চিঠি দিও
৭
____________
গতকাল ডালিয়াদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে উপমা। ডালিয়া বলেছিল কলেজের কাছেই ওদের বাড়ি। আসলে কলেজ সীমানাতেই। সাইন্স বিল্ডিংয়ের বাঁয়ের রাস্তা দিয়ে কিছুদূর হাঁটলে স্টাফদের কোয়ার্টার। ওখানেই থাকে ডালিয়ারা। ডালিয়ার বাবা-মা দু’জনেই মূলত এই কলেজে চাকরি করেন। যার দরুন কোয়ার্টার পাওয়া। এখানে অবশ্য ওরা একা নয় আরও দুটো পরিবার থাকে।
নতুন বানানো বিল্ডিং। ছোট্ট ছিমছাম গোছানো বাড়ি। দেখেই মন ভালো হয়ে গেছে উপমার। এই বাড়িটারও চারিদিক উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। উপমার ধারণা দেয়ালে ঘেরার বিষয়টা এখন ফ্যাশনের মতো হয়ে গেছে;বাড়ি নির্মাণের ফ্যাশন।
দেয়ালের ওপাশে ছোট্ট একটা রাস্তা এবং কিছু আবাদি জমি রয়েছে। কিছুটা হাঁটলে স্বল্প পরিসরে নেট দিয়ে ঘেরা সূর্যমুখীর বাগানও দেখা যায় একটা। প্রতিবেশীর কারোর একজনের জমি হবে। আসার পথে দূর থেকে এক ঝলক সূর্যমুখীর গাছগুলো দেখেছে উপমা৷ আকাশপথে উর্ধ্বমুখী মাঝারি আকারের সবুজ সবুজ গাছ। ফুল এখনও ফোটেনি। ফুটবে শীতে। সমভূমি এলাকায় শীত ও বসন্তকালে সূর্যমুখী ফোটে। ডালিয়া বলেছে ফুল ফুটতে শুরু করলে ওকে জানাবে। জন্মদিনে ছোটো চাচা এবার ক্যামেরা গিফট করবেন উপমাকে। চাচার কাছে ছবি তোলাটাও শিখে নেবে উপমা। তারপর ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে এসে পড়বে বন্ধুর বাড়ি সূর্যমুখীর ছবি তুলতে। কি দারুণ হবে বিষয়টা! ভাবতেই প্রবল উত্তেজনা কাজ করে উপমার মধ্যে। উত্তেজনা অবশ্য এখনও কম নয়। লেখাপড়ার বয়সে এই প্রথম বাড়ি ছেড়ে বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে আসা। এমন নয় সে ঘরকুনো। টুকটাক ঘুরে ফিরে বেড়ানো হয় তার। কখনো একা, কখনো পরিবারসমেত। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও রাত্রিযাপন হয়েছে বেশ কয়েক বার। তবে ওখানে এতখানি মজা নেই যতখানি বন্ধুর বাড়িতে আছে। এতদিন কোনো বন্ধু হয়নি বলে উপলব্ধি করেনি উপমা। এখন করছে। এও উপলব্ধি করেছে সমবয়সীদের সাথে ঘুরতে ফিরতে, হাসি-তামাশা করতে তার খুব ভালো লাগে। এই যে একটা বন্ধুমহল বানিয়ে নেয়ার পর নিজের সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করতে পারছে; এগুলো ওকে ভীষণ ভীষণ আনন্দ দিচ্ছে।
বেশ চটপটে হয়েছে উপমা। তার সাথে যোগ দিয়েছে ইঁচড়েপাকা ডালিয়া। কোথায় কোথায় ঘুরবে, কীভাবে সাজুগুজু করবে, কবে চড়ুইভাতি করবে এসব পরিকল্পনা করেই দিন কেটে যাচ্ছে ওদের৷ মিতালি আর লায়লা থাকলে আনন্দ আরও বেশি হতো, কিন্তু মিতালির তো বাবা নেই। মাকে একা রেখে বেরোনোর সাহস পায় না মেয়েটা। আর লায়লার বাড়িতে বাধানিষেধের অভাব নেই। কলেজ আর বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই তার। বেশি জেদ করলে পড়ালেখা বন্ধ করে সোজা বরের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে এমন শর্ত জারি করে রাখা হয়েছে বহু আগে। চাইলেও বেচারির পক্ষে অনেক কিছু সম্ভব নয়৷ পড়াশোনাই করে সে কত ফাইট করে!
বাধা যে উপমার নেই তা কিন্তু নয়। তার জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা তো সেজো ভাই। সেজো ভাই একাই সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতে যথেষ্ট। মানুষের বাড়িতে রাত্রিযাপন, একা একা ঘুরেফিরে বেড়ানো এসব একদমই পছন্দ করে না সেজো ভাই। ভাগ্যিস ইদানিং ইলেকশনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, রাতের পর রাত বাড়ি ফিরছে না। ও থাকলে অবশ্যই আটকাতো। ও নেই, আটকানোরও কেউ নেই। বড় মামা অবশ্য গাঁইগুঁই করেছিলেন একবার। কিন্তু সেজো ভাবী এমনভাবে তাকে মানিয়েছে, আর নিষেধ করল না মামা। এছাড়া ডালিয়ার বাবা-মাকে খুব ভালোভাবে চেনে মামা। তাঁদের বাড়িতে যে যত্নের ত্রুটি হবে না খুব জানত উনি। আর রইলো মেজো মামি! বড় মামা যেখানে অনুমতি দিয়েছে ওখানে ওনার কিই বা বলার থাকে! আড়ালে অবশ্য বকাঝকা করেছে উপমাকে। মন খারাপ হয়েছিল উপমার;আবার ভুলেও গেছে।
এই মুহুর্তে উপমার নিজেকে চড়ুই পাখি মনে হচ্ছে। পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্তির আনন্দ গায়ে মেখে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়ানো চড়ুইপাখি। চারদেয়ালের বাইরের জগৎটা এত স্নিগ্ধ, এত সুন্দর! অবলোকন করতে করতেই হাজারবার পুলকিত হয় উপমা।
বিকেলের দিকে দুটিতে সাজগোজ করে বড়দের মতো ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে ঘুরে ফিরে বেড়িয়েছে। দূরে যাওয়ার অনুমতি নেই বিধায় নিজেদের ক্যাম্পাসেই ঘুরেছে। মাঠে বসে বুট-বাদাম খেয়েছে, এক ফাঁকে মার্কেটও ঘুরে এসেছে। তারপর সন্ধ্যে হলে জয় বাংলা হোটেলে বসে সন্ধ্যেভোজের জন্য ঢুকে গেছে। হোটেল ভর্তি বিভিন্ন বয়সী পুরুষদের মধ্যে ওরা দুটি মেয়ে। উপমাদের শহর ছোট্ট শহর। এখানে সন্ধ্যেবেলা মেয়েদের বাইরে বেরুতে দেখা যায় না তেমন; অথবা বলা যায় নিয়ম নেই। এতটাও আধুনিকতা আসেনি এখানে। তাই এতগুলো পুরুষ মানুষের মধ্যে কমবয়সী দুটো মেয়েকে সাবলীলভাবে বসে খাওয়া-দাওয়া করতে দেখা অনেকের কপালে ভাঁজ ফেলেছিল বৈকি৷ তবে কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি। না পাওয়ার কারণ ওদের সাথে উপস্থিত ছিল স্বয়ং ডালিয়ার বাবা এবং দ্বিতীয়ত রওনক নামক লোকটাও ঐ মুহুর্তে বসা ছিল হোটেলে। উপমা লক্ষ করেছে লোকটার উপস্থিতি কোথাও থাকলে পরিবেশটা কেমন নিস্তব্ধ থাকে। মানুষ কথা বললে রয়েসয়ে বলে, অকারণ কেউ বিশৃঙ্খলা করতে চায় না। সকলের চোখজুড়ে ছেয়ে থাকে অন্যরকম আতংক।
অদ্ভুত! এই বিষয়গুলো দেখেছিল ও সেজো ভাইয়ের ক্ষেত্রে। সেজো ভাই ছাড়াও অন্য কারোর উপস্থিতি মানুষের মনে আতংক সৃষ্টি করতে পারে অজানা ছিল উপমার। অবশ্য রওনককে প্রথম দেখায় পাতি গুণ্ডা-মাস্তান মনে হয়েছিল ঠিক। এখন তো মনে হচ্ছে ওর পাওয়ারও নেহাৎ কম নয়।
এই বিষয়গুলোই দিনকে দিন ওর মধ্যে আগ্রহের জন্ম দিচ্ছে রওনকের প্রতি । বুঝে উঠতে পারছে না কার কাছে গেলে সমস্ত প্রশ্নের জবাব পাবে! কে মেটাতে পারবে ওর আগ্রহ৷
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে ডালিয়ার বাবা রিকশা ঠিক করে দিলো দু’জনকে। উনি এশার নামাজ পড়ে ফিরবেন। রিকশায় উঠতে উঠতে একঝলক রওনকের পানে তাকাল উপমা এবং আশ্চর্যজনকভাবে রওনকও একই সময়ে তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। হয়ে গেল দুজনের দৃষ্টি বিনিময়। যদিও তা স্বল্প সময়ের জন্য। অতটুকুতে স্বাভাবিক অভিব্যক্তিই দেখল উপমা রওনকের মধ্যে। না বাড়তি কোনো মুগ্ধতা, না কোনো প্রগলভতা। ও কি আশা করেছিল এমন কিছু? নিজেও তো বোধহয় স্বাভাবিকই ছিল;নাকি ছিল না? কেমন একটা অস্বস্তিভাবের খোঁচায় বিড়বিড় করে ডালিয়াকে জিজ্ঞেস করল,
— আমাকে কেমন লাগছে ডালিয়া? ভালো লাগছে? সাজটা কি মানিয়েছে?
ওর প্রশ্নে অবাক হয়ে তাকাল ডালিয়া। সবিস্ময়ে বলল,
— মানে?
— নাহ্ না কিছু না।
চকিতে ঘোর কেটে গেল উপমার। ভ্রু কুঁচকে কতক ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ডালিয়া অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলল,
— আগামীকাল একটা ইন্টারেস্টিং জায়গায় নিয়ে যাব তোকে। বহুদিন থেকে যেতে চাই কিন্তু একা একা সাহস হয় না।
— কোথায়?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডালিয়ার পানে তাকাল উপমা। ডালিয়া ওর বাহু টেনে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— রুনু ভাইয়ের আড্ডা খানায়।
— রুনু কে?
বোকার মতো প্রশ্ন করে বসল উপমা।
— এ্যাই আস্তে। রুনু হলো রওনক ভাই। ঐ যে হোটেলে বসে ছিল। চিনিস না?
বাহুতে মৃদু থাপ্পড় দেয় ডালিয়া। সংশয়পূর্ণ গলায় উপমা বলে,
— ওখানে কেন?
— আরেহ্ এমনিই আগ্রহ। শুনেছি জায়গাটা সুন্দর। গলির একদম শেষ মাথায়। খোলামেলা, গাছপালায় ঘেরা তার মধ্যে ঘরটা৷
— না বাবা। কেউ যদি জেনে যায়?
— আরে জানবে কীভাবে। আমরা এমন সময় যাব যখন কেউ থাকবে না।
— এতটা রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না।
— আরেহ্ ভীতু। কিচ্ছু হবে না আমি আছি তো।
বাহুতে হালকা চাপ দিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে ডালিয়া। ভয়ডর উপমার মধ্যে নেই। সে শুধু ভাবছে ধরা পড়ে গেলে কি মনে করবে লোকটা! যদি বুঝে যায় উপমার ওকে নিয়ে আগ্রহ আছে তাহলে বিষয়টা খুব অস্বস্তিকর হবে।
_______________________
গত কয়েকদিন যাবৎ বাইরে বাইরে রাত কাটাচ্ছে রওনক। যা ওর স্বভাব। নাওয়া-খাওয়ার তো কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। কখনো হোটেলে খেয়েছে, কখনো মিজানের বাড়ি, কখনোবা জুনিয়র কোনো ছেলে পেলের মেসে। তবে আজ সে বাড়ি ফিরবে। বাবার হুকুম। লোক মারফত চিঠি পাঠিয়েছেন বাবা। সেখানে কড়া শব্দে হুকুম জারি করা হয়েছে বাড়ি ফেরার। অবশ্য বাবার হুকুম না থাকলেও আজ তাকে বাড়ি ফিরতেই হতো। প্রচারণার কাজের জন্য আনিস শেখ ব্যাগ ভরা টাকা দিয়েছে তাদের হাতে। এই টাকা সামলে রাখার দায়িত্ব ওর। ছেলেপেলে সব জেঁকে ধরে বলেছে ওরা কেউ এতবড় দায়িত্ব নিতে পারবে না, দায়িত্ব সব রওনকের। নির্বাচন উপলক্ষে সভা করা হবে তাদের কলেজে, আগামী সপ্তাহে। তার জন্য আলাদা প্রস্তুতি। দম ফেলার ফুরসত নেই রওনকের। তবে আজকের দিনটা একটু ছুটি চাই তার। যতই হোক পরিবারের ডাক উপেক্ষা করা যায় না। ছেলেপেলেদের ভাগ ভাগ করে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে মিজানকে সব দেখতে বলে বেরিয়ে পড়ল রওনক। পথে আশিকের জন্য চিপস,চকলেট নিতে ভুলল না।
খুব অদ্ভুতভাবে রওনকের হোন্ডার শব্দ দূর থেকে শুনলেও চিনতে পারে আশিক। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। চাচ্চু আসছে বুঝতে পেরে সে সাধের খেলনা ছেড়ে একছুটে গেটের কাছে চলে এসেছে এবং কড়ে আঙুলে উল্টোদিক থেকে দশ, নয়, আট, সাত গুনতে শুরু করেছে। সবসময় এমনই করে। তার বিশ্বাস গুনতি যখন এক এ পৌঁছে থেমে যাবে তখনই তার চাচ্চু উপস্থিত হবে তার সামনে। এবং এমনটাই হয়। আজও হলো। দুই টপকে গুনতি এক এ চলে আসার সাথেসাথে রওনকের জলপাই রঙা হোন্ডা বাড়ির গেটে থেমে গেল। তৎক্ষণাত উজ্জ্বল হয়ে উঠল আশিকের মুখ। গেট খুলে সোল্লাসে ছুট লাগাল সে রওনের দিকে। রওনকও তড়িঘড়ি করে হোন্ডা থেকে নেমে সহাস্যে দু-হাত বাড়িয়ে লুফে নিলো আদরের ভাতিজাকে। কোলে চড়ে গলা জড়িয়ে ধরে মায়া মায়া কণ্ঠে আশিক বলে উঠল,
— আমার চকলেট আননি চাচ্চু?
— আনবো না মানে অবশ্যই এনেছি। আমার আব্বার পছন্দের কথা আমি কখনো ভুলতে পারি? এই যে পকেটে হাত দাও পেয়ে যাবা।
বুক পকেটের দিকে ইশারা করল রওনক। তড়িৎ পকেটে হাত দিয়ে চকলেট বের করে চমৎকার হেসে আশিক থেমে থেমে বলল,
— থ্যাংক ইউ।
ওর মুখে “থ্যাংক ইউ” শুনে অবাকই হলো রওনক। গাল চেপে ধরে চুমু খেয়ে বলল,
— আমার আব্বা থ্যাংক ইউও বলা শিখে গেছে। কে শেখালো তাকে এত সুন্দর শব্দ হু?
— মা।
লজ্জা লজ্জা ভাব করে জবাব দিলো আশিক। ওকে লজ্জা পেতে দেখে হেসে উঠল রওনক। বাচ্চাটা একদম ভাইয়ের মতো হয়েছে। ভদ্র, শান্ত। চাচার নেওটা। রওনকের মনে পড়ে গেল নিজের ছোটবেলার কথা। সে আর বদি দু’জনেই ওদের চাচার খুব প্রিয় ছিল। দুই ভাতিজাকে নিয়ে চাচার কত কত যে আহ্লাদ! সাইকেলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, কাঁধে বসিয়ে বাজারে নিয়ে যাওয়াসহ আরও কত কি! ওরাও ভীষণ ভালোবাসত চাচাকে। বদি তো চাচা বলতে পাগল ছিল। সে চাচা যখন কলেরা হয়ে মারা গেল, কি কষ্টটাই না পেয়েছিল দুই ভাই। আহারে! বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রওনকের৷ অতীত ভাবনায় আর সময় নষ্ট করতে চাইলো না সে। চকলেটে মনোনিবেশ করা ভাতিজাকে শক্ত করে চেপে ধরে বাড়ির ভেতরে পা রাখতে রাখতে সে জিজ্ঞেস করল,
— আব্বা, ও আব্বা। ভালো আছো? আমাকে মিস করেছ আব্বা?
জবাবে ওপর নীচে মাথা নাড়ল ছোট্ট আশিক৷ এতদিন তার চাচ্চুকে সে কতখানি মিস করেছে, চাচ্চু বিনা কতটা খারাপ সময় কেটেছে গলা জড়িয়ে ধরে সেই গল্পই শোনাতে লাগল।
বসার ঘরে পত্রিকা হাতে বসে ছিলেন রওনকের বাবা শাহজাহান ইসলাম। ঘরে ঢুকেই বাবার মুখোমুখি হয়ে গেল রওনক। বাবাকে খুব শ্রদ্ধা করে সে। তার সামনে ভদ্র-মার্জিতভাবে থাকার চেষ্টা করে। আজ বহুদিন পর মুখোমুখি হওয়া বাপ-ছেলের। ওর বাউণ্ডুলের মতো বাইরে বাইরে ঘোরা মোটেই পছন্দ করেন না বাবা। একসময় নিষেধ করতেন। রওনক শুনতো না। পরে নিষেধ-বারণ বাদ দিয়ে দিলেন। বুঝলেন বারণ শোনার ছেলে তার নয়। যেভাবে চলছে চলুক। মনটা শুধু শক্ত করতে হবে। বড় ছেলেকে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে দেখেছেন, ছোটোটার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে এইতো।
আশিককে কোলে নিয়েই বাবার কাছে এগিয়ে গেল রওনক। বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— বাবা ভালো আছ?
ক্ষণিক চুপ থেকে সালামের জবাব দিলেন শাহজাহান সাহেব। কুশল বিনিময়ে না গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন,
— কদ্দিন পর ফিরলা?
বাবার প্রশ্নে লজ্জা পেয়ে গেল রওনক। বিব্রতভাবে জবাব দিলো,
— সপ্তাহখানেক হবে।
— অহ্ আমি ভাবছিলাম বছর বয়াত। বাপের সামনে তো আসো না। দেখাসাক্ষাৎও করো না। না দেখতে না দেখতে চেহারাই ভুলে যাইতেছি আপন ছেলের।
কৌতুকের সুর থাকলেও বাবার কথায় যে স্পষ্ট খোঁচা আছে বুঝতে অসুবিধা হলো না রওনকের। তীব্র অস্বস্তি চোখেমুখে ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। ছেলে যে বিব্রত বোধ করছে বুঝতে অসুবিধা হলো না শাহজাহান সাহেবের। পত্রিকা নামিয়ে গম্ভীর স্বরে তিনি আদেশ করলেন,
— যাও গোসল-টোসল করে আসো। টেবিলে ভাত দিতেছে তোমার ভাবী। বাড়ির সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া করব আজকে।
এতক্ষণে রওনক হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আশিককে বাবার কাছে দিয়ে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল শোবার ঘরের দিকে।
_____________
যেখানেই যাক না কেন কলেজ মিস দেয়ার অনুমতি নেই উপমার। বই-খাতা, কলেজ ড্রেস সব নিয়েই এসে পড়েছে সে বান্ধবীর বাড়িতে। পড়াশোনা হোক আর না হোক ক্লাস করতে হবে। মামা বলে দিয়েছে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে খোঁজ নিয়ে যাবে। সেই ভয়ে হলেও ক্লাসে এসেছে দুই বান্ধবী। ফুল পিরিয়ড অবশ্য করবে না। টিফিন ব্রেকেই পালাবে বলে ঠিক করেছে। ওদের মাথায় এখন রওনকদের ক্লাবঘর দেখার ভূত চড়ে বসেছে। সে ভূতকে তুষ্ট না করা অবধি শান্তি আছে?
লায়লা আজ কলেজে আসেনি। মিতালিকে পালানোর কথা বললে সে সাফ মানা করে দিলো। সাজুর সাথে মেশার পর থেকে পড়াশোনার প্রতি তার বেশ আগ্রহ জমেছে। নাহ্ ভালই। সাজুকে পেতে হলে তো পড়াশোনার দিক দিয়েও এগোনো উচিৎ। এই সিদ্ধান্তে খারাপ কিছু দেখছে না উপমা। তবে ডালিয়া ভেঙচি কেটেছে। ভেঙচি কেটে বলেছে,
— বন্ধুত্বের খাতিরে মাঝেমধ্যে ক্লাস বাঙ্ক দেয়াই যায়। একদিন ক্লাস না করলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়!
ভাগ্যিস মিতালি শুনতে পায়নি। শুনলেই দুটোর ঝগড়া লেগে যেত। উপমা পরে ধমকেছে ডালিয়াকে। চোখ গরম করে বলেছে,
— কি এক অভিযানে যাওয়ার কথা। সবাইকে জানিয়ে যেতে চাস?
এ কথা শুনে পরে শান্ত হয়েছে ডালিয়া।
নিয়মানুযায়ী তিনটে ক্লাস পর টিফিন পিরিয়ড। পূর্ব পরিকল্পনা মতো দুই বান্ধবী ব্যাগ নিয়ে সুর সুর করে পালিয়ে এসেছে। নাহ্ বাড়ি যায়নি ওরা। পালিয়ে সোজা এসেছে তাদের গন্তব্য পৌঁছুনোর গলিতে। আগেই ক্লাবের দিকে যাবে না ওরা। দূর থেকে আগে দেখবে মানুষের সরগম বোঝা যায় কি না! যদি মনে হয় মানুষ আছে সঙ্গে সঙ্গে উল্টো পথ ধরবে।
সতর্কতার সাথে চারদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে হাঁটছে দুজন। কথাবার্তাও জোরে বলা যাচ্ছে না। তাই নিশ্চুপ আছে। গলিটা খুব সরু৷ দু’পাশে দোকান ভরা। শাটার নামানো দোকানগুলো কোন উদ্দেশ্যে বানিয়ে রাখা আন্দাজ করতে পারল না উপমা। ওগুলোর ওপরে নামও তো লেখা নেই কোনো। হাঁটতে হাঁটতে বারবার ঘুরে ফিরে দোকানগুলোকেই দেখছে উপমা। নির্জীব দৈ”ত্য মনে হচ্ছে ওর ওগুলোকে। গলিটা প্রস্থে কম হলেও দৈর্ঘ্যে বেশ। হাঁটতে হাঁটতে রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছে উপমা।
গতকাল রাতে ডালিয়ার কাছে অনেক কিছুই শুনেছে রওনকের সম্পর্কে। লোকটা ওদের কলেজেই পড়ে। অনার্স তৃতীয় বর্ষ। বাংলা ডিপার্টমেন্ট। তবে পড়াশোনার বালাই তার নেই। ক্লাস ট্লাস কি করবে দল করে কূল পায় না। ছাত্র সংগঠনের লিডার। সারাদিন মিছিল মিটিংয়ের ব্যস্ততা। আবার নাকি মাস্তানদের মতো অস্ত্র বার করে মানুষকে ভয় দেখানোর অভ্যেস আছে। ভালো কথায় না হলে শাসিয়ে কাজ উদ্ধার করে। আর নেশা-পানি খেয়ে টাল হয়ে ক্লাবঘরে পড়ে থাকে। রওনক সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডালিয়ার চোখ দু’খানা রসগোল্লার সাইজ হতে দেখেছে উপমা। রসগোল্লা চোখে আবার মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। এত বিরক্ত লেগেছে! মেয়েগুলোর চয়েজ এত খারাপ হয়ে যাচ্ছে কেন দিন দিন? শেষ পর্যন্ত গুণ্ডা মাস্তানের ওপর ফিদা হচ্ছে।
উফফ ঢঙ!
যদিও ডালিয়া ওকে গুণ্ডা-মাস্তান সম্বোধন করে কিছুই বলেনি। উপমা একাই সম্বোধন জুড়ে দিয়েছে। গতকাল এই পাতি মাস্তানের চোখে মুগ্ধতা দেখার আশা করেছিল ভাবতেই কি ভীষণ বিব্রতবোধ করেছে। ইশশ!
__________
কয়েকদিনের জন্য শাহজাহান সাহেব গ্রামের বাড়িতে যেতে চান। গ্রাম থেকে ছোট ভাইদের চিঠি এসেছে। সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা। আসলে শাহজাহান সাহেবের বাবা খুব সম্পদ প্রিয় মানুষ ছিলেন। সৎ-অসৎ উভয় পন্থা অবলম্বন করে সম্পদের পরিমাণ শুধু বাড়িয়েই গেছেন আর বাড়িয়েই গেছেন। সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সন্তানের সংখ্যা। সম্পদ আর সন্তান সমান্তরালে বাড়তে থাকলেও সুষ্ঠু বণ্টন করা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি ওনার পক্ষে। তার পূর্বেই ডাক এসেছে পরপার থেকে। এখন সে সম্পদগুলো ভাই-বোনদের গলায় কাঁ”টা রূপে বিঁ”ধে গেছে। না পারছে তা গিলতে, না পারছে উগড়ে দিতে। সময় নেই, অসময় নেই সে সম্পদ নিয়ে বি”শৃ”ঙ্খলার সৃষ্টি হয়। গত কয়েক মাসে কোনো বি”শৃ”ঙ্খলা হয়নি। এবার কি নিয়ে শুরু হলো বুঝতে পারছেন না শাহজাহান। চেয়েছিলেন রওনককে সাথে নিয়ে যেতে। বাউণ্ডুলেপনাটা বাদ দিলে ছেলে তার ভীষণ মেধাবী আর চালাকচতুর। পারিবারিক পলিটিক্স বোঝার জন্য উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু এই ছেলের তো এসব ব্যাপারে কোনো আগ্রহই নেই। গ্রামে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে সমীহের সাথে সে নিজের ব্যস্ততার ফিরিস্তি শুনিয়ে দিলো। পাল্টা প্রস্তাব দিলো বড় ভাইকে নিয়ে যেতে। মুখের ওপর না শুনে রাগ হলো শাহজাহান সাহেবের। বকাঝকাও করতে পারলেন না, বিনীতভাবে বলেছে ছেলে। এমনভাবে নিজের সমস্যা দেখিয়েছে, ওখানে তো বলার কিছু থাকে না। অসন্তোষের সাথে পরে চুপচাপ মেনে নিতে হয়েছে।
খেয়েদেয়ে বাবা উঠে যাওয়ার পর বদি রওনককে উদ্দেশ্য করে বলল,
— গেলেই পারতি রুনু। গ্রামের বাড়ির ঝামেলাটা আসলেই জটিল।
ভাইয়ের কথায় রওনক বেশ অবাক হলো। বলল,
— তুমি এই কথা বলতেছ ভাইয়া? জানো না এই সময়টা কত সেন্সিটিভ! কি ব্যস্ততা যাইতেছে আমার।
ফোঁস করে শ্বাস ফেলল বদি।
— বিষয়আশয়ের প্রতিও একটু খেয়াল দেয়া উচিৎ রুনু। বড় হইছিস যথেষ্ট। পারিবারিক বিষয় গুলা বুঝেশুনে না নিলে সমস্যা। সহজে লোকে ঠকাতে পারবে তোকে।
— তুমি থাকতে আমাকে ঠকাবে কে? তুমি আছো না এইসব দেখে নেয়ার জন্য।
বিস্মিত গলায় বলল রওনক। চকিতে বদি তাকাল রওনকের মুখের দিকে। এই ছেলেটা ওকে এত ভরসা করে! চোখ ছলছল করে উঠল বদির। হাত হারানোর পর থেকে নিজেকে সবসময় বোঝা মনে হয় বদির। পরিবারে তার অবদান ক্ষীণ। যা করার চার হাত-পায়ে দাপিয়ে তার বাবা আর ছোটো ভাইটি করে। জড় পদার্থ হয়ে সংসারে পড়ে আছে ভাবতে গেলেই অস্বস্তি হয় বদিউজ্জামানের। লজ্জা লাগে। মনে হয় কোথাও একটা পালিয়ে যেতে পারতো যদি! তাহলে এই লজ্জার হাত থেকে মুক্তি মিলতো। অথচ অবাক হয়ে যায় এই উপলব্ধি করে ওর ধারণা কতখানি ভুল! আজও সে তার পরিবারের মানুষগুলোর মনে সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
— শোনো ভাইয়া আজকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দেই। বিষয়সম্পত্তির লোভ আমার কোনো কালে ছিল না, নাইও। এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় নাই আমাদের মধ্যে যে আলাদা হয়ে যাইতেছি, এখন সম্পত্তি বুঝে নেয়া লাগবে। আমি জানি সে পরিস্থিতি কখনো আসবেও না। আলাদা হবো আমি কার থেকে? ছয় বছর বয়স থেকে মায়ের ছায়া উঠে গেছে মাথার ওপর থেকে। মা কেমন হয়, মায়েরা কি করে সন্তানদের জন্যে এইসব জানি নাই। একটা উৎসবের দিন, পরীক্ষা, অসুস্থতা মা বিহীন আমার আর পাঁচটা দিনের মতো সাধারণতভাবে কা*টার কথা ছিল । অথচ কা”টেনাই। কারণ কি? কারণ হইলো মায়ের অভাব মনে করে ছোটো ফীল যেন না করি সেইজন্য তুমি আমার সব গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্ত আরও গুরুত্বপূর্ণ করে দেয়ার চেষ্টা করছো। কত প্রয়াসই না তোমার ছিল! ছেলে মানুষ হয়ে তুমি কত শত আয়োজন করতা, কার কাছ থেকে জানি রান্নাবান্না শিখে ঐসব বানায় বানায় খাওয়াইছো। আমার সব কঠিন সময়ে আমি তোমাকে ঢালের মতো পাশে পাইছি। ভাবী আসার পর তো আমার ঢালের সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে। সে আমাকে প্রতি মুহুর্তে অনুভব করাইছে মা কেমন হয়! তোমাদের দুইজনের কাছে যে আমি সন্তানতূল্য এইটা বুঝতে তো সমস্যা হয় নাই আমার। তোমরাও আমার কাছে তেমন বাবা-মা। তোমাদের সাথে কখনো ঝামেলা করব এইটা আসলেও মনে হয় তোমাদের? আসলেও?
— তুই ভুল বুঝতেছিস রুনু।
ছলছল চোখে আর্দ্র গলায় বলল বদি। ওদিকে হাসনারও চোখ ভরে উঠেছে। তথাপি সে রওনককে উদ্দেশ্য করে বলল,
— বাচ্চা কাচ্চা বড় হইলে আস্তে আস্তে তাদের প্রাপ্যটা বুঝায় দেয়া শুরু করা লাগে ভাই। সেই সেন্সে বলছে তোমার ভাইয়া। আব্বার পর এইসব তোমাদের দুই ভাইকে দেখাশোনা করা লাগবে। তাই এখন থেকে একটু একটু করে বোঝায় নেও।
— পরের হিসাব আগে করলে তো হবে না ভাবী। ভবিষ্যতে তো আমরা বাঁচি না, আমরা বাঁচি বর্তমানে। সম্ভাবনার চিন্তা করে আমরা চলমানটাকে কেন নষ্ট করব?
তোমরা জানোই আমার এইসবে কোনো আগ্রহ নাই। তাছাড়া ভাইয়ার চাইতে বেটার কেউ সামলাতেও পারবে না এসব। আমাকে নাহয় বড় ভাবা লাগবে না। ভাববা আমি এখনও ছোটো আছি। দায়িত্ব সব এখনও তোমাদের কাঁধেই আছে। প্লিজ তোমরাই সামলাও সব। আমাক টানিও না।
কথার সাথে খাওয়াও শেষ রওনকের। হাত ধুয়ে তাই চট করে উঠে গেল সে টেবিল থেকে। বিছানায় গা দিতে ইচ্ছে করলেও উপায় নেই। অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন কাজে ফিরতে হবে। কে জানে ছেলেপেলেগুলো ঠিকঠাক সামলাতে পারছে কি না!
ক্লাবঘরটা এই মুহুর্তে তালাবদ্ধ। সতর্কতার সাথে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করে তবেই এসেছে উপমারা। ডালিয়া ঘুরে ঘুরে দেখছে চারপাশ। উপমার ওসবে মন নেই। এখানে সুন্দর লাগার মতো কোনো জায়গা সে খুঁজে পাচ্ছে না। তার আগ্রহ তো ঘরটা নিয়ে। কি আছে ঘরটার ভেতর? অস্ত্র নাকি নেশাদ্রব্য। শুনেছে রওনকের হাতে পিস্তল থাকে একটা। পিস্তল দেখতে কেমন হয়? বাস্তব জীবনে তো কখনো দেখেনি উপমা। দেখেছে টিভিতে। বাস্তবে দেখার খুব শখ ওর। কোমরে হাত রেখে সরু চোখে বদ্ধ ঘরটায় চোখ বোলালো উপমা। কাঠের পাল্লা লাগানো একটা জানালাও আছে। জানালাটা অবশ্য বন্ধ না। অর্ধেকটা খোলা। কি ভেবে ঐ খোলা অংশ দিয়ে ভেতরটা দেখার বুদ্ধি এলো উপমার মাথায়। এক মুহুর্ত দেরি না করে সাথে সাথে ডালিয়াকে ডেকে উঠল সে। দুষ্টুমি সব কাজে এক পায়ে খাড়া ডালিয়া। তাই উপমা বলা মাত্র তার খুশি দ্বিগুণ হয়ে গেল। নাচতে নাচতে সেই এগিয়ে গিয়ে চোখ রাখল অর্ধখোলা জানালা দিয়ে। দুষ্টু হেসে উপমাও অনুসরণ করল ওকে।
এদিকে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে সোজা ক্লাবের দিকে রওয়ানা হয়েছে রওনক। জয় বাংলার সামনে আসামাত্র দলের কিছু ছেলেপেলেদের সাথে দেখা হয়ে গেল। তাদের থেকে কাজের সমস্ত আপডেট নিয়ে মিজানের খোঁজ করল ও। ছেলেরা জানালো মিজান কলেজেই আছে। টাকাপয়সার ব্যাপারে মিজানের সাথে গোপন আলোচনা আছে রওনকের। এই মুহুর্তে মিজানকে তার দরকার। কলেজে ঢুকলেই কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে। নাহ্ ক্লাবে বসতে হবে। ছেলেদের একটার হাতে হোন্ডা ছেড়ে দিয়ে মিজানকে ডেকে আনার নির্দেশ দিলো রওনক। এরপর হেঁটে রওয়ানা হলো ক্লাবের দিকে। দ্রুত তার চলন। পৌঁছুতে বেশি সময় লাগল না। কিন্তু গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর এক চমকপ্রদ দৃশ্য তার হাঁটার গতি চট করে থামিয়ে দিলো। অবাক হয়ে রওনক দেখলো অর্ধখোলা জানালার ফাঁক গলিয়ে দু’টো মেয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ভেতরে।
সাধারণত মেয়েদের আনাগোনা তাদের এখানে বিরল। আনাগোনা হওয়ার কথাও না। এখানে ওদের কোনো কাজ নেই। সমস্যা থাকলে কোনো না কোনো উপায়ে রওনকের কানে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। কাউকে ক”ষ্ট করে আসতে হয় না। তাহলে এই মেয়েগুলো কোত্থেকে এলো? কেন এলো?
ঠোঁট কামড়ে ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলল রওনক। হাতে ধরা ছিল সিগারেট। শেষ আরেকবার টান দিয়ে ওটা ফেলে ধীরপায়ে মেয়ে দু’টোর দিকে এগোলো রওনক। ওরা তখনও বুঁদ নিজের কাজে। রওনকও নিজের উপস্থিতি জানান দিলো না। পকেটে হাত পুরে নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল ওদের পেছনে। একবার নিজেও উঁকি দেয়ার চেষ্টা করল আধখোলা জানালা দিয়ে। অন্ধকার ছাড়া কিছু নজরে এলো না তার। মেয়েগুলো দেখছে কি? ভেবে পেলো না রওনক। চিন্তা খরচ করার পরিবর্তে ওদেরকেই জিজ্ঞেস করা সমীচীন মনে হলো ওর। এরপর কিছু না ভেবে খলা খাঁকারি দিয়ে উঠল একটা। সাথে গমগমে গলায় আওয়াজ তুলল,
— এখানে কি?
নিজ খেয়ালে বুঁদ দুই বান্ধবী আচমকা গলা খাঁকারি শুনে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।ওর বোধহয় কল্পনাও করেনি এখানে এই মুহুর্তে মানুষ থাকতে পারে। কে দেখার জন্য তড়িৎ ফিরে তাকাতে চাইল দুজনেই। ঠিক তখুনি বাঁধল বিপত্তি। তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে একজন আরেকজনের গায়ে ধাক্কা লেগে ঠাস করে পড়ে যেতে নিলো। অকস্মাৎ এমন হবে রওনকও ভাবতে পারেনি। পকেটে গোঁজা হাতগুলো চট করে বের করে আগলে নেয়ার চেষ্টা করল সে ওদেরকে। কিন্তু হাত তো ওর দু’টো। দু হাতে দু’জন মানুষকে কীভাবে আগলায়। ফলাফল একজনকে ধরতে পারলেও আরেকজনকে ধরতে পারল না রওনক। যাকে পারল সেও অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে নিলো ওকে চট করে। রওনক টের পেলো কখানা ধারালো নখ একদম আঁচড়ে দিল ওর গলার কাছটা। দাঁতে দাঁত পিষে ব্যথা হজম করে সে পূর্ণ দৃষ্টি রাখল মেয়েটার পানে। কোঁচকানো ভ্রু জোড়া আরেকটুখানি কুঁচকে বিস্মিত গলায় বলল,
— তুমি এখানে?
কর্ণকুহরে পরিচিত স্বরের ধা’ক্কায় চট করে চোখ মেলে তাকাল উপমা। মুখের ওপর ঝুঁকে থাকা ব্যক্তিটার চেহারা স্পষ্ট হওয়ার পর তার চোখ দুখানাও রসগোল্লার আকার ধারণ করে নিলো নিমেষে। রওনকের কলার জড়িয়ে রাখা ওর হাত দুখানা বল হারিয়ে ফেলল চকিতে।
শুকনো ঢোক গিলে ও স্বগতোক্তি করল,
“ধরণী দ্বিধা হও”
ধরণী দ্বিধা হলো কি না! দুর্বল ওর হাতজোড়া কলার ছেড়ে দিলে ডালিয়ার মতো পতনশীল হলো সেও। ওকে সামলাতে হাতে বল প্রয়োগ করে কটিদেশ লতার মতো পেঁচিয়ে নিজের দিকে টেনে নিলো ওকে রওনক। এবং চোখের পলকে ও রওনকের বুকে।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara