ভালোবাসি তোকে ❤ #লেখিকা: অনিমা কোতয়াল #পর্ব- ২৫

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৫
.
আদ্রিয়ান নিজের স্টাইলে ভ্রু বাকিয়ে কিউট এক্সপ্রেশন দিয়ে এক কান ধরে বসে আছেন। ওনাকে এভাবে দেখে আমার খুব হাসি পাচ্ছে।এতো কিউট কেনো উনি? সত্যি কথা বলতে ওনার মুখের দিকে তাকালেই ওনার প্রতি জমা সব রাগ গলে জল হয়ে যায়। আমি হাসিটা চেপে রেখে ওনার দিকে তাকাতেই উনি ঠোঁটটা হালকা বাকিয়ে চোখ ছোট করে ইশারা করলো মাফ করে দিতে। আমি বাকি সবার দিকে তাকিয়ে দেখি সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি কী করি সেটা দেখার জন্যে। আমি কিছু একটা ভেবে হাত ভাজ করে গম্ভীর মুখ করে ভ্রু নাচিয়ে বললাম,

— ” সরি কীসের জন্যে?”

উনি একটু আশেপাশে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বললেন,

— ” এখানেই বলতে হবে?”

আহারে! বেচারা সবার সামনে বলতে হেজিটেড করছে। কিন্তু আমিতো বলিয়েই ছাড়বো। তাই আমি মুখে সিরিয়াস ভাব নিয়েই বললাম,

— ” হ্যাঁ। সবার সামনে যখন সরি বলছেন তখন সরি বলার কারণটাও তো সবার সামনেই বলতে পারা উচিত তাইনা? কেনো বলছেন সরি?”

ইফাজ ভাইয়াও একটু পিঞ্চ করে বলল,

— ” হ্যাঁ বল কেনো বলছিস সরি?”

জাবিন হাত দুটো সামনে এনে এক করে দুলতে দুলতে বলল,

— ” হ্যাঁ ভাইয়া বলনা কেনো বলছিস?”

এরপর সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো,

— ” তাইতো কেনো বলছো?”

আদ্রিয়ান সবার দিকে তাকিয়ে একটা হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” বিয়ের প্রথমরাতে খুব বেশি খারাপ ব্যবহার করেছি তোমার সাথে। যা হয়েছে সবকিছুর জন্যে তোমাকে ব্লেম করেছিলাম, যেখানে তুমি ঠিক ততোটাই নিরুপায় ছিলে যতোটা আমি। এরপর প্রায় না চাইতেও তোমাকে কষ্ট দিতে হয়েছে বারবার। তাই এতোদিনের সবকিছুর জন্যে সরি বলছি। আ’ম রিয়েলি সরি।”

বলে মুখটা আবার আগের মতোই ইনোসেন্ট করে ফেলল। সবাই বলছে সরি এক্সেপ্ট করে নিতে। নাহ এই ছেলের ওপর আর রাগ করে থাকতে পারব না আমি। এভাবে সরি বললে আর রেগে থাকা যায়? তাই আর ভেতরে হাসিটা চেপে না রেখে ফিক করে হেসে দিলাম। হাসতে হাসতেই হাত বাড়িয়ে দিলাম ওনার দিকে ওঠার জন্যে। উনি আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন। সবাই হেসে হাততালি দিয়ে উঠল। আদ্রিয়ান বিরক্ত হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” আরে টিম অফ গাধাস্। এভাবে হাততালি দেওয়ার কী আছে? প্রপোজ করছি আমি ওকে? সবগুলো তারছেড়া।”

আদিব ভাইয়া তুরি বাজিয়ে বললেন,

— ” বেস্ট আইডিয়া। আদ্রিয়ান সরি যখন বললি প্রপোজটাও করে ফেল?”

সাথে সাথেই সবগুলোতে মিলে হইহই করে উঠল। সবাই মিলে বলতে শুরু করল প্রপোজ করার জন্যে। আমি বোকার মতো একেকবার একেকজনের দিকে তাকাচ্ছি। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে সবার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

— ” চুপপ!”

সবাই সাথেসাথেই চুপ হয়ে গেলো। আদ্রিয়ান বিরক্তি মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

— ” বউটা কার? আমার। প্রপোজ কে করবে? আমি। আমি আমার বউকে যখন ইচ্ছে যেখানে ইচ্ছে নিয়ে গিয়ে প্রপোজ করবো তাতে তোদের কী রে?”

ইফাজ ভাইয়া মুখ ফুলিয়ে বললেন,

— ” আদ্রিয়ান এটা ঠিক না। আমরা সবাই হেল্প করেছি তোর বউকে সরি বলতে। এখনি ভুলে গেলি?”

আদ্রিয়ান ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে বলল,

— ” হ্যাঁ তো? এটা ডিউটি ছিলো তোমাদের সবার নিজের ভাইয়ের প্রতি। বুঝলে?”

কেউ আর কিছুই বলল না কারণ সবাই জানে আদ্রিয়ানের সাথে তর্কে কেউ পেরে উঠবে না। এরপর সবাই ছাদে মামা মামীদের আর নানুকে ছাদে নিয়ে এলাম। নানু এসেই আদ্রিয়ানকে পিঞ্চ করে বলল,

— “কীগো ভাই আমার নাতনির মান ভাঙানো হচ্ছিল বুঝি?”

আদ্রিয়ান হেসে গিয়ে নানুকে একহাতে জরিয়ে ধরে গাল টেনে বলল,

— ” হ্যাঁ সুইটহার্ট। তোমার নাতনির রাগ তো না যেনো মহা শক্ত এক পাথর। ভাঙাতে ভাঙাতে আমার অবস্থা কাহিল।”

— ” করতে তো হবেই। আমার খুব আদরের নাতনি বুঝলে। আর যদি কখনও ওকে কষ্ট দিয়েছ তো লাঠির বাড়ি একটাও নিচে পরবেনা হ্যাঁ।”

আদ্রিয়ান মুচকি হাসি দিয়েই বলল,

— ” আমি ইচ্ছাকৃত আর কোনো কষ্ট দেবোনা তোমার নাতনিকে। কিন্তু তোমার নাতনি ভবিষ্যতে আমাকে কষ্ট না দিলেই হয়।”

আমি ওনার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালাম। উনি মুখের হাসির রেখাটা আরও বড় করলেন। এরপর সবাই মিলে ছাদে পাটি পেতে বসে গরম গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ডিনার করতে বসলাম। বিকেলে বৃষ্টি হওয়ায় ঠান্ডা পরেছে তাই আরও মজা লাগবে। ঠান্ডায় গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছের তুলনা হয়না। কিন্তু খেতে বসে আরেক সমস্যা হলো। আমি মাছ বাছতে পারিনা। সবসময় আম্মু বেছে দিতো। অনেকে বলে ইলিশ মাছ বাছার কী দরকার? কিন্তু আমি না বেছে মোটেও খেতে পারিনা। তাই মাছটা পাতে নিয়ে বসে আছি। এতো সুন্দর ঘ্রাণ আসছে যে খেতে ইচ্ছে করছে। ধ্যাত! হঠাৎ করেই আদ্রিয়ান আমার পাত থেকে মাছটা নিজের পাতে নিয়ে নিলেন আমি অবাক হয়ে তাকালাম। সবাই খাওয়া থামিয়ে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান মাছ বেছে বেছে আমার পাতে দিতে লাগল। সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। আমি কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। বাকিরাও খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। খেতে খেতে সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দিলাম। সত্যিই পরিবারের সবাই একজায়গায় বসে আনন্দ মজা করার মজাটাই আলাদা। এক অদ্ভুত শান্তি থাকে এগুলোর মধ্যে। পরিবার মানেই আস্তো এক ভালোবাসা। সবারই উচিত এই ভালোবাসাটাকে মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করা।

_________________

রুমে এসে বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটছি আর টেনশন করছি। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। না জানি কালকে কী হবে? এসব চিন্তায় শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। উনিও ওয়াসরুম থেকে বেড়োচ্ছেন না এখনও। আমার টেনশন বেড়েই চলেছে। একটু পরেই উনি ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেললেন। টাওয়েলটা দ্রুত রেখে আমার সামনে বসে কপালে গলায় হাত দিয়ে বললেন,

— ” কী হয়েছে অনি? এভাবে কাঁপছো কেনো? শরীর খারাপ লাগছে? ভয় পেয়েছো কোনো কারণে? কেউ কোনো ফোন বা মেসেজ করেছে? সেসব দেখে ভয় পেয়েছো? বলো?”

আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে ফোন, মেসেজ, ভয় কী বলছেন? আমার কিছু হতে দেখলেই ওনার মাথার তার ছিড়ে যায়। আমি নিজেকে সামলে অসহায় গলায় বললাম,

— ” কালকে রেসাল্ট দেবে তাইনা?”

আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বললেন,

— ” এইজন্যে টেনশনে এভাবে ভয় কাঁপছো আর ভয় পাচ্ছো?”

আমি করুণদৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। আদ্রিয়ান একটা শ্বাস ফেলে আমার দুই গালে হাত রেখে বললেন,

— ” কাম অন অনি? এতো টেনশন কেনো করছো? আমি বলেছি না একদম টেনশন করবে না? যা হবে ভালো হবে।”

আমি মাথা নিচু করে নিচু স্বরে বললাম,

— ” আমার ভয় করছে।”

আমার কথাটা শুনে আদ্রিয়ান উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বেডের ওপর পাশ দিয়ে গিয়ে উঠে বেডে হেলান দিয়ে বসে আমাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এক হাতে জরিয়ে ধরে বললেন,

— “তোমার মেডিকেলে চান্স হবে এটা শিউর আমি। আমি নিজে প্রিপার্ড করেছি তোমাকে তাই বলছি। এখন প্রশ্ন ডিএমসি তে হবে কী না? সেটা তুমি এক্সাম কেমন দিয়েছো তার ওপর ডিপেন্ডেড। আর তুমিতো বলেছো ভালো দিয়েছো? যা হবে খুব ভালো হবে।”

ওনার কথায় একটু শান্ত হতে পারলেও ভয় পুরোপুরি কাটলো না তাই ওনার টিশার্ট খামছে ধরে বসে রইলাম। উনি কিছুক্ষণ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে তারপর হাত বাড়িয়ে টি-টেবিল থেকে চকলেটের বক্সটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

— ” এটার থেকে দুটো নিয়ে খাও অনেকটা রিলাক্সড লাগবে। ”

আমি এমনিতেই চকলেটে মরি, তারওপর আবার টেনশনে আছি তাই কথা না বলে বক্সটা নিয়ে একটা চকলেট বেড় করে চকলেট বলটার র‍্যাপিং খুলে মনের আনন্দে খেতে লাগলাম। আপাতত অসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি এখন শুধু একমনে খাচ্ছি। একটা শেষ করে আরেকটা প্রায় শেষের দিকে তখন আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি হাত ভাজ করে একদৃষ্টিতে দেখছেন আমাকে, কপাল হালকা কুচকানো। হঠাৎই উনি এগিয়ে আসতে শুরু করলেন আমার দিকে। আমি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো? আমার বেশ অনেকটা কাছে এসে পরেছেন উনি আমি পেছানোর শক্তিও পাচ্ছিনা শক্ত হয়ে বসে আছি। উনি আস্তে আস্তে ওনার মুখটা আমার দিকে এগিয়ে আনতেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। একটু পরেই খেয়াল করলাম উনি আমার ঠোঁটের চারপাশে আঙুল ছোয়াচ্ছেন। আমি আরো অবাক হয়ে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি উনি আমার ঠোঁটের আশেপাশটা হালকা হাতে মুছে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

— ” বেবি সাধে বলি তোমায়? কীভাবে খাচ্ছো দেখো? পুরো বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।”

আমি ওনার দিকে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে বাকি চকলেটটা একবারে মুখে পুরে চিবোতে লাগলাম। উনি হেসে দিলেন আমার কাজে। এই ছেলেটার হাসিতেও সম্মোহনী ক্ষমতা আছে আছে। এতো সুন্দর করে হাসে কেউ? হাসলে ওনার চেহারার সৌন্দর্য কয়েকগুন বেড়ে যায়। উনি হাসলে চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে যায়, ওনার সবগুলো দাঁত সোজা সুন্দর হলেও প্রি-মোলার দাঁতটা একটু বাঁকা। যার ফলে ওনার হাসিটা আরও সুন্দর লাগে। ওনার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। উনি আমার চুলগুলো হাত দিয়ে সেট করে দিয়ে বললেন,

— ” পিচ্চি একটা।”

আমি চিবোনো বন্ধ করে থম মেরে গেলাম। মাঝে মাঝে ওনার এই ছোট ছোট আদুরে কথাগুলো শুনলে কেমন জেনো অদ্ভুত শিহরণ হয় শরীরজুড়ে। এক অন্যরকম ভালোলাগা। উনি ইশারা ইশারা করতেই আমি মুখের চকলেট টা শেষ করে ফেললাম। এরপর উনি আমাকে ধরে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর দিয়ে দিলেন। এরপর আমার পাশে শুয়ে একহাতে আমার পেট জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলেন।

_________________

সোফায় একগাদা টেনশন নিয়ে বসে আছি। আদ্রিয়ান রেসাল্ট দেখার জন্যে ল্যাপটপ খুলেছে। সবাই উৎসুক হয়ে বসে আছে। পুরো শরীর কাঁপছে অলমোস্ট। ভয়ে এক সকাল কেঁদেই দিয়েছি। আদ্রিয়ান অনেক কষ্টে আমার কান্না থামিয়েছেন। এখনও ভয়ে আছি। আমার অবস্থা দেখে আদ্রিয়ান আমায় এক হাতে জড়িয়ে ধরে রেখে অপর হাতে রেসাল্ট চেক করছেন। অরু, ইশু, ঐশি সবার ডি এম সি তে হয়ে গেছে একটু আগেই কল এলো। আমাদেল কলেজের স্টুডেন্টদের মধ্যে চারজনের ডিএমসিতে হয়েছে বলে এখনও জানা গেছে। আমার না হলে কী হবে? আমিই এতোক্ষণ চেক করতে দেইনি ভয়ে। অনেক কষ্টে আমাকে রাজি করিয়ে বসিয়েছেন উনি। আদ্রিয়ান কী ভাববেন? কেমব্রিজ থেকে পাশ করা একজন ইঞ্জিনিয়ার এর বউয়ের মেডিকেলেও চান্স হলোনা? এসব চিন্তা করে আদ্রিয়ানের শার্ট শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।কিছুক্ষণ পর উনি বললেন,

— ” অনি ল্যাপটপের স্ক্রিণে তাকাও?”

আমি চোখ বন্ধ রেখেই না বোধক মাথা নাড়লাম। উনি আবারও আলতো গলায় বললেন,

— ” একবার দেখে তো নাও?”

— ” না আমার ভয় লাগছে আপনিই বলুন।”

আদ্রিয়ান এবার একটু জোরেই বললেন,

— ” অনি আমি দেখতে বলেছি তোমায়।”

ওনার হালকা ধমকিতে ভয় পেয়ে পিটপিটিয়ে ওনার দিকে তাকাতেই উনি স্ক্রিনে দেখতে বললেন। আমি ভয়ে ভয়ে স্ক্রিণে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা আমি।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here