছাল। নার্স, ডাক্তার সবাইকে ডেকে হুলস্থুল কান্ড শুরু করলো। নিজে একজন ডক্টর হয়েও এতটা উত্তেজিত হওয়াটা তার শোভা পায়না। কিন্তু সে পারছে না। পদ্ম’র কান্নার শব্দ তাকে আরো বেশি বিচলিত করে তুলছে। পদ্ম’র ডেলেভারির জন্য গাইনী ডক্টর আদিদ আগেই ঠিক করে রেখেছিল। আদিদ তাকে কল দিয়ে আসতে বলে। সমস্ত প্রস্তুতি শেষে পদ্ম কে নিয়ে ও.টি তে যাওয়া হয়। যদিও আদিদের এই অপারেশনে কোনো কাজ নেই তাও সে ও.টি তে থাকল। পদ্মও তার হাত ছাড়ল না। শক্ত করে চেপে ধরে রাখল তাকে। গাইনী ডক্টর প্রথমে বলেছিলেন, নরমাল ডেলেভারির জন্য একবার ট্রাই করতে। কিন্তু পদ্ম’র চিৎকারে আদিদের আর সেই সাহস হয়নি। সে ডক্টর কে তাড়া দিয়ে সি-সেকশনেই যেতে বলে। প্রায় আধঘন্টা পর পদ্ম’র চিৎকার থামে। আর তারপরেই শুরু হয় তার মেয়ের চিৎকার। গাইনী ডক্টর তখন হেসে বলেন,
‘এতক্ষণ মা চিৎকার করে পুরো হসপিটাল মাথায় তুলছিল আর এখন মেয়ে। পুরো মা’র মতোই হয়েছে।’
মেয়ের গলার স্বর পেয়ে পদ্ম একেবারে থমকে যায়। বাচ্চা টা কে আদিদের কোলে দেওয়া হয়। র’ক্তমাখা ছোট্ট শরীরটা কে আদিদ তখন নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। চিৎকারের কী জোর। মা’কেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পদ্ম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাপ বেটির দিকে। পদ্ম স্পষ্ট দেখতে পায় আদিদের চোখগুলো টলমল করছে। পদ্ম তাকিয়ে থাকে সেই চোখ জোড়ার দিকে। কত ভালোবাসা এই চোখে। যেন এক্ষুণি সেগুলো টুপ করে উপচে পড়বে।
আদিদ মেয়েকে গোসল করিয়ে একটা শুকনো কাপড়ে মুড়িয়ে পদ্ম’র কোলে দেয়। মেয়েকে পেয়ে পদ্ম যেন তার জীবন ফিরে পায়। অনেক অনেক আদর করে তাকে। খুব করে কাঁদেও কিছুক্ষণ। ডক্টর রা সবাই বেরিয়ে যায়। অনেকক্ষণ পর আদিদ বাবু কে কোলে নিয়ে বাইরে বের হয়। রুবি হোসেনও নাতনী কে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেলেন। বাচ্চা টা কে কোলে নিয়ে আদর করেন অনেকক্ষণ। রাণীও কোলে নেয়। আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় তাকে। তারপর আবার আদিদ তাকে নিয়ে পদ্ম’র কাছে যায়। বাবুর কান্না থামছিল না বলে সে বাবু কে পদ্ম’র কোলে দিয়ে বলে,
‘বাবুর জীবনের প্রথম আহারের সময় হয়েছে পদ্ম। তুমি ওকে ফিডিং করাও আমি বাইরে আছি।’
.
বিকেলের দিকে হসপিটালে অভি আর অনিক আসে। অভি এসে ঠাট্টার স্বরে আদিদ কে বলে,
‘শালা, একটা ছেলে দিতে পারলি না? তাহলে তো আমার মেয়েটা কে তার সাথে বিয়ে দিতে পারতাম।’
অভির কথা কে কেন্দ্র করে সেখানে অনেক হাসাহাসি হয়। আদিদ বলে,
‘আমার ছেলে হলে তোর মেয়ে আমার ছেলের থেকে কত বড়ো হত সেই হিসাব আছে?’
‘হত বড়ো, সমস্যা কী?’
মাঝখান থেকে তখন রাণী বলে উঠে,
‘আচ্ছা তাহলে আমাদের ছেলে হলে, আমাদের ছেলের সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিও, কেমন অভি ভাই।’
রাণীর কথা শুনে অনিক বিষম খায়। কাশতে কাশতে বলে,
‘হয়েছে হয়েছে, তোমাকে আর এত পূর্ব পরিকল্পনা করতে হবে না।’
রাণী তখন জবাব না দিয়ে বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বসে থাকে।
____________________________
সময় যায়। সম্পর্কের বয়স বাড়ে। আর তার সাথে বাড়ে ভালোবাসার পুরুত্ব। আদিদ আর পদ্ম’র ছোট্ট রাজকন্যা আদিতা, আজ এক বছরে পা রাখতে চলেছে। মেয়েটা প্রচন্ড দুষ্টু। তাকে সামলাতে গিয়ে পদ্ম’র দিন রাত নাকানিচুবানি খেতে হয়। আদিদ সারাদিন হসপিটাল শেষে বাসায় ফিরতেই মেয়েটা তার শান্ত হয়ে যায়। বাবার সামনে সে যেন একটা মিনি বেড়াল। যেন তার মতো লক্ষী বাচ্চা পৃথিবীতে আর একটাও নেই। আর সেই জন্যই পদ্ম মেয়েকে নিয়ে আদিদের কাছে হাজার টা বিচার দিলেও আদিদ সেটা বিশ্বাস করে না। কীভাবে বিশ্বাস করবে তার মেয়ে যে তার সামনে আসলে ভালো হয়ে যায়।
আদিতার জন্মদিন উপলক্ষে অনেক আয়োজন করা হয়। সকাল থেকেই পদ্ম খুব ব্যস্ত। দম ফেলার জো নেই। আদিদও আজ হসপিটালে যায়নি। সারাদিন মেয়ের সাথে কাটাবে বলে ঠিক করেছে। রাণীও খুব সকাল সকাল তাদের বাড়িতে চলে এসেছে। সে বার বারই রান্নাঘরে আসছিল পদ্ম কে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু পদ্ম তাকে কিছু করতে দিচ্ছিল না। বার বার তাকে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। রাণী তিনমাসের প্রেগনেন্ট। আর এই তিন মাসেই তার শরীর একদম গলুমলু হয়ে গিয়েছে। এখন সত্যিকার অর্থেই তাকে পুতুল লাগে। পদ্ম তো রাণীকে দেখলেই তার রসোগোল্লার মতো গালগুলো টেনে তাকে আদর করে দেয়। এমনকি তার ছোট্ট মেয়েও তাই করে। রাণীকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। রাণী বোঝেনা এই ছোট্ট মেয়েটা তার মাঝে কী পায়, দেখলেই তাকে যেতে দেয়না। জোড় করে তার কাছে রেখে দেয়।
.
পদ্ম রান্নাঘরে কাজ করছিল। হঠাৎ সেখানে আদিদ এলো। পদ্ম’র কাছে গিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ব্যাপার কী বলুনতো?’
পদ্ম চকিত হয়ে বললো,
‘কী ব্যাপার?’
আদিদ ব্রু কুঁচকে গম্ভীর সুরে বললো,
‘বয়স বাড়ছে অথচ সৌন্দর্যের মাঝে কোনো ঘাটতি পড়ছে না, ব্যাপার টা তো খুব ভাবাচ্ছে আমাকে। রহস্য কী হু? দিন দিন এত সুন্দর হচ্ছেন কেন? দু দিন পর তো মেয়ের বিয়ে দিবেন, এবার তো একটু বুড়ো হওয়ার প্রয়োজন তাই না।’
আদিদের কথা শুনে পদ্ম হাসে। বলে,
‘হয়েছে যান তো। এসব আজগুবি কথা বলে আমাকে আর ডিস্টার্ব করবেন না।’
আদিদ উল্টো পদ্ম’র আরো কাছে এসে তার চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলে,
‘বিশ্বাস হয় না বুঝি। নিজেকে তো আর আয়নায় ভালোভাবে দেখেন না তাই বিশ্বাস করছেন না। আপনার সৌন্দর্যে আপনার আদিতার বাবা দিন দিন যে কী পরিমাণ বিধ্বস্ত হচ্ছে সেই সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে ম্যাডাম?’
পদ্ম কোমরে হাত দিয়ে বলে,
‘আমাকে না জ্বালালে হয় না বুঝি? বাপ আর মেয়ের সারাক্ষণ খালি একটাই কাজ, আবার পেছনে লেগে থাকা।’
আদিদ তখন মুচকি হেসে পদ্ম’র অধর জোড়ার কাছে যেতেই, রান্নাঘরের দরজার সামনে থেকে কেউ আদো আদো সুরে ডেকে উঠে,
‘বাববা।’
আদিদ তাকিয়ে দেখে তার ছোট্ট মেয়েটা তার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আদিদ গিয়ে তাকে কোলে নেয়। আফসোসের সুরে বলে,
‘আহ, বাচ্চাটা আমার সব সময় ভুল টাইমে চলে আসে।’
পদ্ম ব্রু কুঁচকে তাকাতেই আদিদ ঠোঁট কামড়ে হেসে সেখান থেকে চলে যায়। আর সে যেতেই পদ্ম তপ্ত শ্বাস ফেলে। তবে আজ সেই শ্বাসে মিশে ছিল এক আকাশ সুখ আর ভীষণ শান্তি। সে আজ নতুন করে উপলব্ধি করতে পারে, “সত্যিই জীবন সুন্দর, যদি ধৈর্য ধরে লড়াই করে যাওয়া যায়।”
______________সমাপ্ত_______________
(শেষ হয়ে গেল😢 আমি কি গল্পটার একটা পরিপূর্ণ সমাপ্তি দিতে পেরেছি, নাকি পারিনি? অবশ্যই সেটা কমেন্টে বলবেন পাঠকমহল। নতুন গল্প আসবে। তবে এখনও কোনো প্লট মাথায় আসেনি। আসলেই লিখতে বসবো। এইটুকু সময়ের জন্য কেউ আবার আমাকে ভুলে যাবেন না কিন্তু। ও হ্যাঁ, পদ্ম আর আদিদের প্রতি আপনাদের এত এত ভালোবাসা দেখে আমার একটা কথা মাথায় এসেছে। এখন যদি আপনারা সাঁই দেন তবেই আমি সেটা নিয়ে আগাবো। আমি ভাবছি ওদের নিয়ে মাঝে মধ্যে অনুগল্প দিব? এখন আপনাদের কী মত, জানান আমাকে।
অবশেষে, এই এত বড়ো সময়টা যারা এত এত ধৈর্য ধরে আমার পাশে ছিলেন তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আর আমার কিছু পাঠক আছে যারা শুরু থেকেই ভীষণ সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করে আমাকে অনুপ্রাণিত করে এসেছেন, তাদের জন্য আমার এত্তগুলো ভালোবাসা❤❤। বিশ্বাস করুন, আপনাদের এক একটা কমেন্ট আমাকে যে কী পরিমাণ খুশি করে সেটা আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আমি এই কমেন্ট গুলো সবসময় আমার ছোট বোনকে পড়ে পড়ে শোনাই আর বলি, দেখেছিস এই অপরিচিত মানুষগুলো আমাকে না চিনেই কতটা ভালোবাসে। এতটা ভালোবাসা সত্যিই আমার প্রাপ্য না। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। সবসময়ই এইভাবেই পাশে থাকবেন, ধন্যবাদ❤❤)