#বিলম্বিত_বাসর
#পর্ব_৬
#Saji_Afroz
.
.
.
আদুরের মুখে ‘গভীর কিছু’ কথাটি শুনতেই মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো আবেশের।
আদুরে অপেক্ষমান নয়নলোচনে আবেশের দিকে লক্ষ্য করছে। আর ভাবছে, এইতো আমার স্বামী আমার ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিচ্ছে।
কিন্তু না, এমন কিছুই যে হবেনা আদুরের অজানা।
নিজেকে স্বাভাবিক করে মৃদু হেসে আদুরের নাকে নাক ঘষতে ঘষতে আবেশ বললো-
বাড়ি যাবেনা?
-উহু।
-কি বলে পাজি মেয়েটা! এসব পরে হবে। শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে এখন।
.
কথাটি বলেই আবেশ তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে নামতেই আদুরে তার দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে রইলো।
একজন পুরুষ কিভাবে এতোটা আনরোমান্টিক হয় বুঝে উঠতে পারছেনা আদুরে।
লজ্জা বাদ দিয়ে নিজে ইঙ্গিতও দিয়েছে সে কি চাই আর ওই ম্যান্দামার্কা কিনা কিছুই বুঝলোনা!
শোয়া থেকে উঠে রাগান্বিত দৃষ্টিতে আবেশের দিকে তাকিয়ে আছে আদুরে।
আবেশ সেদিকে লক্ষ্য না করে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তৈরী হতে।
.
.
.
-সে কি! আজই পড়ালেখা শুরু হয়ে গেলো?
.
ফাতেমা বেগমের প্রশ্নে পরী লিখতে লিখতেই বললো-
হুম। আয়ান ভাইয়াটা হুট করেই আমাকে বললো লিখতে। এতো গুলো লেখা লিখতে বললো অথচ আমার ইচ্ছেই করছেনা।
.
পরীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আয়ান জিজ্ঞেস করলো-
কি করছে তোর?
-আপুর সাথে কথা বলতে।
-কোন আপু? সীমা?
-না। আবেশ ভাইয়ার বউ।
-ওইটা ভাবী হবে।
-সে তোমার ভাবী, আমি যা খুশি ডাকতে পারি।
-সেই তুই যা ডাকিস আমার সমস্যা নেই। কতোটুকু লিখেছিস?
-৬৫ পর্যন্ত।
-পুরোটা শেষ কর।
.
পেছনে ফিরে দরজায় দাঁড়ানো ফাতেমা বেগমের উদ্দেশ্যে পরী বললো-
ও খালা? বলোনা আজ যেনো ছুটি দেয়। বাকিটা কাল লিখবো। পিচ্চি একটা মেয়েকে একদিনে এতো চাপ দেয়া ঠিক?
.
পরীর কথা শুনে তাকে ব্যঙ্গ করে আয়ান বললো-
বাকিটা কাল লিখবো! ওরে আমার পিচ্চিরে! ক্লাস ১০ এ এখন তুই। ওতটাও পিচ্চি না যতটা তোর স্বভাবে লাগে।
.
আয়ানের কথা শুনে হেসে উঠলেন ফাতেমা বেগম।
হাসতে হাসতেই তিনি বললেন,
-ঠিক বলেছিস তুই।
-আমি ঠিকই বলি।
-আচ্ছা ড্রয়িং রুমে চল। তোর ভাইয়া ভাবী বের হবে। ভাবীর বাবার বাড়ি যাচ্ছে। দেখা করে নে।
-দেখা করার কি আছে!
-আসবি তুই!
-তুমি যখন বলেছো না এসে পারি!
.
ল্যাপটপটা বিছানার এক পাশে সরিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে পড়লো আয়ান। একটা হাই তুলে পরীর দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো-
পুরোটা শেষ কর লেখা।
.
.
.
-তুমি চাইলে আমাদের সাথে যেতে পারো আয়ান? মা বলেছিলেন সবাইকে নিয়ে যেতে।
.
আদুরের কথা শুনে হালকা হেসে আয়ান বললো-
আপনারা যান ভাবী। আমি নাহয় পরে কখনো যাবো।
-ঠিক আছে। আর তুমি আমাকে তুমি করে বলতে পারো। বড় বোন হিসেবে?
.
কিছু না ভেবেই আয়ান বললো-
হুম বলা যায়।
-আচ্ছা আসি আমরা।
.
ফাতেমা বেগমকে সালাম করে দাঁড়াতেই পেছন থেকে কারো স্পর্শ পেলো আদুরে।
আদুরেকে পরী জড়িয়ে ধরে বললো-
আপু তাড়াতাড়ি চলে এসো কেমন?
.
পরীর গলার স্বর শুনে আদুরে হেসে বললো-
চলে আসবো।
.
.
.
মেয়ে তার স্বামীর সাথে আজ বাসায় প্রথমবারের মতো আসতে চলেছে। সেদিন তাদের দেখেছে, কতোটা সুখী আছে তারা!
আদুরের মা তানিয়া হক অনেক খুশি তার জন্য।
তিনি সেই সকাল থেকে ব্যস্ত আছেন ঘর সাজাতে, রান্না করতে। সব মিলিয়ে একটুখানি বসার সময়টুকু যেনো তার নেই।
.
চুলোর উপরে রান্নার জন্য চিংড়ির পোলাও বসিয়েছেন তানিয়া হক। আদুরের চিংড়ির পোলাও খুব প্রিয়। তাই তিনি নিজের হাতে তার মেয়ের জন্য পোলাও করছেন।
হঠাৎ পেছন থেকে আদুরের ভাই তাহাফ বলে উঠলো-
বাহ আম্মিজান! আমি এতোদিন বললাম তুমি আমার পছন্দের মোরগের পোলাও করে দিলেনা। আর আজ আপুর সব প্রিয় খাবার সকাল থেকেই লিস্ট করে রেঁধে চলেছো। আব্বু ঠিক বলে। তুমি আসলে আপুকেই বেশি ভালোবাসো।
.
তাহাফের কথা শুনে হেসে ফেললেন তানিয়া হক। পোলাও নাড়তে নাড়তেই তিনি বললেন-
বোন পরের বাড়িতে চলে গিয়েছে খারাপ লাগেনা তোর? হিংসুটে টাইপের কথা কেনো বলছিস শুনি?
-খারাপ লাগেনা। বরং ভালোই লাগে। পুরা ঘরে আমি রাজ করতে পারি। হু…
.
কথাটি বলে তাহাফ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোজা আদুরের রুমে চলে আসলো।
বরাবরই তার আদুরের রুমটাই পছন্দের ছিলো। কতো আবদার, মারামারি করেছে এই রুমটা নেবার জন্য কিন্তু আদুরের বিয়ে হবার পর রুমটা ফাঁকা হওয়ার পরেও সে এই রুমটা নিতে পারলোনা। এই রুমে আসলেই যেনো আদুরের জন্য বুকটা হু হু করে উঠে। ইচ্ছে করে সেই মারামারি, খুনসুটিতে আবার মেতে থাকতে।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে তাহাফ বিড়বিড় করে বললো- কেনো যে বোনদেরই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়!
.
.
.
ফোনটা এখনো বন্ধ করে রেখেছে আয়ান। সে নিজেই বুঝছেনা এতোটা রাগ তার কিভাবে হচ্ছে! লামিয়ার কথা মনে হতেই মন বলছে ফোন বন্ধই রাখতে। যদিও শুধুই তার নাম্বারটা ব্লক লিস্টে ফেলে দেয়া যায় তবে অন্য কোনো নাম্বার থেকে লামিয়া যে ট্রাই করবেনা তার গ্যারান্টি কি!
.
.
মা, বাবা, ভাই, বোন, বান্ধবী প্রায় সবার নাম্বার থেকেই আয়ানের ফোনে ডায়াল করেছে লামিয়া। প্রথমে সে ভেবেছিলো হয়তো অভিমান করে আয়ান তার নাম্বার ব্লক লিস্টে দিয়েছে কিন্তু এখন দেখছে সত্যিই সে রাগ করেছে!
এতোটা রেগে যাবে আয়ান ভাবেনি কখনো লামিয়া। আয়ানের চিন্তায় সে সকাল থেকে কিছু খেতেও পারেনি।
-লামিয়া? কতক্ষণ ডাকছি তোকে? এখন কি দুপুরে খাবিনা ঠিক করছিস?
.
মায়ের কথা শুনে চেঁচিয়ে লামিয়া বলে উঠলো-
হুম খাবোনা। তাতে তোমার এতো অসুবিধে কিসের শুনি?
আমার খাবার আমি খাবোনা৷ তুমি যাও তো এখান থেকে।
.
লামিয়ার এমন ব্যবহারের সাথে পরিচিতি রয়েছে তার মায়ের। রাগ উঠলেই কারো উপর চেঁচিয়ে ঝেড়ে ফেলে সে। কিন্তু ইদানিং অতিরিক্ত মাথাটা গরম করছেনা লামিয়া? কিন্তু কেনো? বিষয়টা ভাবাচ্ছে…
কোনো কথা না বলে লামিয়ার মা রুমের দরজা থেকে সরে যেতেই নিজের মাথায় নিজেই একটা বারি খেলো সে। কেনো যে মায়ের উপরেই বারবার আয়ানের রাগ ঝাড়তে যাই ভেবেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো লামিয়া মাকে সরি বলার জন্য।
.
.
.
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আদুরেরা এখনো এসে পৌছায়নি।
এদিকে ক্ষিদেই পেটে চো-চো করছে আদুরের বাবা আশরাফুল হকের। তিনি ডাইনিং টেবিলে এসে বসলেন। চোখের চশমাটা ঠিক করে তানিয়া হকের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন-
আমি আর অপেক্ষা করতে পারবোনা বলে দিলাম। খেতে দাও আমাকে। ওই ছেলেকে এমনিতেও আমার শুরু থেকেই পছন্দ না। ওর সাথে একই টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। তাই আমাকে এখনই দিয়ে দাও। খেয়ে নিজের রুমে চলে যাই। পরে দেখা হলে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিবো।
.
আশরাফুল হকের কথা শুনে তার দিকে এগিয়ে আসছেন তানিয়া হক। মাঝেমধ্যে এই লোকটার কি যে হয়না!
.
.
.
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে আবেশ ও আদুরে।
আদুরে তার হাত ধরে বললো- এসো ভেতরে?
-না মানে…
-কি?
-কেমন যেনো লাগছে। অনেকটা দেরী হয়ে গেলো। তোমার বাবা কিছু বলবেন নাতো?
-বললে শুনে নিবে। দোষতো তোমারই।
.
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো আবেশ।
এই আবেশ তার বাবাকে এতো ভয় পায় কেনো এখনো বুঝে উঠতে পারলোনা আদুরে।
আদুরে তার হাত ধরে টানতে টানতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো।
.
.
.
দুপুরে ভাত খেতে এসে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়েছে পরীর মা নাসরিন আক্তার।
এই পর্যন্ত কোনো কথা সে বলেনি পরীর সাথে।
এখন মায়ের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে পরী তার উদ্দেশ্যে বললো-
ফ্যাক্টরিতে যাবেনা আর?
.
মেয়ের কথা শুনে
তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নাসরিন আক্তার বললেন-
হাজার নিষেধ করা স্বত্তেও তুই আমার কথা শুনলিনা তো? ঠিকই ওই বাড়িতে পা দিলি তুই!
.
(চলবে)