গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
২১.২২.২৩
পর্বঃ২১
,
,
চারিদিকে কোলাহলে পরিপূর্ণ। মানুষে গিজগিজ করছে আশপাশ।এতো এতো কথাবার্তা হচ্ছে যে কান ঝালাপালা হয়ে যাবার উপক্রম।
এতো কোলাহলের মাঝেও দুএকজনের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
হুহু করে বুক ফাটা কান্না।
অপু নিশ্চল হয়ে বসে আছে।চোখ দিয়ে ফোটায় ফোটায় অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পরছে।
মুখ চোখ ফুলে লাল বর্ন ধারন করেছে তার।
অতিরিক্ত কান্নায় মাথা ধরে আছে।
পাশে নয়না খালা বসে আহাজারি করছে।
রুজি খালা মিসেস রিচিকে সামলাচ্ছে।
মিসেস রিচিও কাঁদছে।
আকুল হয়ে কাঁদছে। যেমনই মানুষ হোক না কেন তিনি তবুও তার স্বামীর মৃত্যুতে তিনি ভেঙে মুষড়ে পরেছেন।
অপু ভেজা ঝাপসা চোখে আরমান খানের নিষ্প্রান দেহ দেখছে।
সকালে যাকে চা দিয়ে হাসি মুখে ভার্সিটি গিয়েছিলো অপু আর এখন একটু সময়ের ব্যবধানে সে নেই?
এতোক্ষণ যার একটা নাম ছিলো এখন তার নাম পরিবর্তন হয়ে গেলো?নতুন নাম হলো লাশ?
আরমান খানের মুখের দিকে তাকাতেই তার হাসিমাখা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
তার আদরমাখা মা ডাকটা আর কখনো শুনতে পাবেনা অপু?
মায়ের পরে এই লোকটাই তো অপুকে এতোটা আপন করে নিয়েছিলো।আর এখন সেও চলে গেলো?
এ বাড়িতে আরমানের খানের ভরসায় ই তো অপু থাকতে পেরেছিলো।মাথার ওপর বটগাছের মতো দাড়িয়ে ছিলো লোকটা।
অপু ডুকরে কেদে উঠলো।
মাথার উপর ঠান্ডা রুগ্ন এক হাতের উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ মেলে উপরে তাকালো সে।
এক বয়স্ক বৃদ্ধা।অপুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তার চোখও ভেজা।গালে শুকিয়ে যাওয়া পানির দাগ।
কেমন মমতাময়ী চোখ!
তবে মুখ চোখ কুঁচকে আছে বেশ,বয়সের ছাপ স্পষ্ট।
অপু অবাক হয়।
এই বৃদ্ধাকে আগে কখনো দেখেনি সে।
ইনি কোথা থেকে এলেন?
অপুর চোখে মুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে রুজি খালা এগিয়ে এসে অপুর উদ্দেশ্যে বলে,
—ইনি বড় সাহেবের মা।তোমার দাদি শাশুড়ী।
অপু সালাম দেয়।
কন্ঠ কেমন যেন শোনায়।এতক্ষণ যাবত কান্নার ফলে গলা ভেঙে গেছে।
বৃদ্ধা মহিলাটি সালামের উত্তর নিয়ে অপুকে জড়িয়ে ধরে।অপু ডুকরে কেঁদে ওঠে।
বৃদ্ধাও কেদে ফেলেন।
কাউকে সান্তনা দিতে গিয়ে কাঁদতে নেই তিনি জানেন,তবু তিনি নিজেকে সংযত করতে পারেননা।
—–
জানাযা,দাফন শেষ হয়েছে।
বাড়িতে এখন শুনশান নিরবতা।একটা টু শব্দও শোনা যাচ্ছে না।
একটু আগে যেখানে মানুষের কোলাহলে কানে তালা লাগছিলো সেখানে এখন নিস্তব্ধতায় গা ছমছম করছে।
রুজি আর নয়না খালা রাতের রান্না শেষ করে বসে আছেন।
কেউ একটা দানাও মুখে তোলেনি।
অপু একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে নোমানের দাদির রুমে যায়।
বৃদ্ধার বয়স হয়েছে খুব।গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে,সোজা হয়ে ঠিক মতো হাটতেও পারেননা।
হাটতে গেলে একটু কুঁজো হয়ে হাটতে হয়।
তবুও তিনি নাকি ভীষন রকমের রাগী মহিলা।
কাজের একটু এদিক ওদিক হলেই নাকি বাড়ি মাথায় তোলেন।
তিনি এ বাড়িতে থাকতেননা।
গ্রামে থাকতেন।আরমান খানের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিলোনা তার।
তিনিই নিজেই সম্পর্ক ছেদ করেছিলেন।
কারন ছিলো আরমান খানের দ্বিতীয় বিয়ে।
নোমানের মাকে ফেলে রিচিকে বিয়ে করায় ঘোর আপত্তি জানিয়েছিলেন তিনি।এমনকি মেনেও নিতে পারেননি এ বিয়ে।
ছেলের কৃতকর্মের জন্য তার সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে গ্রামে থাকতেন বৃদ্ধা।
কিন্তু এখন ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে আর রেগে থাকতে পারেননি তিনি।তাইতো ছুটে এসেছেন ছেলেকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে।
অপু এসব কিছু শুনেছে রুজি খালার মুখ থেকে।
বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে সালাম দেয় অপু।
বৃদ্ধা খাটে বসে তজবি পরছিলেন।অপুকে দেখে তজবি হাতে নিয়ে সোজা হয়ে বসেন।বলেন,
—-আয় বইন,ঘরে আয়।
অপু হাতের খাবারের প্লেট পাশে রেখে বলে,
—খাবার খাননি কেনো দাদি?
—খাবার কি আর গলা দিয়া নামবো আমার?
—কিন্তু কিছু না খেলে যে আপনি অসুস্থ হয়ে পরবেন।তখন কি হবে বলুনতো?
বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
—কি আর হইবো,ছাওয়ালডার সাথে গিয়া একলগে থাকমু তখন।আমার আর কেডাই বা আছে?
–আমরা নেই?
বৃদ্ধা চকিত দৃষ্টিতে তাকায়।
সে দৃষ্টি অনুসরণ করে অপু আবার বলে,
—আমাদের কথা ভাববেন না দাদি?আমরা কি আপনার কেউনা?
বৃদ্ধা অবাক হয়।
চেনা নেই জানা নেই হুট করে একদিনের পরিচিত কাউকে কেউ এতোটা আপন করে নিতে পারে?এভাবে আকুল হয়ে তার সাথে কথা বলতে পারে?
তার চোখ ছলছল করে।
অনেকদিন পর এমন স্নেহার্দপূর্ন আচরনে তার বুক ভরে আসে।
অপু যেন তা বুঝতে পারে।
বৃদ্ধার রুক্ষ হাতদুটো নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।
যেন আশ্বাস দেয়,এইতো আমি আছি।আপনার আপন কেউ।
—-
বৃদ্ধাকে একমুঠো পরিমান খাবার খাইয়ে অপু নিজের রুমে আসে।
ক্লান্ত লাগছে তার।
শরীর মন দুটোই ক্লান্তিতে দুমড়ে মুচড়ে মুখ থুবড়ে পরছে যেনো।
কোনমতো শরীরটা টেনে হিঁচড়ে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।
ফ্রেশ হয়ে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়।
চোখ বুজে আসে।
আবার ফট করে চোখ খুলে বসে পরে।
আরমান খানকে তারা বাইরে কবরস্থানে রেখে এসেছে?
মাটির ঘরে শুয়ে আছেন তিনি আর অপুরা এতো নরম বিছানায়,আরাম করছে?
অপুর আবার কান্না পায়।
চোখ দিয়ে অঝোরে জল পরে।
বেলকনিতে শব্দ পেয়ে অপু থামে।
এতোরাতে বেলকনিতে কে?
পরমুহূর্তে মনে পরে,নোমান বাড়িতে আজ।
সে হয়তো বেলকনিতে আছে।
ধীরপায়ে বেলকনির দিকে এগোয় অপু।
নোমানের কি অবস্থা কে জানে।বাবাকে তো সে খুব ভালবাসতো।মুখেই বলতোনা শুধু।
বেলকনির দরজার কাছে দাড়িয়ে অপু থমকে যায়।
নোমানকে দেখে তার বুকটা মুচড়ে ওঠে।
এলোমেলো বিদ্ধস্ত অবস্থা তার।
চুলগুলো এলোমেলো,বুকের শার্টের উপরের বোতামগুলো খুলে আছে,নিচের দিকের শার্ট কুঁচকানো।
চোখদুটো অসম্ভব লাল।
অপুকে দেখে নোমান নরম গলায় বলে ওঠে,
—অপরুপা?এসো।
অপুর বুক ধক করে।
এই প্রথম হয়তো নোমান তার নাম ধরে ডেকেছে।
অপু ধীর পায়ে এসে নোমানের পাশে দাড়ায়।
নোমানের চোখ তখন গ্রীল ভেদ করে অন্ধকার আকাশ দেখায় ব্যাস্ত।
অপুর উপস্থিতি বুঝে সে অপুর দিকে ঝোঁকে।
অপু চোখ বন্ধ করে ফেলে।
নোমান অপুর মুখপানে একদৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
—আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে অপরুপা?খুব যন্ত্রনা হচ্ছে।
অপু মাথা ঝাকায়।এমন আকুতিভরা আবেদন ফেলতে পারেনা সে।
বলে,
—ঘরে আসুন দিচ্ছি।
—উহু,ঘরে না।এখানেই।
—এখানে?
—হু,এইযে এই দোলনার উপর বসো তুমি।
নোমানের কথা অনুসারে দোলনায় বসে অপু।
নোমান হাটু মুড়ে বসে অপুর কোলে মাথা রাখে।
দুহাত টেনে চুলে ঢুকিয়ে দেয়।
অপু যত্নকরে চুলে হাত বুলায়।
নোমান বলে,
—উত্তরার বাড়িটায় আমি খুব একা জানো অপরুপা,তুমি কি যাবে আমার সাথে?আমার আপন কেউ হয়ে?
,
,
গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
পর্বঃ২২
,
,
নোমানের বাড়িটা বিশাল।এতো বড় বাড়ি যে অপুর চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।
কি বিশাল বাগান সামনে,কতো নাম না জানা গাছ,ফুল।
সাইডে সুইমিংপুল।কি সুন্দর দেখতে সেটা।
কালো জামা পরা সিকিউরিটি গার্ড দাড়ানো লাইন দিয়ে।
অপু কয়েকঘন্টা ধরে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে।
নোমান সেদিকে ডাকায় না।
গাড়ি থেকে নেমে সোজা ঘরে ঢুকে নিজের রুমে চলে যায়।
অপু চারিপাশে দেখতে দেখতে এগোয়।
নোমানের রুম খুজতে খুজতে হাপিয়ে যায় অপু।
এতো বড় বাড়িতে এতোগুলো রুমের ভিরে নোমানের রুম কি করে খুজে পাবে অপু?আশেপাশে তাকায় কাউকে জিজ্ঞেস করার জন্য।
এ বাড়িতে কাজের লোকের ছড়াছড়ি। সবাই একরকম জামা কাপড় পরে চুপচাপ নিজেদের কাজ করে চলেছে।
অপুর কাছে এদের রোবট রোবট লাগছে।
অপু কাউকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করেনা।
এমন রোবটমার্কা মানুষদের সাথে অপুর কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।
সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে সে।
একরুম একরুম করে উকি দিয়ে নোমানকে খোঁজে।
অনেক খুজে একটা রুমে নোমানকে পায়।
এতোটুকু টাইমের মাঝে নোমান গোসলও সেড়ে ফেলেছে।
একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার পরে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে সে।
অপু দরজায় দাড়িয়ে নক করে।
নোমান সেদিকে তাকিয়ে আবার ল্যাপটপে নজর দেয়।সেদিকে তাকিয়েই বলে,
—ভেতরে এসো।
অপু রুমে ঢুকে একপাশে দাড়িয়ে থাকে।
কোথায় থাকবে, কি করবে বুঝতে পারেনা।
এমনকি অপু তো এটাও জানেনা যে এই রুমে সে নোমানের সাথে থাকবে কি না?নাকি তার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা আছে।
অপুকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নোমান আবার বলে,
—কি ব্যাপার,দাঁড়িয়ে আছো কেনো?
যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।
—কিন্তু আমার জামা?
—ঐ কাবার্ডে আছে দেখো।
নোমানের ইশারা করা কাবার্ড থেকে অপু জামা বের করে।
কিন্তু এটা তো শাড়ি।অপু আরও খোজে।নাহ,একটাও থ্রি পিস বা,অন্য কোন জামা নেই।
সব শাড়ি।
অপু বলে,
—এখানে তো সব শাড়ি।
নোমান কাজ করতে করতেই বলে,
—হুমমম তো?
–না মানে একটাও থ্রি পিস নেই?শাড়ি পরতে আমি কমফোর্টেবল ফিল করিনা।
নোমান ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে অপুর দিকে তাকায়।বলে,
—কমফোর্টেবল না হলেও অভ্যাস করে নাও।এখন থেকে তোমায়,সবসময় শাড়িই পরতে হবে।থ্রী পিস ইজ নট এলাউড।
অপু মুখ ভার করে।
লোকটা তাকে জোর করছে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে অধিকার খাটাচ্ছে।
পরমুহূর্তে খুশিতে মনটা ভরে ওঠে তার।
নোমান তার উপর অধিকার ফলাচ্ছে?
তারমানে সে কি অপুকে মেনে নিয়েছে?
খুশি মনে শাড়ি হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোয়।
আবার কিছু মনে পরতেই ফিরে আসে।
কাবার্ড খুলে তন্ন তন্ন করে কিছু খোজে।
না পেয়ে হতাশ হয়।
নোমান সেদিকে আড়চোখে তাকায়।
বলে,
—কি খুজছো?
অপু নোমানের সামনে দাড়িয়ে মুখ ফুলায়।একহাতে শাড়ি ধরে সামনে বাড়িয়ে ধরে।
নোমানের কপাল কুঁচকে আসে আপনাআপনি। বলে,
—কি?শাড়ি দিচ্ছো কেনো আমায়?আমি কি করবো শাড়ি দিয়ে?
—শাড়ির সাথে আর জিনিসগুলো কই?
—আর জিনিস মানে?
—শাড়ির সাথে ব্লাউজ পেটিকোট লাগে,জানেননা?সেগুলো কোথায়?
নোমান মাথা চুলকায়।সে সত্যি জানতোনা।ভেবেছে হয়তো শাড়িই কিনতে হয়,সাথে যে এতোকিছু লাগে সেটা মনে নেই তার।
বলে,
—এখনকার মতো চালিয়ে নাও।
আমি কাউকে বলে এখনি ওগুলোর ব্যবস্থা করছি।
অপু শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।
নোমান রুবেল কে ডাকে।
রুবেল তার সহকারী। নোমানের একডাকেই রুবেল হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে।
নোমান বলে,
—ব্লাউজ আর পেটিকোট লাগবে,নিয়ে এসো তো।
রুবেল হতভম্ব হয়।তার স্যার ব্লাউজ পেটিকোট দিয়ে কি করবে?
নোমান রুবেলের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
—কি হলো যাও।
রুবেল আমতাআমতা করে।সাহস করে বলে,
–আপনার মাপের ব্লাউজ পেটিকোট আনবো স্যার?সত্যিই আনবো?
নোমান রেগে যায়।ধমক দিয়ে বলে,
—আমার জন্য নাকি ইডিয়ট, তোমার ম্যামের জন্য।
গর্দভ বেরোও আমার রুম থেকে।
আউট!
রুবেল বুঝতে পেরে আবুল মার্কা হাসি হাসে।নোমানের চিৎকার, ধমক তার গায়ে লাগেনা।এতোকাল ধরে এসব শুনতে শুনতে সে এখন অভ্যস্ত।
মুখে বলে,
—ওহহ,বুঝছি স্যার।আচ্ছা এখনি আনছি।
রুবেল বেরিয়ে যেতেই অপু ওয়াশরুম থেকে বেরোয়।শাড়ি এদিকওদিক টানাটানি করে সে।
নোমান সেদিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়।
গ্রামের মহিলাদের মতো শাড়ি পরেছে অপু।
চুল একপেশে করে রেখেছে সে।
চুল থেকে টপটপ পানি ঝরছে।
নোমান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
অপু বিষয়টা লক্ষ করে লজ্জায় নুয়ে পরে।
নোমানকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে হুট করে পেছোন ঘোরে সে।
নোমান আবারও থমকায়।অপুর উন্মুক্ত খোলা পিঠের উজ্জলতায় চোখ ঝলছে আসে যেনো।হার্টবিট দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়।
শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়।হাত পা জমে আসে।
ছুয়ে দেওয়ার আশায় ভেতরটা আকুপাকু করে।পিছনে ফিরতে গিয়ে আবার ফিরে আসে,।ফট করে চুমু খেয়ে নেয় সে পিঠে।
অপু বুঝে উঠে পেছন ঘুরার আগেই গটগট পায়ে হেটে রুম থেকে বেরিয়ে যায় নোমান।
এই মুহুর্তে সে নিজেকে সামলাতে চায়।যা এ রুমে সম্ভব না।
কোন মতেই না।
,
গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
পর্বঃ২৩
,
,
খুব ভোরে ঘুম ভাঙে অপুর।
পাশফিরে দেখে নোমান শুয়ে আছে।নোমান কাল রাতে ওভাবে বেরিয়ে যাওয়ার পর কখন ফিরেছে অপু জানেনা।
নোমানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে খেয়েদেয়ে অপু ঘুমিয়ে পরেছিলো।তারপরে হয়তো নোমান এসেছিলো।
নোমানের মুখের দিকে বেশ কিছুসময় তাকিয়ে থাকে অপু।
জোড়া ভ্রুর পাশের তিলটায় হাত বুলায়।মাথার এলোমেলো চুলগুলো কপালের কাছ থেকে সড়িয়ে হাত দিয়ে ঠিক করে দেয়।আবার কি মনে করে এলোমেলো করে।
নিজের এমন বাচ্চামোতে নিজেই হাসে।
কুঁচকে যাওয়া শাড়ি হাত দিয়ে ঠিক করে খাট থেকে উঠে দাড়ায়।
ওয়াশরুম থেকে ফিরে নামাজ পরে নেয়।কিছুক্ষন এদিক সেদিক হাটাহাটি করে জানালার কাছে দারায়।
এই রুমটা অপু যতোবার দেখে ততোবারই মুগ্ধ হয়।
চারদিকে কাচের মতো সচ্ছ দেয়াল।
নিচের প্রকৃতি দেখা যায় কি সুন্দর ভাবে।
মোটা পর্দা টানানো চারিদিকে।
অপু একটা পর্দা সরিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে।
পর্দা সরানোর ফলে রুমে তীর্যক ভাবে আলো ঢোকে।
নোমানের চোখে পরে সে আলো।
নোমান চোখ মুখ কুঁচকায়। ঘুমের ঘোরেই মোচড়ামুচড়ি করে।
অপু সেদিকে তাকিয়ে তারাতাড়ি পর্দা টানায়।
সিড়ি বেয়ে নিচে নামে।
কিচেনে অনেক মানুষের টুংটাং আওয়াজ পেয়ে সেদিকে যায়।
কয়েকজন একরমক ড্রেসআপ পরা লোককে কাজ করতে দেখে।
একটা মানুষের সেবায় এতোলোক নিয়োজিত ভেবেই অপুর হাসি পায়।
একজন বয়স্ক বৃদ্ধ লোক অপুকে দেখে এগিয়ে আসে।
বলে,
—আপনার কিছু কি লাগবে ম্যাডাম?
—কিছু লাগবেনা এমনি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম।
অপু সবাইকে লক্ষ করে বিরক্ত হয়।কেমন রোবটের মতো কাজ করছে সবাই।
মনে হচ্ছে ব্যাটারি চালিত রোবট।
পাশে একটা মেয়ে কফি বানাচ্ছে।
বয়স ১৯/২০ হবে হয়তো।
সে খুব উঁকিঝুকি করছে।
তাকে দেখতে সবার মতো লাগছে না।
মনে হচ্ছে সে রোবট হয়ে চলাচল করায় অভ্যস্ত না।
অপুর ভাল লাগে,মনে হয় যাক একটা মানুষ তো আলাদা আছে।
—-সকালে নাস্তা করে নোমান অফিসে চলে যায়।অপু বাড়ি বসে একা একা কি করবে ভেবে পায়না।
তারচেয়ে ভার্সিটি যাওয়ার কথা ভাবে।
ভাবনা মতো ঝটপট রেডি হয়ে নেয়।
নীল একটা সুতির শাড়ি পরে নেয়।
এতোদিন ভার্সিটিতে সেলোয়ার-কামিজ পরে গেলেও আজ তাকে শাড়ি পরে যেতে হচ্ছে।
কেননা এ বাড়িতে একটাও সেলোয়ার-কামিজ নেই।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে অপু রিকশা নেয়।
কিছুসময় বাদে রিকশা ভার্সিটির গেটের সামনে দাড়ায়।
চালককে তার মজুরি দিয়ে গেটে ঢুকতে যেতেই অপুর হাতে টান লাগে।
পেছন ঘুরে দেখে রায়হান ভাই।
গোছানো পরিপাটি মানুষটার আজ এক অন্যরুপ দেখে অপু।
কেমন এলোমেলো লাগে দেখতে।
কুচকানো এলোমেলো শার্টের একহাত গুটানো আরেক হাতা ছাড়ানো।চোখমুখ কেমন শুঁকনো শুঁকনো ভাব।
অপু নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে রায়হানের হাতের বাধনে তার হাত আটকে আছে।
অপু হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে।মোচড়ামুচড়ি করে।
কিন্তু পারেনা।
রায়হান হাতের বাধন আরও শক্ত করে ধরে।
অপু ভীতি চোখে রায়হানের দিকে তাকায়।বলে,
—আমার হাত ছাড়েন রায়হান ভাই।
রায়হান সে কথার কর্নপাত করেনা।
নিজের মতো করে বলে,
—এতোদিন আসোনি কেনো রুপা? কেনো আসোনি তুমি?
জানো কি অবস্থা হয়েছিলো আমার?তোমাকে না দেখতে পেলে আমার কেমন লাগে জানো তুমি?
কেনো বোঝোনা তুমি?কেন বুঝতে পারোনা আমায়?কেন এতো কষ্ট দাও?
অপু কাঠ হয়ে দাড়িয়ে থাকে।
হাত ছাড়ানোর জন্য বারংবার হাত মোচড়ায়।
বলে,
—আপনি এমন কেনো করছেন?হাত ছাড়েন আমার।
রায়হান হাত ছাড়েনা, উল্টো আরও এগিয়ে আসে।
—ছাড়বোনা আমি হাত।সারাজিবন ধরে রাখতে চাই এ হাত।দেবে সে সুযোগ রুপা?
নইলে যে আমি মরে যাবো।
—এমন পাগলামো কেনো করছেন আপনি?কেনো বুঝতে চাইছেন না?
—কি বুঝবো আমি বলো?কি বুঝবো?
তুমি কেনো বুঝতে চাও না আমাকে?কেনো ভালবাসা যায় না আমায় রুপা?আমি কি এতোটাই খারাপ?এতোটাই অযোগ্য তোমার?
–আপনি অযোগ্য নন।আপনি খারাপ ও নন।কিন্তু আমার কথাটা তো শুনুন।
অপুর কথা শেষ হওয়ার আগেই রায়হান বলে,
—কিচ্ছু শুনতে চাইনা আমি।কিচ্ছু না।
আমি তোমাকে যেমন ভালবাসি তুমিও আমাকে ভালবাসবা।ব্যাস!
—আমি আপনাকে ভালবাসতে পারবোনা রায়হান ভাই।
—কিন্তু কোনো?
অপু শক্ত গলায় জবাব দেয়,
—আমি বিবাহিত রায়হান ভাই। আমি আমার স্বামীকে ভালবাসি।
রায়হান চমকে অপুর মুখপানে তাকায়।
হাতের বাধন আলগা হয়ে যায়।
হতবাক মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
অপু সেদিকে তাকিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়।
দ্রত পায়ে হেটে গেট দিয়ে ভার্সিটিতে প্রবেশ করে।
ক্লাসে গিয়ে ধপ করে বসে পরে।
মাথা ঘোরে খুব।
ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি খায়।
পিহু এসে পাশে বসে বলে,
—কি হয়েছে অপু?তোকে এমন কেন দেখাচ্ছে?
–না না কিছুনা,কিছুনা।
পিহু হেসে গলা জড়িয়ে নেয়।
রাহুল আর তার খুনসুটিময় প্রেমের গল্প শোনায়।
অপু তা শুনে হাসে কিন্তু মনে মনে ঠিকই খারাপ লাগে।
রায়হানকে সে কখনো ঐরকম নজরে দেখেনি।রায়হানকে কষ্ট দেওয়ারও তার কোন ইচ্ছে ছিলোনা।
কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো অপু নিজেও বুঝতে পারেনা।
—-
ক্লাস শেষে গেটের সামনে আবার রায়হানকে দেখে অপু।
পাশ কেটে এড়িয়ে যেতে চায় তাকে।কিন্তু পারেনা।
রায়হান অপুর সামনে এসে দাড়ায়।
পিহু রাহুল আগেই চলে গেছে।
অপু আশেপাশে চেনা মুখের সন্ধানে তাকায়।
কাউকে পায়না।
রাস্তায় একটা গাড়ি দাড় করানো দেখে মুখ চোখ খুশিতে ঝলমল করে।
এক পলকেই সে বুঝে ফেলে, ওটা নোমানের গাড়ি।
,
,
চলবে……