#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২০
.
সময় খুব অদ্ভুত জিনিস। কখনো খুব দ্রুত চলে যায় আবার কখনো যেনো কাটতেও চায় না। এটা নির্ভর করে মানুষ সময়কে কীভাবে চায় তার ওপর। সে বড়ই অবাধ্য। মানুষের মন মস্তিষ্ক নিয়ে খেলে খুব মজা পায় সে। যদি কেউ চায় সময় ধীরে চলুক তাহলে সময় যেনো খুব বেশিই দ্রুত চলে যায়। আবার যদি কেউ চায় সময় তাড়াতাড়ি পার হয়ে যাক তাহলে সময় যেনো আর কাটতেই চায় না। দোষটা আসলে কার? মানুষের মনের নাকি সময়ের সেটাও এক বিশাল প্রশ্ন। দেখতে দেখতে দুইমাস কেটে গেছে এর মধ্যে। সময়টা একটু বেশিই দ্রুত চলে গেলো এরকমটাই মনে হচ্ছে আমার কাছে। কিন্তু কী আর করার?
সন্ধ্যা নেমে আসবে ঘন্টাখানেকের মধ্যে । সূর্য পশ্চিম আকাশে পুরোপুরি ঝুকে গেছে। একদৃষ্টিতে দূরের প্রকৃতি দেখছি আমি। সেদিনের পর আদ্রিয়ানের সাথে কোনোরকম দুষ্টুমি করিনি আমি আর। কেন জানিনা সেদিনের পর থেকেই ওনার কাছে গেলে ভয় লাগে আমার। এইজন্যই একটু দূরে দূরে থাকি। সত্যি বলতে ভয়ের চেয়ে অনেক বেশি অভিমানও আছে ওনার ওপর। ওনার সেদিনের সেই ব্যবহার এ ভয়ের চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম। একটু মজা করেছি বলে এরকম করতে হবে? তাই ওনার সাথে পড়াশোনা আর দরকারি কথা ছাড়া আর কোনো কথা হয়না। অদ্ভুতভাবে ওনার এতে কিচ্ছু যায় এসছে না। এমন মনে হচ্ছে যেনো এটাই স্বাভাবিক। এমন এখন আর আমার ওপর হাত দিয়ে শোয়না। মাঝখানে কোলবালিশ না রাখলেও একটু দূরত্ব রেখেই ঘুমান। ওনার এরকম ব্যবহারে ওনার প্রতি জমা অভিমানটা ধীরে ধীরে বাড়ছে আমার। তবে আগে যেমন ওনাকে নিয়ে, আরও নানা বিষয় নিয়ে কল্পনা জল্পনা করতাম এখন সেসব বাদ দিয়ে দিয়েছি। এখন নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ শুধু পড়াতেই আমার। গত সপ্তাহে এইচ এস সি রেসাল্ট দিলো আমার। আলহামদুলিল্লাহ জিপিএ ফাইভ এসছে। সবাই কতো খুশি হয়েছিল সেদিন। বিশেষ করে আব্বু। রেসাল্ট বার আদ্রিয়ানই করেছেন। কিন্তু আমার রেসাল্ট দেখে উনি খুশি হয়েছেন কী হন নি সেটা বোঝাই যাচ্ছিল না। তবুও আমি পাত্তা দেই নি। উনি খুশি হলে হোক না হলে না হোক আই ডোন্ট কেয়ার। রাতে যখন আমি সবার সাথে মজা করে একটু দেরীতে রুমে ঢুকলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হালকা ধমক দিয়ে বললেন,
— ” অনেক লাফালাফি হয়েছে। এ প্লাস পেয়েছো বিশ্ব উদ্ধার করোনি। এখনও ইম্পর্টেন্ট পরীক্ষাটাই বাকি। তাই এসব লাফালাফি বাদ দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দাও।”
ওনার কথায় সেদিনও খারাপ লেগেছিল। কী হতো একটু মিষ্টি মুখে কনগ্রাচুলেট করলে। ওনাকে নিয়ে ভেবে বা অন্যকিছু নিয়ে ভেবে আর নিজের সময় নষ্ট করবো না আমি। এখন শুধু নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই ভাববো। পরীক্ষাটা শুধু দেই। চলে যাবো আমি এখান থেকে। আব্বু আম্মুর কাছে গিয়েই থাকবো। দরকার নেই আমার ওনার সাথে থাকার। এখন আমার পুরো ফোকাস শুধু পড়াশোনাতেই থাকবে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছি। হঠাৎ আপি এসে পাশে দাঁড়ালো। আমি আপির দিকে তাকাতেই আপি আমার হাতে একটা কফির মগ ধরিয়ে দিলো। আমি ওটা হাতে নিয়ে আবারও বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। আপি বলল,
— ” কী ব্যাপার বলতো? বিকেলে ঘুমাসনি?”
— ” ঘুম আসেনি আজকে আর আপি।”
আপি বেশ অবাক কন্ঠে বলল,
— ” আদ্রিয়ান বকবে তো?”
আমি বাইরে তাকিয়েই কফির মগে চুমুক দিয়ে বললাম,
— ” কী আর করার? বকলে বকুক?”
আপি রেলিং এ ভর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” কী হয়েছে কী তোর বলতো? কেমন যেনো হয়ে গেছিস তুই। আগের মতো আদ্রিয়ানের নিন্দে করিসনা, ওর নামে নালিশ করিস না। একদম চুপচাপ হয়ে গেছিস। কোনো সমস্যা হয়েছে?”
— ” তেমন কিছু না। কী আর হবে? ওনার নামে নালিশ করে ওনাকে বকে কী হবে বলোতো? থাকতে তো ওনার সাথেই হবে।”
আপি ভ্রু কুচকে বলল,
— ” এভাবে বলছিস কেন?”
আমি হেসে দিয়ে বললাম,
— ” ছাড়োতো আপি। আচ্ছা তোমরা হানিমুনে যাবেনা? বিয়ের তো ছয় মাস হয়ে গেলো।”
আপি মুচকি হেসে বলল,
— ” তোর ইফাজ ভাইয়া বলেছে যেদিন আদ্রিয়ান যেতে রাজি হবে সেদিনই আমরা যাবো সবাই মিলে।”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
— ” এটা কোনো কথা হলো? তোমরা নিজেদের মতো করে পার্সোনাল সময় কাটাবে আমাদের জন্যে বসে আছো কেনো?”
আপি একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” তোর সমস্যা কোথায় জানিস? সবসময় একলাইন বেশি বুঝিস।”
— ” ঠিকই তো বললাম।”
— ” হ্যাঁ সে অনেক ঠিক বলেছো। এবার বলতো প্রিপারেশন কেমন চলছে?”
— ” হ্যাঁ ভালো।”
আপি একটু পিঞ্জ করে বলল,
— ” হ্যাঁ সেই বর এতো যত্ন করে ধরে ধরে পড়াচ্ছে যে।”
আমি কিছু না বলে একটু হাসলাম। এরপর দুজনে আরও কিছুক্ষণ গল্প করে নিচে চলে গেলাম। সবার সাথে কথা বলতে।
রাতে আপি আর জাবিনের সাথে গল্প করে নিজের রুমে যাচ্ছি তখনই বাবা মামনীর রুমে কথা শুনে থেকে গেলাম। বাবা আদ্রিয়ানকে বলছেন,
— ” আদ্রিয়ান সবকিছুর সীমা থাকে। মেয়েটা তোমার কাছে একটু এটেনশন চায়। একটু ভালোবাসা চায়। কিন্তু তুমি তোমার ব্যবহারে ওকে বারবার কষ্ট দিচ্ছো।”
মামনী বলল,
— ” দেখ ও বাচ্চা মেয়ে। টিনএজেরার বলতে গেলে। এমন সময় ওদের মনেও তো নানারকম স্বপ্ন ঘুরপাক খায়। তুই যদি এমন করিস মেয়েটার কেমন লাগে? তোরতো উচিত ওকে খুশি রাখা। কিন্তু তু..”
আদ্রিয়ান মামনীকে থামিয়ে বলল,
— ” এটাই তফাত তোমাদের আর আমার মধ্যে। তোমরা সবকিছু সাময়িকভাবে দেখো, চিন্তা করো। তোমরা শুধু সাময়িক আনন্দটা দেখো। কিন্তু আমি আগে পরে কী হতে পারে, কোন কাজের কীএফেক্ট করতে পারে সব বিবেচনা কর তবেই কাজ করি। ওর প্রতি আমার আসল দায়িত্বটাই পালন করছি।..”
আমি আর না শুনেই চলে এলাম ওখান থেকে। বারবার এই দায়িত্ব দায়িত্ব শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি আমি। হ্যাঁ উনি আমার কেয়ার করেন কিন্তু এই দুই মাসে একবার চোখ তুলে ঠিক তাকায়ও নি আমার দিকে। শুধু রোবটের মতো আমার প্রতি নিজের ডিউটি করে গেছে। এভাবে আর কতদিন চলতে পারে?
__________________
আরো একমাস কেটে গেছে। কাল মেডিকেল এডমিশন এক্সাম। তাই বই এর মধ্যে খুব মনোযোগ দিয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছি। রাতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। আদ্রিয়ান আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে বন্ধ। হয়েছে এখন ঘুমিয়ে পরো। আমি একটু হাই তুলে বললাম,
— ” আরেকবার রিভাইস দেবো প্লিজ।”
আদ্রিয়ান বইগুলো সব গোছাতে গোছাতে বলল,
— ” কোনো দরকার নেই। দরকারে সকালে তাড়াতাড়ি ডেকে দেবো এখন চুপচাপ ঘুমিয়ে পরো।”
আমি বেশ অবাক হলাম যেই ছেলেটা রোজ আমার চোখে মুখে বারবার পানি দিয়ে জাগিয়ে রেখে একটা/দুইটা অবধি পড়াতো। সে আজ ঘুমাতে বলছে? কালকে এক্সাম বলে? আচ্ছা উনি ঠিক কী চান? শুধু নিজের দায়িত্বগুলো পালন করেই নিজের জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবেন? এসব ভাবতে ভাবতেই উনি বললেন,
— ” কী হলো শুয়ে পরো।”
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে তারপর শুয়ে পরতেই উনিও বইগুলো সব টেবিলে গিয়ে রেখে বেডে এসে উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে পরলেন। আজ কেনো জানিনা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি যে ওনাকে ভালোবাসি বা ওনার প্রতি দুর্বল তা কিন্তু না। শুধু বিয়ের পর থেকে স্বামী হিসেবে একটু টান অনুভব হয়। কিন্তু খারাপ লাগে এটাই নিজের স্বামী কাছে আমি শুধুই দায়িত্ব। যেটা জোর করে সবাই চাপিয়ে দিয়েছে ওনার ওপর। এরচেয়ে বেশি কষ্টের কী হতে পারে। আমি উল্টো দিকে মুখ করে শোয়া ছিলাম। আস্তে করে ওনার দিকে ঘুরে কাঁপা গলায় বলে উঠলাম,
— ” আদ্রিয়ান?”
উনি পেছনে না তাকিয়ে উল্টোদিকে মুখ করেই বললেন,
— ” হুম?”
— ” একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
— ” চুপচাপ ঘুমাও।”
আমি করুণ স্বরে বললাম,
— ” প্লিজ?”
আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
— ” আচ্ছা বলো।”
আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম,
— ” আমার জায়গায় যদি আপনার পছন্দের কোনো মেয়ে থাকতো? তারপ্রতিও কী শুধুই এভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করে যেতেন?”
আদ্রিয়ান এবার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তরপর বললেন,
— ” সবসময় মাথায় এসবই ঘোরে? ঘুমাও।”
কথাগুলো কঠোর হলেও বলার ওনার টোনটা বেশ ধীর ছিলো। আমি বিনয়ের সুরে বললাম,
— ” প্লিজ। বলুননা?”
— ” না। আমার উত্তর ‘না’। হয়েছে?”
ওনার মুখে না শোনার সাথে সাথেই আর কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছেটাই আর রইলোনা। ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটকাতে চাইছি। ওনার তো দোষ নেই। উনি তো নিজের জায়গায় ঠিক। উনি তো ইচ্ছে করে বিয়ে করেন নি বরং আমাকে এসে বলেওছিলো বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে আমিই অযথা জেদ দেখিয়েছিলাম। তবুও নিজের কোনো দায়িত্বের অবহেলা করেন নি উনি। সব করছেন আমার জন্যে। উনি নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করলে হয়তো খুব সুখি হতেন। আমিও আর ওনার কাছে বোঝা হয়ে থাকবোনা। কালকে পরীক্ষাটা দিয়েই চলে যাবো। খুব ভালো করে পরীক্ষা দিতে হবে আমাকে। কালকে পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর আমার আর কোনো প্রেশার থাকবে না, টেনশনও থাকবেনা, ফ্রি হয়ে যাবো। এরপর আর ওনার জীবনে অশান্তি বাড়াতে ফিরবোনা। কখনো আসবোনা ওনাকে আর জ্বালাতে।
#চলবে…