বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ৭

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৭
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

ইংগেজমেন্ট এর দুইদিন পর বাবার সাথে বিদেশে পাড়ি জমালেন পূর্ণ ভাইয়ারা। ফিরে আসতে লাগবে বহুদিন। একদিকে হবু বরের ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে রাইসা, অন্যদিকে নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত আমি! কারণ, আমার উচ্চ-মাধ্যমিকের ডেট দিয়েছে। পরীক্ষার চিন্তায় দিন-রাত জেগে পড়তে পড়তে খারাপ অবস্থা আমার!
এই কয়দিন দাদীও আমায় তেমন ডিস্টার্ব করেননি কোন কাজের জন্য, কারণ আন্টির কড়া নির্দেশ পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন বাসায় আমায় কোনরকম কাজ করতে না দেখা যায়।

সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। ঠিক তেমনি দিন ফুরোতেও সময় লাগেনা। দেখতে দেখতেই পেরিয়ে গেলো মাস। একটি একটি করে সব পরীক্ষাই শেষ হয়ে গেলো আমার! এতদিন পরীক্ষার জন্য পুরোটা সময় ঘরেই কাটিয়েছি আমি। হাপিয়ে উঠেছে মন! এখন এইচএসসি শেষে আমি যেন মুক্ত পাখি! ডানা মেলে উড়ে বেরাতে ইচ্ছে করছে শহর জুড়ে! তাইতো রাইসার ইয়ার ফাইনাল শেষ হওয়ায় ওকে নিয়ে চষে বেড়াচ্ছি পুরো শহর!
ঘুরতে ঘুরতেই ওর থেকে জানলাম সামনের সপ্তাহে নাকি দেশে ফিরছেন প্রান্ত ভাইয়ারা। আসার কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ের দিনক্ষণ পাক্কা করবেন তারা।

লাজুক মুখে রাইসা বললো, প্রান্ত ভাইয়া চাইছেন রাইসা যেন তার সাথে এয়ারপোর্টে দেখা করতে আসে। এতদিন পর তার জন্য অপেক্ষারত প্রেয়সীকে দেখার দৃশ্য তিনি কোনভাবেই মিস করতে চান না! খুব সুন্দর সাবলীল ইচ্ছা। আমিও সায় দিলাম ওকে দেখা করার জন্য! একটু পর আংকেলের কথা মাথায় আসতেই ওকে জিজ্ঞেস করলাম। তখন শুনলাম আংকেল নাকি কয়দিনে আগেই চলে এসেছেন, শুধু তারা দুই ভাই আসা বাকি এখন। তাই ও এয়ারপোর্টে যেতে রাজি হয়েছে। আর আন্টি ওকে একা যেতে দিবেনা স্বাভাবিকভাবেই, তাই আমাকে সাথে যেতে হবে।
প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে রাইসার অনুরোধ বেশিক্ষণ ফেলতে পারলাম না আমি! ভাবলাম এমনিতেও বাসায় বসেই আছি। তার চেয়ে না হয় যাই ঘুরে আসি এয়ারপোর্টে।
মানুষের প্রেম দেখতেও ভাল্লাগে!!

_________

বর্ষাকাল শেষের দিকে তবুও যেন বৃষ্টি শেষ হওয়ার নাম নেই! অকারণেই যখন-তখন মেঘমালা জটলা পেকে আকাশটা গম্ভীর রুপ ধারণ করে! রেডি হয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে মেঘ দেখতে দেখতে ভাবছিলাম আমি। “গম্ভীর” শব্দটা মাথায় আসতেই হঠাৎ করেই পূর্ণ ভাইয়ার কথা মনে পড়লো। এতদিন শত ব্যস্ততার মধ্যে যেন প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম তাকে! আচ্ছা, কেমন আছেন উনি? সেদিন ইংগেজমেন্ট এর পর থেকে তো তার সাথে দেখাই হয়নি আর আমার! আজকে তো প্রান্ত ভাইয়ার সাথে উনারও ফিরে আসার কথা দেশে! ভাবতে ভাবতেই রাইসা চলে এলো রুমে,

—কিরে তুর, ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি চল। ওরা যেকোনো সময় দেশে ল্যান্ড করবে, আমি লেইট করতে চাচ্ছিনা। আকাশের অবস্থাও তেমন ভালোনা। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে, ছাতা নিয়ে বেরুবো চল!

মাথা নাড়িয়ে ওর সাথে নিচে চলে এলাম আমি। আসলেই আকাশের অবস্থা ভালোনা, আর দেরি করা ঠিক নাহ।

রিকশা থেকে নেমে এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুজন। প্রান্ত ভাইয়ার সাথে ফোনে কথা বলছে রাইসা। উনারা কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবেন সব ফর্মালিটিজ শেষ করে। আমি আশেপাশে চেয়ে মানুষের আনাগোনা দেখছি। এই বৃষ্টি-বৃষ্টি ভাব পরিবেশেও জনমানবের ভীড়ে জায়গাটা ভরে আছে। কেউ বা প্রস্থানরত প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে কান্নায় ভেঙে পড়ছে তো কেউ বহুদিন পর প্রিয়জনকে পেয়ে কান্না করছে। সত্যিই দুনিয়াটা বড়ই অদ্ভুত!

হাতে টান পড়তেই পাশে তাকালাম আমি। রাইসা সামনের দিকে চেয়ে আছে, ওর দৃষ্টি অনুসরণ করতেই সামনে দুই ভাইকে আসতে দেখলাম। চোখে সানগ্লাস, হাতে স্যুটকেস নিয়ে বেশ ভাব নিয়েই হেটে আসছেন দুইজন। দূরত্ব কমতেই আমাদের দেখতে পেলেন প্রান্ত ভাইয়া। একগাল হেসে এগিয়ে এলেন তিনি, তার পিছন পিছন এলেন পূর্ণ ভাইয়া।

রাইসাকে দেখে চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে ফেললেন প্রান্ত ভাইয়া। আলতো হেসে কথা বলতে লাগলেন ওর সাথে। ওদেরকে একান্তে কিছু কথা বলতে দিয়ে আমি সরে এলাম একটু সাইডে। আড়চোখে তাকাতেই চোখ পড়লো পূর্ণ ভাইয়ার উপর। এখনও সানগ্লাস পড়ে ঠাই দাঁড়িয়ে আছেন উনি, যেখানে সূর্যের ছিটাফোঁটাও নেই চারদিকে। তিনি যে কোনদিকে তাকিয়ে থাকেন, কি ভাবেন তার মুখ দেখে বুঝা দায়! আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতেই চোখ কুচকে ফেললাম আমি। বৃষ্টিটা বোধহয় এসেই যাবে এবার। অবশেষে চোখ থেকে সানগ্লাস খুললেন উনি। না চাইতেও আমার চোখ গেলো তার দিকে। গম্ভীর মুখটা কেমন যেন বিষন্ন দেখাচ্ছে। ঘন কালো চোখ জোড়া সামান্য লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। আচ্ছা, উনার কি ঘুম হয়নি রাতে? এমন দেখাচ্ছে কেন লোকটাকে? হঠাৎ করেই তিনি কেমন আছেন জানার তীব্র বাসনা জাগলো মনে। তবে কেন জাগলো সেটা জানিনা। জিজ্ঞেস করবো কি করবো না ভেবে শেষ পর্যন্ত নিরবতা ভেঙে ইতস্তত করে সৌজন্যতার খাতিরে বলেই ফেললাম আমি,

—কেমন আছেন, ভাইয়া?

আমার ধীর গলার আওয়াজে কিছুটা বিস্মিতভাবেই তাকালেন উনি। যেন ভাবেননি আমি কথা বলবো এই সময়, তারপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকালেন আমার দিকে। এদিকে তার উত্তরের আশায় চেয়ে রইলাম আমি। তবে আমার আশায় ব্যাঘাত ঘটালো বৃষ্টি!

শ্রাবণের মেঘগুলো ছোটাছুটি করা শেষে ক্লান্ত হয়ে ঝরেই পড়লো ধরনীর বুকে! হঠাৎ বৃষ্টিতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন প্রান্ত ভাইয়া। তড়িঘড়ি করে ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে গাড়ি আনতে বললেন উনি। তারপর আশেপাশের একটি বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা। প্রান্ত ভাইয়া বিচলিত হলেও পূর্ণ ভাইয়া বেশ শান্তভাবেই দাড়িয়ে আছেন। যেন আশেপাশে কি হচ্ছে এসব নিয়ে তার কোনই মাথাব্যথা নেই। এদিকে উনার আড়ালে উনার ভাবভঙ্গি দেখে অবাকের পর অবাক হয়েই যাচ্ছি আমি!!

গাড়ি আসতেই আমরা একছুটে চলে গেলাম সেখানে। প্রান্ত ভাইয়া রাইসার জন্য গেট খুলে দিচ্ছেন, এদিকে আমি অপর পাশে গেট খুলার জন্য হাত বাড়াতেই আমার সামনে এলেন পূর্ণ ভাইয়া। আমি সরে গিয়ে তাকে সাইড দিলাম চলে যাওয়ার জন্য, যেহেতু উনি ড্রাইভারের পাশে বসবেন সামনে। তবে আমাকে আরেকধাপ অবাক করে দিয়ে আমার জন্য গাড়ির গেট খুলে দিলেন উনি। তারপর কিছু না বলেই চুপচাপ গিয়ে বসলেন ড্রাইভারের কাছে। তার মতিগতির কোন ঠিক-ঠিকানা খুজে পেলাম না আমি! তবে প্রান্ত ভাইয়ার তাড়ায় আর কোনকিছু ভাবার সুযোগই পেলাম না। জলদি ভেতরে ঢুকলাম। বাইরে বৃষ্টির বেগ বেড়ে চলেছে আপন গতিতে।

_________

গাড়ি চলছে আমাদের বাড়ির পথে। আমাকে ও রাইসাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে তারপর নিজেদের বাসায় যাবেন দুই ভাই। পেছনের সিটে আমি আর প্রান্ত ভাইয়া দুই সাইডে বসে আছি, মাঝখানে রাইসা। গাড়িতে ঢুকার কয়েক মিনিট পর থেকেই প্রান্ত ভাইয়া কথা বলতে শুরু করলেন। এয়ারপোর্টে আমার সাথে কথা না হওয়ায় এখন খোজ-খবর নিতে লাগলেন।

—তারপর বলো শালিসাহেবা, কেমন আছো?

—এইতো ভালো আছি, ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?

—যেমনই ছিলাম না কেন, আজ তোমার বোনকে দেখে ভালো হয়ে গেলাম। (দুষ্টু হেসে)

ভাইয়ার কথা শুনে আমিও হাসলাম। রাইসা ঠিকই বলেছিলো ভাইয়াকে বেশ রোমান্টিক মনে হচ্ছে। এবার উনি প্রসঙ্গ পালটে বললেন,

—পরীক্ষা কেমন হলো তোমার? প্লাস আসবে তো? রেসাল্টের পর কিন্তু ট্রিট চাই আমরা!

—প্লাস? পাশ আসবে নাকি সেটাই আগে দেখার ব্যাপার। তারপর প্লাসের চিন্তা করতে বলিস।

পূর্ণ ভাইয়ার গুরুগম্ভীর আওয়াজে উত্তর দেওয়ার আগেই থেমে গেলাম আমি। আমার সাথে অবাক হলো রাইসা আর প্রান্তও। হঠাৎ করে যে উনি এখন কথা বলবেন কেউ ভাবতে পারিনি আমরা। সমস্যা কি লোকটার? উনি কি আমাকে আবার ইনসাল্ট করছেন? আশ্চর্য! দাতে দাত চেপে উত্তর দিলাম,

—পাশ আসবে এটা তো জানা বিষয়। এত কস্ট করে পড়ে পরীক্ষা দিয়েছি পাশ করবোনা কেন?

আমার রাগী গলা শুনে প্রান্ত ভাইয়া হেসে থামালেন আমায়। তবে পূর্ণ ভাইয়া কি রিয়েকশন দিলেন উনি সামনে বসায় দেখতে পেলাম না আমি। কিন্তু এই মুহুর্তে তার উপর রাগ হচ্ছে আমার। এতদিন পরেও বাজে স্বভাব গেলোনা লোকটার। অসহ্য!

—আরে তুরফা, কিছু মনে করোনা। ভাইয়া হয়তো এমনি বলেছে ওটা।

মনে মনে অনেক কিছু মনে করলেও প্রান্ত ভাইয়ার সামনে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললাম কিছু মনে করিনি আমি।

—এখন তো তোমার হাতে সময় আর সময়। কি কি করবে এই ফ্রিটাইমে ভেবেছো?

—আপাতত আপনাদের বিয়ে ইঞ্জয় করাই আমার ছুটি কাটানোর সর্বপ্রথম কাজ, ভাইয়া। (দাত কেলিয়ে হেসে বললাম আমি)

আমার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো। অবশেষে আমাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন তারা। এতক্ষণে আকাশ পরিষ্কার, বৃষ্টিও উধাও হয়ে গেছে।

__________

সন্ধ্যা নামতেই বড়দের মধ্যে আলোচনা হলো বিয়ে নিয়ে। প্রথমে ঠিক হলো একবারেই ধুমধাম করে বড় অনুষ্ঠান হবে। তারপর রাইসাকে শশুড়বাড়ি উঠিয়ে নেওয়া হবে। এ পর্যন্ত ঠিক ছিলো কিন্তু বাধ সাধলেন প্রান্ত ভাইয়া। উনার হাতে নাকি অতদিন অপেক্ষা করার সময় নেই। তিনি নিজে সিদ্ধান্তে অনড় যে আগে আকদ করিয়ে বউ তুলে নিবে তারপর সময় নিয়ে বাকি অনুষ্ঠান হবে! জামাইয়ের পীড়াপীড়িতে আর দুই পক্ষের মতামত নিয়ে শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো যে এই সপ্তাহেই আকদ হয়ে যাবে এবং বউকেও এখনি ঘরে তুলে নিবেন তারা। তারপর সময়সাপেক্ষে বাকি অনুষ্ঠান করা হবে।

মুহুর্তেই মধ্যেই যেন একটা উৎসব-উৎসব আমেজ লেগে গেলো বাসায়। সকলের চোখে-মুখ চকচক করছে খুশিতে! বাড়ির মেয়ের বিয়ে বলে কথা! খুশিমনে আমিও যোগ দিলাম সবার সাথে। আর মাত্র কয়দিন! তারপরেই চলে যাবে রাইসা। এই কয়দিন আনন্দের কমতি রাখা যাবেনা কোনভাবেই!

এত খুশির মুহুর্তেও কেন জানি অজানা এক আশংকায় মনে কু ডাকতে লাগলো আমার! এইরকম লাগার কারণ কি ঠিক বুঝলাম না আমি! তবুও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম রাইসার আকদের জন্য।

#চলবে

পর্ব খানিকটা ছোট হলেও দুঃখিত। ফেসবুক ইস্যুর কারণে আপাতত বেশ সমস্যায় আছি। এক সপ্তাহ লেইট করার কথা ছিলো তবুও পাঠকদের কথা ভেবে গল্প পোস্ট করাটা ম্যানেজ করেছি। চেস্টা করব সময়মত পরের পর্ব তাড়াতাড়ি আপলোড দেওয়ার। এই পর্ব কেমন লেগেছে জানাবেন অবশ্যই। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here