#বিলম্বিত_বাসর
#পর্ব_২২
#Saji_Afroz
.
.
.
সারারুমে পায়চারি করছে আদুরে।
গতকাল প্রেগন্যান্সির টেস্ট করে এসেছে সে। আবেশ ফ্যাক্টরির কাজ সেরে রিপোর্ট আনতে যাবে বলেছে। এতোক্ষণে তো নিয়ে আসার কথা! আবেশের কোনো খবর কেনো নেই? সে কি একটা ফোন দিয়ে দেখবে? নাহ, আবেশ যদি বিরক্ত হয়!
বিছানার উপর বসে পড়লো আদুরে। মাথার উপর ভনভনিয়ে ফ্যান ঘুরলেও সে ঘামছে অনবরত। সে চায়, খুব করে চায় রিপোর্ট যেনো পজিটিভ হয়। কিন্তু আবেশ যে চায়না সেটা! রিপোর্ট যদি পজিটিভ আসে তবে আবেশ কি করবে? বাচ্চাটাকে কি…..?
নাহ, আর ভাবতে পারছেনা আদুরে। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। তার অসাবধানতার জন্যই এসবের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে। নাহলে আবেশের কথামতো বছর খানেক পরেই ফ্যামিলি প্লানিং টা করতেই পারতো!
.
.
.
– কি মনেহয় মোরশেদা? বউমার রিপোর্ট পজিটিভ আসবে তো?
.
ফাতেমা বেগমের কথা শুনে মোরশেদা এক গাল হাসি দিয়ে বললো-
কেনো আইবো না! অবশ্যই আইবো।
-সে আশায় করি। আল্লাহর রহমতে সবটা যেনো ভালোই ভালোই হয়।
.
কথাটি বলতেই ফাতেমা বেগমের চোখটা ছলছল করে উঠলো।
মোরশেদা বুঝতে পারলেন তার মনে কি চলছে। তাই তিনি ফাতেমা বেগমের কাঁধে হাত রেখে বললেন-
আমাগো আবেশের মা আর আয়নার লগে যা হইছে তা আদুরের লগে হবোনা। আমরা খুব যত্ন করমু তার, আল্লাহর কাছে দিন রাত দোয়াও করমু।
.
দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে ফাতেমা বেগম বললেন-
তাই যেনো হয়।
.
.
.
রিপোর্ট হাতে রুমে প্রবেশ করলো আবেশ৷
তাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো আদুরে। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে আবেশের দিকে।
রিপোর্ট টা টেবিলের উপর রেখে আদুরের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো আবেশ।
তার দৃষ্টি দেখেই আদুরের বুকটা ধুক করে উঠলো। তবে কি রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে?
-তোমার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। তবে এবরোশন করার সময় আছে।
.
এতোটা শান্ত ভাবে আবেশকে কথাটি বলতে শুনে আদুরে বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলো।
এই কথাটি মুখে কিভাবে আনতে পারলো আবেশ!
নিজেকে সামলে নিয়ে আদুরে বললো-
বুঝলাম তোমার আমাকে নিয়ে ঘোরা ফেরা করার অনেক শখ। সেটা বাচ্চা নিয়েও করা যায়। যায়না? মানলাম তোমার পছন্দ না। বাচ্চা হলে নিজেকে বুড়ো বুড়ো লাগবে। কিন্তু ভুলবশত হলেও আমার গর্ভে যে আছে সেটা আমাদের অংশ আবেশ! এই কথা তুমি কিভাবে বলতে পারলে?
.
আদুরের কথা শুনে চেঁচিয়ে বলে উঠলো আবেশ-
ভুলবশত কেনো হলো তোমাকে সবটা বুঝিয়ে দেয়ার পরেও? আমার কথার কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?
.
আবেশকে এভাবে উত্তেজিত হতে দেখে চুপ হয়ে গেলো আদুরে।
তার গলার তীব্র শব্দ শুনতে পেয়ে দরজার পাশে চলে এলো বাড়ির সকলে। কিন্তু ফাতেমা বেগমের কথায় কেউ ভেতরে প্রবেশ করলো না। বাইরেই দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ভেতরে কি চলছে, অবশ্য দরজা খোলা থাকার কারণে সবটা শোনাও যাচ্ছে।
আদুরের কাছে এসে দাঁতে দাঁত চেপে আবেশ বললো-
যে দুনিয়াতে আসেনি তার জন্য আমিই পর হয়ে গেলাম?
.
আবেশের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আদুরে বললো-
তুমি এমনটা ভাবছো কেনো আবেশ! কি হলো তোমার?
-আমি বাচ্চা চাইনি। তুমি কেনো বুঝলেনা?
-আবেশ আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। তাই বলে বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দিতে বলছো?
.
আদুরের কথার জবাব না দিয়ে পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে মেঝেতে ফেলে দিলো আবেশ।
টেবিলের উপরে রাখা সমস্ত বইপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো রুম ছেড়ে। এগুতে লাগলো সে ছাদের দিকে।
সে বেরুতেই মেঝেতে বসে পড়লো আদুরে। একেবারে নিশ্চুপ হয়ে আছে সে।
আয়ানের উদ্দেশ্যে ফাতেমা বেগম বললেন-
আবেশের কাছে যা তুই।
.
মায়ের কথামতো আয়ানও এগিয়ে গেলো ছাদের দিকে।
মোরশেদা ও লামিয়াকে নিয়ে ফাতেমা বেগম প্রবেশ করলেন আদুরের রুমে। আদুরের পাশে এসে মেঝেতে বসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো আদুরে।
.
-এই পাগলি মেয়ে! এভাবে কাঁদতে নেই বাচ্চার মতো।
.
ফাতেমা বেগমের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আদুরে বললো-
আমার অপরাধ কি বলতে পারেন মা?
-তোমার কোনো অপরাধ নেই। আবেশের যে অনেক ভয় তোমাকে নিয়ে। কিন্তু আমি নিজেও জানতাম না এতোটা ভয় নিজের মাঝে পুষিয়ে রেখেছে সে। এখন ওর কথা শুনে আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা, ছেলেটা ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
.
অবাক চোখে তাকিয়ে আদুরে প্রশ্ন করলো-
কিসের ভয়?
-এই বাড়িতে এসব কথা আর কখনো তুলতে হবে ভাবিনি। কিন্তু আজ তোমাকে আর লামিয়াকে সবটা জানাবো।
.
কথাটি বলে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফাতেমা বেগম বললেন-
আমি আবেশের জন্মদাত্রী মা নয়।
.
ফাতেমা বেগমের এক কথাই আদুরে আর লামিয়া যেনো থমকে গেলো!
তাদের কাছে কোনো কথার আশা না করে তিনি আবারো বললেন-
হুম আমি আবেশের জন্মদাত্রী মা নয়। আবেশের মা তাকে জন্ম দিয়েই মারা যান। পরে আবেশের বাবা আমাকে বিয়ে করে আনেন আবেশের দেখা শোনার জন্য। আবেশের বাবা তার মাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন৷ তাই তিনি তার ছেলের কাছ থেকে লুকোতে পারেননি, তার জন্মদাত্রী মা অন্যজন! কিন্তু সবটা জানার পরে আমার প্রতি আবেশের ভালোবাসা যেনো আরো বেড়ে যায়। আমি তাকে কখনো বুঝতে দিইনি কিনা, সে আমার পেটের ছেলে নয়! আবেশ ও আয়ানের বয়সের ফারাক খুব বেশি নয় কিন্তু। দুই ছেলেকেই সমান চোখে আমি দেখেছি।
এই দুই ভাইরের অনেক শখ ছিলো, যেনো একটা বোন পায় খেলার সাথী হিসেবে। আল্লাহ তাদের সে আশাটাও পূরণ করেছিলেন৷ আমার একটা মেয়েও হয়। যার নাম আবেশ ভালোবেসে রেখেছিলো আয়না!
.
নামটা শুনেই আদুরের পরিচিত মনে হলো। আবেশ কি প্রায় ঘুমের ঘোরে আয়নার নাম ধরে ডাকে?
.
ফাতেমা বেগমের উদ্দেশ্যে লামিয়া বললো-
আমাকে আয়ান কখনো বলেনি তার বোন আছে।
-আছে না, ছিলো।
.
আবারো যেনো ধাক্কা খেলো আদুরে ও লামিয়া।
চোখ জোড়া বড় করে লামিয়া প্রশ্ন করলো-
ছিলো মানে?
-সে মারা গিয়েছে অনেক আগেই।
-ওহ! কিন্তু আয়ান আমাকে এটা না বলার কারণ কি?
.
ভাঙ্গা গলায় আদুরে বললো-
আমাকে আবেশও আয়নার কথা বলেনি। কিন্তু কেনো মা? এর পেছনে কি কোনো কারণ আছে?
-হ্যাঁ! আমার আয়না অল্প বয়সে এক বখাটের প্রেমের ফাঁদে পড়ে তার সাথে কুমিল্লায় পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নেয় তাকে। আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম নিজেদের কাছে আয়নাকে নিয়ে আসতে। কিন্তু সে আসেনি! ওই বখাটের সাথেই সুখে ছিলো আমাদের সাথে সকল সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে। কিন্তু আয়না যখন ৮মাসের গর্ভবতী ওই বখাটে তাকে ছেড়ে চলে যায়। আয়না এর কিছুদিন পরেই আমাদের কাছে ফিরে আসে। তখন আয়নার কাছে জানতে পারলাম ছেলের আসল বাড়ি কোথায় সে নিজেও জানেনা এবং সেই ছেলে তাকে বিয়েও করেনি।
.
স্তব্ধ হয়ে গেলো পুরো ঘর। কিন্তু ফাতেমা বেগমের চোখের পানি ঝরতে লাগলো অঝরে।
কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বললেন-
৮মাসের গর্ভবতী মেয়ে এসে বলছে তার নাকি বিয়েই হয়নি! এসব সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে যান আবেশের বাবা।
এতোকিছুর পরেও আবেশ তার বোনের গায়ে একটা হাত পর্যন্ত তুলেনি। কেউ বোনকে নিয়ে কিছু বললে তার সাথেই লড়েছে উল্টো!
এতো ভালোবাসার বোনটাকেই বাঁচাতে পারেনি আবেশ!
.
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আদুরে জিজ্ঞাসা করলো-
খারাপ কিছু করেছে নিজের সাথে আয়না?
-না! ডেলিভারির সময় বাচ্চাসহ ওপারে পাড়ি জমায় সে।
.
আয়নাকে চিনেনা আদুরে, চিনেনা লামিয়া। তবুও তাদের চোখ বেয়ে পড়ছে তার জন্য অশ্রু!
নিজের চোখজোড়া মুছতে মুছতে ফাতেমা বেগম বললেন-
আয়না চলে যাবার পর
আবেশ বলেছিলো, তার ব্যাপারে কেউ যেনো কোনো কথা না তুলে। আবেশ চায়না তার বোনকে কেউ খারাপ চোখে দেখুক। ধীরেধীরে আমরা সবাই স্বাভাবিক হয়ে উঠলেও ঠিক হলেন না আবেশের বাবা। তিনিও পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। দুই ছেলের মুখ দেখে দিন কাটিয়ে দিচ্ছিলাম দিন। একদিন নাসরিন বললো, তার পরীর পেছনে অনেক ছেলে পড়ে আছে। কথাটা বুকে গিয়ে লেগেছে আমার। আমার আয়নার পেছনে ওসব বখাটে লেগে থাকতো। আমি চাইনি আয়নার মতো পরীর এমন দশা হোক। কেননা পরীর মাঝে আমি আয়নাকে খুঁজে পেতাম! তাই আমি নাসরিনেকে পরীর সাথে আবেশের বিয়ের কথা বলেছিলাম। কিন্তু আবেশ যে আর কাউকে ভালোবাসতো আমি জানতাম না। জানার পরেও প্রথমে নারাজ থাকলেও পরে আবেশের খুশির জন্য সবটা মেনে নিয়েছি। ভেবেছি আমার ছেলেটা সুখী হবে। কিন্তু সে যে ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারেনি আমার জানা ছিলোনা।
.
এপর্যায়ে মুখ খুললেন মোরশেদা-
একইরকম কইরা প্রথমে আম্মা পরে বোনরে হারায়ছে আমার বাবাজিটা! কেমনে ভয়ডা কাটবে তার! তবে দুঃখের বিষয় হলো আমরা তা বুঝবার পারিনাই।
.
আদুরের হাত ধরে ফাতেমা বেগম বললেন-
মারে ওর কথায় কষ্ট না পেয়ে ওকে বুঝাও ওকে। ভয়টা কাটাতে সাহায্য করো। আবেশের ভয় কাটাতে তোমাকে যে তার বড় প্রয়োজন মা! একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি সবসময় হয়নারে মা, এটা আবেশকে বোঝাতে হবে তোমার।
.
.
.
আবেশকে নানাভাবে শান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তার পাশে বসে আছে আয়ান। হঠাৎ আদুরের উপস্থিতি টের পেয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। আদুরের ইশারায় সে চলে যেতে থাকলো।
আবেশের পাশে বসে আদুরে তার হাতটা নিয়ে নিজের পেটের উপরে রেখে বললো-
আমার ম্যান্দামার্কা বাবা হতে চলেছে এর চেয়ে বেশি খুশির আমার কাছে কিছু হতেই পারেনা। তুমি আমার উপর যতই রাগ করোনা কেনো আমি তোমার সাথে অভিমানও করতে পারবোনা।
.
আদুরের কথা শুনে শান্ত গলায় আবেশ বললো-
আমার এতোদিনের কার্যকলাপ দেখে অন্য কেউ হলে হয়তো আমার উপর আঙুল তুলতো সন্দেহ নিয়ে। কিন্তু তুমি…..
-উহু এসব বাদ দাও! রুমে চলো।
-মা তোমাকে সবটা জানিয়ে দিয়েছে তাইনা?
-হু।
-আমি তোমাকে হারাতে চাইনা আদু। বাচ্চা হতে গিয়ে যদি তোমার কিছু হয়ে যায়! আমি আর সহ্য করতে পারবোনা। এতো আঘাত আমি সহ্য করতে পারবোনা।
.
আবেশের অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া নিজের হাত দিয়ে মুছে দিয়ে আদুরে বললো-
আমার কিচ্ছু হবেনা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবেনা। যে আসতে চলেছে তাকে আসতে দাও আবেশ!
-কিন্তু….
-তুমি কি চাইছো? আমাদের অংশ কে শেষ করে দিবো?
-নাহ! আমি রাগের মাথায় বলেছি ওমন কথা।
-তাহলে?
-আমি তোমাকে হারাতে চাইনা।
-তোমার কাউকেই হারাতে হবেনা। না আমাকে না আমাদের বেবিকে।
-কথা দিচ্ছো?
-দিলাম কথা। এইটা বলো যে তোমার ছেলে লাগবে নাকি মেয়ে?
-দুইটাই একসাথে। যাতে তোমাকে আর প্রেগন্যান্ট হতে না হয়। আর একবারেই আমি ছেলে মেয়ে দুজনকেই যেনো পাই।
.
আবেশের কথা শুনে হাসতে হাসতে তার বুকে লুটিয়ে পড়লো আদুরে।
আবেশ তাকে জড়িয়ে ধরে বললো-
আমার আদু আমার কাছেই থাকবেতো?
-হু। তুমি একদম ভয় পেওনা। তুমিই তো আমার শক্তি!
-হুম।
.
মুখে হুম বললেও আবেশের মন থেকে ভয় কাটেনি।
আদুরের কোনো ক্ষতি ছাড়াই সন্তান জন্মদানে সক্ষম হতে পারবে কি সে? নাকি তার মা ও বোনের সাথে যা হয়েছিলো আদুরের সাথেও তা হবে? বড় অভাগা যে সে! সুখ যেনো ধরা দিতেই চায়না তাকে।
.
(চলবে)