বৃষ্টিময়_প্রেম #পর্বঃ৪৮

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ৪৮
#লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিস্তব্ধ দুপুরে বাসার সবাই ভোজন শেষে বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত। খাবার টেবিলে বসে আছি আমি আর পূর্ণ। উনার সাথে খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেও এখন খাওয়ার ইচ্ছাটাই উড়ে গেছে আমার! পূর্ণ নিজের মতো খাচ্ছেন আর একটু পরপর কি যেন বলছেন। উনার আওয়াজ আমার কানে এলেও কি বলছেন তা মাথায় আসছেনা কেননা আমার মাথায় এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে প্রিয়া ও রায়হান ভাইয়ার কথা। একবার ভাবছি বলে দিই উনাকে, ঝামেলা মিটে যায়। পরে ভাবছি এখনো তো প্রেমের সম্পর্ক শুরুই হয়নি ঠিকমতো দুজনের মধ্যে তাতেই বলে দেওয়া কি ঠিক হবে? রায়হান ভাইয়ার মনে প্রিয়ার জন্য কি অনুভূতি আছে সে সম্পর্কে এখন অব্দি আমরা কেউ পুরোপুরি নিশ্চিত নই। অযথা আগে আগে বলেও তো লাভ নেই! অদ্ভুত মুশকিলে পড়ে গেছি যেখান থেকে কিভাবে বের হবো ভাবা দায় হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য!

—তুরফা?

পূর্ণর স্পর্শে উনার দিকে তাকালাম। বাম হাতে আমার বাহু ঝাঁকিয়ে বলছেন,

—কি হয়েছে তোমার? কখন থেকে এত অন্যমনস্ক হয়ে কি ভাবছো? এতবার ডাকলাম একবারো সাড়া দিলে না যে!

—ক-কিছু না। আপনি কি যেন বলছিলেন?

পূর্ণ খানিকটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে৷ তবে মুখে বললেন,

—তুমি খাবেনা? রাইসা বললো তুমি এখনো খাওনি৷ আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে কেন? ক্ষুধা লেগেছিলো নিশ্চয়ই।

—ক্ষুধা চলে গেছে৷ আর খেতে ইচ্ছে করছেনা। আপনি নিজেরটা শেষ করুন। আমি ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিবো।

উনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না মনে হয়। কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে পুনরায় খাবারের দিকে মনোযোগ দিলেন। আমিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ভাবনায় ডুব দিলাম। হঠাৎ মুখের সামনে পূর্ণর হাত আসতেই অক্ষিদ্বয় নিজ হতেই উনার দিকে ফিরলো। চকিত কণ্ঠে বললাম,

—কি করছেন? খাবোনা এখন বললামই তো!

—চুপ! তুমি খাবেনা বলবে আর আমি মেনে নিবো। এতদিনে এই চিনেছো আমাকে?

—কিন্তু..

—কোন কিন্তু না, তুরফা। ভালোভাবে খাইয়ে দিচ্ছি খেয়ে নেও। রাগিয়ো না আমায়। এমনিতেই এত ভালো থাকার পরেও আমি একজনের কাছে খারাপ ! আর খারাপ হতে চাইনা।

ব্যঙ্গাত্বক সুরে বললেন পূর্ণ। উনার কথায় বিরক্তিকর ভংগীতে চোখ মুখ খিচে তার হাতে ধরে রাখা লোকমাটি খেয়ে নিলাম। এবার উনার মুখে তৃপ্তির হাসি। উদ্দেশ্য সফল হয়েছে সে! নিজেও খাচ্ছেন, সাথে আমাকেও খাইয়ে দিচ্ছেন। অবশ্য না খাওয়ার অপশনটাই রাখেন নি যে আমার সামনে! এটাই জ্বা/লা আমার, তাকে কিছু একটা বললেই হলো! একদিন কিছু বললে সেটা নিয়ে বহুদিন খোটা দিবে! অসহ্যকর!

_______________

দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতেই রেডি হয়ে নিলাম দুজনে। বের হতে ধরতেই পূর্ণর ফোনে কল এলো যথারীতি। আমি হতাশ দৃষ্টিতে সেদিক তাকাতেই উনি ইশারায় বুঝালেন “তুমি বাহিরে যাও, আমি দু মিনিটে আসছি”। উনার কথায় বাসার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি।

লক্ষ্য করলাম বাড়ি হতে সামান্য দূরেই এক গাড়ি এসে থামলো। সেখান হতে নামছে প্রিয়া। ওকে দেখেই আমার দৃষ্টি সরু হলো। ও মাত্র বাসায় আসছে? আর আমি ভেবেছি এতক্ষণে বাসায় এসেও গেছে হয়তো! প্রিয়ার থেকে দৃষ্টি ফিরতেই ড্রাইভিং সিটে বসা রায়হান ভাইকে চোখে পড়লো। প্রিয়ার সাথে কি যেন কথা বলছেন। এদের মাথায় কি সমস্যা আছে নাকি আমি বুঝলাম নাহ! বাসায় কেউ না জানুক সেটাও চায় আবার বাড়ির ত্রিসীমানায় দাড়িয়ে কথাও বলছে! এতক্ষণ একসাথে থেকে, কথা বলে কি শখ মিটেনি নাকি? এদিকে পূর্ণও চলে আসবেন যেকোন সময়। ভয়ে-চিন্তায় জমে গেলাম আমি। এদিকে যার ভয় পাওয়ার কথা সে দিব্যি মনের সুখে কথা বলছে রায়হান ভাইয়ের সাথে!

প্রিয়ার উপর হাল ছেড়ে দিয়ে আমি দ্রুতকদমে ভেতরে চলে গেলাম, পূর্ণ এদিকেই আসছিলেন। তাড়াহুড়ায় উনার সাথে ধাক্কা খেলাম ঠিকি তবে পড়ে যাওয়ার আগেই উনি ধরে ফেললেন আমায়! আমায় তুলে পূর্ণ বললেন,

—আস্তে, তুরফা। পড়ে যেতে তো আরেকটু হলেই। হয়েছেটা কি তোমার দুপুর থেকে বলো তো? এমন অদ্ভুত আচরণ করছো কেন?

প্রশ্নগুলোর কি জবাব দেবো ভেবে পেলাম না আমি। উনাকে তো বাইরে যাওয়া থেকে থামাতে হবে! তাই তৎক্ষণাত যা মাথায় এলো সেটাই করলাম আমি, হঠাৎ করেই জড়িয়ে ধরলাম উনাকে। আমার এভাবে আচমকা জড়িয়ে ধরায় পূর্ণ যেন আকাশ থেকে পড়লেন। অবাক কণ্ঠে বললেন,

—কি হয়েছে তোমার? আজকে এতবার জড়িয়ে ধরছো যে? তোমার লক্ষণ তো ভালো নয়, তুর পাখি!

উনার কথায় বিব্রতবোধ করলেও আপাতত সেটাকে পাত্তা না দিয়ে তাকে ধরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ধীর কণ্ঠে বললাম,

—এতক্ষণ লাগে কেন আপনার আসতে? কিসের এত কাজ আপনার সারাক্ষণ হ্যাঁ? যখনি আপনার সাথে থাকি তখনি আপনার ফোন আসবেই! আমার ভালো লাগেনা এসব, বুঝেছেন? সত্যি করে বলেন তো আপনি অফিসে প্রেম-ট্রেম করছেন নাকি? কিসের এত ফোন আসে সারাদিন আপনার?

—আহা! তুমি কি জেলাস নাকি? এজন্য ওভাবে ছুটছিলে তখন? কি করবো বলো কাজের চাপ অনেক বেশি আমার। বাবা কয়েক বছর পর রিটায়ার্ড হবেন তখন তো আমার উপর দায়িত্ব ও কাজ আরও বেড়ে যাবে। তাই এখন থেকেই অভ্যস্ত হচ্ছি। আর প্রান্তও তো নতুন জয়েন করেছে তাই ওকে শিখাতে হয় অনেক কিছুই। সবমিলিয়ে ব্যস্ত সময় পার করি অফিসে।

একটু থেমেই আবার ফিসফিসিয়ে বললেন,

—তোমার আমায় নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই, বউ। এ পূর্ণ আজীবন এক নারীতে আসক্ত ছিলো, এখনো আছে। পূর্ণর জীবনে তুর পাখি ছাড়া না কেউ কখনো ছিলো, না কেউ থাকবে কোনদিন। সো ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু ওয়ারি। তোমার বর শুধুই তোমার!

উনার কথায় বেড়ে গেলো হৃদস্পন্দন, ইষৎ কেপে উঠলাম আমি! ঠিক কতটা ভালোবাসা মিশিয়ে কথাগুলো বললেন উনি, সে ধারণা কি আছে তার? মানুষটা যে আমাকে কতটা ভালোবাসেন হয়তো উনি নিজেও জানেন নাহ! এক মুহুর্তের জন্য যেন থমকে গেলাম আমি। উনাকে কেন আটকিয়েছি, চারপাশে কি হচ্ছে সব ভুলে গেলাম! শুধু চুপচাপ উনার হৃদস্পন্দন শুনায় মনোযোগ দিলাম। কিছুক্ষণ পর পূর্ণর কথায় স্তম্ভিত ফিরে পেলাম আমি।

—ছাড়বেনা? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো আমাদের। তুমি চাইলে ফিরে এসে আমাদের রুমে সারারাত জড়িয়ে ধরে রেখো আমায়, আমি কিছু বলবোনা। কিন্তু এখন মার্কেট চলো! টাইম চলে যাচ্ছে, তুরফা!

লজ্জায়-ইতস্ততায় উনাকে ছেড়ে সরে দাড়ালাম আমি। কিছু বলে উঠার আগেই বাসার গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো প্রিয়া। হেলেদুলে আসতে আসতে আমাদের দেখে থেমে গেল সে। প্রথমে আমায় দেখে হাসলেও পরে আমার পাশে পূর্ণকে দেখে নিমিষেই সে হাসি উড়ে গেলো ওর ওষ্ঠদ্বয় হতে! খানিকটা হকচকিয়ে গেলো যেন এ সময় নিজের ভাইকে বাসায় দেখে। আমতা আমতা করে বললো,

—কোথাও যাচ্ছো তোমরা? বড় ভাইয়া, তুমি এত তাড়াতাড়ি বাসায় এসেছো যে?

—কেন? আমাকে এ সময় দেখে খুশি হোস নি তুই?

—খ-খুশি হবোনা কেন, ভাইয়া? আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম। কই যাও তোমরা?

ভয়ার্ত মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললো প্রিয়া। পূর্ণ সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ ওর দিকে। এরপর স্বভাবত গম্ভীর স্বরে বললেন,

—কিছু কাজ ছিলো তাই বাইরে যাচ্ছি। তুই এত দেরিতে বাসায় এলি কেন? তোর আবার কি কাজ ছিলো কলেজ শেষে?

—ফ্রেন্ডদের সাথে বের হয়েছিলাম, লাঞ্চ করতে করতেই দেরি হয়ে গেলো।

কাচুমাচু মুখে বললো প্রিয়া। তবে ওর কথা পূর্ণ ঠিক বিশ্বাস করলেন কি না উনার মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই! শুধু মাথা নাড়িয়ে গাড়ি বের করতে চলে গেলেন গ্যারেজ থেকে। পূর্ণ যেতেই যেন হাফ ছেড়ে বাচলো প্রিয়া! ছুটে এলো আমার কাছে। নিচু কণ্ঠে বললো,

—বড় ভাইয়া আজ এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে তুমি আমায় বলোনি কেন, ভাবী? একটু আগে বের হলেই তো আমায় রায়হান ভাইয়ার গাড়ি থেকে নামতে দেখতো! ওহ মাই গড! কথাটা ভাবতেই আমার লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে!

—তোমার ভেবেই ভয় লাগছে তাহলে তোমাকে রায়হান ভাইয়ার সাথে বাসার বাহিরে দেখে আমার কি ভয় লেগেছিলো একবার ভাবো? তোমার কি বুদ্ধি লোপ পেয়েছে নাকি প্রিয়া? কিভাবে বাড়ির এতকাছে এসেছো উনার সাথে? কেউ দেখে ফেললে কি হতো?

—সরি, ভাবী। আমার একদম মাথায়ই ছিলো না যে বড়ভাইয়া এমন সময় বাসায় আসতে পারেন! এরকম আর কখনো হবেনা!

—হুম, না হলেই ভালো। আজ না হয় উনাকে আটকিয়েছি আমি, রোজ এমন করবোনা কিন্তু। আমার ভালো লাগেনা উনার থেকে কিছু লুকোতে! উনি খুব বিশ্বাস করেন আমায়!

—আই প্রমিস, আমি আর কোন সুযোগই দিবোনা তোমাকে ভাইয়ার রাগের সম্মুখীন হওয়ার। এবারের মতো সরি আর আমায় বাচানোর জন্য থ্যাংক ইউ, ভাবীজান!

আমায় জড়িয়ে ধরে বললো প্রিয়া। ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। মেয়েটা অনেক সরল, ওর এমন হুটহাট আচরণের পরিণতি কি হবে তার ধারণাও নেই ওর মধ্যে! একে নিয়ে কি করবো আমি! এরই মধ্যে পূর্ণ ফিরে এলেন। বাসার বাহিরে গাড়ির হর্ণ বাজতেই আমি গিয়ে গাড়িতে বসলাম।

গাড়ি ছুটার আগেই জানালার কাচে টোকা দিলো প্রিয়া। সেদিকে তাকালাম আমরা দুজন। কাচ নামাতেই সে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো,

—কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরো তোমরা দুজন। একটা সারপ্রাইজ আছে তোমাদের জন্য!

প্রিয়ার কথায় চমকে গেলাম আমি, ভ্রু তুলে তাকালেন পূর্ণ । কিসের সারপ্রাইজের কথা বলছে সে হঠাৎ?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here