#বিলম্বিত_বাসর
#পর্ব_১৩
#Saji_Afroz
.
.
.
মায়ের ঠিক সামনের সোফায় বসে আছে আবেশ ও আয়ান।
তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে আদুরে।
সবার দৃষ্টিই ফাতেমা বেগমের দিকে। তার মতামত কি হতে পারে? হ্যাঁ নাকি না?
সিদ্ধান্ত শোনার জন্য অধীর আগ্রহে সকলেই।
এমন সময় ফাতেমা বেগম বলে উঠলেন-
কতো বছরের সম্পর্ক তোমাদের আয়ান?
.
মাথা নিচু করেই আয়ান জবাব দিলো-
প্রায় ২বছর।
-কি মনে হয়? ভালো থাকতে পারবে তার সাথে?
.
কোনো দ্বিধা ছাড়াই আয়ান জবাব দিলো-
হুম।
-তাহলে বলো, তার বাসায় কবে প্রস্তাব নিয়ে যাবো?
.
ফাতেমা বেগমের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো সকলেই। হুট করে তার সিদ্ধান্ত এভাবে জানিয়ে দিবেন ভাবতে পারেনি কেউ।
আদুরে হাসিমুখে বলে উঠলো-
আলহামদুলিল্লাহ! মা? শুভ কাজে দেরী করতে নেই। আমার মনে হয় বিয়েটা করে ফেললেই ভালো হবে।
.
হাসলেন ফাতেমা বেগম। আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন-
লামিয়ার সাথে কথা বল। তার বাসায় কবে যাবো আমরা জিজ্ঞাসা কর।
.
আয়ানের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছেনা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে মায়ের দিকে।
আবেশ একটা কাশি দিয়ে আয়ানের উদ্দেশ্যে বললো-
তৈরী হইয়া যা ভাই বিয়ের জন্য।
.
-তা না হয় হইবো, দেহি সবাই নাস্তা খাইতে আহো।
.
মোরশেদার কথায় আদুরেও সবার উদ্দেশ্যে বললো-
হুম হুম আগে নাস্তা করে নাও। পেট শান্তি তো সব শান্তি!
.
.
.
-কিরে? এতো বেলা হলো তাও শুয়ে আছিস কেনো?
.
মায়ের ডাকে শোয়া থেকে উঠে বসলো লামিয়া।
মায়ের দিকে তাকিয়ে সে বললো-
এমনিতেই।
-আয় নাস্তা করবি।
-ইচ্ছে করছেনা মা।
-তোর পছন্দের চিকেন রোল করেছি।
-লোভ দেখাচ্ছো?
.
লামিয়ার মা হেসে বলে উঠলেন-
তুই বস। আমি নিয়ে আসি। নিজের হাতে তোকে খাইয়ে দিবো।
-কষ্ট করোনা। হটপটে রেখে দাও। আমি কিছুক্ষণ পর এসে খেয়ে নিবো।
-সত্যি তো?
-হুম একদম।
.
লামিয়ার মা রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ দিলো লামিয়া। সকাল ৯.১৫ হলো। এখন একটা ফোন দেওয়াই যায় আদুরেকে। বালিশের পাশে থাকা মোবাইলটা হাতে নিয়ে লামিয়া ডায়েল করলো আদুরের ফোন নাম্বারে।
.
.
নিজের রুমটা গুছাতে ব্যস্ত আদুরে। আজ পুরো রুমটা সে মনের মতো গোছাবে বলে ঠিক করলো। কোমরে শাড়ির আঁচল পেচিয়ে প্রথমেই এগুলো ড্রেসিংটেবিলের দিকে। সাথে সাথে বেজে উঠলো তার ফোন। দ্রুতপায়ে সোফার দিকে এগিয়ে গিয়ে সোফার উপর থেকে ফোনটা হাতে নিলো সে। অচেনা নাম্বার দেখে খানিকটা বিরক্ত হলো আদুরে। ভেবেছিলো বাসা থেকে ফোন এসেছে।
তার ফোনে সচারাচর অপরিচিত কেউ কল দেয়না। তাহলে এটা কার কল! ভাবতে ভাবতেই ফোনের রিং টোন বন্ধ হয়ে গেলো তার।
হাত থেকে ফোনটা রাখার সময় আবারো রিং বেজে উঠলে সাথে সাথেই রিসিভ করে আদুরে বললো-
হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়া আলাইকুমুসসালাম ভাবী। আমি লামিয়া।
.
লামিয়ার নাম শুনে খানিকটা অবাক হয়েই আদুরে প্রশ্ন করলো-
আমার ফোন নাম্বার কিভাবে পেয়েছো?
-কাল আবেশ ভাইয়ার কাছে চেয়ে নিয়েছিলাম।
-ও আচ্ছা। তা ভালো আছো তুমি?
-আর ভালো থাকলাম কই। আপনার দেবরতো ফোন চালু করলোনা।
-তোমাকে এখন এমন একটা খবর দিবো শুনলেই মন, দিল সব ভালো হয়ে যাবে।
-কি খবর?
-মা….
.
কথাটি বলতে গিয়েও থেমে গেলো আদুরে। যার মুখে কথাটি শুনলে লামিয়া বেশি খুশি হবে তার মুখেই কথাটি শোনা ভালো নয় কি! হ্যাঁ এই সংবাদটা আয়ানের জানানোর অধিকার।
.
-কি ভাবী?
.
কথা ঘুরিয়ে আদুরে বললো-
সেটা পরে শুনবা আগে বলো তুমি কোনো দরকারে ফোন দিয়েছো?
-ইয়ে মানে…
-কোনো সংকোচ ছাড়াই আমাকে বলতে পারো।
-আয়ানকে বলবেন প্লিজ ফোনটা চালু করতে?
.
মৃদু হেসে বললো আদুরে-
এখুনি বলছি।
.
.
.
ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবছে আয়ান, এবার কি ফোনটা চালু করবে সে?
.
-করে দাও ভাই। ম্যাডাম অস্থির হয়ে আছে।
.
আদুরেকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে দেখে আয়ান বললো-
ভাবী আপনি?
-হু আমিই।
-আপনি কি করে বুঝলেন, আমি ফোন চালু করবো নাকি ভাবছিলাম?
-প্রেম আমিও করেছি ভাই। তোমার ভাইয়ের মতো ম্যান্দার্মাকা না তাই বুঝেছি।
.
হেসে উঠলো আয়ান। হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করলো –
ম্যান্দামার্কা মানে?
-ও তোমার ভাইয়ার থেকেই জিজ্ঞেস কইরো। এখন লামিয়াকে একটা ফোন দিয়ে তোমাদের কথা জানাও দেখি। ফোনের সাথে সাথেই এই কথা শুনলে কতোটা খুশি হবে ভাবতে পারছো?
-হু।
-তাহলে করো ভাই। আমি গেলাম।
.
কতোটা খুশি হবে লামিয়া? বেশি নাকি অনেক বেশি! ভাবতে ভাবতেই ফোনটা চালু করলো আয়ান।
.
.
বহু প্রতিক্ষার পর যেনো আশার আলো দেখতে পেলো লামিয়া। ফোনের স্ক্রিনে আয়ানের নামটা দেখতেই হাত পা কাঁপা শুরু করলো তার। মনে হচ্ছে এই প্রথমবার সে আয়ানের সাথে কথা বলতে যাচ্ছে তাই এতো নার্ভাস লাগছে তার।
ফোনটা রিসিভ করে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে লামিয়া বললো-
হ্যালো?
-লাম্মু একটা সংবাদ আছে।
.
কথাটি শুনেই মেজাজ বিগড়ে গেলো লামিয়ার। এতোদিন পর কথা হচ্ছে আর এই ছেলে কিনা সংবাদ নিয়ে পড়ে আছে! কোথায় সরি বলবে, একটু ভালোবাসা দেখাবে তা না!
দাঁতে দাঁত চেপে লামিয়া বললো-
কি সংবাদ?
-মা জিজ্ঞাসা করেছেন তোমাদের বাসায় আমাদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কখন যাবেন?
.
কথাটি শুনেও যেনো বুঝতে পারলোনা লামিয়া।
সে আয়ানের উদ্দেশ্যে বললো-
কি বললে?
.
আয়ান এক প্রকার চেঁচিয়েই বললো-
আরে লাম্মু আমার বউ হবি তুই। কখন প্রস্তাব নিয়ে যাবো বল তোর বাসায়?
.
খুশিতে চোখ বেয়ে পানি পড়ছে লামিয়ার।
আয়ান বুঝতে পেরে বললো-
কাঁদছিস কেনো?
-আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম আয়ান৷ আমি যা করতাম তা একেবারেই ঠিক করতাম না। নিজের ভুলের জন্য তোমাকে হারাতে বসেছিলাম। আমি….
.
কান্নার বেগ বেড়ে গেলো লামিয়ার। তাকে থামিয়ে আয়ান বললো-
আমিতো এমনিতেও মোবাইল চালু করতাম৷ তোমাকে একটু কষ্ট দিলাম আরকি।
-খুব খারাপ তুমি।
-মানলাম আমি খারাপ। এখন তোমার বাসায় জিজ্ঞাসা করো আমাকে জামাই বানাবে কিনা?
-সকলেই জানেন তোমার কথা।
.
চমকে গেলো আয়ান। অবাক স্বরে বললো-
কিভাবে?
-আমি তোমার চিন্তায় দেবদাসী হয়ে যাচ্ছিলাম। মা আঁচ করতে পেরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সবটা বলেছিলাম মাকে।তারপর মা বাবাকে জানায়। তারা রাজী আছেন।
-দেবদাসী! এই মেয়েটা আমার জন্য দেবদাসী হতে পারে জানা ছিলোনা।
-অনেক ভালোবাসি তোমাকে।
-আমিও। এবার বউ হয়ে চলে আসো। আর হ্যাঁ, শুনো? আর বেকার বলবানা। পরীক্ষা দিয়েই ভাইয়ার সাথে কাজে হাত লাগাবো।
-বাবা বাসায় আসলেই মাকে বলবো বাবার সাথে কথা বলতে।
-ঠিক আছে।
.
.
.
কোমরে আঁচল প্যাচালে যে মেয়েদের এতোটা সুন্দর লাগে জানা ছিলোনা আবেশের।
আদুরে পুরো রুমটা এতোক্ষণ নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছে। একটানা কাজ করায় একেবারে ঘেমে নেয়ে গিয়েছে সে। তবুও এতোটুকু ক্লান্তির চিহ্ন যেনো তার মুখে নেই। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো আবেশ। আবেশের দিকে চোখ পড়তেই আদুরে বলে উঠলো-
ম্যান্দামার্কা দেখি রোমান্টিকভাবে তাকাতেও জানে!
.
আদুরের কথায় চোখ জোড়া সরিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো আবেশ। আলনার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা লুঙ্গি আর তোয়ালে হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে ওয়াশরুমের দিকে। মাঝপথে আদুরে তাকে থামিয়ে বললো-
আমি যাবো আগে। এতো কাজ করলাম ঘেমে গিয়েছি।
-না আমি যাবো। প্রচুর গরম লাগছে।
.
কথাটি বলেই দ্রুতবেগে আবেশ এগিয়ে যায় ওয়াশরুমে। আদুরেও তার পেছনে ছুটে এসে ওয়াশরুমের দরজাটা ধরে বললো-
বন্ধ করতে দিবোনা।
-এ কেমন ছেলে মানুষি আদু! হাতে ব্যথা পাবে।
-তাহলে ছেড়ে দাও তুমি।
.
দরজা থেকে আবেশ হাত সরাতেই আদুরে ঢুকে পড়লো ওয়াশরুমে। ঠান্ডা গলায় আবেশ বললো-
ঠিক আছে। তুমি থাকো। আমিই বরং পরে করবো।
.
আবেশের হাতটা আঁকড়ে ধরে ওয়াশরুমের দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে আদুরে বললো-
একসাথে করা যায়না বুঝি?
.
আদুরের এই আবদার যেনো আবেশ ফেলতে পারছেনা! কিছু বলার আগেই আবেশের খুব কাছে এসে পড়লো আদুরে।
সে বুঝতে পারলো কি ইশারা করছে আদুরের চাহনি।
আর কিছু না ভেবেই আবেশ হাত বাড়ালো আদুরের কোমরে প্যাচানো শাড়ির সেই আঁচলের দিকে।
.
.
.
দুপুর তিনটা….
অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত পরী। তার দিকে তাকিয়ে আয়ান বলে উঠলো-
হলোরে তোর?
-না হয়নি।
-কেনো হয়নি?
-সময় লাগেনা বুঝি করতে?
-যা আজ ছুটি।
.
হাসিমুখে পরী বললো-
সত্যি?
-হু সত্যি। আজ আমার মনটা অনেক ভালো।
.
কৌতুহল নিয়ে পরী জিজ্ঞাসা করলো-
কেনো?
-আমার বিয়ে ঠিক হলো। শুনিস নি?
-নাতো! তোমার হবু বউ কি আদুরে আপুর মতো সুন্দর?
-হু।
-বাহ! আমার ২টা আপু হবে!
.
হাসলো আয়ান। পরী বললো, আমি তাহলে আদুরে আপুর কাছে যাই? গল্প করবো।
-আচ্ছা যা।
.
.
.
পরীর সাথে সোফার উপরে বসে গল্পে মেতে আছে আদুরে। তার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে আবেশ।
দুপুরে নিজেই একসাথে গোসল করবে বলে জেদ করলো। কিন্তু যেইনা আবেশ তার শাড়ির আঁচল সরাতে শুরু করল অমনি বলে উঠলো-
আমিতো মজা করেছিলাম। তুমিই আগে করে নাও।
.
কথাটি বলেই আঁচলটা বুকের উপর টেনে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো আদুরে।
ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও তাকে আটকালো না আবেশ।
.
.
-কি দেখছো?
.
আদুরের ডাকে ঘোর কাটলো আবেশের। সে কিছু বলার আগেই পরী বলে উঠলো-
আমাকে দেখছে আমাকে।
.
পরীর কথায় হেসে উঠলো আদুরে। তার সাথে যোগ দিলো আবেশও।
.
.
.
ঘড়িতে সময় সন্ধ্যা ৭টা।
পরীর মুখে আয়ানের বিয়ের কথা শুনে রাগে শরীরটা গিজগিজ করতে থাকলো নাসরিন আক্তারের। তিনি ভেবেছিলেন পরীর রূপের জালে হয়তো আয়ান ফাঁসবে। কিন্তু সে সময়টাই সে পেলোনা। তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো! না এটা মানা যায়না। ফাতেমা বেগমের কাছে তার যেতেই হবে। সেদিন বড় মুখে বলেছিলেন, অন্য কোনো ভালো ছেলে পরীর জন্য ঠিক করবেন তিনি। তাহলে সে ছেলেটা আয়ান নয় কেনো নয়! জানতেই হবে তার। আয়ানকেই চায় নাসরিন আক্তারের। নিশ্চয় তিনি না করতে পারবেন না!
কালই ও বাড়ি যেতে হবে তার।
ভেবেই লম্বা একটা শ্বাস ফেললেন নাসরীন আক্তার।
.
.
.
লামিয়ার কথা শুনে আয়ানের মাথায় যেনো বাজ পড়লো।
সকালেই শুনলো তার পরিবারে সব ঠিক আছে তাহলে কেনো এখন লামিয়া বললো, বিয়েটা সে করতে পারবেনা!
.
(চলবে)