বিলম্বিত_বাসর #পর্ব_১২

#বিলম্বিত_বাসর
#পর্ব_১২
#Saji_Afroz
.
.
.
মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে মোরশেদার। মনে হচ্ছে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। তার এমন শান্ত চাহনি এতদিন দেখতে পায়নি আদুরে। তবে কি মোরশেদার জীবনে এমন কোনো ঘটনা আছে? যে কারণে তার মেজাজ সবসময় খারাপ থাকে বা খারাপ রাখতে চায়?
নিজেরমনে প্রশ্ন করা বাদ দিয়ে মোরশেদা কেই আবারো প্রশ্ন করলো আদুরে-
খালা? বলেন কিছু?
.
আদুরের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললেন মোরশেদা। পেছনে ফিরে কলসির পাশে এগিয়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিলেন তিনি। পুরো গ্লাসের পানি ঢকঢক করে গিলে আদুরের উদ্দেশ্যে বললো-
রাত কম হয়নাই! নিজের রুমে যাও দেহি। রাত বিলাতে আইসা বিরক্ত করবা না একদম কইলাম।
.
এই মোরশেদা খালার পেট থেকে কোনো কথা বের হবেনা ভালোভাবেই বুঝতে পারলো আদুরে।
মুচকি হেসে সে এগিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে।
.
.
সোফার উপর বসে বসে পত্রিকাতে চোখ জোড়া বুলিয়ে নিচ্ছে আবেশ। সারাদিন ঘুমের জন্য পত্রিকা পড়ার সময় পায়নি।
আদুরে রুমে প্রবেশ করে দেখলো, আবেশ পা নেড়ে নেড়ে পত্রিকা পড়তে ব্যস্ত। ধীরেধীরে আদুরে তার পাশে গিয়ে বসে হালকা কেশে উঠলো। কিন্তু আবেশের মনোযোগ সম্পূর্ণ পত্রিকার মাঝেই।
খানিকটা বিরক্ত হলো আদুরে। এই ছেলে এমন একটা ভাব করে যেনো সে একাই এই রুমে থাকে। একটা যে বউ আছে তা তার মনেই থাকেনা!
আবেশের খুব কাছাকাছি এসে বসলো আদুরে। হাতটা তার পেটের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সুড়সুড়ি দিতে থাকলো আচমকা। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলোনা আবেশের মাঝে। আদুরে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো-
এ কি! তোমার সুড়সুড়ি নেই?
.
পত্রিকাটা সোফার এক পাশে রেখে আবেশ বললো-
নেইতো!
-আমি আরো পেটের কথা বের করার জন্য সুড়সুড়ি দিচ্ছিলাম তোমাকে।
-কথা বের করার জন্য সুড়সুড়ি! তা কি কথা?
-মোরশেদা খালার কোনো খারাপ অতীত আছে?
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-জানতে ইচ্ছে হলো। উনার পরিবার কোথায়?
-এই যে আমরা। এখন থেকে তুমিও।
-তা বুঝলাম। কিন্তু স্বামী, সন্তান?
-তার স্বামী যাকে ভালোবাসতো তার সাথে পালিয়েছে।
-বুঝলাম না?
-মোরশেদা খালার মা আমাদের বাসায় কাজ করতেন। তা আমার দাদা মোরশেদার খালার বিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই লোকটা অন্য একজনকে ভালোবাসতো। এটা কারো জানা ছিলোনা। দাদা লোকটাকে বলেছিলেন খালাকে বিয়ে করলে জমিজমা, টাকা, স্বর্ণ এসব দিবেন। এই লোভে হয়তো প্রেমিকাকে ছেড়ে খালাকে তিনি বিয়ে করেন।
-তারপর?
-তারপর খালার সাথে এক বছর সংসার করার পর যার সাথে আগে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো তাকে নিয়ে পালিয়ে যান লোকটি। পালানোর আগে ব্যবসার অযুহাত দিয়ে জায়গা-জমিন, স্বর্ণ সব বিক্রি করে দেন। যাবার সময় সবটা নিয়ে যান শুধু দিয়ে যান একটা চিঠি।
-কি লেখা ছিলো জানো?
-হু। তিনি যাকে ভালোবাসতেন তাকে ভুলতে পারেননি। তাই এমনটা করতেই হলো তার।
-এতো জঘন্য মানুষও পৃথিবীতে আছে!
-এখানেই কাহিনি শেষ নয় আদুরে। খালার স্বামী যখন তাকে ছেড়ে চলে যান তিনি তখন গর্ভবতী।
-এটা তিনি জানতেন?
-হ্যাঁ।
-এটা জেনেও….
.
থেমে গেলো আদুরে।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো সে। আবেশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো-
খালার সন্তান কোথায়?
-সেও খালাকে একা রেখে চলে গেলো।
-কোথায়?
-খালার ছেলে দেখতে সুদর্শন একটা ছেলে। ঢাকায় পড়াশোনা করতো সে। ঢাকার একটা বড় ঘরের মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক হয়। মেয়েটার বাবা শর্ত দেন সে যেনো ঘর জামাই হিসেবে থাকে তাদের সাথে। মোরশেদা খালাকেও সাথে রাখতে পারবেন না।
-আর এই শর্তে সে রাজী হয়?
-হুম।
.
.
.
মোরশেদার রুমে এসে দেখলো আদুরে, তিনি ঘুমোচ্ছেন। নাক ডাকছেন তিনি ঘুমের মাঝে। মেয়েরাও যে ঘুমের মাঝে নাক ডাকেন এটা আদুরে প্রথম দেখলো, যদিও বা শুনেছে প্রচুর।
আজ বুঝলো আদুরে, কেনো প্রেমের বিয়েতে আপত্তি মোরশেদার। কেনো তার মেজাজ সবসময় এতোটা খিটখিটে থাকে। তার নিজের সাথে যদি এসব ঘটতো তাহলে সে কি স্বাভাবিকভাবে জীবনটা কাটাতে পারতো? কখনই না!
.
.
.
আজ আয়ানকে দেখে মনটা ফুরফুরে হলেও মাথায় চিন্তা একটা থেকেই গেলো লামিয়ার। আয়ানের মনে কি চলছে??
সে এখনো ফোনটা বন্ধ কেনো রেখেছে?
আজ তার বাসায় পর্যন্ত বিনা দ্বিধায় গিয়েছে লামিয়া। এর পরেও আয়ান ফোন বন্ধ রাখার কারণ কি হতে পারে!
আবেশ যখন লামিয়ার সাথে তাকে বাসায় পৌছে দিতে এসেছে তখনি আদুরের ফোন নাম্বারটা নেয়া হয়েছে লামিয়ার। একবার আদুরেকে ফোন দিয়ে কি সে দেখবে?
দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখলো অনেকটা রাত হয়ে গেলো। এই রাতে আদুরেকে ফোন দেয়াটা ঠিক হবেনা ভেবেই বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো লামিয়া।
.
.
.
ফোন বন্ধ রাখার একটাই কারণ। তোমাকে একটু বুঝতে দেয়া, আমি কতোটা কষ্ট পাই বিনাকারণে তোমার সাথে কথা বলতে না পারলে। এইটুকু শাস্তি না পেলে যে ভালোবাসার কদর তুমি বুঝবেনা লামিয়া। তবে আজ বুঝতে পারলাম, তুমিও আমাকে ভালোবাসো। ঠিক কতোটা ভালোবাসো তা তুমি নিজেও জানোনা। ভালো না বাসলে এভাবে ছুটে আসতেনা। তবুও আমি তোমাকে আরেকটু শাস্তি দিবো। আরেকটু বুঝো তুমি, ভালোবাসা আসলে কি!
.
হাতে থাকা লামিয়ার ছবির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে ছবিটার উপরে আলতো করে একটা চুমু খেলো আয়ান।
লামিয়ার দিকটা পরিষ্কার হলেও মায়ের দিকটা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারলো না সে। তার মা কি মেনে নিবেন তাদের সম্পর্ক নাকি আবেশের সাথে যা করেছিলেন তা করবেন! ভাবতেই অন্যরকম একটা ভয় কাজ করছে আয়ানের মাঝে।
.
.
.
মাত্র ৫মিনিটের ব্যবধানে মানুষ কিভাবে ঘুমিয়ে যায় মানে এই আবেশ কিভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারে ভেবেই হতবাক হয়ে গেলো আদুরে। মোরশেদার সাথে কথা বলার জন্য মাত্রই বের হলো সে। তাকে ঘুম দেখতে পেয়ে চলেও আসলো। এতটুকু সময়ে আবেশ ঘুমিয়ে পড়লো! আসলেই ছেলেটা একেবারে ম্যান্দামার্কা।
.
নিজের মনে বকবক করে শুয়ে পড়লো সে আবেশের পাশে।
এদিকে ওপরপাশে ফিরে ঘুমানোর অভিনয় করে চলেছে আবেশ। আর কতোদিন এভাবে দূরে ঠেলে রাখতে পারবে সে তার আদুকে!
.
.
.
আটার রুটি বানাতে ব্যস্ত মোরশেদা। তার পাশে এসে পিড়ি পেতে বসলো আদুরে।
তার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে রুটি বেলতে বেলতে মোরশেদা জিজ্ঞেস করলেন-
নতুন বউ রান্নাঘরে কি?
.
সে কথার উত্তর না দিয়ে আদুরে বললো-
সবাই এক না খালা। আপনার সাথে যা হয়েছে তা সবার সাথে হবে কথা নেই। বিশেষ করে আবেশ বা মায়ের সাথে এমন কিছুই হবেনা। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।
.
আদুরের কথা শুনে থেমে গেলেন মোরশেদা।
আদুরের কোনো প্রয়োজন নেই তার সাথে এভাবে ভালোভাবে কথা বলার! তাকে এভাবে শান্তনা দেওয়ার। তাহলে মেয়েটাকে চিনতে ভুল করলেন তিনি!
.
অশ্রুসিক্ত নয়নে আদুরের দিকে তাকাতেই সে হেসে বললো-
আমরা আপনার পরিবার নয় কি? আমাদের আপন ভেবে নাহয় সবটা ভুলে গিয়ে আমাদের সাথেই ভালো থাকুন?
.
মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছেনা মোরশেদার। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন তিনি। তা দেখেই আদুরে বললো-
দেখি এখন? আপনি রুটি বেলে দিন আমি ভেজে দিচ্ছি।
.
.
.
উঠোনে দাঁড়িয়ে বাইরের প্রকৃতি উপভোগ করছে আয়ান। সেই সময়ে উপস্থিত হয় আবেশ।
আয়ানের উদ্দেশ্যে আবেশ বললো-
আমার ভাইয়ের বউ দেখি অনেক সাহসী।
.
মৃদু হেসে আয়ান বললো-
বউ হয়নি এখনো।
-হয়ে যাবে।
-মা কিছু জানায়নি।
.
-জানাতে এসেছি।
.
দুভাই পেছনে তাকিয়ে ফাতেমা বেগমকে দেখতে পেয়ে চুপচাপ হয়ে গেলো।
তাদের উদ্দেশ্যে ফাতেমা বেগম বললেন-
ভেতরে এসো তোমরা।
আমি আমার সিদ্ধান্ত জানাতে এসেছি লামিয়ার ব্যাপারে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here