#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪০
.
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আদ্রিয়ানের দিকে। কতোটা রেগে গেছে সেটাই ভাবছি আমি। কতটা রেগে গেলে আমাকে তুইতুকারিও করছে সেটাই ভাবছি। যদিও ওর এই রাগের মধ্যেও আমার প্রতি ওর সীমাহীন ভালোবাসা লুকিয়ে আছে, ওর ভালোবাসার মারাত্মক পাগলামো লুকিয়ে আছে। ওর কথার উত্তরে কোনো কথাই আর মুখে এলোনা শুধু ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ও আমার বাহু ঝাড়া দিয়ে ছেড়ে শুয়ে পরলো উল্টোদিকে ঘুরে। আমি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। আমি অসহায় চোখে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওর পাশ দিয়ে শুয়ে পরলাম। কিছুটা সময় কেটে গেল কিন্তু ও আমার দিকে ঘুরেও তাকাল না। অথচ আমি শোয়ার সাথে সাথে আমাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। খুব বুঝতে পারছি বাবু সাহেব ভীষণ রেগে আছে আমার ওপর। আমি নিজেই পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও আমার হাত ধরে সরাতে নিলে আমি ওর টিশার্ট থামচে ধরে টাইট করে ধরে রইলাম। ও যতই ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আমি ততই শক্ত করে ধরছি আমি ওকে।কিছুক্ষণ পর ও আর ছাড়ানোর চেষ্টা করলোনা চুপচাপ শুয়ে রইল, আমিও মুচকি হেসে ওকে জরিয়ে ওর সাথে মিশে শুয়ে রইলাম। ওর শক্তির কাছে আমার শক্তি কিছুই না, ও যদি সত্যিই চাইত তো এক ঝটকায় আমাকে ছাড়াতে পারতো কিন্তু বাবু সাহেব তো সেটা চায়ই নি, শুধু ওপর ওপর দিয়ে রাগ দেখাচ্ছে। ছেলেটা আসলেই একটা পাগল। ওর ভালোবাসা, যত্ন, দায়িত্ববোধ এর মত ঠিক তেমনই ওর শাসন, অভিমান আমাকে একই ভাবে মুগ্ধ করে। এসব নানারকম কথা ভাবতে ভাবতে ওকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পরলাম।
সকাল রোদের হালকা আলো চোখে পরতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটা লম্বা হাই তুলে উঠে বসে দেখলাম আদ্রিয়ান নেই পাশে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি আদ্রিয়ান ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে। আর একদৃষ্টিতে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছি এখনও রেগে আছে আমার ওপর। কারণ রোজ সকালেই ও আমার কপালে চুমু দিয়ে আমায় ঘুম থেকে তোলে। উফফ! এই ছেলের ভালোবাসা যত মারাত্মক, রাগ তার চেয়েও বেশি মারাত্মক। তবে আমিও দেখি এই ছেলে কতক্ষণ রেগে থাকতে পারে আমার ওপর। আমি গিয়ে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর একহাতে কফি মগ তাই আরেক হাত দিয়ে আমার এক হাতের ওপর হাত দিয়ে সরাতে নিলো কিন্তু আমি ছাড়লাম না। আদ্রিয়ান বলল,
— ” অনি ছাড়ো।”
আমি আরও টাইট করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— ” উমহুম? তোমার কথায় ধরেছি নাকি যে তোমার কথায় ছাড়বো?”
— ” সকাল সকাল আবার ড্রামা শুরু করে দিলে?”
আমি দুষ্টু হাসি দিয়ে বললাম,
— ” বাংলা ড্রামা। আর ড্রামার নাম “পতীদেবের মান ভাঙাও”।
আমার কথাটায় ওর মুখের রিঅ্যাকশন ঠিক কেমন হয়েছে সেটা বলতে পারছিনা কারণ ও উল্টো ঘুরে আছে। কিছুক্ষণ পর ও বলল,
— ” ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমাকে খাইয়ে হসপিটালে যাবো আমি।”
— ” আমিও তো যাবো।”
ও এবার আমাকে ছাড়িয়ে পেছনে ঘুরে বলল
— ” থাপ্পড়টা হয়তো অনেকদিন যাবত খাননা আপনি? তাই খাওয়ার খুব শখ হয়েছে। নিজের অবস্থা দেখেছো?”
আমি মুখ ফুলিয়ে মাথা নিচু করে বললাম,
— ” তুমি আছোতো? তোমার সাথেসাথেই থাকব। কিচ্ছু হবেনা দেখো।'”
— ” চুপচাপ গিয়ে ফ্রেশ হতে এসো।”
আমি এবার করুণ স্বরে বললাম,
— ” প্লিজ! আমি বাবুকে দেখব।”
আদ্রিয়ান চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
— ” জেদ করোনা অনিমা। মিনিমাম তিনদিনের আগে বাড়ি থেকে বেড় হতে দেবোনা আমি।”
— ” কিন্তু..”
— ” নো মোর কিন্তু! আমি ভিডিও কলে নূরের সাথে কথা বলিয়ে দেবো তোমার সাথে। আর বাবুকেও দেখিয়ে দেবো।”
আমি গোমড়া মুখ করে আস্তে আস্তে হেটে ওয়াসরুমে চলে গেলাম কারণ আমি জানি যে আদ্রিয়ান যখন একবার বলে দিয়েছে বেড়োতে দেবেনা তখন দেবেই না। এতোক্ষণ ও আমার ওপর রেগে থাকলেও এখন আমিও ওর সাথে আছি।
আদ্রিয়ান হসপিটালের আর নিজের ল্যাবের সব কাজ সেড়ে রাতে বাড়ি ফিরলেন। সারাটাদিন বড্ড বোরিং কেটেছে আমার। সারাটাদিন আমার একলা সময়ের ফ্রেন্ড ‘বোনি” এর সাথেই কাটিয়েছি। বোনি কে চিনলেন না নিশ্চয়ই? আসলে আমাদের মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের একটা ক্লোজ, ডিয়ারেস্ট ফ্রেন্ড থাকে। সেটা হলো আস্তো একটা মানব কঙ্কালের মডেল। কঙ্কালই বলা যায়। রিয়েল না হলেও দেখতে পুরোটাই রিয়েল লাগে। আমি ওনার নাম রেখেছি ‘বোনি’ যেহেতু এটা বোন থেকেই বোনি নামটা রেখেছি। তো ওটাকেই কোলে নিয়ে বসে বসে কথা বলছিলাম তখনই ও রুমে এলো। যেহেতু আমি ওর দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বোনির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
— ” দেখলি? এলো সারাদিন পর। হুহ মুখেই এতো কেয়ার। আসলে সবটাই আমাকে ঘরে আটকে রেখে দেওয়ার ধান্দা।”
আদ্রিয়ান টাই খুলতে খুলতে ভ্রু কুচকে বলল,
— ” কী বিড়বিড় করছো?”
আমি নিজেকে সামলে একটা মেকি হাসি হেসে বললাম,
— ” না কিছুনা তুমি বসো আমি তোমার খাবার আনছি।”
— ” না ম্যাম। আপনাকে এতো কষ্ট করতে হবেনা। আমি মনিকে বলে দিয়েছি এক্ষুনি নিয়ে আসবে।”
আমি একটা মুখ ভেংচি দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। আদ্রিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আয়না দিয়ে আমায় দেখছে। আর আমি মাঝেমাঝে আড়চোখে ওকে দেখছি আর মুখ বাঁকাচ্ছি। একটু পর মনি আমাদের দুজনের খাবারের প্লেট নিয়ে এসে রেখে দিয়ে গেল। আর আদ্রিয়ানও ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এলো। খাওয়ার সময় দুজনের কেউই কারো সাথে আর কথা বলিনি। সব ঠিক করে ওয়াসরুম থেকে এসে দেখি আদ্রিয়ান নিজের চুল ঠিক করছে আয়না দেখে। আমার মেজাজটা মারাত্মক খারাপ হচ্ছে। ঠিক করে কথাও বলছেনা আমার সাথে। ভাব! আমি বেড ঠিক করতে করতে গুনগুনিয়ে গাইতে লাগলাম,
— ” দেখতে বর বর কিন্তু আস্ত বর্বর
একটা জুটে গেছে কপালে
দেখতে হ্যান্ডসাম কিন্তু ফেলুরাম
ফেসে গেছি আমি অকালে..”
গেয়ে আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও ভ্রু কুচকে আয়না দিয়ে দেখছে আমাকে। আমি বালিশগুলো ঠিক করে বসিয়ে দিতে দিতে গাইলাম,
কফিনের ফেলেছি গর্ত করে
ক’দিনেই গিয়েছি জ্বলে পুড়ে
গেলো না আর এই জীবনে
আমায় ছেড়ে এ আজব হেডএক
হুমমম হুমম হুমমমম হুমমম হুমম
দেখতে বর বর কিন্তু আস্ত বর্বর
একটা জুটে গেছে কপালে
দেখতে হ্যান্ডসাম কিন্তু ফেলুরাম
ফেস..”
এটুকু গাইতে গাইতে আমি পেছনে তাকাতেই আমি চমকে গেলাম, হাত থেকে বালিশটা পরে গেলো। আদ্রিয়ান আমার একদম সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পুরোপুরি গানের তালে থাকায় শেষের লাইনটা চেষ্টা করেও আটকাতে পারলাম না মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়েই গেল,
— ” ফেসে গেছি আমি অকালে।”
ও একটু এগিয়ে বলল,
— ” ফেসে গেছো?”
আমি একটু পিছিয়ে প্রথমে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লেও ব্যপারটা বুঝতে পারার সাথে সাথেই না বোধক মাথা নাড়লাম। আমি আরও পেছাতে গেলেই ও আমার কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
— ” আমি বর্বর? ফেলুরাম?”
আমি আবারও খানিকা তুতলে বললাম,
— ” অব্ আমিতো আসলে গান গাইছিলাম। এটাতো বাংলা একটা মুভির গান।”
ও চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,
— ” দিন দিন খুব বেশি দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো তুমি! আর তোমার সাহসও বেড়ে যাচ্ছে।”
আমি একপলক ওর দিকে আবার নিচের দিকে তাকালাম। ও আমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে হেসে দিল আর আমিও হেসে দিলাম।
_________________
সপ্তাহ কেটে গেছে। নূর আপুকে আগেই বাড়িতে আনা হয়েছে। আজ নূর আপুদের বাড়িতে ছোট করে একটা গেট টুগেদার হচ্ছে। সবাই মিলে একসাথে খাওয়াদাওয়া করব, আর বাবুর নাম রাখা হবে এটুকুই। আমাদের বাড়ি থেকে আমরা সবাই গেছি। ও বাড়িতে গিয়েই নূর আপুকে জড়িয়ে ধরলাম। আপুর চেহারা এখন একটু হলেও খুশির ঝলক আছে। মা হয়েছে তো, নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিজের বুকের চাপা কষ্ট কিছুটা হলেও কমাতে তো পারছে। বাবুকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করলাম। বাবুর নামকরণের দায়িত্ব নূর আপু আমার আর আদ্রিয়ানের ওপর দিলো। আমি আর আদ্রিয়ান পাশাপাশি সোফায় বসে ছিলাম। বাবু আমার কোলে। আমি আর আর আদ্রিয়ান দুজনেই ভাবছি আর বাবু দেখছি। ছেলেটার চেহারা প্রায় পুরোটাই বাবার মতই হয়েছে, কিন্তু নাক আর গায়ের রং নূর আপুর মত। ইশরাক ভাইয়া উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ছিলেন যদিও কিন্তু নূর আপু বেশ ফর্সা আদ্রিয়ানের মতই। কিছু একটা ভেবে আমি আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— “ইসরার”
আর আদ্রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” নীড়।”
এরপর আমরা দুজনেই একটু ভেবে ওর পুরো নাম ঠিক করলাম ‘ইসরার আহমেদ নীড়’। সবারই নামটা খুব পছন্দ হয়েছে। সুন্দরভাবেই সব মিটেছে। তবে এসবের মাঝে নূর আপুর চোখের কোণের জল এড়ায় নি আমার। হয়তো ইশরাক ভাইয়ার কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। সত্যিই উনি থাকলে হয়তো দিনটা অন্যরকম হতো।
আপির আগে সবাই একদিন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চে গেছিলাম। সবাই খাচ্ছি আর ইশরাক ভাইয়া আলোচনা করছে ওনার বেবিকে নিয়ে। নূর আপু বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” ইশরাক থামবে তুমি? বেবি আসা অবধি তো ওয়েট করো। সব প্লান এখনই করে ফেলছো।”
ইশরাক ভাইয়া হেসে বলল,
— ” আরে সুইটহার্ট আমার বেবি আমি ভাববোনা?”
আদ্রিয়ান হেসে বলল,
— ” তা সব ঠিক করলি বাচ্চার নামটা ঠিক করলি না? সেটা ফেলে রাখলি কেন?”
ইশরাক ভাইয়া মাথা নেড়ে বলল,
— ” উমহুম সেটা তুই করছি। বেবি আসার পর। আর তারমধ্যে যদি বিয়ে করে ফেলিস তো বউয়ের সাথে মিলে করবি।”
আদ্রিয়ান হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলল,
— ” আমার আর বিয়ে। দেখ কবে সে বড় হয় আর আমার ঘরে আসে।”
আদ্রিয়ানের কথার অর্থ সেদিন কেউ বুঝিনি আমরা। ইশরাক ভাইয়া হেসে বলল,
— ” আসবে মাম্মা আসবে। আমার বেবির কপালে যদি তোর বউয়ের দেওয়া নাম লেখা থাকে ঠিক চলে আসবে।”
অট্টোহাসির রোল পরে গেছিল সেদিন ওখানে ভাইয়ার কথা শুনে। তবে এখন এসব মনে পরলে আর হাসি পায়না। শুধু বেড়িয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস।
#চলবে…