#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৯
.
অপেক্ষা! ভীষণ কঠিন একটা জিনিস।অপেক্ষার সময়গুলো কাটতেই চায়না। আর সেই অপেক্ষা যদি কোনো ভয়ংকর সময় কেটে যাওয়ার তাহলে সেই অপেক্ষার প্রহর পার করা যে কত কঠিন সেটা কোন ভাষা বা শব্দ বোঝানো যায় না। প্রতিটা মুহূর্ত একেকটা যুগের মতো মনে হয়। আমাদের ক্ষেত্রেও ব্যপারটা তাই হয়েছে। সময় কাটতেই চাইছে না, অপেক্ষার একেকটা প্রহর শেষই হচ্ছে না। এটা যেন অনন্তকালের অপেক্ষা। সবাই হসপিটালের ওটির সামনে বসে আছি। ইশরাক ভাইয়ার মা মানে আন্টি বেঞ্চে বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে কাঁদছেন আর আঙ্কেল ওনাকে সামলানোর চেষ্টা করছে । আদিব ভাইয়া আর ইফাজ ভাইয়া আর আপি একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বড় আব্বু, আর বাবাও ওপর একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছেন। আর আদ্রিয়ান একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে ভ্রু কুচকে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি ওর কাছ থেকে একটু দূরে। সকলের মুখেই মারাত্মক চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। নূর আপু আর ওনার বাচ্চা আমাদের কাছে যে শুধু দুটো প্রাণ নয়, আমাদের সবার আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা সব মিশে আছে ওই দুজনের সাথে। আর ইশরাক ভাইয়াও তো আমাদের খুব ভালোবাসার একজন মানুষ ছিল। আর ওরাতো একজন ইশরাক ভাইয়ার অর্ধাঙ্গিনী আর একজন ইশরাক ভাইয়ার অংশ। দুজনের কারোরই যদি সামান্যতম ক্ষতি হয়ে যায় তাহলে আমরা নিজেদের সামলাতে পারবোনা, কিছুতেই না।
আদ্রিয়ান বেড়িয়ে যাওয়ার পরেই কয়েকসেকেন্ড ‘থ’ মেরে বসে থেকে আমি ওড়নাটা হাতে নিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলাম। আদ্রিয়ান খুব জোরে ড্রাইভ করছে। হসপিটালে পৌছাতেই আমরা দুজনে গাড়ি থেকে নেমে একসাথে প্রায় দৌড়ে ভেতরে গেলাম। ভেতরে গিয়ে দেখি আঙ্কেল, আন্টি বসে আছেন। আদ্রিয়ান দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে আঙ্কেলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ” নূরের কী অবস্থা এখন?”
আঙ্কেল আস্তে করে বললেন,
— ” ওপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হয়েছে। ডক্টর বলেছে আঘাত বেশ ভালোভাবেই লেগেছে। বাচ্চাটাকে হয়তো বাঁচাতে পারবোনা।”
আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলো। আমিও আন্টিকে জড়িয়ে ধরে নিজের চোখের জল ছেড়ে দিলাম। আদ্রিয়ান বলল,
— ” কী করে হলো এসব?”
এরপর আঙ্কেল আমাদের সবটা খুলে বলল। আঙ্কেলের ভাষ্যমতে, নূর আপুকে খাবার নিয়ে আসতে গিয়েই আপুর চিৎকারের আওয়াজ পায় আন্টি এরপর খাবার ফেলেই দৌড়ে গিয়ে দেখল নূর আপু ওয়াসরুমের ফ্লোরে পরে আছে আর পেট ধরে চিৎকার করছে। এরপরেই প্রতিবেশিদের ডেকে গাড়িতে তুলে হসপিটালে আসার পথেই আদ্রিয়ানকে ফোন করেছে। আমি আন্টিকে ধরে বেঞ্চে বসলাম। আঙ্কেল ও বসল। আমাদের বাড়িয়েও খবর দেওয়া হয়েছে। একটু পর বড় আব্বু, বাবা, ইফাজ ভাইয়া, আপি আর আদিব ভাইয়া এলেন।
আর এরপর থেকেই এই নিরব, দমবন্ধকর পরিবেশে আটকে আছি আমরা। ভেতর থেকে এখনও কোনো খবর আসছে না। কিছুক্ষণ পর একজন নার্স একপ্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে এলো, আমরা কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না।কিছুক্ষণ পর যখন নার্স ফিরে এলো তখন আদ্রিয়ান ওনাকে আটকে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু নার্স উত্তর না দিয়েই চলে গেল। সুতরাং খুব সহজেই আমরা সবাই বুঝতে পারলাম যে নূর আপুর অবস্থা একেবারেই ভালো না। আদ্রিয়ান দিকে তাকিয়ে দেখলাম আদ্রিয়ানের নিচের ঠোঁটটা হালকা কাঁপছে। আদ্রিয়ান দেয়ালে জোরে একটা পাঞ্চ মেরে হনহনে পায়ে চলে গেল ওখান থেকে। আমিও আদ্রিয়ানের পেছনে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি ও বাইরের একটা বেঞ্চে বসে দুই হাতে মুখ চেপে ধরে চুপচাপ বসে আছে। আমি ধীরপায়ে ওর পাশে গিয়ে বসে ওর কাধে হাত রাখলাম। ও মাথা তুলে আমার দিকে ছলছলে চোখে একবার তাকিয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেল। আমি ওর পিঠ আকড়ে ধরতেই ও আমার জরিয়ে ধরে রেখেই ভাঙা গলায় বলল,
— ” নূর আর ওর বাচ্চার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা অনি। ইশরাককে কী জবাব দেবো আমি? ও তো ওদের দায়িত্ব আমাকেই দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যদি আজ কিছু হয়ে যায় নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবো। ইশরাকের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ ছিল ওরা। ইশরাক কে না চাইতেও যেতে দিতে হয়েছে কিন্তু ওদের যেতে দিতে পারবোনা।”
আমি ওকে আরও শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললাম,
— ” কিচ্ছু হবেনা নূর আপুর। ওরা দুজনেই ভালো থাকবে দেখবেন। আল্লাহ এতোটা নির্দয় হতে পারেন না। একটা মানুষের বারবার এরকম ভয়ংকর পরিণতি দেবেন না উনি। দেখবেন এবার সব সব ঠিক হবে।”
আমার কথায় আদ্রিয়ান কিছুটা স্বস্তি পেল কী না জানিনা কিন্তু ওর কাঁপুনি পুরোপুরি থেমে গেল। কিন্তু আমাকে ছাড়লোনা ও খুব শক্ত করেই নিজের সাথে জরিয়ে রেখে দিল। আমিও চুপচাপ ওকে ধরে বসে রইলাম।
এভাবে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল। শ্বাসরুদ্ধকর কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরে সবাই বুক থেকে পাথর নামিয়ে দিয়ে ভালো খবর এলো। নূর আপুর ছেলে হয়েছে। আর নূর আপু আপু এবং বাবু দুজনেই সুস্থ আছে। তবে আপুর অনেকটা ব্লাড চলে গেছে যার ফলে রক্ত দিতে হচ্ছে এখনও। আঙ্কেল আন্টিকে দেখিয়ে আদ্রিয়ানের কোলে যখন বাচ্চাটাকে দিল। আদ্রিয়ান কাঁপাকাঁপা হাতে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কপালে একটা চুমু দিল। চোখ ছলছল করছে ওর। আমিও এগিয়ে গেলাম। বাচ্চাটা একদম ইশরাক ভাইয়ার মত হয়েছে। আদ্রিয়ান আমার দিকে এগিয়ে দিল আমিও বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম। তারপর ডক্টর বাচ্চাটা নিয়ে চলে গেল।
হঠাৎই ডক্টর এসে বলল,
— ” দেখুন পেশেন্ট ঠিক আছে কিন্তু ওনার এখন আরও রক্তের প্রয়োজন। ব্লাডব্যাংকে আপাতত AB+ আর নেই। যা আছে সেটা ওনাকে দেওয়া যাবেনা। কারণ উনি সদ্য বাচ্চা প্রসব করেছেন। আপনাদের কারো AB+ রক্ত হবে?”
আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে বললাম আমার রক্ত AB+। ডক্টর সাথে যেতে বললেন। আমি যেতে নিলেই আদ্রিয়ান আমার হাত ধরে বলল,
— ” তুমি এমনিতেই দুর্বল অনি। পারবেতো?”
আমি চোখের ইশারায় হ্যাঁ বললাম। আদ্রিয়ান কিছু বলতে গিয়েও বলল না। কারণ রক্ত দেওয়াটা এখন সত্যিই জরুরি। আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সব টেস্ট করে চেক করে নিয়ে ব্লাড নেওয়া হলো। বেশ অনেকটাই রক্ত দিতে হয়েছে। প্রথমে ডক্টর এতটা নিতে চায়নি কিন্তু ব্লাড দরকার নূর আপুর। তাই আমি ডক্টরকে রিকোয়েস্ট করে আরো দিয়েছি। আর এটাও বলেছি আদ্রিয়ানকে না বলতে। তবে এসবে ডক্টরকে কন্ভেন্স করতে আমার অনেক কাঠখর পোড়াতে হয়েছে। ভাগ্যিস উনি আব্বুর বন্ধু তাই আমার রিকোয়েস্ট ফেলতে পারেননি। মেডিক্যাল স্টুডেন্ট হওয়ার জন্যে এটুকু জানি যে এতে আমি মরে যাবোনা শুধু তিন চারটা দিন শরীর খুব উইক যাবে। একটু বেশি খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অনেকটা রক্ত দেওয়ায় শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছে আমার। ডক্টর আঙ্কেল বলল,
— ” মামনী আমি বলেছিলাম তোমাকে এমন করোনা। তুমি নিজেও এমনিতে উইক। এখন আরো অসুস্থ হয়ে পরছো। ”
আমি কিছু বলব তখনই আদ্রিয়ান এলো। আদ্রিয়ান আমার রেস্টের জন্যে আলাদা একটা কেবিন নিয়েছে। যদি জানতে পারে বেশি রক্ত দিয়েছি তখন আমার গালে ঠাটিয়ে না মারলেই হয়। আমি কেবিনে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই মাথা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল। আমি পরে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান আমাকে ধরে ফেলল। ডক্টর আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” এতোটা উইক কীকরে হলো।”
উনি কিছু বললেন না। মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আদ্রিয়ান উত্তরের অপেক্ষা না করে আমাকে কোলে তুলে নিলো। আমি বোকার মত তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ওর চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে যে রেগে আছে। ও আমাকে নিয়ে কেবিনে বালিশে হেলান দিয়ে শুইয়ে দিলো। এরপর ওখানে রাখা ডাবেল জলের গ্লাসটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
— ” ফিনিস ইট!”
আমি মুখ কুচকাতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু ওর চোখ রাঙানো দেখে আমি আর সেটা পারলাম না ইচ্ছে না থাকা ঢকঢক করে গিলে ফেললাম। এরপর ডিম সেদ্ধ এরপর ডিম সেদ্ধ খেতে হলো খালি। জনমেও এভাবে ডিম সেদ্ধ খাইনি কিন্তু আদ্রিয়ানের ভয়ে সেটাও কয়েক কামড়ে খেয়ে ফেললাম। এরপর ও পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো সেটাও খেয়ে নিলাম। শরীর ভীষণ দুর্বল লাগায় বালিশে সব ভর ছেড়ে দিয়ে হেলান দিলাম। আদ্রিয়ান সব পাশে রেখে আমার পাশে রেডে এসে বসে আমার দুই বাহু একটু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— ” এক্সট্রা ব্লাড দিয়ে তাইনা?”
ড্যাম! এই ছেলের কাছে কী জীবণেও কিছু লুকাতে পারবোনা আমি? ঠিক ধরে ফেলেছে। মিথ্যেও বলতে পারিনা ওকে আমি। তাই মাথা নিচু করে ফেললাম। ও একটু ঝাড়া দিয়েই আমার হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর কিছু না বলে কাউকে কল দিয়ে বলল,
— ” অনির কেবিনে এসো। একটু পর ফ্রুটস খাইয়ে দিও একটু। আমি দেখে আসছি বেইবি ঠিক আছে কী না।”
বলে আমার দিকে না তাকিয়ে বলল,
— ” আশা করি ফ্রুটসগুলো খেয়ে আমাকে উদ্ধার করবেন। এটার জন্যে অন্তত আমাকে আর কিছু বলতে হবেনা।”
আমি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর যাওয়ার দিকে এভাবে ওভার রিঅ্যাক্ট করার কী আছে? মরে গেছি আমি? কিন্তু আমার মনে আরেকটা প্রশ্নও জাগছে। নূর আপি পরলো কীকরে? এই শেষ মুহূর্তে হঠাৎ এমনিই স্লিপ কেটে পরে গেল? যেখানে আপু খুব শতর্ক মানুষ ছিল। এটাকি সত্যিই এক্সিডেন্ট? কেমন জেনো খটকা লাগছে।
রাতটা পার হয়ে বিকেল অবধি হসপিটালেই কাটলো। সন্ধ্যায় চলে এলাম আমরা। নূর আপু ভালো আছে এখন আর বাচ্চাও । কিছুদিন হসপিটালে থাকবে। সাথে আঙ্কেল আন্টি তো আছেই। আদ্রিয়ান সারাদিন আমার যথেষ্ট কেয়ার করলেও দরকার ছাড়া কথা বলেনি। আর যেটুকু করেছে আপনি করে করে বলেছে। ভীষণ রেগে আছে বাবু সাহেব। আমি খাটে হেলান দিয়ে বসে আছি ও খাইয়ে দিচ্ছে আমায়। আমাকে খাওয়ানোর সময়ও ও কিছু বলল না। আমার ভালো লাগছেনা ওর এই রাগ করে থাকা। সব ঠিক করে রেখে শুতে নিলেই আমি নিচু বললাম,
— ” সরি।”
ও কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের মতো কাজ করছে। আমি এবার কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম,
— ” সরি তো। আর হবেনা।”
ও এবার ঠোঁট কামড়ে নিজের চুলগুলো উল্টে ধরে তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আমার দুই বাহু টাইট করে ধরে বলল,
— ” সরি হ্যাঁ? সরি? এরকম কেন করিস তুই? আমাকে টেনশনে ফেলে কী মজা পাস বল? বুঝিস যে আমার ভয় হয়? দম আটকে আসে? কতোবার বোঝাবো তোকে এসব? ব্লাডের ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যেত। কে বলেছিল এসব করতে? হ্যাঁ? তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কী হবে ভেবেছিস তুই? আমাকে জিন্দা লাশ বানানোর খুব শখ তোর? মেরে ফেলতে চাস আমায়?কীভাবে বোঝাবো যে তোকে আমার কতোটা প্রয়োজন? কী করলে বুঝবি যে ভালোবাসি তোকে? বল কী করলে?”
#চলবে…
(রি-চেইক করতে পারিনি। একটু কষ্ট করে মিস্টেক গুলো বুঝে নেবেন।)